বইয়ের প্রতি মারাত্মক রকমের ভালবাসা আমার সেই ছোটবেলা থেকেই। ছোটবেলা বলতে স্কুল বয়স না, জন্ম নেওয়ার পর থেকেই। আম্মার কাছে শুনেছি ছোটবেলায় যখন কান্নাকাটি করতাম তখন আমার হাতে বই ধরিয়ে দিলেই নাকি কান্না থেমে যেত। অন্য বাচ্চাদের যখন বল, ললিপপ কিংবা খেলনা দিয়ে ঠান্ডা করতে হত তখন আমি নাকি বই পেলেই শান্ত হয়ে যেতাম। মনের আনন্দে সেইগুলোকে ছিঁড়তাম আর হাসতাম। আমাকে ঠান্ডা রাখার এত সহজ তরিকা পেয়ে আম্মু বেজায় খুশি ছিলেন। সবাই পত্রিকা জমে গেলে বিক্রি করত আর আমার মা সেগুলো কিনে রাখতেন যেন আমি ছিঁড়তে পারি।
আরেকটু বড় হবার পর কাগজ ছিঁড়ার মাত্রা কমে আসল। যেহেতু নিউজপ্রিন্ট কাগজ তরল পদার্থ শোষণ করতে পারে তাই আম্মা আমার দ্বারা ফ্লোর ভিজানো প্রতিরোধে কাগজের ব্যবহার বাড়িয়ে দিয়েছিলেন। তখন নাকি বই বা পত্রিকা পেলেই ড্যাব ড্যাব করে তাকিয়ে থাকতাম। কি দেখতাম তা অবশ্য আম্মা মনে করতে পারেন নি তবে আমি নিশ্চিত সেটা বাংলা সিনেমার মুখরোচক কাহিনি বা নায়িকাদের ছবি না হয়েই যায় না। হাজার হলেও human psychology নিয়ে ফ্রয়েড তো আর ফালতু প্যাচাল পারেন নি।
বই এর প্রতি এই মারাত্মক রকমের ভালবাসা দেখে আমার বাবা-মা যারপরনাই খুশি ছিলেন। বাবা মা কে বলতেন “বই এর প্রতি যে আগ্রহ তাতে আমি নিশ্চিত আমার ছেলে বড় হয়ে ভার্সিটির টিচার হবে”। আর মা বাবা কে বলতেন “ডাক্তার হতে হলে তো অনেক পড়তে হয়। দ্যাখো আমার ছেলে বড় হয়ে নিশ্চিত ডাক্তার হবে। তা হতে না পারলে ইঞ্জিনিয়ার তো হবেই।“ বড়ই আফসোসের কথা আমি কোনটাই হতে পারি নি। কপালের ফেরে আমি আজ একজন ফার্মাসিস্ট।
প্রাইমারি স্কুলে যখন পড়তাম তখন কমিকস খুব পছন্দ করতাম। কিন্তু মফস্বল শহরে কমিকস এর বই পাওয়া আর চাঁদ মামাকে বালিশের নিচে পাওয়া ছিল একই ঘটনা। একটাই অবলম্বন ছিল স্কুলের পাশের সরকারি লাইব্রেরী। কিন্তু সেখানে প্রাইমারি স্কুলের ছাত্রদের প্রবেশাধিকার সংরক্ষিত ছিল শুধু ডিসি কিংবা এসপির ছেলেদের জন্য। লুকিয়ে লুকিয়ে কমিকস পড়তে গিয়ে বহুবার ধরা পড়েছি কিন্তু পরাজয়ে ডরে না বীর এই মন্ত্রে যে না জেনেই দীক্ষিত হয়েছিলাম তা তখন বুঝিনি। তাই বারেবারেই সেখানে গিয়েছি। অবশ্য লাইব্রেরিয়ানের পিচ্চি মেয়েটার সাথে বন্ধুত্ব করার ঝুঁকি নিতে হয়েছিল। বই এর প্রতি প্রগার ভালবাসাই আমাকে সেই ঝুঁকি নিতে সাহস যুগিয়েছিল।
