কিছু মানুষকে প্রথম দেখাতেই বিরক্ত লাগে। যার প্রসংগে বললাম তিনি দেখতে নিতান্তই গোবেচারা টাইপ মানুষ, তাও প্রথম দেখাতেই বিরক্তি লেগেছিল। একজন মানুষের চেহেরার জন্য তার সঙ্গে খারাপ ব্যাবহার করা খুবই নিচুমানের কাজ! আমি মানুষ হিসেবে ততোটা নিচুমানের না। অফিসের ব্যাচেলর কোয়ার্টারে একা এক রুমে থাকতাম। তখন হুট করে শুনি ঐ লোক আমার নতুন রুমমেট! নতুন রুমমেট হলে নানান ঝামেলা, বিরক্তির কারণ সম্ভবত এটিই। যখন উনাকে আমার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেয়া হল তখন তাকে নানা ভাবে বোঝানোর চেষ্টা করলাম যে এখানে চাকরি করা কিংবা আমার সাথে উঠা ঠিক হবেনা। লোকটি আমার কথায় পটেছিল ঠিকই কিন্তু ১৯ মাস বেকার থাকার পর তার নাকি আর কোন উপায় ছিল না। তখন আমার রাগে মাথার চুল ছিঁড়তে ইচ্ছে করছিল এই বিরক্তিকর উপাদানের সঙ্গে একই রুমে থাকতে হবে এই ভেবে। বিরক্তির মাত্রা চরমে পৌঁছে গিয়েছিল যখন এই লোক আমার ঘুমের টাইমে বসে বসে ডায়রী লিখে কিংবা ফোনে কথা বলত তখন। আমি একদিন নিষেধ করে দেয়ার পর সে ফোনে কথা বলত ছাদে গিয়ে, যদিও এই হাড়কাঁপা শীতে ছাদে গিয়ে কথা বলে তা ভেবে মায়া লাগত কিন্তু যখন রুমে এসে ধাম করে দরজা খুলে আবার লাগিয়ে ঘুম ভেংগে দিত ইচ্ছে হত ওকে লাত্থি মেরে রুম থেকে বের করে দেই। তবুও যথেষ্ট মানবতাবোধ আছে বলে এড়িয়ে গিয়েছি। কিন্তু আরেকদিন যখন দেখলাম রাত দেড়টায় লাইট জ্বালিয়ে ডায়রী লিখছেন আমার আর সহ্য হয় নি। এক ঢিলে জানালা দিয়ে ফেলে দিলাম ডায়েরি! লোকটা কিছু বলেনি অনেক্ষণ শুধু সেদিকে তাকিয়ে ছিল। পরদিন অফিসে কি একটা কাজে অফিসে আমার ডেস্কে আসল, আমি তখন এক্সেলে কাজ করছি। তখন পিছনে থেকে বলে ভাই এই জিনিসটা ভিলুকআপ ইউস করে আপনি আরো অনেক কম কষ্টে করতে পারেন। আমার উঠলো বেজায় রাগ। দুই দিন হয়েছে চাকরিতে জয়েন করেছে আমাকে পরামর্শ দেয়। আমি বললাম আপনি করেন দেখি। আমাকে অবাক করে দিয়ে লোকটা সত্যিই অনেক অল্প সময়ে কাজটা করে দিল। আমার অহংবোধ কমে নি, তাই তার কাছ থেকে পদ্ধতিটি শিখি নি। আমি আবার কারও ঋণ রাখতে পছন্দ করি না। অফিস শেষে বাসার পাশের কনফেকশনারীর দোকানে বসে কোল্ডড্রিংস্ক খাচ্ছিলাম, তাকে যেতে দেখে ডাক দিয়ে হাতে একটা কোল্ড ড্রিংকস ধরিয়ে বললাম "খান".
বিনয়ের সঙ্গে বলল "ভাই আমি কোল্ডড্রিংকস খাই না"
-কেন?
:এম্নিতেই!
-স্ট্রেইঞ্জ ! এম্নিতেই কেন খাবেন না?
: না এম্নিতেই
-উহু। নিশ্চয়ই কোন কারণ আছে। অনেকদিন আপনার সাথে এক রুমে থাকছি কিন্তু আপনার সম্পর্কে তেমন কিছু শোনা হয় নি। আচ্ছা বলুনতো রাত জেগে আপনি কার সঙ্গে কথা বলেন?
:আমি একটা মেয়েকে পছন্দ করি ভাই। ওর সঙ্গে!
-বাহ! কতদিনের প্রেম?
:প্রেম না ভাই।
-হা হা! প্রতিদিন কথা বলেন আর বলছেন প্রেম না!
: হ্যাঁ ভাই। আমি মেয়েকে পছন্দ করি সে করেনা।
-কি বলেন! কিভাবে পরিচয়?
