১.
সামাজিক জীব হিসেবে মানুষের অন্যের সঙ্গে কথা বলা অতি স্বাভাবিক বিষয়।জুঁই বাবু নামের ছেলেটির এই স্বাভাবিক কাজটি মেনে নিতে পারছে না।আচ্ছা কারণটা কি!ছেলেটির সঙ্গে এক অজানা মোহে তার কথা বলা ও কাছে আসা।কিন্তু ক্রমেই কেন জানি এই ছেলেটিকে আর সহ্য হচ্ছিল না।পরে ছেলেটিকে সোজাসোজি কথাটি জানিয়ে দিল।শুনে বাবু রেগে অবশ্য তাকে অনেক কথাই বলেছিল। জুঁইয়ের মনে মনে রাগ লাগলেও আর কিছু বলেনি। কিন্তু এখন এই বাবু অন্য মেয়ের সঙ্গে কথা বলছে দেখে তার কেমন যেন অনুভূতি হচ্ছে!আচ্ছা এই অনুভূতিটির নাম কি!নামটি মনে হয় জুই জানে। নিজের মনের অজান্তেই নামটি চিন্তা করে হেসে উঠল।
'একা একা হাসছ যে!'
অনেকটা অপ্রস্তুত ভঙ্গিতে কথাটি হজম করে প্রশ্নকর্তা ছেলেটির দিকে তাকালো জুই।কি অসম্ভব রুপবান একটি ছেলে!কানন নামক ছেলেটিকে ইতোপূর্বে দূর থেকে দেখলেও কাছ থেকে এই প্রথম। ছেলেটি সায়েন্সে পড়ায় তেমন দেখা হয় না। দূর থেকে দেখলে যতটা না সুন্দর তার চেয়ে অনেক বেশি সামনে থেকে। একটি ছেলের এতো সুন্দর হতে হবে কেন!
'না এম্নিতেই' নিজেকে সামলে নিয়ে জবাব দিল জুই।
'ক্লাস শেষ?'
'হুম, প্রাইভেট আছে।জালাল স্যার'
'আমারও ঐ দিকে প্রাইভেট আছে।চল একসঙ্গে যায়'
'আমি বান্ধবীর সঙ্গে যাব'(আসলে মিথ্যা বলেছে জুই।সে একাই যাবে)
'ও আচ্ছা। যাও তাহলে'
২.
'এতো জায়গা থাকতে শ্মশানে আসলাম কেন?' বিরক্ত ভঙ্গিতে কাননকে জিজ্ঞেস করল সাইফ।
'এম্নিতেই, এইগুলা কি চিনিস?'
'চিনব না কেন! সিদুঁর।এগুলো নিচ্ছিস কেন?'
'এইগুলার কাজ কি জানিস?'
'তোদের ধর্মে মেয়েরা নাকি বিয়ের পরে কপালে দিয়ে রাখে বলেই তো জানি।'
'হুম। আমিও এই কারণেই নিয়েছি।'
'তুই আবার বিয়ে করছিস কবে?'
‘যখন করব আরকি।জানিস ‘জুঁই’ মাথায় সিদুঁর পরে আছে দৃশ্যটি কত সুন্দর হবে!!'
'কি আজেবাজে বকছিস। ও তো মুসলমান!'
'তো কি! ও ওর পহেলা বৈশাখের সাদা শাড়িটা পরে মাথায় সিদুঁর দিয়ে রেখেছে। জানিস এই দৃশ্যটি প্রায়ই আমি কল্পনাতে দেখি।'
'ও মুসলমান মেয়ে। সিদুঁর পরতে যাবে কেন!আর বিয়ের সময় সাদা শাড়িই বাঁ পরবে কেন?তোর কথার মাথামুন্ডু কিছু বুঝি না।'
৩.
