somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

জয় পরাজয় : ছোট গল্প লিখেছেন শাহরিয়ার কবির

১১ ই অক্টোবর, ২০২২ সন্ধ্যা ৬:৪২
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :



যারা পুরোনো ঢাকায় থাকো, তারা হয়তো ব্রাদার পলকে দেখে থাকবে। মোটা সোটা হাসিখুশি মানুষটি। ঘামে আর রোদের আঁচে টক টকে চেহারাটা যেন ভাজা চিংড়ির মত ঝলসে গেছে। থুতনিতে সুন্দর করে ছাঁটা ফ্রেঞ্চকাট দাড়ি। মুখে মোটা একটা হাভানা চুরুট, সাইকেলে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। পথে পরিচিত কাউকে দেখলেই সাইকেলে বসে হাত তোলেন। চেঁচিয়ে বলেন, ‘গুড মর্নিং’ নয়তো ‘গুড আফটারনুন!’ তারপর–হাউ ডু য়্যু ডু?
সেদিন আমি এই ব্রাদার পলের কাছেই একটা মিথ্যে কথা বলেছিলাম। ব্রাদার সেদিন সেই মিথ্যাটাকেই সত্যি বলে বিশ্বাস করেছিলেন। তাই আমার হয়ে ব্রাদার ডিক সম্পর্কে কড়া মন্তব্য করে মিশনে চিঠি লিখেছিলেন। যার জন্য স্কুলের নতুন টিচার সেদিন বাধ্য হয়েছিলেন স্কুল ছাড়তে।
সেই দিনটার কথা এখনো পষ্ট আমার চোখের সামনে ভাসছে। ক্লাশ টেনে পড়ি তখন। অর্থাৎ রীতিমত কর্তা গোছের। ক্লাশ ছুটি। আমরা সবাই তবু ক্লাশে বসে জটলা করছি। আলোচনাটা ব্রাদার ডিককে নিয়ে। সালেহ্, ফারুক, মাসুক ওরা সবাই বলছিলো ব্রাদারকে একটা ভালো মত শিক্ষা দেয়া দরকার। সালেহটা এর মধ্যেই গায়ে গতরে দিব্যি পাণ্ডা গোছের হয়েছে। গলা শোনা যাচ্ছে বেশি ফারুকের। ব্রাদার নাকি বলেছেন, বাংলা চামারের ভাষা। আমার সাথে কেউ বাংলা বলতে পারবে না। ইংরেজিতে কথা বলবে’ (ব্রাদার অবশ্য এসব ইংরেজিতেই বলেছেন)। আর ক্লাশ সিক্সের একটা ছেলেকে নাকি লাথি মেরে সিঁড়ি থেকে নিচে ফেলে দিয়েছেন। কারণ ছেলেটা নাকি এর প্রতিবাদ করেছিলো।
ওদের আলোচনা দিব্যি গরম হয়ে উঠেছে। আমি মাঝে মাঝে শুনছিলাম, আবার মাঝে মাঝে নিজেদের আলাপে ফিরে যাচ্ছিলাম। আনোয়ার আর ইউসুফ বসে সামনে টেষ্ট পরীক্ষার বিষয়ে আলাপ চালিয়ে যাচ্ছে। গরম বেশি ফারুকদের আলোচনা। মাঝে মাঝে টেবিলে চড়-ঘুষির শব্দও পাওয়া যাচ্ছে। হাতে চক পেয়ে জহির আর আনসারী বিজি আচারিয়া স্যারকে নকল করে বোর্ডে জ্যামিতির আঁক কষছে। এমন সময় সুয়িং ডোর-এর উপর দিয়ে তাকালেন ব্রাদার ডিক।
নতুন এসেছেন ব্রাদার আমেরিকা থেকে। অল্প বয়স, সাড়ে ছ’ফুট লম্বা, খাঁটি ‘ম্যারিকান’ চেহারা। কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে তাকিয়ে রইলেন ক্লাশের ভিতরের দিকে, যেখানে আমরা কেউ টেবিলে, কেউ চেয়ারে, কেউ বেঞ্চে হাত-পা মেলে বসে।
আনসারীই ব্রাদারকে প্রথম দেখেছে। আমাদের হুঁশিয়ার করে দেয়ার জন্যে হাতের ডাস্টারটা ছুঁড়ে মারল কোণার দিকে। তোবারক ভাবলো ওকেই বুঝি ছুঁড়ে মারা হয়েছে। সেও পাল্টা ছুঁড়তে যাবে–তক্ষুণি বুঝি বাজ পড়লো ক্লাশের মধ্যে। ব্রাদার ডিক গর্জে উঠলেন–গেট আউট। অল অব ইউ গেট আউট!
