somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

প্রত্যক্ষদর্শীর চোখে মুক্তিযুদ্ধ পর্ব ১

১৮ ই জুন, ২০২১ রাত ৮:৩৩
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


কবীর চৌধুরী ছিলেন বাংলাদেশের একজন প্রথিতযশা শিক্ষাবিদ, প্রাবন্ধিক ও অনুবাদক। তিনি বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক দেশের জাতীয় অধ্যাপক নির্বাচিত হয়েছিলেন। তিনি অধ্যাপক কবীর চৌধুরী নামে সমধিক পরিচিত; তার ডাকনাম মাণিক। কবীর চৌধুরীর ছোট ভাই শহীদ বুদ্ধিজীবী অধ্যাপক মুনীর চৌধুরী। তিনি জীবন, শিল্প, সমাজ, সংস্কৃতি, রাজনীতি নানা বিষয় নিয়ে লিখতেন।

গণহত্যার শুরু
অধ্যাপক কবীর চৌধুরী

(জন্ম : ৯ ফেব্রুয়ারি, ১৯২৩ মৃত্যু : ১৩ ডিসেম্বর, ২০১১)
(১৯৯১ সালের সাক্ষাকারের ভিত্তিতে তৈরি)

মাঝরাতে গোলাগুলির আওয়াজ কানে এলো। ঘুম ভেঙ্গে গেলো। আগুনের লেলিহান শিখাও চোখে পড়লো। সুরণকালের নৃশংসতম গণহত্যা অভিযান যে শুরু হয়ে গেছে তা আমরা, আমাদের শহরতলীর বিচ্ছিন্ন এলাকার যারা বাস করি, তখনো বুঝতে পারিনি। আমার মনে হল সৈন্যদের সঙ্গে বাঙালি ছাত্র জনতার খণ্ড সংঘর্ষ চলছে, তারই শবদ শুনছি আমরা। টেলিফোনের লাইন কাটা, কারো সঙ্গে কোন যোগাযোগ করার উপায় নেই। ২৫ শে মার্চ রাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা, রাজারবাগ পুলিশলাইন ও অন্যান্য জায়গায় বাইফেল, মেসিনগান, কামান ও ট্যাঙ্কের সাহায্যে পাকিস্তানের ঘাতক বাহিনী যে নিষ্ঠুর মানুষ শিকারে মেতে উঠেছিলো তার কিছুই আমরা জানতে পারিনি ২৭ শে মার্চ ভোরের আগে পর্যন্ত।
১৯৭১-এর ২৫ শে মার্চের কথা কোনদিন ভোলা যাবে না। তবে এর স্মৃতির সঙ্গে ২৫ শে মার্চের অভূতপূর্ব অবিশ্বাস্য ঘটনাবলীই জড়িয়ে নেই, তার পরতে পরতে মিশে আছে ২৫ শে মার্চের আগের ও ২৫ শে মার্চের পরের নানা ইতিবৃত্ত। '৭১-এর গোটা মার্চ মাসটাই আমাদের জীবনে এক সঙ্গে আনন্দের ও বেদনার, পরম গৌরবের ও চরম লাঞ্ছনার। মনে পড়ে ৭ ই মার্চে বঙ্গবন্ধুর অতুলনীয় ভাষণের কথা, যেখানে তিনি দেশবাসীকে ডাক দিলেন ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তুলতে, ঘোষণা করলেন যে এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম। বলতে গেলে তারও আগে থেকে, ১ লা মার্চ থেকেই, বাংলাদেশ একরকম স্বাধীন। সারা দেশ তখন চলছে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের নির্দেশে। আমি এই সময় বাংলা একাডেমীর প্রধানরূপে কর্মরত। বঙ্গবন্ধুর ডাকে আর সবার মতো আমিও আপিসে যাই না। মধ্য - মার্চ পেরিয়ে বাংলার স্বাধীনতাকামী উদ্দাম চঞ্চল মানুষ তাকিয়ে আছে সামনের দিকে। ফেডারেল কাঠামোর মধ্যে বাংলাদেশ স্বাধীন ভৌণ প্রজাতন্ত্রের মর্যাদা পাবে এই সম্ভাবনা অনেকের চিত্তে একটা বড় রকম জায়গা করে নিয়েছে। স্বাধীন বাংলার পতাকা পর্যন্ত তৈরী হয়ে গেছে। আমার বাড়ির এক প্রান্তে উড়ছে সে পতাকা, অন্য প্রান্তে পাকিস্তানী সৈনিকদের গুলিতে নিরস্ত্র বাঙালি হত্যার প্রতিবাদস্বরূপ শোকের প্রতীক কালো পতাকা। বাড়ির মাথায়ও উড়ছে কালো পতাকা।
