"রেষ্টুরেন্টে একা খেতে যাবার অর্থ হল মানুষটির বন্ধু বান্ধব কেউ নেই"
এইরকম একটা কোন বইয়ে লিখা ছিল? গত কয়েক মাসে সাজ্জাদের এত বই পড়া হয়েছে মনে থাকার কথাও না। বই পড়া যে সাজ্জাদের শখ এমন না। কিন্তু কি করবে? অফিসে বেশিরভাগ সময় ওর কোন কাজ থাকে না। তাই পিসিতে কিছু গল্পের বইয়ের পিডিএফ কপি রাখা আছে সেগুলো পড়ে বসে বসে। যখন সে পড়াশোনা করত কিংবা পড়াশোনা শেষ করে বেকার ছিল তখনো এত গল্পের বই পড়ে নি। গল্পের বই তো দূরের কথা কাজের বইপত্রের সঙ্গে তার যোগাযোগ ছিল কমই। নাহলে কি আর এতদিন বেকার থাকে! কত ভাইভা দিয়েছে! কতভাবে অপমানিত হতে হয়েছে! তাও বেকারত্ব শেষমেষ নিজ যোগ্যতায় ঘুচাতে পারে নি। পুরোপুরি ভাবীর অবদান! আরেকজন চলে যাওয়াতে তার ভাবীর যখন প্রমোশন হল তখন এইচ আর ডিপার্টমেন্টে একটি পোস্ট খালি হয়ে গেল। সেখানে সাজ্জাদকে ভাবী এপ্লাই করতে বললেন। রিটেন টেস্টের কোশ্চেন টাও দিয়ে দিয়েছিলেন পরীক্ষার আগেই। তাও রিটেন পরীক্ষায় সাজ্জাদ হয়েছিল দশম! কিছু মানুষের জন্মই হয় মানুষের কাছে অপমান অপদস্হ হবার জন্যে। সাজ্জাদ যেদিন ভাইভা দিতে আসল সেদিনও অপমানিত হতে হয়েছিল। রিসিপশন রুমে সে সোফায় পায়ের উপর পা তুলে আরাম করে বসে ছিল। হঠাৎ ফ্রন্ট ডেস্কের রিসিপশনিস্ট মহিলা বলে উঠলো, "আপনি অভদ্রের মত বসেছেন কেন? এখান দিয়ে প্রায়ই আমাদের এমডি স্যার চলাচল করেন! মুর্খ কোথাকার!"
সাজ্জাদ গাধা হতে পারে কিন্তু অভদ্র ছিল না কখনোই! সেদিনের ঘটনায় তার চোখ দিয়ে পানি আসার উপক্রম হয়েছিল। সেই দুঃখ সে মনে রাখেনি কারণ এখন প্রতিদিন অফিসে প্রবেশ আর বেরোনোর সময় সে রিসিপশনিস্ট মহিলাই দাঁড়িয়ে তাকে সম্মান জানায়। এই টুকুও অবশ্য নিজ যোগ্যতায় হলে বিষয়টা গর্বের হত। ভাইবা বোর্ডে তার ভাবী উপস্থিত ছিলেন। ভাইভা বোর্ডে এজিএম একের পর এক প্রশ্ন কিছুই পারছিল ন সাজ্জাদ । শেষমেষ এজিএম স্যার ওর ভাবীকে বললেন , "ম্যাম সে তো মনে হয় পড়াশোনা তেমন করে না। আপনি দেখুন তো বেসিক কেমন"
ভাবী জিজ্ঞেস করল, "আপনার কোন সাব্জেক্ট পছন্দ? বাংলা অংক না ইংরেজি?"
সাজ্জাদ জানে যা থেকেই জিজ্ঞেস করে সে কিছুই পারবেনা। সে ইতস্তত করে বলল, "তিনিটাই"
তখন ভাবী বললেন, "আপনি যেহেতু সায়েন্সের স্টুডেন্ট অংক থেকে প্রশ্ন করি।"
ভাবী খাতায় একটি ডিফারেন্সিয়েশন করতে দিলেন। সে ভুলে করল ইন্টিগ্রেশন। পরপর চারটা অংক দিল চারটাই ভুল।
ভাবী বলল, "স্যার বেসিক তো বেশ ভাল!"
