somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

শব্দের ভেতর তলিয়ে থাকে নৈঃশব্দ্য

২১ শে নভেম্বর, ২০২১ সন্ধ্যা ৬:২৪
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :



এক কবি-বন্ধুর কাছে একবার প্রশ্ন রেখেছিলাম, কী মনে করো তুমি, কবিতা কি থাকবে, মানুষ যেভাবে কবিতা বিমুখ হয়ে যাচ্ছে ক্রমেই, এই প্রচার সর্বস্ব ডিজিটালাইজেশানের শতাব্দীতে, এই অগমেন্টেড রিয়ালিটির পৃথিবীতে ধরো যদি সত্যি সত্যি কবিতা মানুষের কাছ থেকে মুছে যায়—তখন কী হবে? তখন কি মানুষ বুঝতে পারবে, কবিতার ওই না-থাকাটাকে? বলা হয়ে থাকে এই মহাবিশ্বের শুরুটা যেমন হয়েছে এক মহাবিস্ফোরণে, ঠিক তেমনি শেষটাও হবে এক মহা-বিস্ফোরণ-যজ্ঞেই। প্রাগৈতিহাসিক সময় থেকে এই ধারণায় আচ্ছাদিত হয়ে আছি আমরা। এর বিপরীত বা এর বাইরেও যে অন্য কিছু হতে পারে সেইভাবে কি ভেবেছি কখনও? মানে, মহাবিশ্বের অথবা এই পৃথিবীর শেষটা তো হতে পারে গাঢ় নৈঃশব্দ্যেও। সমস্ত সৃষ্টির অগোচরে একটা সময়ে এসে নৈঃশব্দ্যের অতলেও তলিয়ে যেতে পারি আমরা। হতে পারে সেটাই আমাদের মহা-সমাপ্তি। কিন্তু সমাপ্তির কথা কেন? মুছে যাওয়ার কথাই-বা কেন আসছে? কথা তো হওয়া দরকার আমাদের জীবনের, আমাদের অস্তিত্বের। আমাদের সমস্ত রকম মানবিক সম্ভাবনার। আমাদের বুঝতে হবে, পৃথিবীকে শাসন করবার জন্য নয়, আমাদের অস্তিত্ব এই পৃথিবীর সময়ের সাথে, সৃষ্টির সাথে—গাছপালা, পশুপাখি সহ সমস্ত জীব ও জড়ের সকলের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে থেকেই আমরা আসলে মানুষ। আমাদের চেষ্টা করে যেতে হবে সব-রকম-ভাবে সম্ভাব্য সমস্ত মানবিক সম্ভাবনাগুলির উন্মেষের। তারই জন্য তো কবিতার বেঁচে থাকাটা জরুরি। হয়তো-বা তার রূপ পালটাবে, গঠন ও প্রকাশভঙ্গি পালটাবে; কিন্তু সে থাকবে। বিশ্বজগতের নিয়ম আর অনিয়মের মাঝখানে, মানব হৃদয়ের কোনও এক কোণায়, মানব মননে ঠিকই রয়ে যাবে সে। কেননা, মানুষ সৃষ্টিশীল। তার হৃদয় অনুভূতিপ্রবণ আর স্পর্শকাতর। পৃথিবীতে চলতে গিয়ে পদে পদে যেই অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হবে, তার সেই অনুভূতিপ্রবণ মন তখন আপন অজান্তেই আশ্রয় খুঁজবে কবিতায়। কোথাও না কোথাও তা মিলেও যাবে। মিলে যায়, আমরা দেখেছি। এই যেমন গতকালই, বিকেলে, ছেলেকে সাইকেল চালাতে দিয়ে হেঁটে যাচ্ছিলাম রাস্তায়। পাশ থেকে অপ্রত্যাশিতভাবে এক বয়োবৃদ্ধ রিক্সাচালক আমাকে ডাকলেন, ‘বাবা, একটু শুনে যান..।’ কিন্তু রিক্সা নেবো না তো। কোথাও যাওয়ার নেই এখন। এদিক সেদিক কিছুটা সময় হাঁটাহাঁটি মাত্র। আর, সন্ধ্যার আগেই বাসায় ফিরবো। তবু, একটু এগিয়ে যেতেই শুনতে পাচ্ছিলাম তাঁর পরের কথাগুলোও। বলতে বলতে মনে হলো কাঁপছিলেন কি একটু করে। এই বয়সে রিক্সা নিয়ে বেরিয়েছেন মানে বুঝাই যাচ্ছে কেমন তাঁর আর্থ-পারিবারিক অবস্থা। প্রথম দু’তিনটা শব্দের পর আক্ষরিক আর্থেই আর কোনও কথায় আমার মন ছিল না। মুহূর্তে চলে গিয়েছিলাম যেন অন্য কোথাও। মাথার ভেতর ঘুরপাক খেতে শুরু করলো কয়েকটা কবিতার লাইন। কাল রাতেই তো পড়ছিলাম—

