কড়া রোদ পড়েছে আজ। ফাল্গুন শেষ হতে চলেছে। গাছেদের পাতা ঝরা দিন চলে। বাতাসে কেমন একটা একটানা ক্লান্তি ভেসে বেড়াচ্ছে। আমি দাঁড়িয়ে আছি জ্যামে। রমনা পার্কের পাশে। দাঁড়িয়ে আছি বললে ভুল হবে, রীতিমতো বাদুরের মতো ঝুলছি। বাস ঠায় দাঁড়িয়ে আছে অনেকক্ষণ ধরে। প্রচুর গাদাগাদি ভেতরে।
আমার একহাতে কাঁধব্যাগ ধরা। বেশ ঝক্কিই পোহাতে হচ্ছে ব্যাগ নিয়ে। আমি যে সিটের সামনে দাঁড়িয়ে আছি সেখানে এক মধ্য বয়স্কা নারী বসা। উনি আমার অবস্থা টের পেলেন খানিকটা। বললেন, ব্যাগটা আমার কাছে দিন, আপনি ঠিক করে দাঁড়াতে পারবেন। উনার বলার মধ্যে কী যেন একটা ছিল। দিলাম ব্যাগ। উনি ধরে বসলেন।
আমি বাইরে তাকালাম। রাস্তায় গাদাগাদি করে দাঁড়িয়ে আছে গাড়ি আর গাড়ি। চারিদিকে চিৎকার, হাঁকডাক আর ভ্যাপসা গরম। বাইরে তাকিয়ে আমার চোখ বেশ আরাম পেল। কি সুন্দর এক দৃশ্য।
রমনা পার্ক আর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানকে আলাদা করা রাস্তার মাঝের সড়কদ্বীপ বাগান বিলাসে ছেয়ে আছে। কি সুন্দর ঝলমলে রঙ। চোখে কোমলতা আনে। আমি তাকিয়ে আছি ফুলের দিকে। বাগান বিলাস গাছের ফাঁকে একটা বড় পেয়ারা গাছে চোখ আটকে গেল আমার। মনে হলো এই গাছটি পৃথিবীর সবচেয়ে দুঃখী পেয়ারা গাছ। গাছের শরীর স্বাস্থ্য অনেক সুন্দর, কিন্তু সব ডালপালা ছাটা। দেখেই মনে হয় এই গাছ খুব বেশি হলে হাত পাঁচেক লম্বা হতে পেরেছে এতদিনে। একটা দুটো ডাল আছে গাছে। তাতেই খলবল করে বেড়ে উঠেছে অনেকগুলো সতেজ সবুজ পাতা। আহারে গাছটা।
বাসের ভেতরে মানুষজন বিরক্ত হয়ে গেছে। একসাথে সাত আটজন নেমে গেলো বাস থেকে। অনেকগুলো সিটই ফাঁকা হলো। উনার কাছ থেকে ব্যাগ নিয়ে জানালার পাশে একটা সিটে বসলাম। সুন্দর করে ধন্যবাদ দিতেই উনি হেসে ফেললেন। বেশ আমুদে মানুষ। এতক্ষণ আশেপাশের সবার সাথেই বেশ গল্প করছিলেন। হাসতে পারেন। যারা হাসতে পারে তাদের প্রতি আমার একটা আলাদা টান কাজ করে। নির্মল হাসির মানুষ চিনি আমি কয়েকজনকে। আমার প্রিয় মানুষদের একজন কবি রইস মনরমের হাসি সেই শৈশব থেকেই পরম প্রিয় আমার। উনার হাসি দেখলে মন ভালো হয়ে যায়। আরেকজনকে জানি যিনি সরল মানুষ। শহীদুল্লাহ ফরায়েজি ভাই। কী সারল্য সুন্দর হাসি তাঁর। উনার সাথে মিনিট দশেক আড্ডা দিলে মনে হয় একটা বই পড়ে ফেললাম।
