১.
- অঝোর বৃষ্টি…বৃষ্টির চাদর আলাদা করে ফেলেছে আমাদেরকে। সমস্ত পৃথিবী থেকে আলাদা। পাশাপাশি সাদা চাদরের নীচে দুজন মানুষ। কোন কথা নেই...শুধু শরীর কথা বলছে...আর শরীরের কথা শেষ হলেও নিঃশব্দে কথা বুনছে হৃদয়। আমরা সমস্ত পৃথিবী থেকে পালিয়েছি।
- হুম..
- আমি সব মনে রাখতে চাই...তোমার বুকের গন্ধ...তোমার স্পর্শ...তোমার শরীরের স্বাদ...তোমার হৃৎপিণ্ডের ধুকপুক শব্দ...কানের পাশে তোমার অর্থহীন কথা...আর ভালোবাসার কষ্ট।
- আর...
- একসময় আমি কাঁচের পাশে গিয়ে দাঁড়ালাম, বৃষ্টি দেখার জন্য, সাদা চাদরে জড়ানো। হঠাৎ আমার চুল সরিয়ে পিঠে তোমার চুমু...চমকে গেছি...কিন্তু আসলেই কি মনে মনে ঠিক তাই চাইছিলাম না!!!
- তারপরে?
- রাগ করে তাকানোর চেষ্টা করতেই আমার ক্রিপ্টোনাইট...তোমার মাতাল চোখ আজ পাগল হয়ে গেছে। ওই চোখের কাছে কে না হারতে চায়...কে না হারাতে চায়!!! সাদা চাদর মেঝেতে...আর সারাদিন এই অঝোর বৃষ্টি যা বার বার মুছে দিচ্ছে...আমরা সেটা আবারো লিখলাম...আমাদের নিষিদ্ধ গল্প।
কাঁচের ওপাশে বৃষ্টির রুপালী পর্দা; হঠাৎ বিদ্যুৎ চমক। প্রচন্ড শব্দের সাথে আলো আঁধারীতে ঝলসে উঠলো চকচকে ইস্পাতের ফলা। মাতাল চোখ দুটো কি ঠান্ডা, আর শীতল; বাইরে শার্সিতে চেপে থাকা ঠান্ডায় নীল নীল বৃষ্টি ভেজা একটা মুখ।
শীলা নিঃশ্বাস নিতে পারছে না; ঘুম ভেঙ্গে উঠে বসল। গলা শুকিয়ে কাঠ; বুকের ধুকপুকানি থামছে না। অনেকদিন পরে ও আবারো সেই স্বপ্নটা দেখলো। গত সাতমাস ওই স্বপ্নটা ঘুমে হানা দেয়নি।
২.
“নীল পর্দা...নীল পর্দাআআআ...এই যে নীল পর্দা...আপনাকে বলছি?” চমকে গিয়েছিলো শীলা। সিভিল বিল্ডিংয়ের সামনে পেছন থেকে ডাক শুনে শীলা বুঝতেই পারেনি যে ওকে ডাকা হচ্ছে। ছেলেটা খুব কাছে এসে আবার ডাকাতে ও ঘুরে দাঁড়িয়েছিলো “আমাকে বলছেন?”
- হুউউ...আপনিই তো নীল পর্দা…কেমন আছেন?
- আপনাকে ঠিক মনে করতে পারছি না...
- আরে সপ্তাহ দুয়েক আগে আপনার সাথে পলাশীর মোড়ে রিক্সা খোঁজার সময় কথা হলো না...
- কি কথা হয়েছিলো বলেন তো?
- আরে ওই যে রিক্সার পর্দা নীল না দেখে আপনি উঠলেন না...মনে নেই?
শীলা রিক্সার জন্য পলাশীর মোড়ে দাঁড়িয়ে। শিশিরের মতো নিঃশব্দে বৃষ্টি নেমেছিলো। রঞ্জু দাঁড়িয়েছিলো এসে ওর পাশে; মাথার ওপরে বিশাল এক ছাতা। সামান্য ঝিরঝিরে বৃষ্টিতে এমন ছাতা; এতো মশা মারতে কামান দাগা। একটা রিক্সা থামতেই রঞ্জু বলেছিলো “আপনি চলে যান।” শীলা রিক্সাওয়ালাকে বলেছিলো “এই শোনেন আপনার পর্দা কি রঙের?” “ফুলআলা আফা...রংচঙ্গা” “ওহ্...তাহলেতো হলো নাহ!!” শীলার ঠোঁটে চাপা হাসি; স্বরে একটু ব্যঙ্গ “আপনি যান…বলা যায় না জোরে নামলে বৃষ্টি দেবী আপনার এই বিশাল বর্ম ভেদ করে ফেলবে!!!” “কি হলো না বলুনতো?” রঞ্জুকে খুব অবাক করে দিয়ে শীলা বলেছিলো “নীল পর্দা না হলে আমি বৃষ্টির সময় রিকসায় চড়ি না।“
- ওহহহ্...মনে পড়েছে...আপনিও বুয়েটে? কোন ডিপার্টমেন্ট?