কানন শুধুমাত্র জুঁইয়ের জন্য বাংলা প্রাইভেটে ভর্তি হয়েছে।আর্টসে পড়া জুইয়ের সঙ্গে একসঙ্গে প্রাইভেট পড়ার এই একমাত্র সুযোগ কাজে লাগাতে তাকে অবশ্য বাবা মা'র সঙ্গে অনেক সংগ্রাম করতে হয়েছে। আজ স্যারের বাসায় পরীক্ষা।কি কারণে যেন জুঁইয়ের প্রেমে পরার পর থেকে তার পড়াশোনায় আগের মত মনযোগ বসে না। পড়তে বসলেই ওর কথা মাথায় চলে আসে।আজ ও সাইফ থেকে দেখে লিখছে। হঠাত পিঠে একটা আলতো ছোঁয়া লাগলো. পেছনে ঘুরে ফিরে তাকিয়ে দেখল জুই তাকে ডাকছে।
'এই প্রশ্নোত্তর পার?'
'আমি নিজে পারি না। ওর থেকে দেখে লিখেছি'
'ওকে।দেখাও '
কানন দেখাল। ঐ কয়েকটি মুহুর্ত এখন পর্যন্ত তার জীবনের শ্রেষ্ঠ কয়েকটি মুহুর্তের একটি। আচ্ছা জুই কি ওকে হাত দিয়ে ডাক দিয়েছিল না স্কেল দিয়ে? দুটোর স্পর্শ কি দুরকমের!স্পর্শ টা কেমন!আচ্ছা সেই মুহুর্তের কোন অনুভূতি তার মনে নেই কেন!
পরীক্ষা শেষে প্রচণ্ড উৎফুল্ল মনে কানন বাড়ি ফিরছিল।
'এই কানন। ছাতিটা না খুলতে পারছি না। একটু খুলে দাও না..'
অনেক আকুতির ভঙ্গিতে জুই কাননকে বলল। কানন ছাতিটি হাতে নেয়ার পর অবাক হয়ে লক্ষ্য করল তার হাত কাপছে।এধরনের ছাতি খুলতে তার প্রায়ই সমস্যা হয় কিন্তু এ যাত্রায় সে একচাপেই খুলতে পারল।তার খুব আনন্দ হচ্ছে।
৪.
'পারুল দোস্ত আমি তো কাননকে অনেক অনেক পছন্দ করি।আই মিন অন্য রকম পছন্দ.ভালো ..'
লজ্জাহীন ভঙ্গীতে প্রিয় বান্ধবীকে বলল জুই।
'মানে কি!ও তো হিন্দু!'
'জানি। কিন্তু ওকে দেখলে আমার মাথা ঠিক থাকেনা। ও প্রতিদিন এস এম এস করে। সেগুলো পড়লে আর কোন কাজেই মন বসে না'
'বলিস কি!ও তোর নম্বর পেল কিভাবে!'
'আরে স্যারের খাতা থেকে নিয়ে নিয়মিত মিসকল দিতাম।কল ব্যক করত।একদিন ভুলে ধরে
ফেলেছি।আর দুষ্টুটাও বুঝে ফেলল এটি আমার নাম্বার!'
'তুই কি জানিস?ওর প্রতি তোর যেটা জন্মেছে সেটি প্রেম নয়। অতি রূপবান পুরুষ দেখলে মেয়েদের মনে যা জাগে তা। আর দ্বিতীয়ত সবে মাত্র কদিন হল বাবুর সঙ্গে তোর ঝগড়া হয়েছে। ওর প্রতি রাগের ও ব:হিপ্রকাশ এটি'
'সত্যি বলতে কেন জানি এখন আর ওকে দেখলে আগের মত অনুভূতি কাজ করে না '
'তার মানে তুই বলতে চাচ্ছিস তোর হার্টে বাবুর স্থানটি কানন দখল করে নিয়েছে? দেখ যা করবি বুঝে শুনে করিস.সম্পর্ক শেকড়ের মত। যত সময় যায় তা তত গভীরে প্রবেশ করে।পরে ইচ্ছে করলেও উপড়ানো যায় না'
৫.
দিনে দিনে তাদের সম্পর্ক এগুতে থাকলো ফোন কল এবং এস এস এম এসের মাধ্যমে।দুজনই একটু পর পর মোবাইল চেক করতো কোন এস এম এস এসেছে কিনা দেখার জন্য। যদিও জুইয়ের কাছে শুরুর দিকে সম্পর্কটা এট্রাকশনের মত ছিল কিন্তু হঠাৎ সে লক্ষ্য করলো ঘুমাতে গেলেই শুধু কাননের কথা মনে হয়!!আচ্ছা এমনটি হয় কেন? আগে কারো জন্যে তো এমনটি হয় নি। একজন মেয়ের জীবনে এমন ছেলে কয়জন আসে যার কথা চিন্তা করে ঘুম হয় না?
