আজ আমার বিয়ের দিন। বিয়ে শব্দটার সাথে পরিচয় খুব ছোটবেলায়। তখন আমার কাছে কারও বিয়ে মানেই ঈদ ছাড়া আনন্দের উপলক্ষ। একটি বাড়িতে অনেক বড় একটি গেইট টানানো হবে, মরিচ বাতি জ্বলবে নিভবে!, বিয়ের আগেরদিন বাড়ির তরুণরা উচ্চস্বরে গান বাজানোর চেষ্টা করবে, যদিও বেশিরভাগ সময়েই সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগবে কোন গান ছেড়ে কোনটা ছাড়া উচিৎ, মাঝেমধ্যে একজনের চালানো গান আরেকজন এসে পরিবর্তন করে দেয়, তাই সব গান শোনা যায় এক কলি থেকে দুই কলি, কোনটার শুরুর বাজনা শুনেই শেষ। বিয়ের দিনের দৃশ্য আরো সুন্দর! দুপুর থেকে একদল মানুষ চকচকে কাপড় পরে হাতে কলসি ধরণের কোন তৈজসপত্র কিংবা চকচকে কাগজে মোড়ানো একটি প্যাকেট নিয়ে হাজির হবে এবং কিছু একটা দিয়ে দাঁত খুঁচাতে খুঁচাতে ফেরত যাবে! ছোটবেলায় একবার স্কুল থেকে ফেরার পথে দেখলাম আমাদের বাড়ি থেকে একটু দূরের এক বাড়িতে বিয়ের অনুষ্ঠানে। বাসায় ফিরে আম্মাকে বললাম, "ওদের বিয়াতে কি উপহার দিবা?"
তিনি জানালেন, "ওরা ত আমাদের দাওয়াত দিসে না"
প্রচণ্ড অভিমানের সুরে বলেছিলাম, "আমাদের বিয়েতেও ওদের দাওয়াত দিব না"
আনন্দময় বিয়েও যে কারও কারও জন্য কষ্টের হতে পারে সেটি প্রথম টের পেয়েছিলাম রুপাপুর বিয়ের দিন। এই প্রথম খুব কাছের আত্নীয় কারও বিয়ে হচ্ছে, আমার আনন্দের সীমা নেই। কি করব তা বুঝতে না পেরে রুপাপুর রুমের জানালা দিয়ে উঁকি দিতে গিয়েছিলাম বউ সাজানো দেখার জন্য। কিন্তু জানালার কাছে গিয়ে শুনি কান্নার আওয়াজ! লুকিয়ে লুকিয়ে শোনার চেষ্টা করলাম কি হচ্ছে! যা শুনেছিলাম তার সারমর্ম, শুধুমাত্র খালা খালুর অবাধ্য হবার সাহস নেই বলে রুপাপু এত বয়সী একটি লোককে বিয়ে করতে রাজী হয়েছিল। রুপাপুর কান্না সেদিন আমাকে প্রচন্ড নাড়া দিয়েছে। যদিও ছোট ছিলাম তাও সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম জীবনে কোনদিন অনেক বেশি ব্যবধানে বিয়ে করব না। হ্যাঁ, প্রতিজ্ঞা মেনে আমি কাছাকাছি বয়সের একটি মেয়ের প্রেমে পড়ি। প্রেমে পরার পেছনে খুব বড় কোন কারণ ছিল না। একদিন বৃষ্টিতে কাকভেজা হয়ে ডিপার্টমেন্টের বারান্দায় কোন রকম দৌড়ে পৌঁছে খাতা থেকে কাগজ ছিড়ে মাথা মুছছি তখন পেছনে থেকে একটা মেয়ে খুব আবেগ নিয়ে বলল, "আমার ছাতাটা খুলতে পারছিনা, একটু খুলে দেন না।"
হয়তো সেখানে আর কেউ না থাকায় আমাকে বলেছিল কিন্তু এক মুহুর্তের জন্য কেমন জানি এক অনুভূতি হয়েছিল! তারপর থেকে প্রায়ই মেয়েটির চোখের সামনে পড়তাম। কখনো কিছু সাহস করে বলি নি। মাঝেমধ্যে কোন এক অজানা কারণে রিক্সা দিয়ে ওর রিক্সাকে ফলো করতাম। প্রতিদিন রুটিনে দেখতাম ওদের ক্লাস কখন, প্রথম ক্লাসের আগে যত কাজই থাকুক ভার্সিটির গেইটে দাঁড়িয়ে থাকতাম, মনে হত কোন একদিন সে এসে ঐদিনের ছাতা খুলে দেয়ার জন্য পাওনা ধন্যবাদটা দিবে। দিলে জবাবে কি বলব তাও চিন্তা করে রেখেছিলাম। সেদিনটি সত্যিই এসেছিল, তবে অন্যভাবে! একদিন এসে বলল, "আমার কাছে তো ভাংতি টাকা নাই, ভাড়াটা দিয়ে দেন"
আমি বললাম, -'তুমি কি এবার রেজিস্ট্রেশন কর নি?'