: তখন আমি অনার্সে পড়ি। কোচিংয়ে ক্লাস নেই। মোটামুটি জনপ্রিয় টিচার ছিলাম। এক কোচিং সেন্টার প্রসপেক্টাসে আমার ছবি নাম দেয় সাথে ফোন নম্বর। তখন অনেকে ফোন দিত। তাদের মধ্যে একজন সে। প্রায়ই ফোন দিয়ে নানা সাহায্য চাইতো। সেভাবে পরিচয়!
-এক প্রকার স্টুডেন্ট বলা চলে।
:ঠিক তা না। আমার মাত্র দু বছরের ছোট।
-বয়স যাই হোক। তারপর ছাত্রীকে পটালেন কিভাবে?
:সেরকম কিছুনা ভাই। ও প্রায় ফোন দিত। আস্তে আস্তে সব খোঁজ খবর নিয়েছে। আমার বাসায় কে আছে। কারও সাথে সম্পর্ক আছে কিনা। কেন নেই। আমার কেমন মেয়ে পছন্দ, তার সাথে কথা বলে কেমন লেগেছে।
-ও। আপনি না বললেন সে আপনাকে পছন্দ করে না?
: হ্যাঁ ভাই। আমিও আপনার মত ভুল বুঝেছি। তখন আস্তে আস্তে তার প্রতি দুর্বল হতে থাকি। কিন্তু কখনো প্রকাশ করিনি ভয়ে।
-কিসের ভয়?
: আমাদের পরিচয় হয় একটি মিথ্যার মাধ্যমে! এই সত্যি প্রকাশ হয়ে যাবে এই ভয়ে!
-মানে?
: আমি তখন ঢাকা কলেজে পড়তাম। কিন্তু টিচার হিসেবে ভাল ছিলাম। তাই কোচিংয়ে আমাকে প্রস্তাব দেয়া হল মফস্বলে গিয়ে ক্লাস নিতে। আমি ভাল সম্মানী দেখে রাজি হয়ে গেলাম। তখন তারা প্রসপেক্টাসে পরিচয় দিল আমি ঢাবিতে পড়ি। ও সেই প্রসপেক্টাস থেকে আমার নম্বর নেয়। সত্যি কথা বললে ও আর আমাকে পছন্দ করবেনা সে ভয়ে কখনো বলিনি।
-তারপর কি হল?
:যখন সে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়ে গেল তখন সে বলল সে আর ফোন ব্যাবহার করবেনা। আমার মাথায় এক প্রকার আকাশ ভেঙ্গে পড়ল। আমি প্রচন্ড কষ্টে মোবাইল বন্ধ করে রাখলাম বেশ অনেকদিন! তখন আস্তে আস্তে যেভাবেই হোক তাকে ভুলে যেতে হবে সে প্রিপারেশন নিয়েছি এম্নিই একদিন কি কারণে সিম খুলে দেখি তার ম্যাসেজ!
-কি লিখা ছিল?
:ঠিক মনে নেই। তবে তখন আবার মাঝেমধ্যে কথা হত। নিয়মিত কথা বলে আমার বাজে অভ্যাস হয়ে গিয়েছিল বিদায় খুব কষ্ট লাগত।
-লাগারই কথা।
:তবে কষ্টের মাত্রা ছাড়িয়ে গিয়েছিল যেদিন দেখলাম ঢাকা এসে সে তার মোবাইল অফ করে রেখেছিল আমি হয়তো দেখা করার জন্য ফোন দিব এ ভয়ে। আমার সত্যি তার সঙ্গে দেখা করার মত আশা ছিল না কিন্তু সে এই ভয়ে মোবাইল অফ করেছে ভেবে প্রচন্ড কষ্ট লাগে।
-আহারে।
:এরকম কষ্ট অনেকবারই পেয়েছি। আমার বড় বোনের তখন ক্যান্সার ধরা পরেছে। রিপোর্ট দেখে আমার খুব কষ্ট লাগে। কাউকে জড়িয়ে ধরে কাঁদব সে পরিস্থিতি ছিল না। হাসপাতালের ওয়াশরুমে গিয়ে ওকে ম্যাসেজ দিলাম। ও রিপ্লাই করে "কে" আমি অবাক হয়ে ফোন দিয়ে জিজ্ঞেস করলাম "নম্বর সেইভ নেই?" ও বলে "আপনি?সরি আমি আসলে বুঝতে পারছিলাম দিন দিন আপনার সাথে বেশি কথা বলা হয়ে যাচ্ছে। ঠিক হচ্ছেনা, তাই নম্বর ডিলিট করে দিয়ে সিম অফ করে দিতে চাইছিলাম"
আমি ওকে ফোন দিয়েছি দু:খের কথা বলতে কিন্তু জানতাম না আমি আগুন থেকে বাঁচতে ট্রাকের নিচে ঝাপ দিয়েছি। সেদিনের মত বাজে দিন আর আসেনি।
-so sad! আপনার বোনের ক্যান্সার?
