কিন্তু হঠাতই একদিন যেন আকাশ ভেঙ্গে পরল তোমার মাথায়!
তুচ্ছ কারণেই একদিন রেগে গেল তোমার স্বামী। যে লোক তোমাকে এত ভালোবাসে তার রাগে তুমি মনে বিশেষ কষ্ট পাও না। কিন্তু সেদিন চড়ও কষিয়ে দিল গালে। তাতে কি, স্বামীর অধিকার আছে স্ত্রীকে শাসন করার, রাগ কমলেই সব ঠিক হয়ে যাবে। কিন্তু না ঠিক হলো না। রাগ যেন তার মাঠায় উঠে গেছে! তিনবার বলে ফেলল 'তালাক তালাক তালাক'! বলেই বুঝল কি করেছে - ঠিক যেন বজ্রাহত হয়ে গেল মানুষটা! আসলে তো সে তোমাকে তালাক দিতে চায়নি, রাগের মাথায় বলে ফেলেছে।
কিন্তু প্রতিবেশীরাতো সবই শুনেছে, হইচই থেকে তালাক - সব। চেয়ারম্যানের কাছে পৌঁছে গেল সংবাদ। ধর্মভীরু চেয়ারম্যান শরীয়তের বাইরে যেতে পারেন না, ঘোষনা করলেন তোমাদের তালাক হয়ে গেছে! তোমাকে তোমার স্বামীর ঘর ছাড়তে হবে আর প্রাক্তন (!) স্বামীর সঙ্গে পর্দা করতে হবে! যে মানুষটাকে তুমি চারটি সন্তান উপহার দিলে, যৌবনের তেরটা বছর কাটালে যার সাথে, তার সাথেই করতে হবে পর্দা! সে আজ থেকে তোমার কাছে বেগানা পুরুষ!
এলাকার ঈমাম অবশ্য পুরোপুরি একমত নন এই তালাক কার্যকর হওয়া সম্পর্কে। তিনি মাওলানা ওহিদুদ্দিনের 'ইসলামী শরিয়াতে নারী' এনে ১০৯ নং পাতা বের করে হাদিস দেখান - মহানবী (সঃ) একশ্বাসে তিনবার তালাক উচ্চারন করাকে একবার উচ্চারন করা বলে সাব্যস্থ করেছেন। ঈমাম সাহেব শরীফ চৌধুরীর 'ইসলামে নারীর অধিকার' বইয়ের ৫১ নং পাতায় দেখান আরো একটি হাদিস - মহানবী (সঃ) এরকম একটি ঘটনায় অত্যন্ত রাগান্বিত হয়ে বলেছে "তোমরা কি শর্বশক্তিমান মহান আল্লাহ তা'লার কিতাব নিয়ে তামাশা করছো, যেখানে আমি এখনো তোমাদের মঝেই আছি!" কিন্তু বেচারা ঈমাম চুপ করে গেলেন যখন চেয়ারম্যান সাহেব মাওলানা ওহিদুদ্দিনের বইয়েরই ১১০ নং পাতা বের করে দেখান যে খলিফা হযরত উমর (রাঃ) একশ্বাসে তিনবার উচ্চারিত তালাককে তিনবার তালাক উচ্চারনের শামিল বলেই রায় দিয়েছেন, যা তার যুগ থেকে কার্যকর ছিল।
তার মানে তুমি এখন তালাকপ্রাপ্তা! তোমার স্বামী তোমাকে তালাক দিয়েছে! কি ছিল তোমার দোষ? তুমি বুঝতে পারছো না, তুমি হতবাক!
চেয়ারম্যান সাহেব এরপর কোরান শরীফ খুলে সুরা বাকারার ২৩০ নং আয়াত পড়ে শোনান - "অতঃপর যদি সে তাকে তালাক দেয় (তিনবার) তবে সে (স্ত্রী) তার জন্য বৈধ হবে না যতক্ষন না সে অন্য পুরুষকে বিবাহ করে। এখন যদি সেও (২য় স্বামী স্বেচ্ছায়) তাকে তালাক দেয় তাহলে তাদের (প্রথম স্বামী ও স্ত্রীর) কোন পাপ হবে না যদি তারা পরস্পরের কাছে ফিরে আসে..."