হাত বাড়িয়েছিল একটি পঙ্গু ভিক্ষুক।
আমি তাকে ফিরিয়ে দিলাম সহজেই।
যেন কিছুই ঘটেনি,
কিছুই হয়নি।
যদি সমাজটা বদলানো না-যায়
তবে ভিক্ষা দিলে
এখানে শুধু
একজন ভিক্ষুকই বাড়ে,
সমস্যাটার কিছুই হয় না।


এই পর্যন্ত। পরের কথাগুলো স্মৃতির ভেতর অস্পষ্ট হয়ে ছিল। পুরো মনে আসছিল না। আর আসছিল না বলেই বারবার আওড়ে যাচ্ছিলাম। বৃদ্ধ মানুষটা বলিরেখায় আচ্ছাদিত একটা হাতে আঁকড়ে ছিলেন রিক্সার হাতল। আরেকটা হাত আমার দিকে দ্বিধান্বিত। ক্ষীণ কুঞ্চিত চোখে সন্দেহ, কথাগুলো পৌঁছল কিনা আদৌ উদ্দিষ্ট’র কানে। আমি তখন মনে-না-পড়ার যন্ত্রণায় বিদ্ধ হচ্ছি খুব। তিনি যে সমস্যার কথা বললেন, তা আমার কাছে গুরুত্বের পাল্লায় নিচের দিকে নেমে যাচ্ছে ক্রমেই। এইরকম সমস্যায় হাজারো লক্ষ লোক পড়ে আছে। ক’টার সমাধান করতে পারি আমি। ইনফেক্ট এনারটাই তো পারি না। যদি সমাজটা বদলানো না-যায়। যদি সমাজটা বদলানো না-যায়.. কেউ একজন বলেছিলেন কথাটা। কবিতায় উল্লেখ ছিল তাঁর নাম। হ্যাঁ.. নাট্যকার। এইতো মনে পড়ছে। দ্রুতই মিটিয়ে নিলাম ওখানে। তাৎক্ষণিক যতটুকু সম্ভব আর কিছু সহজ পরামর্শের পর বাসার দিকে রওনা দিলাম। নাট্যকার বার্নারর্ড শ। বাসায় পৌঁছে বইটা খুলে দেখে নিলাম—

এ কথা বলেছিলেন
নাট্যকার
জর্জ বার্নারর্ড শ।
আমিও তাঁর কথা মনে করেই
বেচারাকে ফিরিয়ে দিলাম,
নির্দ্বিধায়।
কী হবে
এইভাবে ভেবে
অথবা না-ভেবে?
ঈশ্বরের একটা বিফল চিত্র তো
এই পথ দিয়ে চলে গেল—
এর জবাব কে দেবে?
ঈশ্বর, না মানুষ?