সারা ক্লাশ তখন ঘোষাল স্যারের ভাষায় ‘পিন ড্রপ সাইলেন্ট’। একে একে সবাই সুড় সুড় করে উল্টো দিকের দরজা দিয়ে বেরিয়ে যেতে লাগলো। আমারই মাথায় বোধ হয় শনি ভর করে ছিলো। বুঝতে পারছিলাম না ব্রাদারের এত রাগের কারণ কি ঘটেছে। ব্রাদার আবার চিৎকার করে উঠলেন –গেট আউট অব দা ক্লাস!
আমার বিস্ময়টা বেড়েই চলেছে। ক্লাশে তাকিয়ে দেখি সবাই বেরিয়ে গেছে। আমাকেই কি তাহলে ব্রাদার যেতে বলছেন? ব্যাপারটা কী? স্যান্ডেল খুঁজে পরতে একটু দেরিই হয়ে গেলো। ঝড়ের বেগে ব্রাদার ক্লাশে ঢুকলেন। চেঁচিয়ে বললেন, ডি’ন্ট ইউ হিয়ার মি সোয়াইন?
এবার মাথা তুলে তাকালাম। বিস্ময় আর রাগ দু’টোই মিশে আমাকে মুহূর্তের জন্য ভুলিয়ে দিলো আমি যে তখনো ক্লাশেই আছি। ব্রাদারের চোখের দিকে তাকিয়ে বললাম, হাউ সিলি! হোয়াই মেক্স ইউ অ্যাঙগ্রি!
হোয়াট!
আবার যেন ক্লাশে বাজ পড়লো।
ইউ-ইউ–
রাগের মাথায় কথা হারিয়ে ফেললেন ব্রাদার ডিক। ঘাড় ধরে টেনে নিয়ে আমাকে ছুঁড়ে দিলেন হল রুমের দিকে।
ছেলেরা সবাই বিস্ময়ে হতবাক হয়ে গেছে। রাগে আমি প্রায় জ্ঞান হারিয়ে বললাম, ইডিয়ট! হাউ ডেয়ার ইউ কল মি সোয়াইন?
এবার বাজ নয়, পাঁচশো পাউন্ডের একটা বোমা যেন ফাটলো হল রুম-এর ভেতর–হোয়াট!
মনে হল পুরো বাড়িটাই বুঝি ব্রাদারের চিৎকারে থর থর করে কেঁপে উঠেছে।
ইউ কল মি ইডিয়ট? এবারে ঘাড় ধরে আর ছুঁড়ে ফেলে দিলেন না। প্রায় শূন্যের মাঝে ঝুলিয়ে নিয়ে এলেন টিচার্স রুমের ভেতর দিয়ে একেবারে হেড মাস্টারের অফিস রুমে।
ছুটি হয়ে গেলেও প্রায় টিচারই যান নি, টিচার্স রুমে বসে গল্প করছিলেন। সবাই ছুটে এলেন। গোমেজ স্যারের বিস্ময়টাই সবচেয়ে বেশি। বললেন, কী হয়েছে শাহরিয়ার?
বললাম, ব্রাদার আমাকে অপমান করেছেন।
স্যার আর কথা বাড়ালেন না। ব্রাদারের সাথে যখন গণ্ডগোল তখন কেউ আর সহানুভূতিও দেখালেন না।
ব্রাদার ডিক আমাকে বসিয়ে রেখে বললেন, স্ট্যান্ড হিয়ার, ডোন্ট মুভ!
ক্লাশের অন্যান্য ছেলেদের কাছে ব্যাপারটা ধারণার বাইরে। ক্লাশের সবচেয়ে শান্ত ছেলেটাকে এভাবে রাগতে দেখে তারাও কেউ কাছে আসতে সাহস করলো না।
আধ ঘন্টার মত কেটে গেলো। ভাবছিলাম হেড মাস্টারকে নিয়ে বুঝি ব্রাদার ডিক আসছেন। কিন্তু কারো দেখা নেই। হেড মাস্টারের রুমের সামনে দাঁড়িয়ে রাগে আমার হাড়পিত্তি জ্বলে যাচ্ছিলো। শেষে আমাদের দপ্তরি ধনাইকে দিয়ে খবর পাঠালাম, হেডমাস্টার অর্থাৎ ব্রাদার ম্যাকডোনাল্ড যেন এক্ষুণি একবার আসেন।
ব্রাদার ম্যাক এলেন। অফিস খুলে ভেতরে গিয়ে বসলেন। বললেন, কি হইয়াছে। শ্যরিয়র?