আমি বাইরে তাকালাম। রমনার পার্কের ভেতরে বেশ নীরবতা বোঝা যাচ্ছে। একজন মানুষ এই গরমের মধ্যেও দৌড়াচ্ছেন। আশেপাশের মানুষজন তাঁর দিকে হা করে তাকিয়ে আছেন। ভদ্রলোক দরদর করে ঘামছেন। মেদবহুল শরীর নিয়ে এই গরমের মধ্যে তাঁর দৌড়াতে যে বেশ কষ্ট হচ্ছে বোঝাই যাচ্ছে। তবে তাঁর একাগ্রতার জোরে দৌড়াচ্ছেন এটা বেশ বোঝা যাচ্ছে।
একটা দমকা হাওয়া খেলে গেল যেন। একসাথে অনেক গাছ পাতা ঝরিয়ে ফেললো এই সুযোগে। একটা ছোটখাট পত্রবৃষ্টি হয়ে গেল মুহূর্তের মধ্যেই। বেশ চোখে লাগার মতন দৃশ্য। আমি তাকিয়ে রইলাম অনেকক্ষণ। বাস এখনো ঠায় দাঁড়িয়ে।
রমনার গাছগুলো কেমন যেন জবুথবু হয়ে গেলো হুট করে। গাছের ফাক গলে রোদ পড়ে চিকচিক করছে রমনার লেকের জল। দুপুর হয়ে আসছে যেন। দুপুর শব্দটা কী সুন্দর! জনারণ্যেও নির্জনতা নামিয়ে নিয়ে আসে এ সময়। যদিও প্রতিটা ঋতুতেই পাল্টে যায় এ দুপুরের স্বাদ। দুপুরেরও কিছু শব্দ আছে, ঘ্রাণ আছে। শব্দের ছায়া ধরে দুপুরকে চিনে নেয়া যায়। প্রতিটা দুপুরই ভিন্ন। পাখির ডাক আলাদা, বাতাস আলাদা, উত্তাপও আলাদা। চুপিচুপি নেমে আসা বৃষ্টির গন্ধটাও আলাদা।
কখনো এসব দুপুর নেমে আসে সহসা, ঠিক জাদুর মতো। কবিতা নামিয়ে আনে পৃথিবীতে। পেখম মেলে দেয় তার। আবার উল্টো দুপুরও আসে৷ ক্লান্ত, ছায়াহীন আর ঘর্মাক্ত নিরস সেসব দুপুরের গল্প খরচ হয়ে যায় জীবনের খাতা থেকে।
কেউ কেউ দুপুর নির্জনতা পোষে। সেইসব দুপুর বৃক্ষের মতো বড়ো হয়, ছায়া দেয়। নিজেকে আবিষ্কার করা যায় এইসব দুপুরে। এইসব দুপুরের দেখা পাওয়া যায় হুটহাট৷
ঝলমলে রোদের দুপুর আমার ভীষণ পছন্দের। আমার হাঁটতে ভালো লাগে। তবে কেমন পালটে গেছে সময়। আগে মন চাইলেই বের হয়ে যেতাম দুপুর উপভোগের ঘ্রাণ কুড়াতে।
বাস নড়ার নাম নেই। আরও কয়েকজন নেমে গেছে বাস থেকে। আমিও নেমে হাঁটা আরম্ভ করবো ভাবছি। জানালা দিয়ে বাইরে তাকালাম। দুজন তরুণ তরুণী হেঁটে যাচ্ছে ফুটপাত দিয়ে। হাতে হাত ধরে। আমি অপলক তাকিয়ে রইলাম। দুজনই ঝলমলে রঙের পোশাক পরে আছে। মনে হচ্ছে তারা যেদিক দিয়ে যাচ্ছে সেখানটাই রঙিন হয়ে উঠছে।
আবার এক দমকা হাওয়া এলো। গাছেদের পাতা ঝরানোর খেলা শুরু হয়েছে ফের। তরুণ তরুণী হাসতে হাসতে হাত ধরে হাঁটছে। তাদেরকে অভ্যর্থনা জানাচ্ছে বসন্তের বাতাসে ঝরতে থাকা কিছু শুকনো মৃত পাতা। দুজন ফুটপাত ধরে হেঁটেই যাচ্ছে। কী অপূর্ব দৃশ্য।
এই কোমল সুন্দর দৃশ্য দেখে আমি বাস থেকে নামতে ভুলে গেছি। ইশশ দৃশ্যটা বাঁধিয়ে রাখতে পারতাম...
২২ ফাল্গুন | ১৪২৮
(ছবি উদ্যান থেকে তুলেছিলাম অনেক আগে)
সর্বশেষ এডিট : ২০ শে আগস্ট, ২০২৩ দুপুর ১:১৪