সাজ্জাদ অনেক্ষণ বিস্ময়ে অভিভূত ছিল। মেঘলা নামের এই মহিলা তাকে অনেকবার বিস্ময়ে অভিভূত করেছে, কিন্তু তার জন্য এতবড় মিথ্যা বলবে সে কল্পনা করেনি। একজন মানুষ তার প্রেমিককে এতোটা ভালবাসতে পারে সেটা সাজ্জাদের জানা ছিল না, ভাবীকে দেখে জেনেছে! ভাবী ভাইয়া দুইজন যখন একসঙ্গে ভার্সিটি থেকে পাশ করল তখন সাজ্জাদের ভাইয়া সালামের ফ্যামিলি সাপোর্ট ছাড়া মেসে ভাড়া করে থেকে নিজের খরচ চালানোর জন্য চাকরি ছাড়া উপায় ছিল না! তখন মেঘলা যা করেছে সত্যিই বিস্ময়কর! মেঘলা একটি প্রাইভেট চাকরি করত। তার অর্ধেক টাকা সাজ্জাদকে দিত। শর্ত ছিল সাজ্জাদ বেসরকারি চাকরি না করে শুধুমাত্র বসে বসে পড়াশোনা করে বিসিএস দিবে, বড় চাকরি না করলে যে মেঘলার বাসায় বিয়ে দিতে রাজি হবেনা। মেঘলা প্রতিদিন বাসা থেকে সকাল ৬ টায় অফিসের জন্য বের হয়ে রাত আটটায় ফেরত। পরিশ্রম অবশ্য বৃথা যায় নি। সালাম এখন ডিসি! এত বড় পদে থেকেও তিনি সাজ্জাদের জন্য একটি চাকরির ব্যবস্থা করতে পারেন নি! যেদিন সাজ্জাদ প্রথম বেতন পায় সেদিন আবেগে চোখে জল আসার মত খুশি হয়েছিল। কাছাকাছি বয়সী না হলে সেদিন সাজ্জাদ ভাবীর পা ছুঁয়ে সালাম করত। অবশ্য তার চেয়ে বেশি খুশি লেগেছিল যেদিন সে দেখল সাজ্জাদের অধীনে রেহনুমা জয়েন করেছিল। বেকার অবস্থায় তাকে ইন্টারভিউ তে যারা সবচেয়ে অপমান করেছিল তাদের একজন রেহনুমা! রেহনুমার তখনকার অর্গানাইজেশনে যখন সাজ্জাদ ভাইভা দিয়ে বের হয়ে যাচ্ছিল তখন রেহনুমা সাজ্জাদকে শুনিয়েই ভাইভা বোর্ডের বাকিদের বলছিল "কিছুই ত পারে না। বেশি বোকাসোকা, একেবারেই স্মার্ট না"
অবশ্য সাজ্জাদ যে এখন এত কাজহীন থাকে অফিসে তার কারণ এই রেহনুমাই তার অধিকাংশ কাজ করে দেয়। সাজ্জাদ সময় কাটানোর জন্য বসে বসে পিসিতে বই পড়ে। বই পড়া ছাড়াও আরেকটি কাজ সে করে প্রায়ই। সেটা হচ্ছে ফেইসবুক ব্রাউজিং। অবশ্য নিজের আইডি তে না। পিসিতে একদিন ব্রাউজারে ফেইসবুকে যেতেই দেখে তার ভাবীর আইডিতে লগ ইন করা! আগে সে পিসিতে তার ভাবী ছিল তাই সম্ভবত লগ আউট করতে ভুলে গিয়েছে এবং সেখানে রিমেমবার পাসওয়ার্ড দেয়া! ফেইসবুক লগ ইন দেয়ার সময় ভাবীর মেইল লিখলেই অটো পাসওয়ার্ড চলে আসে। সাজ্জাদ প্রায়ই ভাবীর ফেইসবুকে লগ ইন করে চ্যাটিং দেখে। এক ধরনের অদ্ভুত ফ্যান্টাসি! ভাবীর সবচেয়ে বেশি কনভার্সেশন একটি মেয়ের সাথে প্রায় এক লাখ ম্যাসেজ। বান্ধবী হবে বোধহয়! তারপর সালাম ও বাকি আত্নীয়দের সাথে! জীবনে মেয়েদের সঙ্গে খুব কম মেশার কারণে একটা মেয়ে আরেকটি মেয়ের সঙ্গে কি কথা বলে তা জানার খুব শখ সাজ্জাদের। সে ফ্যান্টাসি থেকে প্রতিদিনের ঐ মেয়ের সঙ্গে ভাবীর কনভার্সেশন দেখে সাজ্জাদ! গতকালের কনভার্সেশন ছিলো তারা দুজন দেখা করবে তা নিয়ে। সেদিন প্রথম ম্যাসেজ ছিল ভাবীর বান্ধবীর
-কি অবস্থা মাই ডিয়ার?
-ভাল, তোমার?
-এজ অলওয়েজ! মাইগ্রেনের ব্যাথা কমেছে? আমি রাতে ফোন দিতে গিয়েও দেই নি। অনেক রাত হয়ে গিয়েছিল তো!
-হ্যাঁ কমেছে! আর যতটুকু খোঁজ নিয়েছ ততটুকুই কে নেয়?