এখন তুমি কি ফিরতে চাও তোমার স্বামীর কাছে? তোমার সন্তানদের কাছে? তোমার অতি পরিচিত সেই ঘর-উঠনে আবার যেতে চাও? তবে তোমাকে বিয়ে করতে হবে অন্য কোন পুরুষকে! অন্য কোন পুরুষের কাছে তুলে দিতে হবে তোমার মাঝ-যৌবনের শরীর, যে শরীর ঐ এক স্বামী ছাড়া আর কেউ কোনদিন ছুয়ে দেখবে তা তুমি দুঃস্বপ্নেও কখনো ভাবতে পারনি। তোমার কি মনে পরে তোমার বাসর রাতের কথা? ঘিয়ে রঙের পাঞ্জাবী গায়ে তোমার যুবক স্বামী যখন এল বাসর ঘরে, কেমন অজানা এক কাঁপুনিতে কেঁপে উঠেছিলে তুমি - মনে পরে? নতুন স্বামীর আগমনেও কি তুমি এভাবেই কেঁপে উঠবে? ঘেন্না হচ্ছে? কেন? এইতো তোমার ধর্মের আইন - আল্লাহর আইন! বড় কঠিন আইন। আল্লাহর আইন চাইলে ক্ষমা করে দিতে পারে চোর, খুনীকে, ডাকাত কিংবা ধর্ষককে কিন্তু তোমার ক্ষমা পাওয়ার কোন সুযোগ নেই। তোমার দোষ কি ছিল? দোষ যদি হয় তো তা তোমার স্বামীর। মুখ ফস্কে রাগের মাথায় বলে ফেলেছে, কিন্তু আল্লাহতো সর্বজ্ঞাতা - তিনি ভালো করেই জানেন তোমার স্বামী আসলে তোমাকে তালাক দিতে চায়নি। সারা গ্রাম যেন নির্বাক হয়ে গেছে।
তোমার কি মনে হচ্ছে তুমি শেষ হয়ে গেছ? লজ্জায় কি তোমার পরান মরে যেতে চাইছে? কিন্তু আইনের কাছে তো দয়া মায়ার কোন স্থান নেই। তুমি মরে গেলে তোমার তিন ছেলের ভবিষ্যত কি হবে? কোথায় যাবে তোমার পরী? আর তোমার স্বামী! আহারে বেচারা!
এগিয়ে এল গ্রামের সবচেয়ে মহত মানুষটি। রাজী হলো তোমাকে বিয়ে করতে, কথা দিল সে তোমাকে বিয়ের পরপরই তালাক দেবে আর তোমাকে ছুঁয়েও দেখবে না। সবাই জানে এই মানুষটার মুখের কথার দাম তার জানের চেয়েও বেশী। দু'চোখের জল ফুরিয়ে এলে একদিন তুমি রাজী হলে বিয়েতে, রাজী হলো তোমার স্বামীও।
কিন্তু আবার বাধ সাধলো চেয়ারম্যান সাহেব, শরীয়া আইনের বই নিয়ে হাজির হলেন এবার। আইন নং ২৫৩৬ পড়ে শোনালেন সবাইকে "...৩য় তালাক উচ্চারনের সাথে সাথেই সে (স্ত্রী) হারাম হয়ে যায় স্বামীর কাছে। কিন্তু যদি অন্য কোন পুরুষের সাথে তার বিবাহ হয় এবং নীচের পাঁচটি শর্ত পূরন করে তবেই তাকে আবার পূর্বের স্বামী বিবাহ করতে পারবেঃ
১) ২য় বিয়ে হতে হবে সাধারন স্থায়ী বিয়ে; মু'তা বা অস্থায়ী বিয়ে হলে তা হবে না।
২) ২য় স্বামীর সাথে স্বাভাবিক যৌন সম্পর্ক স্থাপিত হতে হবে।
৩) ২য় স্বামী স্বেচ্ছায় তাকে তালাক দেয় কিংবা মারা যাবে।
৪) ২য় স্বামীর তালাকের পর ইদ্দতের সময় পার হতে হবে।
৫) যৌন্সম্পর্ক স্থাপনের সময় ২য় স্বামীকে অবশ্যই বালেগ বা প্রাপ্তবয়স্ক হতে হবে। "
