রাইনার মারিয়া রিলকে (১৮৭৫—১৯২৬)
সংক্ষিপ্ত পরিচিতি#
রাইনার মারিয়া রিলকে। ৪ঠা ডিসেম্বর, ১৮৭৫ এ প্রাগে জন্মগ্রহণ করেন। পুরো নাম রেনে কার্ল উইলহাম জোহান যোসেফ মারিয়া রিলকে। জার্মান ভাষার অন্যতম প্রধান কবি। তাঁর ভাষা ছিল জার্মান ও ফরাসি। কবিতায় আধুনিকতা আন্দোলনে যুক্ত ছিলেন। তিনি বোহেমিয়ান অস্ট্রিয়ান কবি ও নাট্যকার হিসেবে পরিচিত। জার্মান ভাষায় লিরিকাল কবিতা ও গদ্যে তাঁর অসাধারণ অবদান।
জীবনকালে সমগ্র ইউরোপ ঘুরে বেড়িয়েছেন। শেষ দিকে সুইজারল্যান্ডে স্থিতু হয়েছিলেন। জার্মান ছাড়াও ফরাসি ভাষায় প্রায় ৪০০ কবিতা লেখেন। তাঁর উল্লেখযোগ্য কাজগুলো হচ্ছে—
দ্যা বুক অব আওয়ারস,
দুইয়োনো এলিজি,
সনেটস টু অরফিয়াস,
দ্যা নোট বুকস অব মাল্টে লরিডস ব্রিগে,
লেটারস টু এ ইয়ং পোয়েট, ইত্যাদি।
আমেরিকায় তিনি এখনো অত্যন্ত জনপ্রিয় কবি। তাঁর স্ত্রী ছিলেন ক্লারা ওয়েস্থফ। ২৯শে ডিসেম্বর, ১৯২৬ সালে সুইজারল্যান্ডে এই কবির মৃত্যু হয়।
রিলকের চিঠি
বাংলা রূপ : ঋতো আহমেদ
আসুন পড়ি রিলকের চিঠি নিয়ে উলরিখ বের কী লিখেছেন—
রিলকে তাঁর জীবনে যেমন পরিচিত ও কাছের বন্ধুদের চিঠি পত্র লিখেছেন ঠিক তেমনি অনেক অপরিচিত পাঠককেও চিঠি লিখেছেন যাদেরকে ব্যক্তিগতভাবে একবারেই চিনতেন না। ১৯২৬ সালে ৫১ বছর বয়সে তাঁর মৃত্যুর সময় চিঠিপত্রের মোট সংখ্যা হয়েছিল ১৪০০০। গদ্য এবং কবিতার মতো এগুলোকেও তিনি প্রকাশিত হওয়ার সমান গুরুত্বপূর্ণ ও মূল্যবান মনে করতেন। এই বিশাল পত্র বিনিময় সম্ভারে ২৩ টি চিঠি আছে যেগুলোকে শোকগাঁথা বলা যায়। প্রায় ১০০ বছর হয়ে গেল, এগুলো আমাদের উদ্দীপিত করছে এবং সাধারণ দৃষ্টির আড়ালে এগুলোর যেন এক শক্তিশালী অন্তর্দৃষ্টি আছে। বিশৃঙ্খলভাবে আর কিছু কিছু পুনরুদ্ধারে সম্ভব নয় এমনভাবে প্রকাশিত হয়েছে। আর সমাহিত হয়ে আছে দুই মহাদেশের দুই সংগ্রহশালায়। এই প্রথমবারের মতো সেগুলো এখন একসাথে করে ছোট আকারে প্রকাশের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। এখানে পাওয়া যাবে রিলকের সেই চিঠিগুলো যাতে ক্ষয়, বিষাদ আর মরণশীলতা বিষয়ে তাঁর গভীর চিন্তা ভাবনা প্রতিফলিত হয়েছে। মৃত্যু যে একটি রূপান্তর প্রক্রিয়া তা এই চিঠিগুলোয় সৎ ও স্থির স্বীকারোক্তির মাধ্যমে