মানুষের কাছে কিছু শব্দ শুনতে অকারণেই বেশ খারাপ লাগে। ফারিয়ার কাছে তেমনি ওদের কলিং বেলের শব্দ। আম্মুকে অনেক বার বলা হয়েছে চেইঞ্জ করতে,কিন্তু লাভ হয় নি। কিন্তু আজ সন্ধ্যার পর থেকেই ফারিয়া শব্দটি শোনার জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে।কলিংবেল বাজলেই ড্রইংরুমের দরজার পর্দার ফাক দিয়ে উঁকি দিচ্ছে কে আসছে দেখার জন্য। আজ স্যারের পড়াতে আসার কথা।এমন নয় যে স্যার আজ কোন সুসংবাদ নিয়ে আসবেন কিংবা স্যারের কাছে পড়তে ওর অনেক ভালো লাগে। শুধু স্যারের কাছে নয় কারোর কাছে পড়তেই ভালো লাগে না।তার উপর স্যার পড়ান ফারিয়ার কাছে বোরিং সাবজেক্ট ইংরেজি। প্রতিদিন এসে একটি প্যরাগ্রাফ লেটার কিংবা এসে লিখতে দেন। লেখার পর সেটি খুটিয়ে খুটিয়ে দেখে হাজারটা ভুল বের করেন।
আবার কলিং বেল। ফারিয়া এবার দরজা খুলতে গেল। প্রথমে দরজার ফুটো দিয়ে তাকালো কে এসেছে দেখার জন্য। মনে হয় স্যারই,কারণ স্যার সব সময় এমন ভাবে দাড়ান যেন ফুটো দিয়ে দেখা না যায় কে এসেছে. উনার মতে এতে সারপ্রাইজ নষ্ট হয়ে যায়।
'স্লামালিকুম স্যার'
'কি ব্যপার স্যার আপনি যে আজ দরজা খুললেন! '
'এম্নিতেই স্যার'
'ও হোমওয়ার্ক কি লেটার ছিল লিখেন,মার্জিন দিবেন, কাটাকাটি কম করবেন ,সাবধান বানান যাতে ভুল না হয়'
পড়ার টেবিলে বসতে বসতে স্যার বললেন।
ফারিয়া নিজের মধ্যে একধরনের উত্তেজনা অনুভব করছে।কলম দিয়ে যেন লেখা বের হতে চাইছে না। লেখাও খুব বাজে হচ্ছে। এতো প্র্যাকটিস আগে কোন লেখা লিখতে সে করেনি। তবুও এমন হচ্ছে কারণ সে জীবনের প্রথমবারের মত কাউকে প্রপোজ করতে যাচ্ছে। মেয়ে হয়ে ছেলেদের প্রপোজ করার ঘটনা 'রেয়ার' হলেও ফারিয়া এ কাজটি করতে যাচ্ছে। কি লেখবে আগে থেকে প্ল্যান করে রাখা। তারপর ও সব কিছু গুলিয়ে যাচ্ছে যা একদমই ভালো লক্ষণ নয়। ইংরেজী তে চিঠি লেখা সব সময়ই কঠিন। তাও প্রতিটি কঠিন শব্দের ইংরেজী আগে থেকেই স্যার থেকে জেনে নেয়া। স্যারের সিক্সথ সেন্স প্রবল বলেই ফারিয়ার ধারণা।স্যার ফারিয়ার মনের সব কথা বলে দিতে পারবেন বলেই ফারিয়া মনে করে।কিন্তু কখনো স্যারকে তার এই ধারণার কথা বুঝতে দেয় নি। ধারণার পেছনে সুস্পষ্ট কারণ ও রয়েছে। স্যার পরীক্ষা নেয়ার সময় সবসময় ই ফারিয়া যে বিষয়টা সবচেয়ে কম পারে সেটি দেন। ১০ টা ভয়েস চেঞ্জের একটাও যদি ফারিয়া না পারে সেটিও তিনি বুঝে ফেলেন। যেমন গত সপ্তাহে সে পানি খাবার কথা বলে পড়া থেকে উঠে মোবাইলে বান্ধবীর সঙ্গে কথা বলে এসেছে ,স্যার আসার সঙ্গে সঙ্গে বললেন 'স্যার মিথ্যা বলে উঠে কেন?'