:জ্বি।
-এখন কি অবস্থা?
:বেঁচে আছে কিন্তু ভাল নেই। আমার খুব কষ্ট ভাই। বোনের অসুস্থ তাই বিয়ে হচ্ছেনা। কে বিয়ে করবে? প্রচন্ড কষ্টে আমি ডায়রি লেখি ভাই।
চোখের পানি মুছতে মুছতে লোকটি বলল। চোখের পানি নাকি কঠিন হৃদয় গলাতেও এসিডের মত কাজ করে। আমারও খুব খারাপ লাগল। জানালার পাশে খালপাড় গেলাম লোকটার ডায়েরি খুঁজতে। খুঁজতে খুঁজতে জিজ্ঞেস করলাম, "তারপর ও আপনি ওর সঙ্গে কথা বলেছেন?"
:হ্যাঁ, অন্য কোন উপায় আমার জানা ছিল না। তবে কথা নিয়মিত হতো না। ওর পরীক্ষা আসলেই দুই এক মাসের জন্য কথা বন্ধ। সেদিনগুলো যে কতোটা কষ্টে কাটতো তা প্রকাশের ভাষা আমার জানা নেই ভাই।
-আহারে!
:জানেন আমি সবসময় ওর সময় মেনে কথা বলতাম। ধরুন আমার সকালে এক্সাম ও রাতে ফোন দিয়েছে। তাও ওর সাথে কথা বলব। কারণ অন্য সময়ে নাহলে ওর সাথে কথা বলা হবেনা। আমি যদি বলি আমার এক্সাম আছে তাহলে আর কথাই বলবেনা। বলবে আপনার পরীক্ষায় আমি বিরক্ত করি। আর করব না। এই ভয়ে কখনো বলিনি ভাই।
-আপনি তো দেখছি সাঙ্ঘাতিক বোকা মানুষ!
:হ্যাঁ ভাই।
-এভাবেই চলছে এখনো?
:হ্যাঁ! জানেন আমি যে কোল্ডড্রিংস্ক খাই না এর কারণ সে বলেছে কোল্ডড্রিংকস খাওয়া উচিৎ না তাই। এরকম আরো অনেক কিছু আছে।
-আপনি সত্যিই অনেক বোকা ভাই।
:জানি আমি। আমি অনেক দু:খিত ভাই। রাতে জেগে আপনাকে অনেক বিরক্ত করি। কিন্তু কিছুই করার নেই, ও সময় ছাড়া ওর আর সময় হবেনা। তাকে বলব সে সাহস ও আমার নেই।
-ছি ছি ভাই আমাকে আর লজ্জা দিবেননা।
লোকটার ডায়রী নিয়ে সেদিন ফিরে আসলাম আর ভাবলাম এত বোকাও মানুষ হয়? তারপর থেকে তার সঙ্গে খারাপ ব্যাবহার করিনি। হঠাৎ একদিন শুনি সে রিজাইন লেটার দিয়েছে। আমি অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলাম, "অন্য কোথাও চাকরি পেয়েছেন নাকি?"
:না ভাই। ওর পরীক্ষা সামনে। দুই মাস কথা হবেনা। ওর সাথে না কথা বললে সারাদিন প্রচন্ড মন খারাপ থাকে। খাওয়া দাওয়া করতে ইচ্ছে করে না। এভাবে চাকরি করা সম্ভব না ভাই!
-বোকা নাকি আপনি এত কষ্ট করে চাকরি যোগাড় করেছেন।
তাকে অনেক বোঝালাম! বোকা লোকদের সহজে মটিভেট করা যায় সেদিন বুঝতে পারলাম। কিন্তু তার দিনগুলো ভাল যাচ্ছিলনা। একে বোনের অসুস্থতা বেড়েছে তার উপর প্রায়ই দেখতাম রাতে না খেয়ে থাকত। অনেক জোর করেও খাওয়ানো যেত না। একদিন খুব আয়োজন করে বলে "ভাই কখনো ডিমের জর্দা খেয়েছেন?"
আমি বললাম, "না তো।"
:আমার খুব পছন্দের, দাঁড়ান বানাচ্ছি।
যেই বলা সেই কাজ। চারটি ডিম চিনি তেল কিনে এনে খুব আয়োজন করে জর্দা তৈরি করল। দুজন খেতে বসলাম এম্নিই বলে, 'খাবনা ভাই।'
অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলাম, 'কেন?'