(ঈশ্বর, না মানুষ/একটি গাছের পদপ্রান্তে)

চিত্র বিফলের; কিন্তু এই কবিতাটি কী দারুণ ভাবে সফল! কেননা ফিরিয়ে দিতে পারিনি। কবিতাটি আমাকে তা করতে দেয়নি। হাসান আজিজুল হক বলেছিলেন একটি জাতিকে বুঝতে হলে জানতে হবে তার আর্থ-সামাজিক কাঠামোকে। বদলাতে হলেও সেইখান থেকেই আসতে হবে তার বদল। মহৎ সাহিত্যর বৈশিষ্ট্য হচ্ছে মানুষের ওই ভিত্তিটাতে দাঁড়িয়ে সে কথা বলে। পরিষ্কার চিত্র তুলে ধরে। আজ কয়েক দিন হল তাঁকে আমরা হারিয়েছি। তাঁর মৃত্যুর পর শুরু করেছি তাঁর জন্মের পাঠ। ‘স্মৃতিকহন’ পড়া। চমৎকার সব গল্পের মাধ্যমে অসাধারণ সেই উপস্থাপনা। বাবা তাঁর বেঁচে ছিলেন ৯২ বছর, মা ৮৩ বছর আর তিনি নিজেও ৮৩। অথচ বাঁচার কথা ছিল না কিছুতে। জন্মের পরপর নিউমোনিয়ায় ভুগে মরে যাওয়ার কথা। কেন যে মরলেন না তখন সেটাই আশ্চর্য। রাঢ় বঙ্গের এইসব গল্প পড়তে পড়তে কখন রাত হয়ে গেছে অনেক, টের পাইনি। বউ আর ছেলে দু’পাশে দু’জন কাঁথা মুড়ি দিয়ে শুয়ে পড়েছে অনেকক্ষণ! বাইরের কোলাহলও থেমে গেছে। মাঝেমধ্যে দু’একটা কুকুর যথারীতি চিৎকার দিয়ে উঠছে। পড়া বন্ধ রেখে শুয়ে রইলাম অন্ধকারে। ধীরে ধীরে রাত্রি আরও গাঢ় হয়ে এলো। তবু ঘুম এলো না। মাথার মধ্যে ঘুরপাক খেতে শুরু করলো বিগত রাতের পড়া আরও একটি কবিতা—

এতোটা রাত্রি জুড়ে জেগে আছি
কামড়াতে আসছে না কোনও মশাও এখন
মশারাও ততক্ষণে ঘুমিয়ে গিয়েছে
পৃথিবী যে টিকে আছে জানা যাচ্ছে
কুকুরের প্রশান্ত ধমকে
একটু আয়ু কি আর পাওয়া যাবে
সব কোলাহল শান্ত হলে পর?


(ভূমিকম্পের পরবর্তী রাতে/অগ্রন্থিত কবিতা)

আবারও চিন্তাটা ফিরে এলো। কবিতা কি সমাজ বদলাতে পারে? কিংবা, সাহিত্য পারে? আজকের দিনে পৌঁছে আমাদের কবিতার বা সাহিত্যের সমাজ বদলানোর ভাবনাটা অনেকটাই রোম্যান্টিক বিভ্রমের মতো শোনায় হয়তো। সামাজিক মূল্যবোধের চরম অধঃপতনের এই শতাব্দীতে কবির অবস্থান আসলে কোথায়? ম্যাথিউ আর্নল্ড পরিতাপ করে বলেছিলেন, a beautiful ineffectual angel beating in the void his luminous wings in vain ছাড়া কিছুই নন কবি। আবার অন্যদিকে জ্যাক কেরোয়াকের ওই উদ্ধৃতিটিও যদি মনে করতে চাই, কবি হচ্ছেন, the great rememberer redeeming life from darkness; কেননা, আমরা দেখেছি বিগত শতাব্দীর ইতিহাসে কীভাবে সমাজ বদলের ভূমিকায় কবি সাহিত্যিকরা সক্রিয় ছিলেন। দান্তে, বোদল্যের, র‍্যাঁবো, গ্যেটে, দস্তয়েভস্কি, মায়াকোভস্কি থেকে আমাদের রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, সুকান্ত, জীবনানন্দ—এমনকি শামসুর রাহমান, নির্মলেন্দু গুণ—এঁরা সবাই প্রত্যক্ষ কিংবা পরোক্ষ ভাবে একটা সময়ে সমাজ বদলে ভূমিকা রেখেছেন। তাহলে তো বলাই যায়, কবিতা বা সাহিত্য সেই অর্থে সমাজ বদল করতে না পারলেও পরোক্ষ ভাবে প্রবল সহায়ক ভূমিকা রাখতে পারে। কিন্তু কথা হচ্ছে, আজকের পৃথিবীর প্রেক্ষাপটে তা কতটুকু পারছে? – এর উত্তর হয়তো এই মুহূর্তে দেয়া সম্ভব নয়। আমাদের অপেক্ষা করতে হবে ভাবি কালের পর্যবেক্ষকের জন্য।