প্রকাশিত। যেমনটি রিলকের জনপ্রিয় লিখা “লেটারস টু এ ইয়ং পোয়েট” এ আছে। ঐকান্তিক আত্ম-রূপান্তরের জন্য স্থির স্ব-হিসেব আর একাকীত্বের স্বীকৃতির গল্প এটি। আলাদা ভাবে পড়লে দেখা যায়, রিলকে একেকটি চিঠিতে একেক জনকে লিখেছেন কিন্তু বিষয় সেই একই, জীবনের ক্ষয়িষ্ণুতা, এক-মনে একই উদ্দেশ্য নিয়ে লিখেছেন, কাউকে যেন সহযোগিতা করছেন, যেন ব্যক্তিগত ক্ষতিতে শোকগ্রস্ত কাউকে সান্ত্বনা দিচ্ছেন। ক্ষতিগ্রস্ত হলে কেমন লাগে আমাদের? সমস্ত কথাবার্তাকে নিরর্থক মনে হয়, মনে হয় আমাদের বিষন্নতা আর কষ্টকে প্রশমিত করতে অপারগ এরা। প্রিয়জনের বিয়োগে ব্যথিত কাউকে আমরা কীভাবে সান্ত্বনা দিতে পারি? যে ব্যপারে রিলকে বারবার জোর দিয়েছেন। শুধু কিছু জিনিস সাজিয়ে রাখা ছাড়া আর কিছু পারি না আসলে। ক্ষতি আর বিষাদগ্রস্ত সময়ে এই চিঠিগুলো আমাদের অন্তর্গত কন্ঠকে কাটিয়ে উঠতে দিকনির্দেশনা দেয়। এমনকি চরম বিধ্বংসী অভিজ্ঞতাকেও আমাদেরকে নৈঃশব্দে বা আসাড়তায় আচ্ছন্ন করে ফেলতে দেয় না।
চিঠিপত্র
এখানে প্রথম চিঠিটি রিলকে যাকে লিখেছেন তার নাম মিমি।
মিমি রোমানেল্লী(১৮৭৭—১৯৭০), ইনি আর্ট ডিলার পিয়েত্রো রোমানেল্লীর সর্বকনিষ্ঠ বোন। রূপ-সৌন্দর্য আর সংগীত প্রতিভার জন্য বিখ্যাত ছিলেন। ১৯০৭ সালে ভেনিসে রিলকে এঁর পারিবারিক হোটেলে কিছুদিন ছিলেন। সেখানে তাদের মধ্যে বিশদ রোমান্টিক সম্পর্ক তৈরি হয়েছিল এবং পরবর্তীতে তাদের অনেক চিঠিপত্রের আদান-প্রদান হয়।
প্রতি : মিমি রোমানেল্লী,
ব্রেম্যান এর কাছাকাছি ওবারনুল্যান্ড (জার্মানি) থেকে
রবিবার, ৮ই ডিসেম্বর, ১৯০৭
জীবনে মৃত্যু রয়েছে। অথচ কী আশ্চর্য দ্যাখো, আমরা এই বিষয়টি অবহেলা করার ভান করি। মৃত্যু, যার নির্মম উপস্থিতি আমরা টের পাই আমাদের প্রতিটি টিকে যাওয়া পরিবর্তনের মধ্যে দিয়ে কেননা আমাদের অবশ্যই মরতে শিখতে হবে এবং তা ধীরে ধীরে। মরতে শিখতে হবে: জীবনের খাতিরে। ক্রমশ নিজেকে তৈরি করতে হবে একটি গৌরবময় ও মহৎ মৃত্যুর জন্য। এমন মৃত্যু যেখানে আচমকা-র কোনো ভূমিকা নেই, পূর্ব পরিকল্পিত, উৎসাহ উদ্দীপনা ও আনন্দময় মৃত্যু, যেমনটি সাধু সন্ন্যাসীরা জানেন কীভাবে পেতে হয়। একটি দীর্ঘ ও পাকাপোক্ত মৃত্যু যা এর ঘৃণিত নামকে নিশ্চিহ্ন করে দেবে। এটা একটা সংকেত ছড়া