বললাম, ব্রাদার ডিক আমাকে মিছেমিছি ঘাড়ধাক্কা দিয়ে ক্লাশ থেকে বের করেছেন। আর টিচারদের সামনে আমাকে অপমান করেছেন।
ব্রাদার ম্যাক বিস্মিত হয়ে বললেন, হোয়াই? কেন?
আমি জানি না কেন। তবে ব্রাদার, আমি এর কারণ জানতে চাই, কেন ব্রাদার ডিক আমার গায়ে হাত দিলেন। কেন টিচারদের সামনে ঘাড় ধরলেন, কেন তিনি সোয়াইন বললেন? কালই আমি এর জবাব চাই।
এতগুলো কথা বলে আমি উত্তেজনায় কাঁপছিলাম। ব্রাদার ম্যাক সান্ত্বনার স্বরে বললেন, বি ইজি মাই বয়। গো হোম অ্যাণ্ড সি মি টুমরো।
ব্রাদারের অফিস থেকে বেরিয়ে এলাম। ছেলেরা সবাই একসঙ্গে প্রশ্ন করলো, কী বললেন ব্রাদার?
বললাম সব। ফারুক এবার আস্তে আস্তে বললো, ব্রাদার যদি কিছু না করেন তাহলে তুই কী করবি?
শান্ত ভাবেই ওকে বললাম তাহলে ইশকুল ছেড়ে দেবোএ কেমনতরো পাগলামি। সবাই গুঞ্জন করে উঠলো, ইশকুল কেন ছাড়বি?
এ ছাড়া অন্য কোনো পথ আমি দেখছি না।
ওরা সমস্বরে প্রতিবাদ জানালো। বললো, প্রতিবাদ তুই একা কেন করবি? আমরা সবাই একসঙ্গে করবো।
কি ভাবে? আমি অবাক হই একটু।
আমরা কাল থেকে ক্লাশ কোরবো না।
তা কী করে হয়! মনে মনে খুশি হলেও বাইরে আপত্তি জানাই, টেস্ট সামনে, আমার একার জন্যে কেন তোরা সবাই ভুগবি?
ফারুক বললো না, ডিকের সাথে একবার বোঝাঁপড়া হওয়া উচিৎ। ও কেবলই বেড়ে যাচ্ছে। ভুলে যাস কেন ও বাংলাকে কি বলেছে? ক্লাশ সিক্স-এর ছেলেটাকে ও লাথি মেরে সিঁড়ি থেকে ফেলে দিয়েছে। এর প্রতিবাদ জানানোর এমন সুযোগ আর আসবে না।
ঠিক হল কাল থেকে টেন-এর ছাত্ররা ক্লাশ করবে না।
পরদিন সবাই এলো ইশকুলে। ঘন্টাও বাজলো। কিন্তু টেন-এর ছাত্ররা মাঠে দাঁড়িয়ে রইলো।
আমাদের মিশনারি ইশকুলের কড়া ডিসিপ্লিনের ভেতর এ ধরনের নিয়মভঙ্গ স্কুল-জন্মের গত আশি বছরে কেউ কোনো দিন দেখে নি। ক্লাশ শুরু হ’লকিন্তু আমরা ক্রিকেট খেলার মাঠেই দাঁড়িয়ে রইলাম।
খবর পেয়ে ছুটে এলেন ব্রাদার ম্যাক। বললেন তোমরা কি কেউ ক্লাশে যাইবে না?
মৃদু গুঞ্জন উঠলো। সবাই বললো না।
অপমানে ব্রাদার ম্যাকের টকটকে মুখ থেকে বুঝি রক্ত ছিটকে বেরিয়ে আসবে। ঠাণ্ডা গলাতেই বললেন, শ্যরিয়র! হোয়াট অ্যাবউট ইউ?
আমি চুপ করে রইলাম। ব্রাদার ম্যাক বললেন, ইজ ইট টু শ্যরিয়র? তুমি ব্রাদারকে ইডিয়ট বলিয়াছ? ইজ ইট টু?
ওরা সবাই এক সঙ্গে বললো, মিথ্যে কথা, ও কখনো বলেনি!
ব্রাদার ম্যাকের গলা একধাপ উপরে উঠলো–ইউ বয়েজ! বি কোয়াইট! আই অ্যাম নট আস্কিং ইউ? শ্যরিয়র? (গলা নামিয়ে) ইজ ইট টু?
একবার ওদের সবার মুখের দিকে চাইলাম। মাথা নিচু করে বললাম, নো।
নো! ব্রাদার একটা ধাক্কা খেলেন যেন। পরে বিড়বিড় করে বললেন, হি শুডন্ট টেল এ লাই!
তারপর ব্রাদার আস্তে করে বললেন, ওয়েল বয়েজ। এখন তোমরা কী চাও?
ফারুক গলা তুলে বললো, ব্রাদার ডিককে ক্ষমা চাইতে হবে।
