তখন খুব ছোট।কোন ক্লাসে পড়ি কিংবা সালটাও মনে নেই। বিনোদনের একমাত্র মাধ্যম ছিল বাসার ১৪ ইঞ্চি সাদা কালো টেলিভিশন। তখন প্রচারিত হত হুমায়ূন আহমেদের ধারাবাহিক নাটক আজ রবিবার।নাটক প্রচারিত হবার সময় রাস্তাঘাট খালি হয়ে যেতো।আব্বা খালি বলতেন এটি হুমায়ূন আহমেদের নাটক তাই এতো হাসির ও মজার।আমি হুমায়ূন আহমেদ কে তা জানতাম না।তখন বিটিভিতে নিয়মিত বাংলা ছবি দেখা হতো।তাই ভেবেছিলাম হুমায়ুন ফরিদি হবেন সম্ভবত। কিন্তু পরে জানলাম হুমায়ুন ফরিদি আর আহমেদ দুই জন লোক।আজ রবিবার দেখার পর থেকে লোকটার নাটকের একনিষ্ঠ ভক্ত হয়ে যায়।পরবর্তীতে উনার জোসনার ফুল,এই মেঘ এই রৌদ্র সহ অনেক গুলো নাটক প্রচারিত হয়।যা আমি সহ বংলাদেশের অনেক দর্শক ই দেখার জন্য এক সাপ্তাহ অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করত।উনার নির্মিত চলচ্চিত্র আগুনের পরশমণি দেখে খুব কেঁদেছিলাম।তখন বুঝতে পারলাম মানুষকে প্রাণ খুলে হাসাতে পারা এই লোক টি মানুষকে কাঁদাতেও পারেন।লোক মুখে শুনলাম এই লোক বিখ্যাত হয়েছেন উপন্যাস লেখালেখির মাধ্যমে।উনার ছোট গল্প পড়েছিলাম কিছু।কিন্তু উপন্যাস পড়ার মত ধৈর্য্য কিংবা আগ্রহ আমার ছিল না।ক্লাস এইটে প্রথম উনার উপন্যাস পড়লাম।নাম মনে নেই।একটানা পড়ে শেষ করলাম।পড়ে মুগ্ধ হয়ে গেলাম,যতক্ষন পড়েছি মনে হয়েছিল আমার জীবনের কাহিনী পড়েছি।তারপর থেকে শুরু হল হুমায়ূন আহমেদের বই খোঁজা।বন্ধু আত্নীয় সবার কাছে খোঁজ করতাম।প্রায় সময় ই পুরোনো বই এর দোকানে গিয়ে উনার বই খোঁজতাম।একটা বই পেলে আমার আনন্দ আর দেখে কে!!পাওয়া মাত্র পড়াশোনা যাই থাকুক না কেন আগে উপন্যাস পড়া পরে অন্য কিছু।পাঠ্য বইয়ের উপরে উপন্যাস রেখে পড়তাম যাতে আব্বা আম্মা না বুঝে।সামর্থ্য থাকলে তখন হয়তো উনার সব বই কিনে ফেলতাম। মাঝে মধ্যে হিমু কিংবা মিসির আলী হবার ব্যর্থ চেষ্টাও করেছি।
সবচেয়ে মেজাজ খারাপ হয় যারা উনী অপন্যাস লিখেন বলে বিদ্রূপ করেন তাদের দেখলে।তাদের বলি বাংলা সাহিত্যে নন্দিত নরকে কিংবা শঙ্খনীল কারাগারের মত মানের উপন্যাস কয়টা আছে?হিমুর মত জনপ্রিয় কিংবা মিসির আলীর মত সুপার ন্যচারাল চরিত্র কয়টা দেখাতে পারবেন?জ্যোৎস্না ও জননীর গল্প বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে নির্মিত অন্যতম শ্রেষ্ঠ বই।আগুণের পরশমণি কিংবা শ্রাবণ মেঘের দিন বাংলাদেশের অন্যতম শ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্র।চাঁদনী পশর কিংবা এক বরষায় এর মত জনপ্রিয় গান বাংলাদেশে হাতেগোণা।জাফর স্যার এর গুলো ছাড়া স্যার এর ধারে কাছের মানের বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনী বাংলাদেশে কয়টা?যারা স্যার নাস্তিক নাস্তিক বলে মুখে ফেনা তুলে তাদের স্যারের নিচের লেখাটি পড়ে দেখার অনুরোধ করছি,”আমার ছেলে রাশেদ হুমায়ূনের বয়স দুই দিন। তাকে ইনকিউবেটরে রাখা হয়েছে। সে মারা যাচ্ছে। আমি হাসপাতাল থেকে শহীদুল্লাহ হলের বাসায় ফিরে এলাম। অজু করে জায়নামাজে দাঁড়ালাম। আমি ঠিক করলাম, সম্রাট বাবরের মতো নিজের জীবনের বিনিময়ে পুত্রের প্রাণ ভিক্ষা করব। জায়নামাজে দাঁড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে আমার মনে হলো, এই প্রার্থনা কবুল হবে।
শেষ মুহূর্তে প্রবল ভীতি আমাকে আচ্ছন্ন করল। আমি জীবনের বিনিময়ে জীবনের প্রার্থনা করতে পারিনি। আমি আমার মৃত শিশুপুত্রের কাছে লজ্জিত এবং ক্ষমাপ্রার্থী।“
খুব ইচ্ছে ছিল কষ্টি পাথর সম হাত নিয়ে জন্মানো এ মানুষটিকে খুব কাছ থেকে দেখার..সম্ভব হয় নি