:"করব না কেন?
-'রাইসা নামে কারও এডমিট কার্ড দেখিনি'
:"ওহ আচ্ছা। তা আমার এডমিট কার্ড খুঁজেন কেন?"
-'ইচ্ছা হয়েছে তাই'
:"কেন ইচ্ছা হয়েছে?"
-'এতো প্রশ্নের উত্তর জানা নাই'
:"তাহলে কি আমি বুঝে নিব কিছু?"
-'কি বুঝে নিবা?'
:"আপনাকে কেন বলব। যা বুঝার বুঝছি"
-'ভাল হইসে, তোমার বোঝা নিয়া তুমি থাক'
:"আমাকে এত সার্চ করেন আপনি। আল্লাহ"
-'আসলে এডমিট কার্ডে তোমার ছবি দেখার জন্য'
:"ছবি কেন"
-'এম্নি এম্নি'
-"পিক কাকে দেখাবেন?"
-'কাকে দেখানোর ইচ্ছে থাকলে ত ছবি চাইতাম'
:"তাহলে কেন দেখবেন বলেন"
-'আমার ইচ্ছে হইসে আমি দেখব'
:"কাহিনী কি"
-'কাহিনী বললে বলবেন ফ্লার্ট করতেসি'
:"তাই বলব না।বলেন প্লিজ"
-'পারব না
:"বলেন"
-'বললাম ত না'
:"কাহিনী কি??? আমার পিক কেন খুঁজেন?"
-'পরে এই কাহিনী নিয়ে হাসাহাসি করবা'
:"জ্বী না।"
-'আচ্ছা তুমি রাগ করলে আর খুঁজব না।:
:"এটা রাগের কিসুনা"
-'তাহলে এত প্রশ্ন কেন'
:"ওকে সরি"
-'কেন?'
:"এত প্রশ্ন করার জন্য"
-'আমার আসলে প্রশ্ন করাতে ভাল লেগেছে, তোমার সঙ্গে কথা বলতে পেরেছি'
:হ্যাঁ, তাই তো বলি ভাল ছাত্র কেন আমার জন্য দাঁড়িয়ে থাকে।"
-'ধ্যাত্'
:"রাগ ও আছে দেখি"
-'সিজিপিএ দেখলে বোঝা যায়'
:"হইসে থামেন, আজাইরা যুক্তি"
-'এহ। অবশ্যই ঠিক যুক্তি!'
:"আচ্ছা আমার ক্লাস আছে, যাই! আমার নাম কাগজপত্রে ইসরাত জাহান"
তারপর অনেকদিন দেখা হয়নি। লজ্জায় আর দাঁড়িয়ে থাকতাম না। একদিন রাতে পড়তে বসছি, হঠাৎ খাতা খুলে যা দেখেছি আমি কল্পনাতেও এতদূর ভাবিনি। ওর একটা লাল শাড়ি পরা একটা ছবি। আমার কাছে মনে হয়েছে এরকম ছবি দেখার জন্য চোখবন্ধ করে যুদ্ধে যাওয়া যায়। সারারাত আমার এক ফোঁটাও ঘুম হয়নি। ঐ খাতা খুলে ওর ছবি দেখি কিছুক্ষণ পর পর।
পরেরদিন ক্লাস থেকে বের হয়েছি এম্নিতেই ও বলল, "দেখছেন ছবি?"