তার কিছুদিন পরই বিপত্তি ঘটল। জুইয়ের বাসায় কাননের সঙ্গে সম্পর্কের কথা জানাজানি হয়ে গেল। সাধারণত কোন মা-বাবা’ই অল্প বয়সে মেয়ের সম্পর্ক সহজ ভাবে মেনে নেন না, তার উপর কানন হিন্দু! মেনে নেয়া কল্পনাতীত! হলও তাই।জুইয়ের কলেজ পরিবর্তন করা হল। কাননের সঙ্গে যাতে যোগাযোগ বন্ধ হয় সেজন্যে তার মোবাইল ফোনটিও কেড়ে নেয়া হল।প্রতিদিন তার কলেজ প্রাইভেটে সঙ্গে কেউ যেতো, পাহাড়া দেয়ার জন্য।তাকে নিয়মিত বোরকা পরানো হত।দীর্ঘদিন তাদের কোন যোগাযোগ ই ছিল না। একটা দিন কানন প্রতি মুহূর্তে তার সঙ্গে মোবাইল রাখত। তার মনে হতো একদিন না একদিন জুই ফোন করবেই। মোবাইল ভাইব্রেট করলেই তার বুকের বাঁ পাশে কেমন যেন করে উঠত, এই বুঝি জুই ফোন দিয়েছে। এই কটা দিন সে একবারের জন্যেও মোবাইল চার্জ শূন্য করে নি! এমনকি সে জুইদের বাড়ির সামনের মোড়ের রেস্টুরেন্টে মাঝে মধ্যে বসে থাকতো। হয়তো জুঁইয়ের দেখা পাবে, কিন্তু একটি আরের জন্যেও দেখা হয় নি।
অন্য দিকে জুই ও কানন কে প্রচণ্ড ভাবে মিস করছিল। খাওয়া দাওয়া পড়াশোনা কোন কিছুই ঠিক ভাবে করতে পারছিল না। এক সময় অবশ্য কষ্ট কমতে লাগলো। সে যখন বুঝতে পারলো কোন ভাবেই আর কাননের সঙ্গে যোগাযোগ সম্ভব না। তখন বাধ্য হয়ে একটি চিঠি লিখলো।প্রথম চিঠিটি লেখার সময় পুরো চিঠি পানিতে ভিজে গিয়েছিল। তাই সেটি কপি করে পুনরায় লিখে। সব সময় সে চিঠিটি তার সঙ্গে রাখতো। তার বিশ্বাস একদিন হয়তো কাননের সঙ্গে দেখা হবে সে চিঠিটি দিবে।
প্রিয় k...n,
জানি এতো দিন আমার জন্যে অনেক কষ্ট পেয়েছ। প্রথমেই নিজের ইচ্ছা কিংবা অনিচ্ছায় তোমাকে দেয়া সব কষ্টের জন্য ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি।পৃথিবীতে তো প্রেম ছাড়াও অসংখ্য পবিত্র সম্পর্ক বিদ্যমান। সে সকল সম্পর্কেও হিমালয় সমান ভালোবাসা রয়েছে। আমরা কি অন্তত আমাদের পিতামাতার কথা বিবেচনা করে আমাদের সম্পর্কের লতানো গাছটিকে অন্যদিকে প্রবাহিত করতে পারি না??সারাজীবন খুব ভালো বন্ধু হয়ে থাকতে পারি না?? তোমার মত একজন বুদ্ধিমান ছেলের পক্ষে আমি কি বোঝাতে চেয়েছি বুঝতে একটুও কষ্ট হবার কথা নয়।আশা করছি তুমি সুবিবেচনায় কথাগুলো একবার ভেবে দেখবে। সবসময় ভালো থাক এই কামনায়
ইতি j.i
৬.
