এক দিনের আন্তর্জাতিক ম্যাচে একটি ঘটনাই বদলে দিতে পারে পুরো ম্যাচের দৃশ্যপট। আম্পেয়ারিং এর ভুল সিদ্ধান্তের কারনে সেটি ঘটলে যেকোন দেশর কাছেই সেটা দুঃখজনক আর সমালোচনার বিষয় হয়ে উঠবে সেটাই স্বাভাবিক। বিশ্ব লড়াইয়ের শ্রেষ্ঠ আসর বিশ্বকাপে তেমন ঘটনা ঘটলে মেনে নেয়া যায় না কোন ভাবেই। তেমনি একটি ঘটনার জন্ম দিল ২০১৫ সালের এবারের আসর তাও আবার আমাদের বাংলাদেশের বিরুদ্ধেই। গুরুত্বপুর্ন একটি ম্যাচ ছিল এটি। প্রথমবারের মত চমক সৃষ্টি করা বাংলাদেশ যখন কোর্য়াটার ফাইনালে খেলতে নামলো বর্তমান ক্রিকেটবিশ্ব শাষন করা ভারতের বিরুদ্ধে।
১৯ মার্চ ২০১৫ অস্ট্রেলিয়ার মেলবোর্ন ক্রিকেট গ্রাউন্ডে বিশ্বকাপের কোয়ার্টার-ফাইনালে ভারতের কাছে ১০৯ রানে হারে বাংলাদেশ। টস জিতে ব্যাট করতে নামা ভারতের ইনিংসের ৪০তম ওভারে বিতর্কিত নো বলের সিদ্ধান্ত দেন আম্পায়ার আলিম দার ও ইয়ান গৌল্ড। ওভারের চতুর্থ বলটি ফুলটস দিয়েছিলেন রুবেল হোসেন। বলটিতে বাউন্ডারি মারতে গিয়ে ডিপ মিড উইকেটে ইমরুল কায়েসের কাছে ক্যাচ দেন ভারতের রোহিত শর্মা। তবে বলটি কোমরের ওপরে ছিল দাবি করে লেগ আম্পায়ার পাকিস্তানের দার বোলিং প্রান্তে থাকা ইংল্যান্ডের আম্পায়ার গৌল্ডকে 'নো' বলের সঙ্কেত দেন। গৌল্ড তখন 'নো' ডাকলে বিস্ময়ে হতবাক হয়ে যান বাংলাদেশের ক্রিকেটাররা।
টিভি রিপ্লে দেখে মনে হয়েছে, বলটি কোমরের ওপরে ছিল না। তখন ধারাভাষ্য দিতে থাকা শেন ওয়ার্নও বিষয়টি নিয়ে বিস্ময় প্রকাশ করেন। ধারাভাষ্যকারা তখনই এটিকে ভুল সিদ্ধান্ত বলে উল্লেখ করেন। Espncricinfo ক্রিকেট পণ্ডিত ওয়েস্ট ইন্ডিজের কিংবদন্তি ক্রিকেটার হোল্ডিং তার বিশ্লেষণে সিদ্ধান্তটিকে বেশ কয়েকবার ভুল উল্লেখ করে বলেন, "মাঠের আম্পায়ারদের সিদ্ধান্তের জন্য তৃতীয় আম্পায়ারের কাছে যাওয়া উচিৎ ছিল।" নিউ জিল্যান্ডের কিংবদন্তি ক্রিকেটার মার্টিন ক্রোও হোল্ডিংয়ের সঙ্গে সুর মেলান। ভারতের সাবেক অধিনায়ক সৌরভ গাঙ্গুলী, সাবেক ব্যাটসম্যান ভিভিএস লক্ষণসহ প্রখ্যাত সাংবাদিক সম্বিত বলও এটিকে ভুল সিদ্ধান্ত বলে উল্লেখ করেন। আম্পায়ারদের এই সিদ্ধান্ত নিয়ে আরো অনেক ক্রিকেট পণ্ডিতরা সমালোচনা করেন। রুবেল হোসেনের করা বলটি কোনোভাবেই 'নো' ছিল না বলে মনে করেন ক্রিকেট বোদ্ধারা। আম্পায়ার আলিম দার ও ইয়ান গৌল্ড বলটিতে ভারতের রোহিত শর্মাকে আউট না দিয়ে ভুল সিদ্ধান্ত দিয়েছেন বলে উল্লেখ করেন সাবেক ক্রিকেট তারকরা। ক্ষোভে ফেটে পড়ে বাংলাদেশের ক্রিকেট সমর্থকরা।