-'আমি কিন্তু খাতা থেকে বের করি নি, বারবার খাতা খুলে দেখব!'
:"আচ্ছা দেখেন। আমার বিয়ের ছবি দিব কয়দিন পর। ওইগুলা দেখার আমন্ত্রণ রইল"
কিছুক্ষণ পর নিরবতা ভেংগে ও আবার বলল, "চুপ কেন?"
-'বিয়ে হয়ে গেলে বলবা, তখন বলব কেন দাঁড়িয়ে থাকতাম আর এডমিট কার্ডে ছবি খুঁজতাম'
:"এত ভীতু কেন আপনি?"
-'কেন কি করেছি'
:"কিছু না যাব এখন।"
যেদিন অফিস থেকে ফেরার সময় ওর সঙ্গে দেখা হয়েছিল সেদিনও বৃষ্টি ছিল। আমি অফিস থেকে নেমেছি এম্নিতেই রিক্সা থেকে বলল, "রিক্সায় উঠেন।"
-'কোথায় যাব?'
:"কাজী অফিসে"
যতদূর মনে পরে কাছের কোন আত্নীয় ছাড়া সমবয়সী কোন মেয়ের সাথে সেটিই প্রথম রিক্সায় চড়া। বৃষ্টিতে রিক্সার হুড তুলে দেয়াতে আমার গা ঘেঁষে ও বসেছে, আমি সরে যেতে চাইলে সে আরো চেপে বসে, ওর কনুইয়ের স্পর্শ পাচ্ছে আমার কনুই, এক মুহুর্তের জন্য মনে হয়েছিল জীবনটা কি উপভোগ্য! আমাকে আরো একটিবার মুগ্ধ করে দিয়ে ও সত্যি সত্যি একটা কাজী অফিসের সামনে রিক্সা থামালো। অফিসের বিপরীত পাশের একটু রেষ্টুরেন্টে গেলাম আমরা। প্রতিবারের মত নিরবতা ভেঙ্গে ও বলল, "জানেন আমার না বিয়ে ঠিক হয়ে গিয়েছে"
জীবনে অনেক বড় ধাক্কা খেয়েছি আমি, যখন শেষ সেমিস্টারে একটি কোর্সে ফেইল করি কিংবা বিয়ের প্রথম সাপ্তাহে দুলাভাই মারা যান সেগুলো তার প্রথম দিকে থাকবে, তবে ওর এই কথাটির ভার এতটুকু হবে পূর্বে আঁচ করতে পারি নি! স্বাভাবিক হবার চেষ্টা করে বললাম, 'ও তাই, ভালতো'
:"আপনি জিজ্ঞেস করলেন না যে কাজী অফিসে কেন এসেছি? "
-'কেন এসেছি?'
:"কাজী অফিসটি আমার জন্য স্মরণীয়, আমার বান্ধবী বাসা থেকে ব্যাগ গুছিয়ে একেবারে চলে এখানে এসেছিল পালিয়ে বিয়ে করবে বলে। আমি সাক্ষী হিসেবে এসেছিলাম! সারাদিন দাঁড়িয়ে থাকলাম ছেলেটি আসে নি। আমার বান্ধবী তখন খুব শান্ত ভাবে বাড়ি ফিরে যায়। তারপর দিন তার ঘরে ওর লাশ পাওয়া যায়। ওর ঘরে যে ঘুমের বরির পাতা পাওয়া গিয়েছিল সেটা দেখবেন?"
-'তুমি কি এগুলো সঙ্গে নিয়ে ঘোর নাকি?'