পরদিন শুক্রবার। ছুটির দিন। বাসা থেকে সকাল সকাল বাজারে যাওয়ার তাগাদা থাকায় ঘুম ভাঙলো মোবাইল ফোনসেটে পাতা এলার্মে। এদিকে অপর্যাপ্ত নিদ্রার কারণে মাথার ডান পাশটা টনটন করছে। কিন্তু পেটের তাগিদ সবচেয়ে বড় তাগিদ। তাই কাল ক্ষেপণ না করে উঠে বেরিয়ে পড়লাম। বাসার বাইরে পা রাখতেই এলিস অসবর্নের কথাটা মনে পড়লো, ‘আগেও একবার বলেছি কবিতা হচ্ছে একটা সেতুর মতো। ভাল মানুষ হয়ে ওঠা আর এই বিশ্বটার কাঙ্ক্ষিত পরিবর্তনের একটি তাত্ক্ষণিক পথ বলা যায় একে। বিচ্ছিন্নতার চাইতে, বিভেদ সৃষ্টি করে দূরে সরিয়ে দেয়ার চাইতে, পরস্পরকে কাছে টেনে এনে, মানুষে মানুষে যোগাযোগ সৃষ্টি করে, একটা আত্মিক বন্ধন তৈরি করে কবিতা।’ রিক্সার জন্য অপেক্ষা না করে মোড়ের দিকে হাঁটতে লাগলাম। এলিস আরও বলেছেন, ‘কবিতা আমাদের বুঝতে সাহায্য করে, আমরা নিজেদের যতটা আলাদা ভাবি, আসলে অতটা আলাদা নই একেবারেই। আমাদের মধ্যে পার্থক্য থাকা সত্ত্বেও, আমাদের দুঃখ, বেদনা, আনন্দ বা সুখে আমরা একা নই। পরস্পর ঠিকই সম্পর্কিত।’ তাহলে কবি এন্টি-সোশ্যাল নন কিছুতে। বরং প্রচণ্ড ভাবেই সোশ্যাল। আর তাই হয়তো সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে গুঁজে থাকা অসংগতিগুলো মানতে পারেন না তিনি। আওয়াজ তোলেন কবিতায়। বদলাতে চান ওগুলো। পাঠকের চেতনাকে জাগাতে চান। আবার এও তো দেখেছি কবিতা পড়ে পড়ে, যে তাঁর কবিতা প্রশান্ত মহাসাগরীয় অগ্নিবলয়ের মধ্যে অবস্থিত একটি সুপ্ত আগ্নেয়গিরির মতোই আমাদের অজানা অভ্যন্তরীণ দ্বিধাকে রহস্যময়ও করতে চায়। আমাদের জীবনের মূল সুরকে আমাদের চেনায়, মুখোমুখি করে দেয়। আমরা বুঝে গেছি, আধুনিক সমাজ কেবলমাত্র লিখিত আবেগ আর অভিজ্ঞতা দিয়েই স্মরণযোগ্য। এ’জন্য আজ প্রয়োজন হয়ে পড়েছে, কবিতার শব্দগুলোয় মন্ত্রমুগ্ধ করার ক্ষমতার। যেন তার কাজ সে নিজেই করে নিতে পারে। কবিতা— a journey of wisdom, a palate of colors, a saga of love, life and death. সেইরকমই কিছু কবিতার ভাণ্ডার উল্টাচ্ছিলাম সে’দিন। কয়েক মাস আগেই প্রয়াত হয়েছেন যে কবি। গত বইমেলার আগের মেলায় হঠাৎ করেই যাকে আবিষ্কার করেছিলাম তাঁর কবিতা সমগ্র কিনে। কবি নূরুল হক। আমাদের মাঝে আজ আর নেই তিনি। রয়ে গেছে তাঁর কবিতা। না, তাঁর অতৃপ্ত আত্মা নয়। তাঁর সেইসব নিমগ্ন কবিতাই পৃথিবীতে ঘুরপাক খাচ্ছে। ঘুরছে আমার মাথার ভেতর। যে দিকেই তাকাচ্ছি সে দিকেই ফিরে আসছেন তিনি একেকটা পঙক্তি হয়ে। এই যে এখন ময়লার মোড়ের ঠিক আগেই বাঁ দিকে যে মাংসের ছোট্ট দোকান হয়েছে নতুন, আমি তার সামনে দিয়ে যাচ্ছি আর আমার চোখ বারবার বিঁধে যাচ্ছে ওই টাঙানো ঊরুর মসৃণ মাংসপিণ্ডে। ঘুরে আসছে আবার, কবিতা—