আবার এক ঝলক রক্ত উঠে এলো ব্রাদার ম্যাকের মুখে। বললেন, ক্ষমা! ইউ মিন এ্যপোলজি? হাউ ক্যান ইট বি পসি?
অন্যায়টা ব্রাদারের। ওর গায়ে তিনি হাত তুলেছেন। ক্ষমা তাঁকে চাইতেই হবে। এবার সালেহ গলায় জোর দিয়ে বললো ।
ব্রাদার ম্যাক অবাক হয়ে গেলেন ছেলেদের এ ধরনের দুঃসাহস দেখে। আপোষের। সুরে বললেন, লুক বয়েজ! তিনি তোমাদের শিক্ষক। তিনি কি করিয়া ক্ষমা চাইবেন তোমাদের নিকট?
ফারুক বললো, তিনি অন্যায় করেছেন।
মাঠ দিয়ে এমন সময় ছুটে এলেন ব্রাদার ডিক। হাতে একগাদা ডিটেন স্লিপ। আমাকে আঙুল দেখিয়ে বললেন, ইট ইজ ইউ, সোয়াইন! ইউ শুড লিভ দ্য স্কুল অ্যাটওয়ান্স!
ডিটেন স্লিপগুলো এগিয়ে দিলেন–মাস্ট সি মি আফটার স্কুল।
হাত বাড়িয়ে স্লিপগুলো নিলাম। ওদের দিকে আর একবার তাকালাম। তারপর টুকরো টুকরো করে স্লিপগুলো ছুঁড়ে ফেলে দিলাম।
ব্রাদার ম্যাক কথা বলার সময়ও পেলেন না। স্লিপগুলো ছিঁড়তেই ঠাণ্ডা কঠিন গলায় শুধু বললেন, ব্রাদার ডিক!
ওই বলটুকুই যথেষ্ট ছিলো। ব্রাদার ডিক গটগট করে চলে গেলেন মাঠের ঘাস মাড়িয়ে। এবার ম্যাক আমাদের বললেন, আমি আমার স্কুলে কোনো গণ্ডগোল হইতে দিব না। ক্লাশ না করিলে তোমরা স্কুল কম্পাউন্ডে থাকিতে পারিবে না। তোমরা ক্লাশে যাও, নচেৎ বাহিরে যাও।
পায়ে পায়ে সবাই স্কুল থেকে বেরিয়ে এলাম। এবার? সবার মুখে এক প্রশ্ন, এবার আমরা কী করবো? আমি বললাম, খবরের কাগজে গিয়ে জানিয়ে আসি। তারাই বলে দেবেন কী করতে হবে।
ওরা প্রায় সবাই বললো, তাতে লাভ হবে না, তাঁরা ক্লাশেই ফিরে যেতে বলবেন।
ফারুক পাশের কলেজের দিকে ইঙ্গিত করে বললো, চল ঐ কলেজের ছাত্রদের জানাইগে। ওখানে আমাদের স্কুলের পুরানো ছাত্র অনেকে পড়েন। তারাই যা করার করবেন।
ওর কথা সবাই মেনে নিলো। পাশের কলেজে গিয়ে ওখানকার আলী ভাইকে সব বললাম। আলী ভাই তখন সেখানকার ছাত্র নেতা। বাংলা ভাষা সম্পর্কে অমন বলেছেন শুনে তিনি ক্ষেপে গেলেন। এক গাদা ছেলেকে ডেকে বললেন, চল আমরা এক্ষণি গিয়ে দেখি।
ওরাই আগে আগে ঢুকলেন ইশকুলে। ছুটে এলেন ব্রাদার ম্যাক। এটা বোধহয় তার ধারণার বাইরে ছিলো। বললেন, হোয়া রং? হু আর ইউ? হোয়াই ইউ আর হিয়ার?
প্রথমেই ব্রাদার যে জবাবটা পেলেন, সেটা আলী ভাইয়ের গলায় বাংলায় কথা বলুন।
ব্রাদার একটু থমকে গেলেন। একটু হেসে বললেন, ও-কে। আমি ভালো বাংলা জানি না। তোমরা এইখানে কেন আসিয়াছ?
আলী ভাই আমাকে দেখিয়ে বললেন, এই ছেলেকে ব্রাদার ডিক অপমান করেছেন। তিনি বাংলা ভাষাকে গালি দিয়েছেন। এর কারণ জানতে চাই।
ব্রাদার ম্যাক একবার আমার দিকে চাইলেন। মাথা নিচু করে রইলাম। ব্রাদার বললেন, এখন তোমরা কী চাও?
আলী ভাই বললেন সেই একই কথা–সে জন্যে তাঁকে মাপ চাইতে হবে।
ইতিমধ্যে আমাদের টিচাররা দেখি সবাই বাইরে এসে দাঁড়িয়েছেন। উপরে তাকিয়ে দেখি দোতালার ছাদে ব্রাদার ডিক।