বাংলাদেশ-ভারত ম্যাচের আম্পায়ারিং নিয়ে ক্ষোভের আগুন বাংলাদেশের সবার মনে। সে আগুনের আঁচ আইসিসির সভাপতি এবং বাংলাদেশের সংসদ সদস্য আ হ ম মোস্তফা কামালের মনে, তিনিও আম্পায়ারদের পক্ষপাতমূলক আচরণকেই দায়ী করেন। তিনি বলেন, 'আমি যা দেখেছি, তাতে আম্পায়ারিং ছিল খুব দুর্বল। আম্পায়ারিংয়ের কোনো মান ছিল না। মনে হচ্ছিল যে, তারা আগে থেকে ঠিকঠাক করে মাঠে নেমেছিল। একজন দর্শক হিসেবে এটি আমি বলতে পারি, আইসিসি প্রেসিডেন্ট হিসেবে না'। ব্যাপারটি তদন্ত করে দেখা হবে বলেও জানিয়েছেন তিনি, আম্পায়াররা ভুল করতেই পারেন। এখন আইসিসি বোর্ডে যাঁরা আছেন, তাঁরা দেখবেন আম্পায়াররা ইচ্ছাকৃতভাবে কিছু করেছেন কি না। ভারত-অস্ট্রেলিয়ার সাবেক ক্রিকেটাররাও তো আম্পায়ারিংয়ের বিপক্ষে বলছেন। এখন আইসিসির দায়িত্ব বিষয়টি তদন্ত করে বের করা এখানে গোলমেলে কিছু রয়েছে কি না।'
'নো বল' এর অজুহাতে রহিত শর্মার আউট হওয়া থেকে বেঁচে যাওয়া এবং মাহমুদ উল্লাহর ক্যাচ ধরার সময় ফিল্ডারের বাউন্ডারি সীমা স্পর্শ সত্ত্বেও আম্পায়ারের আউটের আঙুল উঁচানো- বাংলাদেশের মুল ক্ষোভের কারণ। সমর্থকদের সঙ্গে একাত্ম আইসিসি সভাপতি, 'দেশের সমর্থকদের যেমন মন খারাপ, আমারও মন খারাপ। আমি তাদের সঙ্গে একমত। খেলায় হারজিত আছেই। আমরা সৎভাবে খেলে সৎ চেষ্টায় যতটুকু করতে পারি করব। কিন্তু এখন যদি জোর করে কোনো ফল চাপিয়ে দেওয়া হয়, সেটি কেউ মেনে নিতে পারে না।' আম্পায়াররা বাংলাদেশকে হারাতে প্রস্তুতি নিয়ে নেমেছিল উল্লেখ করে কামাল আইসিসিকে ইন্ডিয়ান ক্রিকেট কাউন্সিল বলে অ্যাখ্যা দেন। প্রয়োজনে আইসিসির সভাপতির পদ থেকে পদত্যাগ করার কথাও বলেন তিনি।
তদন্তের আবেদন করবে বিসিবি বোর্ড সভাপতি নাজমুল হাসান স্পষ্ট করে বলেছেন তা, 'আবেদন তো হবেই। তবে দুর্ভাগ্যজনক হচ্ছে, তাতে করে তো খেলার ফল বদলাবে না। আইসিসি প্রেসিডেন্টের সঙ্গে আমার কথা হয়েছে। আইনগতভাবে যা যা করা সম্ভব, আমরা করব।' বাংলাদেশ অন্যায়ের শিকার হয়েছে বলেও দাবি তাঁর, 'একে তো বিশ্বকাপ, তার ওপর কোয়ার্টার ফাইনাল- এমন গুরুত্বপূর্ণ ম্যাচে একটি ভুল সিদ্ধান্ত বিরাট পার্থক্য গড়ে দিতে পারে। সেখানে একাধিক সিদ্ধান্ত আমাদের বিপক্ষে গিয়েছে। আর সেটি সারা পৃথিবী দেখেছে।'
আইসিসির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ডেভিড রিচার্ডসন একটি বিবৃতির মাধ্যমে প্রতিক্রিয়া জানান যে "'নো' বলের সিদ্ধান্তটি পঞ্চাশ-পঞ্চাশ ছিল। খেলাটির 'স্পিরিট' বলে, আম্পায়ারের সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত এবং এটাকে অবশ্যই সমীহ করতে হবে।"
শেষ পর্যন্ত কোয়ার্টার ফাইনালটা খারাপ দিন যাওয়ার দুঃখ বিসিবি সভাপতির কণ্ঠে, 'একটা দিন তো খারাপ যায়ই। দুর্ভাগ্যজনকভাবে আজকের দিনই খারাপ গেল বাংলাদেশের ক্রিকেটের জন্য।'