মৃত্যু এসে দেখা করে গেছে
যার সাথে
সে রকম একজন
ঝুলে আছে সাজানো দোকানে
টাটকা রানের টুকরো হয়ে।
সে মৃত্যুতে তার কোনও আকাঙ্ক্ষা ছিল না,
সম্মতিও ছিল না কিঞ্চিৎ
শুধু
অন্য কারও মত্ততায়
প্রলুব্ধ হিংসায়
ঝুলে আছে সাজানো দোকানে।


(সে রকম একজন/অগ্রন্থিত কবিতা)

মনে আছে হয়তো ‘সেইসব শেয়ালেরা’। না, তুলনা টানছি না কবিতার সাথে কবিতার কিংবা কবির সাথে কবির। সেটা হয় না কোনোভাবেই। সেটা করতে যাওয়াও নীচতা জানি। শুধু মনে পড়ছে কেন তাই বলছি। কিছু কিছু কবিতা আছে পুরো ধরা যায় না। একটা বিভ্রমের ভেতর পড়ে থাকতে হয়। মনে হয় যেন ধরতে পারলাম, আবার পর মুহূর্তে মনে হয় কই-বা পারলাম! কিছু আছে মাস লেগে যায়, ধরা দেয় না। কিছু আছে বছর। আবার কিছু আছে জীবন চলে যায়। টাটকা রানের টুকরোর এই কবিতাটি আমার কাছে অনেকটাই তেমন। ‘সেইসব শেয়ালেরা’ আমি এতো বছরেও ধরতে পেরেছি বলে মনে হয় না। এই কবিতাটি অবশ্য পড়েছি মাত্র দু’দিন। তবে এও ঠিক, এইভাবে জীবনের প্রতি মুহূর্তের অভিজ্ঞতার সাথে মিলিয়ে নিতে নিতে এক সময় মিলেও যাবে। আরও কবিতা পড়তে পড়তে আমরা জীবনের ধ্যানে মগ্ন হয়ে রইবো।

আমার কবিতাগুলো আমাকে অতিক্রম করে যায়
পিছনে রেখে যায় আমার জীবন
এবং শূন্য দুহাত।


(আমার কবিতাগুলো/এ জীবন খসড়া জীবন)