গোমেজ স্যার আমাকে ডেকে বারবার অসহিষ্ণু গলায় বললেন, এ কী করে হয় শাহরিয়ার? তোমাকে আমরা অনেক ভালো বলেই জানি। তুমি এ কী করছো? ব্রাদার কী করে তোমার কাছে ক্ষমা চাইবেন? এ কেমন করে হয়?
চাইতেই হবে! আলী ভাই আমার কানের কাছে গর্জে উঠলেন–তার উচিৎ প্রত্যেকটা বাঙালীর কাছে গিয়ে মাপ চাওয়া। তার কোনো অধিকার নেই, আমাদের ভাষাকে অপমান করার।
সবার গলাতেই প্রতিধ্বনিত হ’ল আলী ভাইয়ের কথাগুলো। সবাই উত্তেজিত হয়ে উঠেছে। খারাপ লাগছে আমার। রাগে অপমানে লাল হয়ে দাঁড়িয়ে আছেন ব্রাদার ম্যাক। গোমেজ স্যার ব্যাকুল হয়ে তাকিয়ে আছেন আমার দিকে। মনে হলো একবার বলি, আলী ভাই আপনারা ফিরে যান। আমি তাকে ক্ষমা করেছি। তাছাড়া আমিতো ব্রাদার ডিককে ইডিয়ট বলেছিলাম। তার জন্যে ব্রাদার ম্যাকের কষ্ট আমি সহ্য করতে পারছি না। পরে ভাবলাম, এখন একথা বললে সবার হাসির পাত্র হবো।
ওরা সবাই গরম হতে লাগলো। আলী ভাই বললেন, কই, তিনি কই? তাঁকে ডেকে আনুন।
ব্রাদার ধনাইকে ইশারা করলেন। বুড়ো ধনাই ছুটলো ব্রাদার ডিককে ডাকতে। ব্রাদার ম্যাক বললেন, শ্যরিয়র! তুমি ব্রাদারকে ইডিয়ট বল নাই?
ছেলেরা সবাই একসঙ্গে বলে উঠলো, না।
ব্রাদার বললেন, ব্রাদাররা কখনো মিথ্যে বলেন না।
আমি চুপ করে রইলাম। ভিড়ের ভেতরে থেকে কলেজের ছাত্রদের একজন বললো, আহা আমার যুধিষ্ঠির রে!
ব্রাদার ম্যাকের মুখ আর একপশলা লাল হলো। ব্রাদার ডিক এলেন। আর এলেন ব্রাদার পল। কোথাও গিয়েছিলেন বোধহয় ব্রাদার পল। কাছে এসে কাঁধে হাত রাখলেন। আমার দিকে একবার চাইলেন। তাঁর সাগর নীল চোখ দুটোয় কোনো রাগ নেই, কোনো তিরস্কার নেই। শুধু সামান্য অভিযোগ–আমি তোমার কাছে ইহা আশা করি নাই শ্যরিয়র।
ইচ্ছা হল মাটিতে মিশে যাই। ব্রাদার পলও একথা বললেন! চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইলাম। ব্রাদার পল আবার বললেন, ব্রাদার ডিকের ক্ষমা চাইবার আগে তোমার ক্ষমা করা উচিত সিল শ্যরিয়র।
এবার আমি আস্তে করে বললাম, আমার আর কোনো অভিযোগ নেই ব্রাদার পল।
ব্রাদার পল আরো আস্তে বললেন, ইহাদের কেন আনিয়াছ?
আলী ভাই ব্রাদার ডিককে বললেন, আপনি কেন বাংলা ভাষাকে চামারের ভাষা বললেন? কেন এ ছেলেকে অপমান করে কথা বলেছেন। এর কারণ জানতে চাই।
লাল হয়ে গেলেন ব্রাদার ডিক। বললেন, আই ডিডিন্ট সে সো।
আবার আলী ভাই গর্জে উঠলেন, চুপ, বাংলায় বলুন। আপনি বলেছেন। আর সে জন্যে আপনাকে ক্ষমা চাইতে হবে!
নো! আই ডোন্ট–
শাট, আপ! ব্রাদার ডিককে বাধা দিয়ে চিৎকার করে উঠলেন আলী ভাই ক্ষমা না চাইলে আপনি ধারণাও করতে পারবেন না আপনার কি হবে!
