১.
তন্বী হাসিবের উপর রেগে মোবাইল ডাটা অফ করে রেখেছে। তবে এ রাগের মধ্যে ভালবাসা মেশানো। একটু আগে ঝগড়া করে এখন মোবাইল সাইলেন্ট করে বসে বসে টিভিতে হিন্দি গান দেখছে। ভালবাসাবাসির সময়ে নাকি অতি তুচ্ছ কারণে ঝগড়া হয়। আজকের ঝগড়ার কারণটাও তুচ্ছ! হাসিব চ্যাটিংয়ের এক পর্যায়ে জিজ্ঞেস করল, আংকেলের পেট অনেক মোটা তাইনা?
তন্বী অবাক হয়ে বলল, "তুমি তো আব্বুকে দেখনি, কিভাবে জানলে?"
হাসিব উত্তর দিল, "ঘুষের টাকা পেট বড় করে :প"
তন্বী জানে হাসিব ফান করেছে, ও সবসময়েই ফান করে। কিন্তু তাতেও রাগ দেখিয়েছে। কারণ তন্বীর প্রচন্ড টেনশন হচ্ছে।পাত্র পক্ষ যখন কনেকে দেখতে আসে তখন সব মেয়েরই কি এমন হয়? হাসিবকে তন্বী চিনে প্রায় তিনবছর ধরে। তন্বীর ফ্রেন্ডলিস্টের কেউ একজন হাসিবের স্ট্যাটাস শেয়ার করেছিল। স্ট্যাটাস পড়ে এতোটাই ভাল লেগেছিল তন্বীর মনে হয় ছেলেটি বোধহয় তন্বীর নিজের মনের কথাগুলো গুছিয়ে লিখেছে। হাসিবের টাইমলাইনের অনেকগুলো লেখা তন্বীর ভীষণ পছন্দ হয়। তাকে ফলো দিয়ে রাখে। এরপর থেকে প্রতিবার ফেইসবুকে লগ ইন করলেই হাসিবের টাইমলাইন এ গিয়ে তার পোস্ট গুলো মুগ্ধ হয়ে পড়ত। একদিন হাসিবের আইডিতে গিয়ে ওর পোস্টের কমেন্ট গুলো পড়ছিল। বিভিন্ন মেয়েদের কমেন্ট দেখে তন্বীর প্রচন্ড রাগ হচ্ছিল যদিও তা হওয়া উচিৎ ছিল না! সে মনে মনে ভাবছিল এই মেয়েগুলোর লজ্জা নেই? একটা ছেলের পোস্টে এসে এত কমেন্ট করতে হবে কেন! কি জানি মনে করে তন্বী সিদ্ধান্ত নিল হাসিবকে ফ্রেন্ড রিকুয়েস্ট দিবে, যদিও সে কোনদিনই কোন ছেলেকে রিকুয়েস্ট দেয়নি। তাই দ্বিধাদ্বন্দ্বে ভুগছিল। রিকুয়েস্ট দিতে তন্বী হাসিবের টাইমলাইন এ গেল ঠিক তখন দেখে একটা ফ্রেন্ড রিকুয়েস্ট এসেছে। সেখানে ক্লিক করে সে তার চোখকে বিশ্বাস করতে পারেনি,রিকুয়েস্ট দেয়া ব্যক্তিটি হাসিব! উত্তেজিত হয়ে কাঁপা কাঁপা হাতে রিকুয়েস্ট একসেপ্ট করে সে নিজেই হাসিবকে নক দিয়েছিল। তারপর থেকে প্রতিদিন কথা হত, ছেলেটার কথায় কি জানি কি একটা ছিল! প্রতিদিন তন্বী হাসিবের ম্যাসেজের জন্য অপেক্ষা করত, প্রতিদিন খুনসুটি হত। এভাবে এক সময়ে এসে ইনিয়ে বিনিয়ে হাসিব ভালবাসার কথা বলত, তন্বী আব্বুর কথা ভেবে প্রতিবারই কথা কাটিয়ে যেত। দিনটি ছিল ভালবাসা দিবস। চ্যাটিংয়ের মাঝেখানে তন্বী হাসিবকে ম্যাসেজ দিল, "আপনি নামাজ পড়েন না?"
-'পড়ি, মাঝেমধ্যে'
-"চলেন না আজ একই সময়ে দুইজন মাগরিবের নামাজ পড়ি?"
-'আমি এখন শুয়ে আছি, ওযু করতে ইচ্ছে করছেনা'
-"প্লীজ একটু কষ্ট করে যান না"
-'যাব না বোধহয়, ভাল্লাগছেনা।'
-"ও ও ও! আমি ওযু করতে গেলাম"
নামাজ পড়ে তন্বী আবার ম্যাসেজ দিল, "পড়লেই পারতেন"
-'আপনি আমি চাইলেও এক টাইমে মাগরিবের নামাজ পড়া হবেনা। কারণ দুই এলাকায় নামাজের টাইমে ৭ মিনিট ব্যবধান। আমার হাত কেটে গেছে।'
-"স্যাভলন দিন।"
-'নেই'
-"আশেপাশে মাকরসার ঝাল থাকলে সেটা মুড়ে দিন। ভাল লাগবে"
-'পারবনা।'
-"আচ্ছা কিছু মনে না করলে আঙ্গুল কতটুকু কেটেছে একটা ছবি দিবেন"
-'এই যে'
-"অনেকটাই কেটেছে, কিভাবে কাটলো?"