:হঠাৎ মনটা খারাপ হয়ে গেল, আপনি খান ভাই।
প্রচন্ড অনুরোধ করেও সে খায় নি। মনে মনে ভাবলাম এত সাইকো মানুষ কিভাবে হয়। ডাক্তার দেখাতে হবে। অসুস্থ লোকটি কিছুটা সুস্থ হয়েছিল মেয়েটির পরীক্ষার পর। কি যে উৎফুল্ল ছিল, মোবাইল হাতে নিলেই দেখতাম ভুবন জোড়ানো হাসি। এত সুন্দর হাসির আড়ালে এত দুঃখ ভাবলেও মনটা ভারী হয়ে উঠে। সে হাসি বেশিদিন ছিল না। হঠাৎ একদিন দেখি লোকটার চোখমুখ লাল হয়ে আছে। সম্ভবত কেঁদেছিল! আমি জিজ্ঞেস করলাম "কি হয়েছে ভাই? অসুস্থ? "
:না ভাই। জানেন ও ফেইসবুকে আমার আইডি খুঁজে পেয়েছে। সত্যি জেনে গিয়েছে আমি ঢাকা কলেজ থেকে পাশ করেছি। আমি মিথ্যা বলেছিলাম আমি ফেইসবুক ইউস করিনা তাই আমার সাথে কথা বলবেনা, কিন্তু ভাই বিশ্বাস করেন ফেইসবুকে বেশিরভাগ লেখাই তাকে নিয়ে। প্রচন্ড কষ্টে সময় কাটাইতাম ফেইসবুক ইউস করে!
-আমি বুঝলাম না, সে আপনাকে বিয়ে করবেনা এখন আপনি যেখান থেকে খুশি সেখান থেকে অয়াশ করুন যা ইচ্ছে তা ব্যাবহার করুন তার সমস্যা কি?
:আমার ওর সাথে মিথ্যা বলা ঠিক হয়নি ভাই। কিন্তু কি করব। সত্যি বলার মত সাহস হয় নি।
-সব ঠিক হয়ে যাবে ভাই। নয়তো মনে রাখবেন যা হয় ভালোর জন্যই হয়।
তারপর থেকে নাকি মেয়েটি তার সঙ্গে খুব একটা কথা বলত না। মাঝেমধ্যে! একদিন হঠাৎ দেখলাম তাকে এইচ আরে। উনার বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স অভিযোগ আনা হয়েছে। অভিযোগ অফিসে মোবাইল পার্সনাল কাজে বেশিক্ষণ ব্যাবহার নিষিদ্ধ, ক্লোজ সার্কিট ক্যামেরায় দেখা গিয়েছে তিনি প্রচুর সময় ধরে মোবাইল ব্যাবহার করেন। এ কারিণে একটি কাজে ভুলও করেছেন। তাই তাকে চাকরি থেকে বরখাস্ত করা হচ্ছে!
আহারে মেয়েটির জন্য এতকিছু! আমার সচরাচর দুঃখ লাগেনা। কিন্তু সেদিন লেগেছিল। প্রচন্ড কষ্ট লাগছিল। লোকটি বাসা ছেড়ে চলে যাবার সময় আমি দেখা করিনি, চোখে পানি আসবে এই ভয়ে।
তারপর অনেকদিন তার সঙ্গে কথা হয় নি। মাঝে একদিন ফোন দেয় নতুন চাকরির কথা জানিয়ে। তাড়াহুড়োতে বোন ও সেই মেয়ের কথা শোনা হয় নি। কয়েকদিন পর ফোন। তার বোন মারা গিয়েছে। আমি অফিস থেকে ছুটি নিয়ে তাদের বাড়ি গিয়েছিলাম। লোকটি আমাকে জড়িয়ে ধরে অনেক কেঁদেছিল, স্বান্তনা দিব কি আমারও কান্না আসছিল। দুইদিন থাকার পর তার সাথে আসরের নামাজের পর গ্রাম দেখতে বের হই। তাকে জিজ্ঞেস করলাম, "উনি কেমন আছে ভাই?"
:আপু যেদিন কোমায় সেদিন তার বিয়ে হয়েছে।
মানুষের কষ্ট সহ্য করার ক্ষমতা অসীম, তবে এ লোকের সে ক্ষমতা দেখে আমি রীতিমতো বিস্মিত হই। ফিরে আসার দিন তাকে বললাম, "ভাই আপনার ডায়রীটা ফেলে আসছিলেন। গল্পটা শেষ করবেন না?এখন তো চাইলেই পারেন।"
বড় একটা দীর্ঘশ্বাস ফেকে বলেছিলেন, "এত ছোট ডায়রীতে এত বড় দুঃখের গল্প জায়গা হয় না ভাই, ফেলে দিন এটা"