আমি তখন আমার দুই কন্যা ও স্ত্রীকে নিয়ে বাস করি গুলশানে। ২৫ শে মার্চ বাড়িতে ফিরছি এয়ারপোর্ট রোড ধরে, ক্যান্টনমেন্টের প্রবেশ পথের কাছে মোড় ঘুরে, মহাখালি হয়ে। ওই ক্যান্টনমেন্টের মধ্যে বাংলাদেশের পতাকা উড়ছে না, তাছাড়া সর্বত্রই তা উজ্জনি। ওই মোড়ের কাছে পাক সৈনিকদের চোখ আমার গাড়ির কালো আর সবুজ - লাল পতাকা দেখে যেন জ্বলে উঠলো। ২৫ শে মার্চ মনে হল সর্বত্র যেন একটা অস্থিরতা, চাপা উত্তেজনা, বিস্ফোরমুখ চাঞ্চল্য। কেউ বলছে ইয়াহিয়ার সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর আলোচনা ভেঙ্গে গেছে, শেখ মুজিব স্বাধীনতা ঘোষণা করবেন আজই, তারপর হয়তো রীতিমতো যুদ্ধ বেধে যাবে। ছাত্ররা নাকি রাস্তায় রাস্তায় ব্যারিকেড তুলতে শুরু করেছে। পথে পথে জনতার ঢল।
কেউ বলছে, না, একটা সমঝোতা হয়ে গেছে, না হলেও হবেই। আপোষ ফমূলা পাওয়া গেছে। অস্থিরতা ও চাঞ্চল্যের মধ্য দিয়ে যা দেখলাম তা আশঙ্কার কালো ততটা নয়, যতটা আশার আলো। “বীর বাঙালি অস্ত্র ধর, বাংলাদেশ স্বাধীন কর”, “তোমার আমার ঠিকানা, পদ্মা-মেঘনা-যমুনা”, “জয় বাংলা” প্রভৃতি শ্লোগানে বাংলার মাঠ ঘাট প্রান্তর উতরোল। সেই ধ্বনির প্রেরণাদায়ী অনুরণন কানে নিয়ে আমরাও ঘুমুতে গেলাম পঁচিশে মার্চ রাত দশটা - সাড়ে দশটার দিকে। মাঝরাতে গোলাগুলির আওয়াজ কানে এলো। ঘুম ভেঙ্গে গেলো। আগুনের লেলিহান শিখাও চোখে পড়লো। স্মরণকালের নৃশংসতম গণহত্যা অভিযান যে শুরু হয়ে গেছে তা আমরা, আমাদের শহরতলীর বিচ্ছিন্ন এলাকায় যারা বাস করি, তখনো বুঝতে পারিনি। আমার মনে হল সৈন্যদের সঙ্গে বাঙালি ছাত্র-জনতার খণ্ড সংঘর্ষ চলছে, তারই শব্দ শুনছি আমরা। টেলিফোনের লাইন কাটা, কারো সঙ্গে কোন যোগাযোগ করার উপায় নেই। ২৫ শে মার্চ রাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা, রাজারবাগ পুলিশ লাইন ও অন্যান্য জায়গায় রাইফেল, মেশিনগান, কামান ও ট্যাঙ্কের সাহায্যে পাকিস্তানের ঘাতক বাহিনী যে নিষ্ঠুর মানুষ শিকারে মেতে উঠেছিলো তার কিছুই আমরা জানতে পারিনি ২৭ শে মার্চ ভোরের আগে পর্যন্ত।
২৭ শে মার্চ ভোরবেলা বাসার বারান্দায় দাড়িয়ে দেখলাম দূরে মাঠ আর জলার উপর দিয়ে ক্যান্টনমেন্টের দিক থেকে কিছু লোকজন যেন বিছানাপত্র আর তৈজস সামগ্রীর পুটুলী নিয়ে দ্রুত বাড়ার দিকে পালিয়ে যাচ্ছে। তখনো বুঝতে পারিনি যে পাক- বাহিনী শুধু এক তরফা হত্যাযজ্ঞ চালিয়ে যাচ্ছে। অবশ্য যুদ্ধও শুরু হয়েছিলো পঁচিশে রাতেই। বিশেষ করে রাজারবাগ পুলিশ লাইনে বাঙালি দেশপ্রেমিক পুলিশ বাহিনী পাকিস্তানী খুনীদের বিরুদ্ধে লড়েছিল অসাধারণ বীরত্বের সঙ্গে। কিন্তু সে খবর আমরা তখনো পাইনি।