- আমি রঞ্জন...ইইই...লেভেল টু-টার্ম টু। আপনি?
- শীলা...আমিও লেভেল টু-টার্ম টু, তবে সিভিলে। তুমি করে বলো। অবশ্য তুইও বলতে পারো...আচ্ছা থাক আগে বন্ধুত্ব হোক তার পরে দেখা যাবে। তোমাকে আগে দেখিনি কেন বলতো? ওহহহ...তুমি তো অন্য ডিপার্টমেন্টে তাই। নাহলে তোমাকে খেয়াল করতাম নিশ্চয়ই। আমার না লম্বা ছেলেদের বেশ ভালো লাগে কিন্তু সিভিলে কি যে সব বাটু বাটু ছেলে।
শীলা বাম দিকে ঘাড় কাত করে বেশ মন দিয়ে রঞ্জুকে আপাদমস্তক দেখে বললো “এই শোনো তুমি না অনেকটা অক্ষয় কুমারের মতো দেখতে। তবে অতোটা হ্যান্ডসাম নও। আচ্ছা তুমি কি হলে থাকো? কোন হলে বলতো? আমাদের সিভিলে কি তোমার কোন বন্ধু আছে? আমি এ সেকশনে। এ সেকশনে তোমার কোন বন্ধু আছে?”
রঞ্জন মুগ্ধ হয়ে শীলার এক নিঃশ্বাসে কথা বলা শুনছিলো। মাত্র পরিচিত কারো সাথে এতো অবলীলায় কেউ এতো কিছু বলতে পারে? ঠিক যেন একটা পাহাড়ী ঝর্ণা; কলকল ছলছল করে বন্ধনহীন কথার বন্যা। কথা বলার সময় শীলার চোখ উৎসাহে ঝলমলিয়ে উঠছে...দেখতে যে কি ভালো লাগছে!!!
৩.
“এই শোন একটা কথা ছিলো...” রঞ্জন ইতস্তত করছে। ওর ভাব দেখে রাকিব বললো “কি রে তোর ভাবসাব তো ভালো ঠেকতেছে না...ঘটনা কি?”
- আরে নাহ...তুই তো সিভিলে? শীলাকে চিনিস?
- চিনব না ক্যান? ওই পাগলীরে কে না চেনে? তোরে আবোল তাবোল কিছু বলসে নাকি?
- আরে না সেদিন পলাশীর মোড়ে পরিচয় হলো তাই জিজ্ঞাসা করলাম।
- মাইয়া খুবই ভালো তবে ইস্কুরুপ ঢিলা...নাহ ঢিলা না দোস্ত ইস্ক্রু খুইল্ল্যা পইড়া গেছে গা...হাহ হা!!
- কাউকে পছন্দ করে কিনা জানিস?
- দোওওওস্ত তোমার ভাব গতিক তো ভালো মনে হইতাছে না। তবে ওরে প্রেম ভালোবাসার কথা কওয়াও কিন্তু জটিল...খুব খিয়াল!!!
- কেন? খুব রাগী? ঝামেলা করে?
- আরে না সে এইসব বুঝলে না ঝামেলা করবে। আমাগো তানভীর ওর সাথে প্রেম প্রেম ভাব কইরা কি ধরাটাই না খাইলো।
বন্ধুদের মধ্যে তানভীরের শীলার ওপরে একটু হালকা দুর্বলতা জন্মেছিলো...বেচারা!! গাধাটা প্রত্যেক সপ্তাহে শীলাকে বিভিন্ন কবিতা আর গান টুকলিফাই করে প্যানপ্যানে চিঠি লেখা শুরু করলো। “...আমাকে না কেউ বোঝে না। জীবনে যাকেই ভালো লেগেছে সে আমাকে ছেড়ে গেছে। বড্ড একা একা লাগে। আমি যার হাতে ফুল তুলে দেই সে-ই প্রথম ভুল বোঝে আমাকে। আমি যার শিয়রে রোদ্দুর এনে দেব বোলে কথা দিয়েছিলাম সে আঁধার ভালবেসে রাত্রি হয়েছে।...“
দু’তিন সপ্তাহ পরে ব্যস্ততার কারণে বোধহয় তানভীর চিঠি দিতে পারেনি। শীলা সকালে ক্লাসে সবার সামনে জোরগলায় জিজ্ঞাসা করে বসলো “কিরে তানভীর...তুই যে এই সপ্তাহে আমাকে চিঠি দিলি না?” ক্লাসের সমস্ত চোখ তানভীরের দিকে; তানভীরের মুখ লাল। সে আমতা আমতা করে বলল “না মানে কবিতা লিখে পড়তে দিয়েছিলাম...” “হ্যা...ও না খুব ভালো লিখে...দাড়া দেখাচ্ছি...” তানভীর মানা করার আগেই ওর সব চিঠি বন্ধুদের হাতে আর...তারপরে ওর জীবন দুর্বিষহ। চিঠির লাইনগুলো বেচারাকে প্রতিদিন শুনতে হয়েছে উঠতে বসতে।
রঞ্জন যাকেই শীলার কথা বলেছে সে হেসে উড়িয়ে দিয়েছে “শীলা? ওটাতো একটা পাগলী...খুবই সরল একটা মেয়ে...” বন্ধুরা রঞ্জনের আগ্রহ বুঝলেও কিছু হবে বলে মনে করেনি। এই মায়াবী বয়সটাতে এমনতো ভালো লাগেই, সব ভালোলাগাতো আর ভালোবাসা হয় না। পাওয়া সহজ নয় বলেই কি রঞ্জন এই সহজিয়াকে পাগলের মতো চেয়েছিলো?