:"না, গতকাল কিনেছি। ফার্মেসিকে মিথ্যা বলে। তাও দিতে চায় না। ছয়টা দোকান ঘুরে সপ্তম দোকানে পটাতে পেরেছি।"
তারপর থেকে ঠিক এক বছর আমার সবসময়কার হাসিখুশি মুখ অনেকখানি মলিন হয়ে গিয়েছিল। মানুষের জীবনে কঠিন পরীক্ষা আসে। আমার পরীক্ষা কতোটা কঠিন ছিল সেটাকি সে জানে? এ সমাজে সবচেয়ে কঠিন কাজের একটি বিধবা মেয়েকে বিয়ে দেয়া। একমাত্র বড়বোনের বিয়ে হচ্ছে না, একটি কোর্সের জন্য ভার্সিটিতে আটকে গিয়েছি সঙ্গে ছোট একটা চাকরি যা দিয়ে বিয়ে করে সংসার চালানোর চিন্তা দিবাস্বপ্ন! তারপর থেকে প্রতিদিন আমি সে কাজী অফিসের বিপরীতের রেষ্টুরেন্টে যাই। বসে এক কাপ চা খাই আর ভাবি ইশ আমি যদি খুব সাহসী হতাম। আমি কতোটা ভীতু বুঝতে পারি যখন শুনি সত্যিই ওর বিয়ে হয়ে গিয়েছে। আমি একদিন ও আর ভার্সিটিতে যাবার সাহস করি নি। ওকে দেখলে খুব কষ্ট পাব এই ভয়ে! তখন দিনে একবার খাই। এমন না যে ক্ষুধা নেই, কিন্তু খাবার সময় মনে হত গলা দিয়ে খাবার নামানোর মত কঠিন কাজ পৃথিবীতে আর একটিও নেই। আস্তে আস্তে খাওয়া দাওয়া স্বাভাবিক হল কিন্তু কষ্ট পুরোপুরি কমে নি। প্রায়ই মাঝরাতে ঘুম ভেংগে যেত দু:স্বপ্ন দেখে। খাতা খুলে ওর ছবিটি দেখি আর চোখ দিয়ে টপটপ করে পানি পরে। একসময় আপুর আবার বিয়ে হয়ে যায়। সার্টিফিকেট পেয়ে আমিও একটা চলার মত চাকরিতে থিতু হয়ে যাই। তখন বিয়ে না করে সারাজীবন থাকব এমন একটিবারও মনে হয়নি তাও কোন পাত্রী দেখতে গেলে ওর কথা মনে হয়ে কোন একটা কারণ দেখিয়ে বিয়ে ক্যন্সেল করে দিতাম। মা অসুস্থ হয়ে যায়। উনার নাকি শেষ ইচ্ছে আমার বিয়ে দিয়ে যাবেন! আমার বয়স ও ত্রিশ পেরিয়ে গিয়েছে। হুট করে একদিন মাকে আইসিইউতে ভর্তি করাতে হল। সবচেয়ে যাকে ভালবাসতাম তার ইচ্ছে পূরণ করতে পারি নি আমি, প্রিয়জনদের সব ইচ্ছে অপূর্ণ থাকবে আমার জন্য এই চিন্তায় বোনদের বললাম আমার জন্য যে কোন এক পাত্রী দেখতে, মায়ের শেষ ইচ্ছেটুকু পূরণ করতে চাই। শেষ মেষ বোনদের ইচ্ছেতে আমার বিয়ে ঠিক হল দুলাভাইয়ের চাচাতো বোনের সঙ্গে। সম্ভবত রাজী হবনা এই ভয়ে আপা মেয়ের বয়স বাড়িয়ে বলে। আজ আখত অনুষ্ঠানে জানতে পারলাম মেয়ে অনার্স ফার্স্ট ইয়ারে পড়ে। আজ আমার রুপাপুর কথা অনেক বেশি মনে পরছে আর মনে পরছে ছোটবেলার প্রতিজ্ঞার কথা। একটি মেয়ে একজন লোককে বিয়ে করতে হবে এই ভাবনায় হাউমাউ করে কাঁদছে। এর চেয়ে হতভাগ্য আর কি হতে পারে!!!!
সর্বশেষ এডিট : ২৯ শে ডিসেম্বর, ২০১৬ রাত ১০:৫১