২৭ শে মার্চ ঘোষণা হল রেডিওতে, সবাইকে আপিসে যেতে হবে। ২৭ শে-ই তো ? কিন্তু সকল যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন, আমরা গুলশানের আটাশ নম্বর সড়কের জন কয়েক বাঙালি। নখনো বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে হরতাল পালনের সিদ্ধান্যে সাটল। সকাল দশটা নাগাদ আমার জৌষ্ঠ কন্যা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা থেকে অস্থির হয়ে ছুটে এলো। কাঁদতে কাঁদতে সে বললো বিশ্ববিদ্যালয় এলাকার হত্যাযজ্ঞের কথা। কিভাবে রাত এগারোটা থেকে সাড়ে এগারোটার সময় প্রচন্ড গর্জনে রাইফেল, সাবমেশিনগান, কামানের সাহায্যে সলিমুল্লাহ হল, ইকবাল হল, জগন্নাথ হন এবং নিকদের আবাসিক এলাকায় নৃহস হামলা চালানো হয়েছে।
ফুলার রোডে ১৬ নং বাড়িতে থাকতো ওরা। ওদের বাড়ির দেয়ালের ওপাশেই হানাদার বাহিনীর সৈনিকরা অবস্থান নিয়েছিলো। তাদের ওয়াকিটকির শব্দ ওরা শুনেছে। সুপরিকল্পিতভাবে পরস্পরের সঙ্গে যোগাযোগ রেখে, যুদ্ধ পরিচালনার মতো চালানো হয়েছিলো এই হত্যাযজ্ঞ। তার কাছেই শুনলাম যে সর্বজন শ্রদ্ধেয় অজাতশত্রু অধ্যাপক গোবিন্দ চন্দ্র দেব নিহত, গুলীবিদ্ধ অধ্যাপক জ্যোতির্ময় গুহঠাকুরতা মৃত্যু পথযাত্রী, সংখ্যাতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক মনিরুজ্জামানসহ আরো অনেকে প্রাণ হারিয়েছেন। গুলশানে। আসার পথেও মেয়ে - জামাই একাধিক মৃতদেহ দেখেছে। রমনা কালীবাড়িটি গোলার আঘাতে উড়িয়ে দেয়া হয়েছে। আমি তখনো আপিসে যাইনি দেখে ওরা আতঙ্কে দিশেহারা। পাক সেনারা যে মানুষ নয় পশু, যেটুকু ইতিমধ্যে দেখেছে, তাতেই সে জ্ঞানটুকু তাদের হয়েছে। অথচ তখনো দেখার কতো বাকী ছিলো।
বারোটার দিকে বাংলা একাডেমীতে এলাম। আজকের নতুন ভবন নয়, পুরানো বর্ধমান হাউস। আদি বাংলা একাডেমী ভবন। দেখলাম এর উপরেও বর্ষিত হয়েছে কামানের গোল। একতলায় সংস্কৃতি বিভাগের দরজা গোলার আঘাতে বিধ্বস্ত। দোতলায় আমার ঘরের উপরও গোলা পড়েছে। অল্প ক’জন কর্মচারী আপিসে এসেছেন। তাদের কাছে পচিশের তাণ্ডবলীলার আরো কাহিনী শুনলাম। শহীদ মিনার আর নেই। পুরানো ঢাকায় অনেক অঞ্চল ধ্বংসস্তুপে পরিণত হয়েছে। তবে এর মধ্যেও শুনলাম প্রতিরোধের আশ্চর্য বীরত্বব্যঞ্জক ঘটনার কথা। একজন ফিসফিস করে জানালো একটি বিশেষ সময়ে বিশেষ স্থানে টিউন করে যেন রেডিও শুনি। স্বাধীনতার যুদ্ধ চলছে।
সেসব দিনের স্মৃতি কি কখনো ভোলবার ?
হারুন হাবিবের সম্পাদিত বই থেকে
সর্বশেষ এডিট : ১৮ ই জুন, ২০২১ রাত ৮:৩৭
২টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। রেজওয়ানা চৌধুরী বন্যা ও পদ্মশ্রী পুরস্কার