৪.
- এই শোন আমার মনে হয় ওই ছেলেটা আমাদের ফলো করছে?
“কোন ছেলেটা? “ বীথি ইশারায় দেখাতেই শীলা বললো “ওহ ওইটাতো রঞ্জন...রঞ্জু...ইইই তে...আমাদের ব্যাচমেট...ও ফলো করবে কেন?”
- আহহা...এতোদিনতো দেখি নাই...এখন খালি এখানে সেখানে দেখা হয়...
- তোর না খালি অদ্ভুত সব চিন্তা!! একটা ক্যাম্পাস...তার সাথে দেখা হতেই পারে...
- তাই বলে এই পলাশীর ব্যাঙ্কের সামনেও...
- বাহ ওর ব্যাঙ্কে কাজ থাকতে পারে না?
- তাতো পারেই কিন্তু ছেমড়াতো ব্যাঙ্কে ঢুকে নাই রে গাধু...সে ব্যাঙ্কের বাইরে ঘুরাঘুরি করতেছে...
- ধুর বাদ দে তো...তোর ভালো লাগলে বল রঞ্জুকে বলি...
- গেলি...আমারতো মনে হয় সে তোকে পছন্দ করে...
- আরে নাহ...পছন্দ করলেতো বলতো...আমরা ফেসবুকে ফ্রেন্ডতো...কই কিচ্ছু উলটাপালটা বলেনিতো...
ওদের প্রতিদিনই দেখা হতেই লাগলো এখানে সেখানে আচমকাই, ক্যাফেটেরিয়ায়, ব্যাঙ্কের সামনে, পলাশীর মোড়ে, সিভিল বিল্ডিং বা লাইব্রেরীর সামনে। শীলা এই যখন তখন দেখা হওয়া নিয়ে মোটেও ভাবেনি। কিন্তু রঞ্জন জানে এই দেখা হয়ে যাওয়া আকস্মিক নয় একটুও। ও শীলা কখন কোথায় থাকে, শীলার ক্লাসের রুটিন, বন্ধুদের সাথে ঘোরাঘুরি সব খোঁজ খবর নিয়ে ফেলেছে।
রঞ্জুর শীলাকে প্রথম দিনই খুব ভালো লেগে গিয়েছিলো; একটু পাগলাটে, একটু ছেলেমানুষ, রঞ্জনের একদম উলটো। রঞ্জন চিন্তা না করে কথা বলে না; জীবনের ব্যাপারেও ওর ভবিষ্যৎ নকশা কাটা আছে। আর শীলা বাড়ীর উঠোনে লতিয়ে ওঠা পুঁই লতার মতো, সতেজ, সুন্দর আর খুবই সহজ। বাগানে গেলে হয়তো তেমন ভাবে প্রথমেই নজর কাড়ে না কিন্তু যে খেয়াল করে সে জানে সরলতার সৌন্দর্য থেকে চোখ ফেরানো কঠিন। শীলার অনেক বন্ধুবান্ধব; সবার সাথে খুব সহজেই মেশে। সহজিয়া বলেই মেয়েদের পাশাপাশি ওর অনেক ভালো ছেলে বন্ধু আছে। ছেলেরা ওকে ঠিক ছোট্ট মেয়ের মতোই প্রশ্রয় দেয়, কখনো ঠিক প্রেমিকা বা একজন রমনী হিসাবে দেখেনি। রঞ্জনের সবচেয়ে ভালো লাগতো যে ও কি অবলীলায় যা মনে হয় তাই বলে দেয়।
রঞ্জু খুবই গোছানো; সে সাধারনত যা চায় সেটা সে শেষ পর্যন্ত হাসিল করে। ও শীলাকে সারা জীবনের জন্য পাশে চেয়েছিলো। আর তার জন্য সে বেশ সাবধানে আঁটঘাট বেধেই নেমেছিলো। জানতো যে বলে কয়ে এই পাগলীর সাথে ভালোবাসা হবে না। তাই ফেসবুকে বন্ধু হয়েছিলো রঞ্জন, প্রথমেই ফোন নম্বর চায়নি। ফেসবুকে পোষ্ট দেখে যে কেউ বুঝবে যে শীলা বৃষ্টি খুব খুব ভালবাসে। ও শীলাকে মাঝে মাঝে বৃষ্টির কবিতা পাঠিয়ে দিতো।