বই এর প্রতি আমার ভালবাসা যে কতটা তীব্র তা বুঝেছিলাম হাই স্কুলে উঠে। টেস্ট পরীক্ষার আগে প্রতি রাতে আম্মা দুধ নিয়ে এসে দেখতেন তার ছেলে মনোযোগ দিয়ে অবজেক্টিভ গাইড পড়ছে। কিন্তু তিনি জানতেন না যে সেই গাইডের ভিতর তিন গোয়েন্দা বা মাসুদ রানার বই শোভা পাচ্ছে। আমি ভাবতাম তিনি জানতেন না কিন্তু মায়েরা বরাবরই ছেলেদের চেয়ে এগিয়ে থাকেন। তাই কয়েকবারই হাতেনাতে ধরা খেয়েছি। অশ্রুসিক্ত নয়নে দেখেছি কিভাবে আমার চোখের সামনে বইগুলো জ্বলে পুড়ে ছারখার হয়ে যাচ্ছে। আমার হৃদয়টাও পুড়ছিল কিন্তু প্রকাশ করতে পারছিলাম না এই যা।
হাতে নাতে ধরা ক্লাসরুমেও খেয়েছি। স্যার যখন বইগুলো বাজেয়াপ্ত করলেন তখন কত ঘুরলাম স্যারের পেছনে। অবশেষে স্যারের মন গলেছিল। সেই জন্য অবশ্য আমাকে স্যারের দুইটা শর্ত মানতে হয়েছিল।
১. নিয়মিত স্যারকে বই সাপ্লাই দিতে হবে।
২. ক্লাসে পড়তে পারব কিন্তু অন্য স্যার সেটা দেখতে পারবেন না।
কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে কত নির্ঘুম রাত কাটিয়েছি বই পড়তে গিয়ে। আবার ভেবে বসবেন না যে রাত জেগে পড়াশুনা করেছি। রাত বারোটার পর আমি কখনোই পড়ার বই পড়িনি। পরিক্ষার সময় ও না। কিন্তু গল্পের বই এর প্রতি ভালোবাসা আমাকে ঘুমাতে দেয় নি বহুরাত। এক মেয়ে পছন্দ করত আমাকে। ডিজুস এর ফ্রি যামানায় সে কতই না ফোন দিত। কিন্তু সম্পর্ক টা হতে হতেও হয় নি। কারন রাত জেগে কথা বলার চেয়ে বই পড়তেই বেশি ভাল লাগত। কিছুদিন পরে দেখি আমার বন্ধুর সাথে সেই মেয়ে চুটিয়ে প্রেম করছে। দীর্ঘশ্বাস ফেলা ছাড়া তখন আমি আর কি ই বা করতে পারি। বই এর ভালবাসার কারন জীবনে রমনীর ভালবাসা পেলাম না।
এখন চাকরি করছি। বেসরকারি চাকরিতে বই পড়ার সময় বের করা খুবই কঠিন, এক কথায় অসম্ভব। তার পরেও সময় বের করে পড়তে চেষ্টা করি। এক্ষেত্রে ই-বুক দারুন উপকার করছে। কিন্তু বিছানায় আধশোয়া হয়ে মলাট ভাজ করে বই পড়ার আনন্দের সাথে কি কিছুর তুলনা চলে? নীলক্ষেত এর বই বাজারের অলি-গলিতে হেঁটে হেঁটে পুরাতন কিন্তু দুষ্প্রাপ্য বই খোঁজা এবং সেটা পাওয়ার ভাললাগার অনুভূতি থেকে কতদিন ই না দূরে আছি। এতকিছুর পরেও বই ভালবাসি। আমৃত্যু ভালবেসে যেতে চাই। ভাষার মাসে এটাই আমার মনস্কামনা।