‘জীবন ও মৃত্যুর মাঝখানে / যে বস্তু ডুবে যায় / সে কি আমি?’ – জীবনের ভেতর মগ্ন হয়ে থেকে এই যে অনুভব, এই যে জিজ্ঞাসা, এ’কি শুধু কবির একার, না আমারও, আমাদেরও? গান্ধী বলেছিলেন, ‘আমার জীবনই আমার বার্তা।’ তেমনি কবির যাপিত জীবন কি কবির একার? সেই জীবনের বার্তাগুলোই তো তাঁর কবিতা। সে কবিতা যেমন তাঁর, তেমনি আমারও, আমাদেরও। আমাদেরও পুরো জীবনটাই তাই তেমনই কি একেকটা কবিতা নয়? যেভাবে আমরা একে যাপন করে যাচ্ছি, যেভাবে মিলছি সকলের সাথে, এর মাধ্যমে নিজেকেই তো উপস্থাপন করে চলেছি নিয়ত। আমাদের প্রতিটি মুহূর্তে কেমন চাই আমরা নিজেদের? অর্থহীন উন্মত্ত বাগাড়ম্বরের মতো? নাকি একটা গীতিনাট্যের মতো? মহাকাব্যের মতো? কিংবা একটা সনেট, একটা লিমেরিক বা হাইকু? কেমন চাই জীবনের মুহূর্তগুলোকে?

আর কবিতার পাঠ মানেই তো ‘an adventure in renewal, a creative act, a perpetual beginning, a rebirth in wonder.’ তৃষ্ণার্ত হৃদয়ের অন্তর্গত আকাঙ্ক্ষা হচ্ছে কবিতা। the grief we cry out from, draws us toward union. কবিতার কাছে এই জন্যই তো যাই আমরা বারবার।

শুক্রবার, ছুটিরই দিন। কলেমায়ে জুম্মাবার। বাজার সেরে এসেছি অনেকক্ষণ। এক কাপ চা খেতে খেতে, বেলকনি পেরিয়ে সারি সারি গাছেদের ওপারে তাকিয়ে দেখতে পাই, রৌদ্রোজ্জ্বল দারুণ একটা শুক্রবার ফুটে আছে। নীচে, লেকের পাড়ে বসে আছে গ্রাম থেকে আসা এক যুবক। প্রায় তাকে দেখি। দেখি বললে ভুল হবে। আসলে শুনি। গলা ছেড়ে গান ধরে ও। বড় মায়াময় তার কণ্ঠ। জীবিকার খোঁজেই হয়তো আসতে হয়েছে কংক্রিটের এই নগরে। কিন্তু মনটা নিশ্চয়ই পড়ে আছে সেই গ্রামেই। নয় তো দুঃখের গানই গেয়ে উঠেবে কেন সে। ভালো লাগে। খুব ভালো লাগে। শিয়রে তুলে রাখা সমগ্রটা হাতে টেনে নিই আবার—

দুপুরবেলার রোদ
কোথাও ঢালভূমি খুঁজছে
জুম্মার নামাজের পর।
গাছগাছালির নীচে
এক এক খণ্ড ছায়া
যেন এক একটি দোয়া।
যেন শান্তি, স্নিগ্ধতা
আর আয়াত দিয়ে
তৈরি
পালক
ভাসিয়ে উড়ছে একটা পাখি
নীল রৌদ্রে।


(কলেমায়ে জুম্মাবার/একটি গাছের পদপ্রান্তে)

কখনও কখনও সেই যুবককে দেখতে ইচ্ছে করে খুব। কাছেই তো। মনে হয়, সিঁড়ি ভেঙে নেমে, কথা বলে আসি। কিন্তু যাওয়া হয় না। কাছে মনে হলেও, আমি নিশ্চয়ই কাছে নই। যোজন যোজন দূরতায়। দ্বিধার একটা অদৃশ্য কংক্রিট মানুষে মানুষে যেমন থাকে, সেই রকমই আছে একটা। আমি পাঠ করি—