রঞ্জু শীলাকে খুব সহজেই জয় করেছিলো...কবিতা আর গান দিয়ে, বিশেষ করে বৃষ্টির কবিতা। আস্তে আস্তে এমন হলো যে শীলা সকালে উঠেই রঞ্জনের পাঠানো কবিতা বা গানের জন্য অপেক্ষা করা শুরু করলো। যে মেয়েটা পাগলের মতো বৃষ্টি ভালোবাসে তাকে যদি কোন ছেলে প্রতিদিন সকালে উঠেই ফেসবুকে একটা অপূর্ব বৃষ্টিভেজা কবিতা পাঠায় তবে তার মনের আকাশে ভালোবাসার বৃষ্টি ঝরতে আর কতোক্ষণ!!
মাঝে হঠাৎ কয়েকদিন রঞ্জু মেসেজ পাঠানো বন্ধ করলো; শীলা অপেক্ষা করতে করতেই কি প্রেমে পড়লো? কে জানে? সেই প্রথম ও কাউকে সরাসরি কিছু বলেনি। অন্য সময় হলে ও মেসেজ দিতেই পারতো যে কি হয়েছে? কিন্তু কেন যেন অভিমান হয়েছিলো রঞ্জন ওকে ভুলে গেছে বলে। আর কখনো যদি কথা না হয় ভেবে সেই প্রথম অচেনা একটা কষ্ট হয়েছিলো, সেই প্রথম মনে হয়েছিলো অধিকার ছাড়া কিভাবে ও মানুষটার কাছে কিছু চাইবে? ভালোবাসা কি এমনই হয়?
সেই কয়েকদিন শীলা বড্ড অন্যমনস্ক ছিলো। সব হাসি খুশীর মাঝেও সুর কেটে যাচ্ছিল; চোখ খুঁজে বেড়াচ্ছিলো কাউকে; একটু পরপরই মেসেজ চেক করা আর কষ্ট পাওয়া। কয়েকদিন পরে মেসেজ এলো "এ কেমন ভ্রান্তি আমার!/ এলে মনে হয় দূরে স’রে আছো, বহুদূরে,... এলে মনে হয় তুমি কোনদিন আসতে পারোনি।/ চ’লে গেলে মনে হয় তুমি এসেছিলে,/ চ’লে গেলে মনে হয় তুমি সমস্ত ভুবনে আছো।“ সেই প্রথম শীলা বলেছিলো “শেষের দুটো লাইন তোমার জন্য...” “তুমি কি আমার শিলাবৃষ্টি হবে? শুধু আমার জন্য ঝরবে?” “হুউউউ...হবো যদি তুমি আমার মেঘ হও...”
রঞ্জু মাঝে মাঝে ওকে নিয়ে কবিতা লিখে পাঠাতো। শীলার এখনো ভাবতে কেমন অস্থির লাগে যে ওর মতো একটা সাধারন মেয়েকে নিয়ে কেউ কবিতা লিখতে পারে। সারাক্ষণ ওরা কথা বলতো; ফোনে, ফেসবুকে, টেক্সটে; ক্লাসের মাঝে, ক্লাসের ফাঁকে, বাসায়, ছুটির দিনে; সকাল দুপুর সন্ধ্যা আর প্রায় সারারাত পরস্পরকে কথা দিয়ে ছুঁয়ে ছুঁয়ে থাকা। আসলে সে সময়টাই যে দারুন ছিলো; বৃষ্টিতে ভিজে পাগলা হাওয়ায় মাতাল হওয়ার দিন।
চলবে... (দ্বিতীয় পর্বে সমাপ্ত) বৃষ্টি চিহ্নিত ভালোবাসা (দ্বিতীয় ও শেষ পর্ব)
© শিখা রহমান
(ছবি ইন্টারনেটে সংগৃহীত)
সর্বশেষ এডিট : ০২ রা নভেম্বর, ২০১৮ ভোর ৬:৩৮