-'তাড়াহুড়ো করে ওযু করে বেরুতে গিয়ে সিটকানি লেগে কেটে গেছে'
-"তারে মানে কি! আপনি নামাজ পড়েছেন?"
-'নাহলে ওযু করলাম কেন?'
এইটা এমন কি ম্যাসেজ ছিল, যে তন্বীর চোখ গড়িয়ে টপটপ করে পানি পরছিল? গায়ে কাটা দিয়ে উঠেছিল! সে অনেক্ষণ কিছু লিখতে পারে নি। খানিক পরে হাসিবের ম্যাসেজ,
-'কি হল?'
মোবাইলে পড়ে থাকা চোখের পানি মুছে তন্বী বলল, "কিছু না"
-'একটা কথা ছিল'
-"বলে ফেলেন"
-'ভালবাসি'
তন্বীর ঘোর পুরোপুরি তখনো কাটেনি। ক্লাসশেষে বান্ধবী চটপটি খেতে বললেও যে তন্বী বাবার কথা ভেবে দেরী হয়ে যাবে এই ভয়ে খেত না সে তন্বীর ব্রেইন সম্ভবত এক মুহুর্তের জন্য থেমে গিয়েছিল। সে জবাবে বলেছিল, "আচ্ছা"
২.
সারারাত নানা চিন্তায় তন্বীর এক ফোঁটাও ঘুম হয়নি, আজ তাকে দেখতে আসবে ঘুমানো উচিৎ ছিল। প্রচন্ড মাথা ধরেছে। ভোর হতেই সে রান্নাঘরে যাবে চা বানাতে সেখানে আব্বুকে দেখে হকচকিয়ে গেল। চশমার ফাঁক দিয়ে তাকিয়ে বললেন "এত ভোরে এখানে কি?"
তন্বী ঢোগ গিলতে গিলতে বলল,
-"টয়লেটে যাব আব্বু"
--"চোখ ফুলে লাল হয়ে আছে কেন?"
-"ঘুম থেকে উঠেছি তো তাই"
--"গিয়ে আবার ঘুমিয়ে নিও"
বুকে থুথু ছিটিয়ে তন্বী আবার রুমে ফিরে গেল। শুয়ে শুয়ে সে চিন্তা করছে। সে কোনদিন কল্পনাও করতে পারেনি আব্বুকে হাসিবের কথা বলতে পারবে। হুট করে একদিন আব্বু অফিস থেকে দ্রুত চলে এলেন।ড্রয়িং রুমে তন্বী আর ওর আম্মুকে ডেকে বললেন, "আমাদের এখানকার মেজিস্ট্রেট সেদিন যাকে বাসায় খেতে বলেছিলাম তন্বীকে পছন্দ করেছে। তোমরা কি করবে ভেবে দেখ।"
কথা শুনে তন্বীর কান মাথা হুট করে গরম হয়ে গেল। হঠাৎ মনে হচ্ছিল চারপাশ ঘুরছে। সে বিছানা থেকে উঠে তার রুমে যাবে কিন্তু কিছুতেই দরজা খুঁজে পাচ্ছিল না। তারপর আর কিছু তন্বীর মনে নেই। জ্ঞান ফেরার পরে সে তাকে বিছানায় আবিষ্কার করল। হাতে স্যালাইন লাগানো। পরবর্তী সাক্ষাতে আব্বু তাকে একটি কথাই বলেছিল "ছেলের ফ্যামিলিকে আসতে বল"।
৩.
তন্বীর হাত প্রচন্ড কাঁপছে। কিছুতেই কপালের মধ্যিখানে টিপ দিতে পারছেনা। হাত কাঁপা রোগটি তন্বীর নতুন না। অতি উত্তেজনায় সবসময় তার হাত কাঁপে।দ্বিতীয়বার মেডিকেল ভর্তি পরিক্ষায় হঠাৎ সে আবিষ্কার করে সময় বাকি ১০ মিনিট। তার আরো ৪৫ টা এমসিকিউ দাগানো বাকি। শুরু হল হাত কাঁপাকাঁপি রোগ। একটা বৃত্ত ভরাট করবে কলম এপাশ ওপাশে সরে যাচ্ছে। কিছুতেই ঠিকভাবে পারা যাচ্ছেনা।অনেকগুলো পারা এমসিকিউ ভুল করে বসল কাঁপাকাঁপিতে। কোচিংয়ে পড়ার সময়ে নামের আগে ডাক্তার লাগিয়ে লিখলেও শেষমেষ সে সরকারি মেডিকেলে চান্স পায় নি। আব্বু তার ইচ্ছে অপূর্ণ রাখেন নি। প্রাইভেট মেডিকেলে পড়িয়েছে।
"এখন ঠিক আছে?" টিপ পড়িয়ে দিয়ে ছোটবোন বন্বী জিজ্ঞেস করল।
শেষ পর্যন্ত তন্বী নিজের হাতে টিপ পরতে পারেনি। বন্বী মাথায় টিপ দিয়ে দিয়েছে। দেয়া শেষ হওয়া মাত্র ড্রয়িংরুম থেকে আম্মুর চিৎকারের আওয়াজ আসল। দুইবোন দৌড়ে ড্রয়িংরুমে যেতেই দেখে আব্বুকে সোফায় চোখবন্ধ করে শুয়ে রয়েছে। এক হাত বুকে চাপানো! মা প্রচন্ড চিৎকার করে কাঁদছে।
৪.