সব শুনে তোমার স্বামী আর মেনে নিতে পারে না, ভগ্নস্বরে বলে ওঠে ঐ শরীয়া আইন শিয়াদের আইন বিশেষজ্ঞের লিখা, সুন্নীদের জন্য তা কি করে প্রযোজ্য হয়? শেষবারের মত তোমার স্বামী তোমাকে অন্য পুরুষের সামনে নগ্ন হওয়ার অপমান থেকে বাচানোর চেষ্টা করল যেন। কিন্তু না শুধু শিয়া নয়, সুন্নীদের জন্যও একই আইন। ঈমাম সাহেবও এবার এগিয়ে এলেন সঠিক আইন প্রতিষ্ঠায়। কোরানের তাফসীর খুলে বের করে করলেন ১২৬ নং পাতা। "১ম স্বামীর সাথে পুনর্বিবাহের শর্ত হলো স্ত্রী ইদ্দিতের পর অন্য কোন পুরুষকে বিবাহ করবে। যদি ২য় স্বামী তার সাথে যৌনকার্যে লিপ্ত হওয়ার পর কোন কারনে স্ত্রীকে তালাক দেয় কিংবা মারা যায় শুধুমাত্র তবেই ১ম স্বামীর সাথে তার আবার বিবাহ হতে পারবে।" এরই মধ্যে কে একজন সেই মকসুদুল মোমেনিন নিয়ে হাজির হল, যা তুমি পাড়ায় বৌদের পড়ে শোনাতে। চেয়ারম্যান সাহেব ২৩১ নং পাতায় পড়তে শুরু করলঃ "...হিলা বিবাহের পূর্বশর্তই হলো ২য় স্বামীর সাথে আবশ্যিক যৌনসম্পর্ক। সাধারন বিবাহের মতই হতে হবে হিলা বিবাব, তালাক বা অন্য কোনরকম শর্ত থাকতে পারবে না। জোর করে তালাকও নেওয়া যাবে না। ২য় স্বামী যদি স্বেচ্ছায় তালাক না দেয় তবে কিছুই করার নেই। "
কিছু শুনতে পাচ্ছ? দেখতে পাচ্ছ? কিছু বলতে চাও? চিরদিন তুমি কেয়ামতের কথা শুনে এসেছো, বিশ্বাস করে এসেছ - এখানে আজ, এই হলো তোমার জন্য কেয়ামত। আল্লাহর বাণী স্মরণ করঃ "ভাল কিছু যা ঘটে তা কিন্তু আল্লাহর কাছ থেকে, আর মন্দ বিষয় যা কিছু ঘটে তা কিন্তু তোমার নিজের থেকে..." [সুরা নিসাঃ৭৯]। খুঁজে দেখো, ভেবে দেখো কোন পাপ করেছিলে কবে, যার জন্য আজ তোমার এই দুর্দশা। কি, পেলে কিছু? তুমি কি নিজেকে এখনো নির্দোষ মনে করছো? না? তাতে কি! এবার তবে প্রস্তুত হও অন্য পুরুষের স্ত্রী হওয়ার জন্য। প্রস্তুত হও নতুন পতির সংসারে যাওয়ার জন্য। আবার একই রান্নাঘর, একই বিছানা - যেমন ছিল তোমার প্রানের প্রিয় স্বামীর সংসারে। ওখানে গিয়েও তোমাকে খুলতে হবে শাড়ির ভাঁজ, কাচতে হবে স্বামীর জাঙ্গিয়া, তিনি চাইলে তোমার ঐ চার সন্তান ধারন করা পেটে আবার ধারন করতে হবে নতুন সন্তানের বীজ।
তোমার কি মনে হচ্ছে তোমার গলায় কেউ ছুরি বসিয়ে দিয়েছে? তোমার সন্তানরা কাঁপছে যেমন করে গরু-ছাগল কাঁপে কসাইখানায়। ওরা কোনদিনই আর পরিপূর্ন মানুষ হতে পারবে না।
প্রিয় বোন আমার, আমি তোমাকে বাঁচাতে পারব না। আমার সেই শক্তি নেই। ধর্মগুরুরা সকল শক্তি জড় করেছে তোমার বিরুদ্ধে। নানা ক্ষেত্রে তাদের নিজেদের মধ্যে এত বিভক্তি - শিয়া/সুন্নী/কাদীয়ানী; একে অন্যকে হত্যা করতেও দ্বিধা করে না। কিন্তু তোমাকে লজ্জার আগুনে পুড়িতে মারতে সবাই এরা একাট্টা। এরা কেউই এই আইনের বিরুদ্ধে নয়। সবাই চায় তোমার লজ্জিত মুখখানাকে আরো লজ্জিত করতে, সর্বপ্রকারে ধর্ষন করতে, তোমার বেঁচে থাকার প্রতিটি দিনকে কলংকিত করতে। আমি অক্ষম বোন, এদের বিরুদ্ধে দাঁড়াবার শক্তি আমার নেই। এরা সংগঠিত আমি একা। তুমিও একা। দু'চোখে জলের ধারা নিয়ে আমি করজোড়ে ক্ষমা চাই আজ তোমার কাছে। ক্ষমা করো আমায় বোন।
(হাসান মাহমুদের লেখা অবলম্বনে)