লিখেছেন শাহ আজিজ, ২৩ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১১:৫৬



এ বছরের পদ্মশ্রী (ভারতের চতুর্থ সর্বোচ্চ অসামরিক সম্মাননা) পদকে ভূষিত করা হয়েছে, বাংলাদেশের রবীন্দ্র সংগীত এর কিংবদন্তি শিল্পী রেজওয়ানা চৌধুরী বন্যাকে।

আমরা গর্বিত বন্যাকে নিয়ে । ...বাকিটুকু পড়ুন

কষ্ট থেকে আত্মরক্ষা করতে চাই

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ২৩ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:৩৯



দেহটা মনের সাথে দৌড়ে পারে না
মন উড়ে চলে যায় বহু দূর স্থানে
ক্লান্ত দেহ পড়ে থাকে বিশ্রামে
একরাশ হতাশায় মন দেহে ফিরে।

সময়ের চাকা ঘুরতে থাকে অবিরত
কি অর্জন হলো হিসাব... ...বাকিটুকু পড়ুন

রম্য : মদ্যপান !

লিখেছেন গেছো দাদা, ২৩ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:৫৩

প্রখ্যাত শায়র মীর্জা গালিব একদিন তাঁর বোতল নিয়ে মসজিদে বসে মদ্যপান করছিলেন। বেশ মৌতাতে রয়েছেন তিনি। এদিকে মুসল্লিদের নজরে পড়েছে এই ঘটনা। তখন মুসল্লীরা রে রে করে এসে তাকে... ...বাকিটুকু পড়ুন

= নিরস জীবনের প্রতিচ্ছবি=

লিখেছেন কাজী ফাতেমা ছবি, ২৩ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৪:৪১



এখন সময় নেই আর ভালোবাসার
ব্যস্ততার ঘাড়ে পা ঝুলিয়ে নিথর বসেছি,
চাইলেও ফেরত আসা যাবে না এখানে
সময় অল্প, গুছাতে হবে জমে যাওয়া কাজ।

বাতাসে সময় কুঁড়িয়েছি মুঠো ভরে
অবসরের বুকে শুয়ে বসে... ...বাকিটুকু পড়ুন

Instrumentation & Control (INC) সাবজেক্ট বাংলাদেশে নেই

লিখেছেন মায়াস্পর্শ, ২৩ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৪:৫৫




শিক্ষা ব্যবস্থার মান যে বাংলাদেশে এক্কেবারেই খারাপ তা বলার কোনো সুযোগ নেই। সারাদিন শিক্ষার মান নিয়ে চেঁচামেচি করলেও বাংলাদেশের শিক্ষার্থীরাই বিশ্বের অনেক উন্নত দেশে সার্ভিস দিয়ে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×