চোখ খুলতেই আক্তার সাহেব নিজেকে হাসপাতালে আবিষ্কার করলেন। কিভাবে এসেছেন কিছুই মনে নেই। সামনে ডাক্তার যামান দাঁড়িয়ে! তিনি সম্ভবত জ্ঞান ফিরতে দেখে দরজায় সবাইকে ডাকতে যাচ্ছিলেন। হাত ইশারায় আক্তার সাহেব তাকে থামিয়ে দিলেন। কাছে ডেকে জিজ্ঞেস করলেন,
--"কি হয়েছিল আমার?"
:'ছোটখাটো একটা স্ট্রোক, টেনশনের কিছু নেই। বড় কোন ক্ষতি হবেনা ইনশাল্লাহ, সবাইকে ডাক দেই?'
--"না বোস। তোমাকে একটা গল্প বলব।"
:'তুমি পুরোপুরি সুস্থ নও। এখন গল্প বলতে হবেনা।'
--"তাও বলব"
:'বল'
--"একবার আমি ট্রেইন থেকে পিচ্চি জসিমকে গ্রেফতার করেছিলাম মনে আছে? পেপারে সেটা নিয়ে খবর আসল?"
:'হ্যাঁ, তিন বছর আগের ঘটনা। এখন এসব বোলছ কেন?'
--"সেবার খবর পেলাম সে ফার্স্টক্লাসে করে ফেণী থেকে ঢাকা যাবে। আমি সিভিল পোশাকে স্টেশনে বসে। পাশের সিটে একটি মেয়ে বসা। তন্বীর বয়সী, চোখেমুখে উৎকন্ঠা! এক ধরণের ভয়। এমন সময় ঘেমেঘেটে অস্থির একটা লোক এসে ওকে বলল, "অনেক কষ্টে একটা শোভন চেয়ার টিকিট ম্যানেজ করলাম রে মা"
-এত কষ্ট করার কি দরকার ছিল?
-"নারে মা, লম্বা লাইনে দাঁড়িয়েও টিকিট পাই নি। শেষে কিছু টাকা ঘোষ দিতে হল"
-আচ্ছা বাবা ঐ ব্যাগটা কি আমাদের?
-"রাগ করিস না। তোর মা চিংড়ি দিয়ে ঝিঙ্গে রেঁধে দিয়েছে।নাহলে তুই গিয়ে সঙ্গে সঙ্গে কি খাবি? আর সাথে এক বয়াম আঁচার আর আমসত্ত্ব ও দিয়েছে"
-আমি বললাম কিছু নিব না। তোমরা সবসময় বেশি বেশি কর।
-"মা না ভাল। অমন করিস না"
-বাবা ৮:৪৫ বাজে। নয়টায় তোমার প্রেশারের ঔষধ খেতে হবে। বাসায় যাও।
-"নারে মা, ট্রেইনে তোকে তুলে পাশেরজনকে খেয়াল রাখতে না বলা পর্যন্ত আমি যেতে পারব না"
-বাবা তুমি যদি না যাও আমি নিজেই বাড়িতে চলে যাব
বাধ্য হয়ে লোকটা চলে যাচ্ছিল। মেয়েটির চোখ দেখলাম চকচক করছে। ট্রেইন যথা সময়ে ছাড়লো। রাত একটায় আমি পেছনে পুলিশ নিয়ে পিচ্চি জসিমেরে খোঁজে একটি করে কেবিন কামড়া গুলো চেক করছি।
অনেক ধাক্কাধাক্কির পরও একটি কেবিনের দরজা খুলছিল না। আমি পেছনে ফোর্স নিয়ে দরজা বাইরে থেকে খোলার সিদ্ধান্ত নিতেই ভেতর থেকে শার্টের বোতাম লাগাতে লাগাতে একটি ছেলে দরজা খুলল। আমি ধাক্কা দিয়ে ভেতরে ঢুকেই দেখি প্ল্যাটফর্মের সেই মেয়েটি ভেতরে একা! মাথার চুল এলোমেলো!"
:'এই সময়ে একথা বলার মানে কি?'
--"কারণ ঐ বোতাম পড়া ছেলেটি ছিল কে জান?"
:'কে?'
--"হাসিব"
সর্বশেষ এডিট : ০১ লা আগস্ট, ২০১৬ রাত ১১:৫৮