সে পুরোপুরি হকচকিয়ে গেলেও কিছু হয়নি এমন ভান করে এড়িয়ে গিয়েছে। আরেকদিন তার খাতায় স্নিগ্ধা’র লেখা দেখে স্যার জিজ্ঞেস করলেন কার লেখা। সে উত্তর দেয়ার সঙ্গে সঙ্গে স্যার বললেন ‘ওর আব্বু রেলে চাকুরী করে তাই না?’
সে চোখ কপালে তূলে জিজ্ঞেস করলো,”আপনি কি ওকে চিনেন নাকি!!’
‘না’ (আসলে স্যার অনুমান করে বলেছিলেন। ট্রেইনে যারা চাকুরী করে তাদের অনেকের সন্তানের নামই হয় শোভন, স্নিগ্ধা এরকম টাইপ)
স্যার দেখতে সাধারণের চেয়েও কম , সব সময় চলাফেরাও করেন অগোছালো ভাবে।বেশির ভাগ সময়ে ইস্ত্রি হীন কাপড় পরেন।এর চেয়ে কত সুন্দর স্মার্ট ছেলে ফারিয়াকে প্রপোজ করেছে!! কিন্তু স্যারের কি যেন একটা আছে যা ঐ ছেলেদের মাঝে নেই। মানুষ মাঝে মাঝে খুব ছোট কারণে মুগ্ধ হয়।মনে হয় ভালোবাসার পেছনে কোন কারণ থাকে না।
ফারিয়ার মনে হচ্ছে সে একের পর এক ভুল করছে। এতো টেনশন.. লেখা শেষ।
ও আরেকবার রিভিশন দিচ্ছে। কাপা কাপা হাতে সে স্যারের দিক খাতা বাড়িয়ে দিল। তার টেনশনে গলা দিয়ে আওয়াজ বের হচ্ছে না। প্রচন্ড তৃষ্ণা পেয়েছে, সঙ্গে আবার টয়লেট ও পেয়েছে বোধহয়। স্যার মোবাইল এ কি যেন করছেন।তিনি ফারিয়ার লেখা শেষ লক্ষ্য করেন নি। এমন তো হয় না! স্যার লেখা শেষ হওয়া মাত্রই খাতা নিয়ে পড়েন। ফারিয়া বললো, 'স্যার লেখা শেষ'
'ও গুড;আজ আর দেখব না।আজ একটু কাজ আছে, যেতে হবে। কাল মুনলিট নাইট শিখে রাখবেন'
'স্যার,এতো কষ্ট করে লিখলাম দেখবেন না!!'
'সরি,আজ সময় নেই' বলে স্যার উঠে চলে গেলেন।
ফারিয়ার মাথা প্রচন্ড ধরেছে।চোখের সামনের সবকিছু ঝাপসা দেখছে। এতো কষ্ট করে লেখা লেটার টা স্যার দেখলেন ই না!!তার প্রচন্ড রাগ হচ্ছে ।রাগ হলে খাতায় সে কলম দিয়ে আঁকাআঁকি করে। সে চিঠির উপরে তাই করলো। তারপর সেটিকে টুকরো টুকরো করে ছিড়ে জানালা দিয়ে ফেলে দিল। পুড়িয়ে ফেলতে পারলে আরেকটো অভিমান কমতো। অভিমানে তার চোখ ভিজে গেছে,চোখ মুছতে গিয়ে পানির পরিমাণ বেড়ে গেল। সে দৌড়ে বাথরুমে গিয়ে অনেক্ষন কাঁদল।
২. প্রতি মাসের শুরুতে একবার আবির ও তার বন্ধুরা ভালো কোন রেস্তোরাঁয় খেতে যায়। আজ সেই দিন। আজ তাদের একটি চাইনিজে খাবার কথা। বাজেট জনপ্রতি ৫০০-১০০০.ভার্সিটিতে ফার্স্ট ইয়ারে থাকতে আবির যেতে পারতো না টাকার অভাবে।নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারে বাসার বাইরে থাকা ছেলের ভালো রেস্তোরাঁর খাবার জন্য প্রতি মাসে এক্সট্রা টাকা চাওয়া অন্যায়ের পর্যায়ে পরে। টিউশনি টা পাবার পর থেকে যায়। টিউশনি পাবার পর থেকে সে অনেক কিছুই করতে পারে , যেমন: প্রতি মাসে নেট প্যকেজ নেয়া ,বিকেলে ভালো নাস্তা করা,অকেশনালি বেনসন খাওয়া, মাঝে মধ্যে ভার্সিটিতে বাসের পরিবর্তে রিক্সা করে যাওয়া, মাঝেমধ্যে ঘুরতে যাওয়া।