কিছু না, যা কিনা অনামি এই বিশ্বে সেইসব নিয়মগুলো ফিরিয়ে দেয়, যেগুলোকে স্বীকৃতি দেয়া আর উদ্ধার করা হয়েছে তীব্র ও মার্জিত জীবন ধারায় মধ্যে দিয়ে। ছোট কাল থেকেই মৃত্যুর এই ধারণা আমার মধ্যে একটার পর একটা বেদনাদায়ক ঘটনার মধ্য দিয়ে গড়ে উঠেছে। আমাকে বাধ্য করেছে ছোট ছোট মৃত্যুকে বিনীত ভাবে গ্রহন করতে, যেন আমি সেই মৃত্যুর যোগ্য হয়ে উঠতে পারি যা আমাদের মহৎ করে তুলবে।
চিৎকার করে বলতে দ্বিধা নেই, প্রিয়তমা, এই সেদিন রবিবার ভোরে একটি শীতল গন্ডোলায় চড়ে ভেনিসের প্রতিটি কোনায় কোনায় ঘুরে বেড়িয়েছি, আবছা আলোয় দেখতে দেখতে মনে হলো এরা শাখা প্রশাখায় বিভক্ত হয়ে চলে যাচ্ছে দূরে, দূরের কোনো শহর যেন। বার্সাইয়োলোর কন্ঠ শুনতে পেলাম একসময়, খালের আগন্তুককে ডাকছে অনুমতিপত্রের জন্য, কিন্তু কোনো উত্তর নেই, যেন মৃত কোনো মুখ সে।
এবং, কিছু সময় আগে যে ঘন্টা-ধ্বনি শুনতে পেয়েছিলাম আমার ঘরে (সেই ঘর যেখানে আমার পুরো জীবনটাই কাটিয়েছি, যেখানে আমি জন্মেছি আর যেখানে মরার জন্য প্রস্তুত হচ্ছি) মনে হলো একদম স্পষ্ট; ওই একই ঘন্টা-ধ্বনি শুনতে পাচ্ছি, যার আওয়াজ ঘুরে ফিরে আসছিল সর্পিল গতির পানির প্রবাহের সাথে সাথে আবারও, কোনো পরিচয় ছাড়াই।
সব সময় মৃত্যু ব্যপারটা আমার ভেতর চলমান থাকে। ভেতরে ভেতরে কাজ করে। আমার হৃদয়কে রূপান্তরিত করে। আমার রক্তের লাল-কে আরো রক্তিম করে তোলে। জীবনকে নামিয়ে আনে যা আমাদের নিজস্ব ছিল, যেন তা আমার রক্তের শিরায় শিরায় কোনো অম্লমধুর বিন্দু, সবকিছুকে তীক্ষ্ণ অন্তর্দৃষ্টি সম্পন্ন করে তুলছে। চিরতরে, যা আমার হওয়া উচিত।
আর, যখন দুঃখ-বেদনা পুরোপুরি আমাকে গ্রাস করে, হে সুন্দরী, তোমার অস্তিত্ব তখন ভালো লাগার সৃষ্টি করে আমার ভেতর। ভয়ভীতিহীন ভাবে তোমার সৌন্দর্যে নিজেকে নিহিত করতেই তখন আমার আনন্দ। যেভাবে পাখি নিজেকে ওড়ায় আকাশে। আমি খুশি, প্রিয়া, অবিচল বিশ্বাস নিয়ে সমস্ত অনিশ্চয়তার মধ্যে দিয়ে তোমার হৃদয়ের সেই দ্বীপে হেঁটে গেছি আমি, যেখানে ব্যথা প্রস্ফুটিত হয় ফুলের মতো। শেষ পর্যন্ত: আমি সুখি।
তোমার রাইনার
...
(চলবে...)
তথ্য সূত্র : উইকিপিডিয়া, দ্যা প্যারিস রিভিউ
ছবি সূত্র : অন্তর্জাল
সর্বশেষ এডিট : ১০ ই সেপ্টেম্বর, ২০১৮ রাত ৯:১০