ব্রাদার পল শান্ত স্বরে বললেন, বি ইজি মাই চাইল্ড। অপমান বলিতে তোমরা কী বুঝিয়াছ? অপমান কোনো দিন উপর হইতে আসে না, তোমাদের পিতা তোমাদের অপমান করিতে পারে না। তোমরা তোমাদের পিতাকে অপমান করিতে পারো। ব্রাদার ডিক তোমাদের পিতৃস্থানীয়। তাঁহাকে তোমরা অপমান করিও না।
আপনি কে? বাধা দিয়ে আলী ভাই বললেন–ও সব আমরা শুনতে চাই না। ওসব কথা ক্লাসে বলবেন। এখন একে ক্ষমা চাইতেই হবে।
ব্রাদার পল একটু থেমে বললেন, আমিও তোমাদের পিতার মতো। ওয়েল বয়েজ! তোমাদের ইচ্ছাই পূর্ণ হউক। ব্রাদার ডিক!
ব্রাদার ডিক তাকালেন। ব্রাদার পল বললেন ব্রাদার ডিক। ইউ শুড-।
ব্রাদার ডিক চুপ করে দাঁড়িয়ে রইলেন। ব্রাদার পল এবার একটু কঠিন গলায় বললেন, ব্রাদার ডিক!
ব্রাদার.ডিক রাগ চেপে আলী ভাইকে বললেন, আমি কী বলিব?
আলী ভাই বললেন, বলুন, আমি যা বলেছি তার জন্যে আমি লজ্জিত, তুমি আমাকে ক্ষমা কর।
থেমে থেমে ভাঙা বাংলায় ব্রাদার ডিক বললেন, আমি যদি তোমাকে অপমান করিয়া থাকি তবে সে জন্য আমি লজ্জিত।
আলী ভাই শক্ত গলায় বললেন, ও ভাবে নয়। যদি কোনো কথা নয়, আপনি সোজা ক্ষমা চান!
গোমেজ স্যার অসহিষ্ণু গলায় বললেন, শাহরিয়ার কিছু বল? তুমি চুপ করে আছো কেন?
ব্রাদার ডিক তাকালেন আমার দিকে। সাপের মত ঠাণ্ডা চাহুনি। বললেন, আমাকে ক্ষমা কর।
আলী ভাই বললেন, ঠিক আছে। আপনি যান। আর হেড মাস্টার স্যার, এ নিয়ে যদি কোনো শাস্তি এই ছেলেকে দেয়া হয় তাহলে এর ফল ভালো হবে না।
আলী ভাইরা চলে গেলেন। ব্রাদার ম্যাক বললেন তোমরা আজ বাড়ি যাও। কাল হইতে ক্লাশে আসিবে।
ওরা চলে গেল। ব্রাদার পল বললেন, শ্যরিয়র, আমার সঙ্গে আস। উপরে নিয়ে গেলেন আমাকে ব্রাদার পল। একেবারে তার ঘরে। বললেন বস।
বসলাম। অনেকক্ষণ পর বললেন, ব্রাদার ডিককে তোমার জন্য স্কুল ছাড়িয়া যাইতে হইবে।
ঢোক গিলে কোনো রকমে বললাম, কেন?
ব্রাদার পল বললেন, তোমার কথা যদি সইত্য হয়, তাহা হইলে ব্রাদার ডিক মিথ্যা কথা বলিয়াছেন।
জবাব দিলাম না, মাথা নিচু করে বসে রইলাম। কিছুক্ষণ চুপ থেকে ব্রাদার পল বললেন, ব্রাদাররা মিথ্যা বলেন না।
গির্জার ঘড়িতে বারোটার ঘন্টা বাজলো। ব্রাদার কিছুক্ষণ নিরব থেকে ঘন্টাগুলো গুনলেন। বললেন, তুমি অন্যায়কে সইয্য কর নাই। এই জিনিসটা আমি সারা জীবন তোমার মইধ্যে যেন দেখি।
ব্রাদার আবার কিছুক্ষণ চুপ করে রইলেন। শেষে আস্তে আস্তে বললেন, তুমি মনে রাখিও বাংলার অপমান তুমি আইজ সইয্য করিতে পার নাই। ভবিষ্যতে কোনোদিন যেন তোমার সামনে বাংলাকে কেহ অপমান করিতে না পারে। বাড়ি যাও। মে গড ব্রেস ইউ! এই বলে ব্রাদার পল বুকে ক্রুস আঁকলেন।
ইশকুলে গেটের বাইরে ছেলেরা তখন যুদ্ধ জয়ের আনন্দে মেতে আছে। আমি দোতালার জানালা দিয়ে একবার দেখলাম। মনে হলো এ জয় আমার নয়। নিচে নামতে ওরা সবাই আমাকে লুফে নিলো। বললো, আমাদের হিরো।
আমি হাসতে চাইলাম। পারলাম না। আমার দুটো চোখ তখন কান্নায় ভরে গেছ।

