somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

লড়াই

০৪ ঠা নভেম্বর, ২০১১ রাত ৯:১১
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :





রাতে একটু দেরী করে চাঁদ উঠলো; কিন্তু আলোটা জমলো না। তাতে মজিবরের প্রাণের শখ মিইয়েও পড়লো না। পাথারের ওই ঢিবিটার উপর বিড়াট দুটি তালগাছ। সেখানে শুকের চাঁদের আলো হতে পূর্ণিমার দিন পর্যন্ত তার প্রেমের সাধ মেটে না, বাঁশির সুর থামে না। একদিন দুদিন করে ছমিরনেরও যেন নেশা লেগে যায়। সেও শুক পক্ষের আলো খোঁজে। কিন্তু আজ কৃষ্ণপক্ষ। তবু কেন যেন আজ মজিবরের মনের পাখি হঠাৎ অদম্য হয়ে উঠেছে। তাই সে ছমিরনকে সাথে নিয়ে ছুট লাগায়, বড় বাঁশঝাড়ের নীচ দিয়ে পাথারের ঢিবির দিকে। হাপিয়ে উঠে ছমিরন, বলে, 'আহ দাড়াও! চুল খোলা থাকলে ভূতে ধরবে।'
'ভূত! এই মমিনপুরের সউগ ভূত মোক্ চেনে। মোর বউওক ধরবে, এতো সাহস।'
'ওমা হয়! হি হি হা হা।'
'তুই হাসিস যে। বিশ্বাস করলু না মোর কথাখান।'

ছমিরন আবার হাসে। মজিবরের বাম বাহু ধরে কাঁধে মাথা রেখে হাসে। মজিবর তাকে নিয়ে আবার ছুট দেয়। আর এক দৌড়ে ঢিবির উপর উঠে বসে দু'জন। দূর থেকে দুটি নর-নারীর ছায়া দেখা যায়, অদ্ভুত তাদের ভালবাসা, চঞ্চলতা, সুখ। ছমিরন স্বামীর গলা জড়িয়ে ধরে, সে জানে তার স্বামী গ্রামে থেকেও যে গ্রাম্য নয়; অনেকের চেয়ে আলাদা। শহরে লেখাপড়া করেছে, তবু গ্রামকে ভালবাসে। এখনও গ্রামের মাঠ-ঘাটে দৌড়ে বেড়ায় কিশোর বেলার মতো। মজিবর পাগলের মতো জড়িয়ে ধরে ছমিরনকে। বলে, 'তুই জানিস বউ! এই তালগাছ দুইটাক্ মুই ভালবাসি ক্যান?'
'ক্যানে, মুই তাক্ ক্যামন করি জানো?'
'মোর মনের সাথোত এ তালগাছ দুইটার খুউব মিল আছে।'
'হি হি হি তালগাছ, তার বলে ফির মন।'
'হয় রে বউ হয়, তালগাছেরও মন আছে। দেইখপার চোখ লাগে। এই যেমন তালগাছ সউগ সমে আকাশত উড়ি যাবার চায়, মোরও তো ইচ্ছা করে অমতোন করি উড়ি যাবার।'
'তাইলে মুই কোনটে যাইম? মোক্ নিয়া যাবার নান।'
'তোক ছাড়ি ফির মুই কোনটে যাঁও। দেখছিস এ্যালাও?'

ছমিরন মজিবরের বুকের আরো কাছে চলে আসে, বাহু আঁকড়ে ধরে আরও শক্ত করে। সে মনে মনে স্বীকার করে বিয়ের পর থেকে তার স্বামী তাকে রেখে কোথাও যায়নি। 'কিন্তুক ....' মজিবর আবার বলে।
'কিন্তুক কি?' ছমিরন স্বামীর দিকে তাকিয়ে থাকে।
'কিন্তুক বউ, তোক ছাড়ি মুই যুদ্ধে যাবার পাও।'
'যুদ্ধে? যুদ্ধে ক্যান গো, যুদ্ধে ক্যান?' ছমিরন উৎকন্ঠিত হয়ে উঠে।
'যুদ্ধে তো মাইনষেক যাবার লাগবে বউ।'
'ও ... তোমরা গুল্যা ঐ মাষ্টারের সাথোত বসি বসি এউগ্লা যুক্তি করছেন।'
'নারে বউ খালি হামরা গুল্যা না, সারা দ্যাশত যুদ্ধ লাগবে, স্বাধীনতার যুদ্ধ।'
'মুই কিছু জানো না। সরকারের সাথোত কি যুদ্ধ করি পারা যায়?'
'সরকার, কিসের সরকার? যামরা হামাক শুষি নিবার লাগছে তামরা! যামরা হামাক মারি ফ্যালবার লাগছে তামরা? ঘামার সরকার এ্যালা হামরা হমো।'
'কিন্তুক...'
'কোন কিন্তুক এ্যটে নাই।'