-ডিসি সাহেবের কি খবর?
-তিনি তো ভীষণ ব্যাস্ত। অনেক প্ল্যান করেও শেষমেষ বাতিল হয় উনার ইমার্জেন্সি কাজ পরে যায়। তা তোমার ডাক্তার কেমন আছে?
-গত সপ্তাহে তার নাইট ডিউটি ছিল। পুরো সপ্তাহে তো দেখাই হয়নি। এ সপ্তাহে অবশ্য ডে।
-ওহ! আচ্ছা ও তোমার ফেইসবুক কখনো চেক করে না?
-না ওর আমার প্রতি এত মনযোগ নেই। তোমার উনি করে?
-হ্যাঁ করে। প্রায়ই।
-আমার ম্যাসেজ দেখে কিছু জিজ্ঞেস করে না?
-নাহ। স্বামীদের অদ্ভুত স্বভাব, যদি তাকে বউয়ের পাসওয়ার্ড দেয়া হয় সে কখনো মেয়েদের সঙ্গে তার স্ত্রী কি চ্যাটিং করছে চেক করেনা।
-হা হা।
-আমার না তোমার সঙ্গে প্রচন্ড দেখা করতে ইচ্ছে হচ্ছে! অনেকদিন দেখা হয় না। মন খুলে কথা বলব অনেক সময় নিয়ে শুনবে এমন তুমি ছাড়া কে আছে? অনেকদিন দেখা হয় না কাল মিট করবা? সামনাসামনি অনেক কথা বলব
-আচ্ছা কাল, ১ টায়। সীমান্ত রেষ্টুরেন্টের ১৩ নম্বর টেবিলে!
-হা হা। তোমার জন্য সবসময় ঐ টেবিল খালি থাকবে মনে হয়!
-থাকবে থাকবে।
সাজ্জাদের ভাবীর জন্য খারাপ লাগছে। সত্যিই ভাইয়া চাকরিতে জয়েন করার পর থেকে একেবারেই সময় দিতে পারে না। তার খুব জানতে ইচ্ছে করছে বান্ধবীকে সামনাসামনি কি বলবে যা ইনবক্সে বলা যায় না। কোইন্সিডেন্স হচ্ছে সীমান্ত রেষ্টুরেন্ট সাজ্জাদের বন্ধু সুমনের। বলতে গেলে এই বন্ধুই তার সবচেয়ে কাছের।
সাজ্জাদ এখন সীমান্ত রেষ্টুরেন্টের ১৩ নম্বর সিটে একা একা বসে আছে। রেষ্টুরেন্টে একা বসে থাকা বিষয়ক উক্তির রহস্য অর্ধেক সমাধান হয়েছে, এটি হুমায়ূন আহমেদের কোন বইয়ের লিখা। আশা করা যায় কিছুক্ষণের মাঝে বইয়ের নাম ও মনে আসবে। তবে এতক্ষণ সময় নেই। এক ঘন্টার মধ্যে এখানে তার ভাবীর বান্ধবীকে নিয়ে আসার কথা। সে তার কাজ ইতোমধ্যে সেড়ে ফেলেছে। টেবিলের নিচে একটা টেপ রেকর্ডার স্কচটেপ দিয়ে আটকে দিয়েছে!
আজও অফিসে শর্ট লিভ শেষে আজও অফিসে প্রবেশের সময় রিসিপশনিস্ট মহিলা দাঁড়িয়ে সাজ্জাদকে সম্মান জানালো, বরাবরের মত অনুভূতি! ডেস্কে যেতেই দেখে রেহনুমা! সাজ্জাদ বলল, "অনেক্ষণ থেকে ওয়েইট করছেন নাকি? আমার তো এখন একটু কাজ আছে! আপনি প্লীজ পরে আসেন।"
-জ্বি স্যার।
কাজ বলতে সাজ্জাদ এখন টেপ রেকর্ডারের কথাগুলো শুনবে। ওয়েইটারকে অর্ডার দেয়া কথাগুলো টেনে টেনে সাজ্জাদ প্রচন্ড বিস্ময় নিয়ে দুজনের কথাবার্তা শুনছে। শেষ পর্যায়ের কথাগুলো ছিল এমন
-আজ বাসায় যাবা?
-কেন তোমার ডাক্তার বাসায় নেই?
-বললাম না ওর ডে চলছে এখন?
-আচ্ছা চল। এই শোন
-বল
-তুমি কখনো তোমার অরিজিনাল আইডি থেকে আমাকে ম্যাসেজ দিও না। সালাম দেখলে ভীষণ কষ্ট পাবে। আমি ওকে অনেক ভালবাসি। কখনো তাকে কষ্ট দিতে পারব না ………