[লেখক পরিচিতি : শাহরিয়ার কবির (Shahriar Kabir) বাংলাদেশের একজন খ্যাতনামা লেখক, সাংবাদিক, ডকুমেন্টারি চলচ্চিত্র নির্মাতা। ১৯৫০ খ্রিস্টাব্দের ২০ নভেম্বর তিনি ফেনীতে জন্মগ্রহণ করেন। লেখক হিসেবে তাঁর প্রধান পরিচয় তিনি একজন শিশুসাহিত্যিক। তিনি ভারতে প্রশিক্ষণের পর ২ নম্বর সেক্টরে যুদ্ধা করেন অল্প কিছু দিন। তারপর শহীদ বুদ্ধিজীবী ও বিশিষ্ট চলচ্চিত্রকার জহির রায়হান বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে ১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দে ২০ মিনিট দৈর্ঘ্যের স্টপ জেনোসাইড (গণহত্যা বন্ধ কর) ছবিতে কাজ করার জন্য ভারতে শাহরিয়ার কবির ডেকে নিয়ে যায়। বলা দরকার জহির রায়হান ও শাহরিয়ার কবির চাচাতো ভাই ]

একাত্তরের যীশু বইয়ের একটি গল্প।
সর্বশেষ এডিট : ১৪ ই অক্টোবর, ২০২২ সকাল ১০:৫২
১টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