ম্লান মানুষের মতো
নতমুখ মানুষের মতো
একটি জীবন্ত ক্ষত
জেগে থাকে
বুকের ভেতরে।
সময়ের পাড় ভেঙে
বিষণ্ণ ধসের মতো
আমার হৃদয়ে শব্দ করে


(স্মৃতি, জীবন/ সব আঘাত ছড়িয়ে পড়েছে রক্তদানায়)

১৯/১১/২০২১
সর্বশেষ এডিট : ২১ শে নভেম্বর, ২০২১ সন্ধ্যা ৬:৩৬
৩টি মন্তব্য ৩টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

গণতন্ত্র আর বাক-স্বাধীনতার আলাপসালাপ

লিখেছেন অনিকেত বৈরাগী তূর্য্য , ২৭ শে মার্চ, ২০২৪ বিকাল ৪:২৩


একাত্তর সালে আওয়ামী লীগের লোকজন আর হিন্দু ধর্মাবলম্বীরা ছিল পাকবাহিনীর প্রধান টার্গেট। যদিও সর্বস্তরের মানুষের ওপর নিপীড়ন অব্যাহত ছিল। গ্রামের পর গ্রাম জ্বালিয়ে দেওয়া হয়েছিল। মুক্তিযোদ্ধা আর তাদের পরিবারের... ...বাকিটুকু পড়ুন

কাফের কুফফারদের দেশে বাস করা হারাম।

লিখেছেন মঞ্জুর চৌধুরী, ২৭ শে মার্চ, ২০২৪ রাত ৯:১৩

ফেসবুকে বাঙালিদের মধ্যে ইদানিং নতুন এক ফতোয়া চালু হয়েছে, এবং তা হচ্ছে "দাওয়াতের নিয়্যত ছাড়া কাফের কুফফারদের দেশে বাস করা হারাম।"
সমস্যা হচ্ছে বাঙালি ফতোয়া শুনেই লাফাতে শুরু করে, এবং কোন... ...বাকিটুকু পড়ুন

স্বাধীনতা দিবসের অনুষ্ঠানে মুক্তিযোদ্ধাদের মুমিনী চেহারা ও পোশাক দেখে শান্তি পেলাম

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ২৭ শে মার্চ, ২০২৪ রাত ৯:৫৮



স্বাধীনতা দিবসের অনুষ্ঠানে স্টেজে উঠেছেন বত্রিশ মুক্তিযোদ্ধা তাঁদের চব্বিশ জনের দাঁড়ি, টুপি ও পাজামা-পাঞ্জাবী ছিলো। এমন দৃশ্য দেখে আত্মায় খুব শান্তি পেলাম। মনে হলো আমাদের মুক্তিযোদ্ধা আমাদের মুমিনদের... ...বাকিটুকু পড়ুন

দু'টো মানচিত্র এঁকে, দু'টো দেশের মাঝে বিঁধে আছে অনুভূতিগুলোর ব্যবচ্ছেদ

লিখেছেন মোহাম্মদ গোফরান, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ রাত ১২:৩৪


মিস ইউনিভার্স একটি আন্তর্জাতিক সুন্দরী প্রতিযোগিতার নাম। এই প্রতিযোগিতায় বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সুন্দরীরা অংশগ্রহণ করলেও কখনোই সৌদি কোন নারী অংশ গ্রহন করেন নি। তবে এবার রেকর্ড ভঙ্গ করলেন সৌদি... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমাদের দুই টাকার জ্ঞানী বনাম তিনশো মিলিয়নের জ্ঞানী!

লিখেছেন সাহাদাত উদরাজী, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ রাত ২:৫৯

বিশ্বের নামীদামী অমুসলিমদের মুসলিম হয়ে যাওয়াটা আমার কাছে তেমন কোন বিষয় মনে হত না বা বলা চলে এদের নিয়ে আমার কোন আগ্রহ ছিল না। কিন্তু আজ অষ্ট্রেলিয়ার বিখ্যাত ডিজাইনার মিঃ... ...বাকিটুকু পড়ুন

×