টিউশনির যোগাড় ও হয়েছে অনেক কাটখড় পুড়িয়ে। সে ফারিয়া মেয়েটিকে পড়ায় ক্লাস এইট থেকে। এখন ও ক্লাস নাইনে। প্রথম যেদিন ওকে পড়াতে গিয়েছিল সেদিন ই তার মেয়েটিকে দেখে কেমন একধরণের অনুভূতি হয়েছিল! সে চিন্তাও করেনি তাকে অসম্ভব রুপবতী এক তরুণীকে পড়াতে হবে। রুপবতী তরুণীদের দেখলেই তরুণ দের মনে একপ্রকার প্রেম জাগে। সম্পর্কে মেয়েটির শিক্ষক হবার পরেও আবিরের সে অনুভূতি হয়েছিল। কিন্তু কখনো প্রকাশ করার সাহস হয় নি। নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান হিসেবে এক লন্ডন প্রবাসী বিলিয়নপতির সন্তানের সঙ্গে প্রেম করতে তার মন কখনোই সায় দেই নি। প্রথম থেকেই তার কাছে মনে হতো মেয়েটি তাকে অপছন্দ করে,কারণ সম্ভবত পড়াশোনায় অতি মাত্রায় প্রেশার দেয়া,মাঝে মধ্যে মা'র নিকট নালিশ দেয়া। অবশ্য তাছাড়া ও পছন্দ করার মত এমন আহামরি কোন ছেলে সে নয়। বয় ফ্র্যন্ড বিবেচনায় তার ক্লাস সাধারণের চেয়েও নিচে। কিন্তু তার সবসময় ই মেয়েটির কথা মাথায় আসতো। ভ্যকেশনে সে যখন বাসায় যেত তখন মেয়েটিকে প্রচন্ড মিস করতো। মেয়েটির নিজস্ব ফোন না থাকায় সে ওর আম্মুকে ফোন দিতো। কিন্তু কখনো সাহস করে ফারিয়াকে দেন বলতে পারতো না। হয়তো ফারিয়াকে চাইলেও ফারিয়া তার সঙ্গে কথা বলতে চাইতো কিনা তার সন্দেহ। এ জন্য অনেকবার তার মন প্রচন্ড খারাপ ও হয়েছে। সে সবসময় মেয়েটিকে মুগ্ধ করার চেষ্টা করে প্রতিবারই ব্যর্থ হতো। যেমন গেল সপ্তাহে মেয়েটি যখন পানি খাবার কথা বলে উঠে গেল আবির পর্দার ছায়ায় লক্ষ্য করলো কে যেন ফোনে কথা বলছে। সে অন্ধকারে মেয়েটিকে ঢিল ছুড়লেন 'স্যার মিথ্যা বললেন কেন?' কিন্তু মেয়েটিকে অবাক হয়েছে বলে মনে হয় নি। একটু পর তার ভুল ভাংলো সে লক্ষ্য করলো মেয়েটি পড়ছে আর ওর আম্মু মোবাইলে কথা বলছে কিন্তু পর্দার আড়ালে অনুরূপ ছায়াই পরেছে।আবির মনে মনে লজ্জিত অনুভব করলো। কিন্তু আজ মেয়েটি আবিরকে অবাক করে দিয়েছে। মেয়েটি তাকে প্রেমপত্র লিখছিল!! সে মেয়েটি লেখার সময় পুরো চিঠিই পড়েছে। তখন তার বুকে কেমন যেন অনুভূতি হচ্ছিল। সে তার চোখকে বিশ্বাস করতে পারছিল না।আনন্দে চোখে পানি আসার মত অবস্থা। ঘোরের মধ্যে চলে গিয়েছিল। কিন্তু মনে মনে বাস্তবতার কথা চিন্তা করে তার মন খারাপ হয়ে গেল। যদি মেয়েটির ফ্যমিলির কেউ টের পায় ঘটনা কেমন হবে চিন্তা করতে সে আতংকিত হয়ে গেল। তার স্পষ্ট মনে আছে একবার ফারিয়ার ইংরেজী তে প্যরাগ্রাফ কমন না পরার কারণে ওর আম্মু আবিরকে কেন ঐ প্যরাগ্রাফ পড়ায় নি বলে ধমক দিয়েছিল ভাবলে এখনো খারাপ লাগে।