স্বাধীনতা দিবসের অনুষ্ঠানে মুক্তিযোদ্ধাদের মুমিনী চেহারা ও পোশাক দেখে শান্তি পেলাম

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ২৭ শে মার্চ, ২০২৪ রাত ৯:৫৮



স্বাধীনতা দিবসের অনুষ্ঠানে স্টেজে উঠেছেন বত্রিশ মুক্তিযোদ্ধা তাঁদের চব্বিশ জনের দাঁড়ি, টুপি ও পাজামা-পাঞ্জাবী ছিলো। এমন দৃশ্য দেখে আত্মায় খুব শান্তি পেলাম। মনে হলো আমাদের মুক্তিযোদ্ধা আমাদের মুমিনদের... ...বাকিটুকু পড়ুন

দু'টো মানচিত্র এঁকে, দু'টো দেশের মাঝে বিঁধে আছে অনুভূতিগুলোর ব্যবচ্ছেদ

লিখেছেন মোহাম্মদ গোফরান, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ রাত ১২:৩৪


মিস ইউনিভার্স একটি আন্তর্জাতিক সুন্দরী প্রতিযোগিতার নাম। এই প্রতিযোগিতায় বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সুন্দরীরা অংশগ্রহণ করলেও কখনোই সৌদি কোন নারী অংশ গ্রহন করেন নি। তবে এবার রেকর্ড ভঙ্গ করলেন সৌদি... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমাদের দুই টাকার জ্ঞানী বনাম তিনশো মিলিয়নের জ্ঞানী!

লিখেছেন সাহাদাত উদরাজী, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ রাত ২:৫৯

বিশ্বের নামীদামী অমুসলিমদের মুসলিম হয়ে যাওয়াটা আমার কাছে তেমন কোন বিষয় মনে হত না বা বলা চলে এদের নিয়ে আমার কোন আগ্রহ ছিল না। কিন্তু আজ অষ্ট্রেলিয়ার বিখ্যাত ডিজাইনার মিঃ... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমি হাসান মাহবুবের তাতিন নই।

লিখেছেন ৎৎৎঘূৎৎ, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ দুপুর ১:৩৩



ছোটবেলা পদার্থবিজ্ঞান বইয়ের ভেতরে করে রাত জেগে তিন গোয়েন্দা পড়তাম। মামনি ভাবতেন ছেলেটা আড়াইটা পর্যন্ত পড়ছে ইদানীং। এতো দিনে পড়ায় মনযোগ এসেছে তাহলে। যেদিন আমি তার থেকে টাকা নিয়ে একটা... ...বাকিটুকু পড়ুন

মুক্তিযোদ্ধাদের বিবিধ গ্রুপে বিভক্ত করার বেকুবী প্রয়াস ( মুমিন, কমিন, জমিন )

লিখেছেন সোনাগাজী, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ বিকাল ৫:৩০



যাঁরা মুক্তিযদ্ধ করেননি, মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে লেখা তাঁদের পক্ষে মোটামুটি অসম্ভব কাজ। ১৯৭১ সালের মার্চে, কৃষকের যেই ছেলেটি কলেজ, ইউনিভার্সিতে পড়ছিলো, কিংবা চাষ নিয়ে ব্যস্ত ছিলো, সেই ছেলেটি... ...বাকিটুকু পড়ুন

×