ছমিরন ভাবে, এখন স্বামী উত্তেজিত, তার মনের ভেতর যুদ্ধের দামামা বাজছে। তার চাইতেও দ্বিগুণ জোড়ে বেজে উঠছে ছমিরনের মনের উৎকন্ঠা। কিন্তু এখন স্বামীকে থামাবে কে? কিভাবে? ছমিরনের মনের কথাই যেন পড়ে ফেলল মজিবর। সে বউকে কাছে ডেকে নেয়। তারপর মাথায় হাত বুলিয়ে দেয় আর নরম করে ডাকে, 'ছমিরন'।
'জী'
'মনে কর, খুউব নোংরা এক লোক তার চায়াও নোংরা তার মন নিয়া তোর দিকে...'
'ছিঃ তোমার মুখোত এইগ্লা কিছু আটকায় না। ছিঃ..'
'তখন মুই কি করিম, যুদ্ধ? না পালে যাইম? ক দেখি বউ।'

ছমিরন মজিবরের বুকে আরও মাথা গুজে দেয়। সে সেখানে গুমরে উঠে, তার কল্পনা ভয়ানক হয়। সে মজিবরকে খুব জোড়ে চেপে ধরে।
মজিবর বলে, 'এই জন্মভূমি মোর মা। জননী জন্মভূমির সর্বস্ব লুটি নিতোছে ঐ সউগ নোংরা সীমার গুল্যা। ক বউ মুই ক্যামন করি বসি থ্যাকপার পারি?'

ছমিরন আরও ডুকরে কেঁদে উঠে। হু হু করে তার চোখ জলে ভিজে ওঠে, ভিজে যায় মজিবরের বুক। মজিবরও কাঁদে, কাঁদে তার দেশের মায়ায়। দেশের ক্ষত-বিক্ষত অবস্থা অনুভব করে। কিন্তু ছমিরন কাঁদে কি জন্য? নারীর ক্রন্দন নাকি বহুমাত্রিক হয়। তাদের স্তনের ভালবাসা যেমনি প্রেমিক পুরুষকে বশ করে তেমনি স্নেহের সন্তানকে আবদ্ধ করে মাতৃত্বে। ছমিরনও কাঁদে এই দেশের জন্যে, এই দেশের শত্রুদের ঘৃণা করে সে কাঁদে, আবার তার প্রিয়তম স্বামীর অমঙ্গল আশঙ্কায় সে কাঁদে।



মজিবরের হাতে বর্শা। সে আজ অন্তত দেশের একটা শত্রুকে হত্যা করবে। দৃঢ় সংকল্প তার চোখেমুখে। শত শত মানুষের মিছিল আজ ধেয়ে চলেছে। আজ খান সেনাদের পরাজিত করে রংপুর ক্যান্টনমেন্ট দখল নেবে তারা। শতমানুষের পদযাত্রা আজ। লাঠিসোটা হাতে।
'রংপুর শহর থাকি গণিভাই, রফিক ভাই সেদিন মাষ্টারের বাড়িতে আস্ছিল, সাথোত আরও কয়েকজন ছাত্র নেতা। সে এক বিড়াট নকশা। তামরা কইছে, ক্যান্টনমেন্ট থাকি বাঙালী সেনারা অস্ত্র নিয়া বেড়েয়া আসপে, তামরা ক্যান্টনমেন্ট দখল করবে; তারে জন্যে সবার সাহায্য করা লাগবে।'

তীক্ষè চোখে মজিবর বর্শার ফলাটা পরখ করে নেয়! আজ শত্রু নিধনের প্রতিজ্ঞাবদ্ধ সে। সামনে থেকে শোরগোল শোনা গেল। তারপর ঘটনার সামনেই এসে গেল সে। তীর ধনুক হাতে শতাধিক সাঁওতাল এসে যোগ দিয়েছে তাদের সাথে। সবার সামনে তাদের সরদার অরুন খালকো। বাঙালী ও আদিবাসীদের মিলনে স্বাধীনতা প্রত্যাশী এই দেশে এক নজির স্থাপন হলো সেখানে। নজিরের হাটে-ঘঘট নদীর তীর হাজার মুক্তিযোদ্ধার পদভারে কম্পিত। আজ শত্রুকে মোকাবেলা করার জন্য লাঠি, বর্শা আর তীর ধনুক।
কিন্তু যুদ্ধ দানবদের অস্ত্র গর্জে উঠলো ঐ পাড় থেকে। ট্যাঙ্ক আর মেশিনগানের সাথে তারা তো অসহায়। কিন্তু তারা তো আশা করে ছিলো ঐ ট্যাঙ্ক আর মেশিনগান হাতে তাদের ভাই বাঙালী সেনারা এসে দাড়াবে!?