গত বছর এমনই এক পহেলা বৈশাখে জুইকে প্রথম দেখেছিল কানন। সাদা রংয়ের শাড়ি পরা। তার বিশ্বাস আজ হয়তো অনেক দিন পড় এখানেই জুইয়ের দেখা পাবে সে।একই জায়গায় অনেকক্ষণ ধরে অপেক্ষা করছে।অপেক্ষার প্রহর যেন শেষ হতে চাই না। সকাল গড়িয়ে দুপুর হতে চললো। কিন্তু জুইয়ের দেখা মিলল না।তাকে এখন খেতে বাসায় ফিরতে হবে, যদিও ফিরতে মন চাইছে না,হয়তো আজও কপালে জুঁইয়ের দেখা নেই।
নতুন কলেজে ভর্তি হবার পড় এই প্রথম জুঁই বাসা থেকে বোরকা ছাড়া বেরিয়েছে। গত বছর পহেলা বৈশাখের শাড়িটি পড়ে।আজকে ওর আম্মুর সঙ্গে বেড়িয়েছে। পূর্ব পরিকল্পনা মত সে দুপুরের দিকে ভীড়ের মধ্যে মায়ের সংগ থেকে পালিয়ে গেল।গিয়ে প্রথমেই রিক্সা নিয়ে কলেজে চলে গেল, যদিও সে জানতো এ জন্যে তাকে কঠিন শাস্তি পেতে হবে , কিন্তু চিঠিটি পেলে হয়তো কানন তাকে স্বার্থপর ভেবে সহজে ভুলে যেতে পারবে এই ভেবে সে কাজটি করছে, কারণ কানন কষ্ট পাক এ জিনিসটি সে চায় না। ঐ তো কানন। ছেলেটিকে দেখামাত্র জুইয়ের বুকের বা পাশে কেমন অনুভূতি হতে শুরু করল।কোন দিন অন্য কোন ছেলেকে দেখেই এমনটি হয় নি। ভিন্ন ধর্মীয় একটি ছেলেকে দেখে কেন এমনটি হবে! সে কি কাননকে চিঠিটি দিতে পারবে!নাহ ,এই ছেলেটির সান্নিধ্য ছাড়া সে বাচতে পারবে না।আল্লাহ তাকে এ ক্ষমতা দেন নি।এমনটা যখন জুই ভাবছিল ঠিক তখন হঠাৎ করে প্রচন্ড শব্দে কি যেন একটা বিস্ফোরিত হল।জুই দাড়ানো থেকে পরে গেল।তার কপালে তীব্র ব্যথা অনুভব হচ্ছে.সে কিছু বলতে কিংবা করতে পারছে না। শুধু দেখছে কানন দৌড়ে এসে তাকে তুলে ধরলো। আহ!কি অসাধারণ সে স্পর্শ...
পুনশ্চঃ পহেলা বৈশাখ তারিখে দুস্কৃতকারী দের গ্রেনেডের আঘাতে জুইয়ের মৃত্যু হয়। কানন তখন খানিকটা দূরেই ছিল। গ্রেনেডের একটি স্প্রিন্টার জুইয়ের কপালের ঠিক মাঝখানে আঘাত হেনেছিল।হঠাৎ দৃশ্য টি দেখে কাননের অতি পরিচিত জুইয়ের সাদা শাড়ি ও সিদুর পরা কল্পনার কথা মনে পরে গিয়েছিল।মাথার রক্ত এমন ভাবে পরছিল অনেকটা সিঁদুরের মত লাগছিল। সে সঙ্গে সঙ্গে দৌড়ে গিয়ে শেষ বারের মত জুইকে জড়িয়ে ধরে চিৎকার করে একটি এম্বুলেন্স কিংবা গাড়ির জন্য হেল্প বলে আহাজারি করছিল আর ভাবছিল তার এতো দিনের কল্পনার এ অসাধারণ দৃশ্যটি কেন এরকম ভাবে দেখতে হবে!এতো সুন্দর একটি দৃশ্য কি সৃষ্টিকর্তা দুজনকে এক ধর্মের কিরে পৃথিবীতে পাঠিয়ে সৃষ্টি করতে পারতেন না!!!মানুষ সাধারণত মৃত্যুর মুহূর্তে আনন্দে অভিভূত হতে পারে না, কিন্তু জুই পেরেছিল, কারণ সে তার প্রিয় মানুষটির সংস্পর্শে মৃত্যুবরণ করতে পেরেছিল।
সর্বশেষ এডিট : ২১ শে সেপ্টেম্বর, ২০১৪ রাত ৯:২২