অপমান বোধ থেকে সে টিউশনি ছেড়ে দিতে চেয়েছিল কিন্তু আর্থিক বিবেচনায় দেয় নি।অবশ্য আরেকটি কারণ ছিল। তার মনে হয়েছিল সে মেয়েটিকে না দেখে থাকতে পারবে না। সে ফারিয়ার আম্মু কি ভাববেন এ ভয়ে ফারিয়ার জন্মদিনে গিফট কিনেও দেয় নি। আর আবির টিউশনি করতে গিয়ে ছাত্রীর সঙ্গে প্রেম করছে জানতে পারলে তার শিক্ষক বাবাই বা কি করবেন!তার উপর একবছর পর মেয়েটির পুরো ফ্যমিলি লন্ডনে চলে যাবে। সেখানেই স্থায়ী হবে। আবির এক বইয়ে পড়েছিল অল্প বয়সী মেয়েদের আবেগ কে পাত্তা দিতে হয় না, সে আবেগ বাতাসে উড়ে যায়।আচ্ছা মেয়েটি তাকে অপছন্দ করে বলে সে জানে, চিঠির মাধ্যমে সেই ফারিয়ার তাকে প্রপোজ করা তাকে ফাসানোর সূক্ষ ষড়যন্ত্র নয়তো! ! সব চিন্তা করে সে চিঠি দেখেও না দেখার বান করে ছুটি দিয়ে চলে এসেছে ।আবির এখন রাস্তায় হাটছে।কষ্টে তার মাথা ধরেছে।সে আজ আর খেতে যাবেনা। এতে টাকাটা বেঁচে যাবে। সেই টাকার সঙ্গে আরো কিছু টাকা যোগ করে নতুন আরেকটি টিউশনির রেজিস্ট্রেশন ফি দেয়ার জন্য রেখে দেয়া যাবে যদিও টিউশনি পাওয়া সময় সাপেক্ষ ব্যপার। পেলে প্রথম মাসের ৭০ভাগ বেতন দিয়ে রেজিস্ট্রেশন করাতে হয়।
৩. মিসেস ফাহিমার মন বেশ খারাপ।একটু আগে উনার মেয়ে ফারিয়ার টিচার উনাকে ফোন করে জানিয়েছেন ছেলেটি মেস চেইঞ্জ করে হলে আসায় সে এতো দূরে আর আসতে পারবে না।সে নাকি আজ একথা বলতেই এসেছিল। কিন্তু তিনি বাসায় না থাকায় বলতে পারে নি। তিনি ছেলেটিকে রিকুয়েস্ট করলে এমনকি টাকা বাড়িয়ে দেয়ার অফার দিলেও এতো দূর থেকে আসা সম্ভব নয় বলে ছেলেটি জানিয়ে দিয়েছে।ছেলেটি টিচার ও ছেলে হিসেবে খুব ভাল।তিনি এ ছেলের সঙ্গে প্রথমবার পরিক্ষার পর প্যরাগ্রাফ কমন না পরায় ফোনে খারাপ ব্যবহার করেছেন ভাবলে এখনো খারাপ লাগে। আরো বেশী খারাপ লেগেছে যখন দেখেছিলেন মেয়ে সেই পেপারে আগেরবারের চেয়ে অনেক নম্বর বেশি পেয়েছিল। উনার মেয়ে অবশ্য স্যারের সঙ্গে উনার এমন ব্যবহারের কারণে উনার সঙ্গে ২দিন কথা বলেনি,ঐ রাতে না খেয়ে ঘুমিয়েছে। মেয়েটি ওর স্যারকে খুব পছন্দ করতো।গত ঈদে ফারিয়া তার বাবার পাঠানো শপিং করার টাকা থেকে সে স্যারের জন্য নিজের পছন্দে খুব দামী একটি শার্ট কিনে দিয়েছে। যদিও তা ছেলেটি জানেনা কারণ উনি নিজেই শার্ট স্যার কে দিয়েছেন। কে কিনেছে তাও বলেন নি মেয়ে নিষেধ করায়। ফারিয়াকে তিনি স্যার আর আসবে না কিভাবে বলবেন ভাবতেই খারাপ লাগছে...
সর্বশেষ এডিট : ১০ ই জুন, ২০১৪ রাত ৩:২২