এদিকে ছমিরনের বিলাপ শোনে সকলে,
'স্বামী নাই, স্বামী নাই, স্বামী নাই,
মোর স্বামী নাই।
সকাল বেলা একনা পন্তা খায়া গেইল্
মোক কইলে বিয়ান বেলা আসপে;
বিয়ান পাড় হয়া এলা রাইত হয়া যাওছে, তাও স্বামী নাই।

মুই কি কঁরো, কোনটে যাঁও,
এটে খোঁজো, ওটে খোঁজো...মোর স্বামী নাই।

শ্যাষে দেওয়ানীর ব্যাটা আলাল আসি কওসে, 'ভাবী, রংপুর ক্যানটেরম্যানে বলে খানের সাথোত যুদ্ধ নাগছে, হাজার হাজার মানুষ বলে গুলি খায়া মরছে, মরি গেইছে। মজিবর ভাইজান ওটে যায় নাই তো?'
'কি জান ভাই মুইতো তাক কিছু জানো না।'

ছমিরনের বিলাপ শোনে মানুষ প্রকৃতি আর মজিবরের প্রিয় তালগাছ।

==শেষ===



[সত্য ঘটনা অবলম্বনে রচিত গল্পটির চরিত্র গুলোও বাস্তব। ২৮মার্চ ১৯৭১ সালে রংপুরের সাধারণ জনতা তীর-ধনুক ও লাঠি হাতে রংপুর ক্যান্টনমেন্ট ঘেরাও করেছিল, তা সে সময় হয়তো হটকারিতা ছিল, কিন্তু আমাদের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে তার কথা কি আজো এমনি অবহেলায় থেকে যাবে?-গল্পকার ]

৫টি মন্তব্য ৩টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

স্মৃতিপুড়া ঘরে

লিখেছেন আলমগীর সরকার লিটন, ২৮ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১১:৩০



বাড়ির সামনে লম্বা বাঁধ
তবু চোখের কান্না থামেনি
বালিশ ভেজা নীরব রাত;
ওরা বুঝতেই পারেনি-
মা গো তোমার কথা, মনে পরেছে
এই কাঠফাটা বৈশাখে।

দাবদাহে পুড়ে যাচ্ছে
মা গো এই সময়ের ঘরে
তালপাতার পাখাটাও আজ ভিন্নসুর
খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে... ...বাকিটুকু পড়ুন

গরমান্ত দুপুরের আলাপ

লিখেছেন কালো যাদুকর, ২৮ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১:৫৯




মাঝে মাঝে মনে হয় ব্লগে কেন আসি? সোজা উত্তর- আড্ডা দেয়ার জন্য। এই যে ২০/২৫ জন ব্লগারদের নাম দেখা যাচ্ছে, অথচ একজন আরেক জনের সাথে সরাসরি কথা... ...বাকিটুকু পড়ুন

রাজীব নূর কোথায়?

লিখেছেন অধীতি, ২৮ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৩:২৪

আমি ব্লগে আসার পর প্রথম যাদের মন্তব্য পাই এবং যাদেরকে ব্লগে নিয়মিত দেখি তাদের মধ্যে রাজীব নূর অন্যতম। ব্যস্ততার মধ্যে ব্লগে কম আসা হয় তাই খোঁজ-খবর জানিনা। হঠাৎ দু'একদিন ধরে... ...বাকিটুকু পড়ুন

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা বৃষ্টির জন্য নামাজ পড়তে চায়।

লিখেছেন নূর আলম হিরণ, ২৮ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৪:৩৮



ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু শিক্ষার্থী গত বুধবার বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের কাছে বৃষ্টি নামানোর জন্য ইসতিসকার নামাজ পড়বে তার অনুমতি নিতে গিয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ এটির অনুমতি দেয়নি, যার জন্য তারা সোশ্যাল... ...বাকিটুকু পড়ুন

=তুমি সুলতান সুলেমান-আমি হুররাম=

লিখেছেন কাজী ফাতেমা ছবি, ২৮ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৮:৩৬



©কাজী ফাতেমা ছবি

মন প্রাসাদের রাজা তুমি, রাণী তোমার আমি
সোনার প্রাসাদ নাই বা গড়লে, প্রেমের প্রাসাদ দামী।

হও সুলেমান তুমি আমার , হুররাম আমি হবো
মন হেরেমে সংগোপনে, তুমি আমি রবো।

ছোট্ট প্রাসাদ দেবে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×