somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

অবাক আলোর স্রোতে

২৭ শে সেপ্টেম্বর, ২০২৩ রাত ১০:০৬
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


সাঁইসাঁই করে ছুটছে ট্রেন। বাড়ি ফিরছি। চারপাশের সবুজ চোখ ভরিয়ে দিচ্ছে৷ প্রত্যেকবার বাড়ি ফেরার সময় এমন একটা অনুভূতি হয়। ভেতরে কেমন ভাঙচুর, উতাল পাথাল ঢেউ। বাড়ি গেলে ঘোরের ভেতর সময় কোথায় হাওয়া হয়ে যায়। মনে হয় সময় যেন পাগলা ঘোড়া। এত দ্রুত দিনগুলো ফুরিয়ে যায়। এবার তো যাচ্ছি মাত্র দু'দিনের জন্য। যাবার আগে থেকেই খারাপ লাগা শুরু হয়েছে। খারাপ লাগার সময় তো আবার দীর্ঘ হয়ে যায়।

অবশ্য ট্রেনের ভেতরে থাকলে সময় কাটানোর জন্য কোন কিছুই লাগেনা। ট্রেনের ভেতরে এক জগত বাইরে আরেকটা। দুটোই সমান উপভোগ্য৷ কেমন অদ্ভুত সুন্দর। ছেলেবেলায় ট্রেনে দুই ঘণ্টার ছোট্ট একটা ভ্রমণে বোনের বাড়ি গৌরিপুর যেতাম। সেই দুই ঘণ্টা সময়কেই কত বেশী মনে হতো তখন। মনে হতো প্রত্যেকটা মিনিট একেকটা গল্প নিয়ে আসে। চানাচুর ওয়ালা, ক্যানভাসারের কণ্ঠ, ভিক্ষুকের গান প্রত্যেকবার এগুলোকে নতুন মনে হতো। সেই লোকাল ট্রেনের ভিড়ে চিড়ে চ্যাপ্টা হয়ে গেলেও খারাপ লাগা ছিল না। ট্রেনের মধ্যে সবচেয়ে লোভনীয় জায়গা ছিল জানালা। ট্রেনের জানালা একটা টেলিভিশনের মতো লাগে আমার কাছে। প্রতি মুহূর্তের গল্প প্রদর্শিত হয় এখানে। চিরচেনা পরিবেশ ট্রেন থেকে দেখলে ভিন্ন রকম লাগে। অন্য একটা জগত হয়ে যায়। জানালা দিয়ে বাইরে তাকালাম। আকাশের রঙটা কেমন বিষণ্ণ।

শাল বনের ভেতর দিয়ে যাচ্ছে ট্রেন। বিকেলের সোনারোদ গাছের ফাঁক গলে পড়েছে। কেমন অপার্থিব একটা আলো। একটু দূরে বড়সড় একটা মাটির সড়ক। দুটো গরু লেজ দিয়ে মশা তাড়াতে তাড়াতে ঘাস খাচ্ছে৷ মুহূর্তেই নাই হয়ে গেল এই দৃশ্য। ঝা ঝকঝকে সবুজ মাঠ। আদিগন্ত। যতদূর দেখা যায়। গত কয়েকদিনের বৃষ্টিতে আরও তাজা, আরও সতেজ। একটু পর পাল্টে গেল এটাও। নতুন দৃশ্যে দেখা গেল আলুথালু কাশফুলের বাহার। ঘন সতেজ সবুজের মাঝে দুগ্ধফেননিভঃ সফেদ কাশফুল। চোখ সরানোর মতো না। চোখ না সরালেও দৃশ্য সরে গেছে। কী অদ্ভুত সুন্দর পৃথিবী।

কিছু কিছু সময় আসে জীবনে, যখন সব কিছুই ভাল লাগে। ট্রেনের জানালা দিয়ে কারো নাক ঝাড়ার দৃশ্যও উপভোগ করা যায়। হয়তো এমন একটা মুহূর্ত পেয়েছি আমি হুট করেই।

একটু আগে এক জোড়া ভিক্ষুক এলেন, গান গাইতে গাইতে। দুইজনই অন্ধ। খুবই অমনোযোগী ভিক্ষুক। একজন একটু পর পর হাই তুলছেন আর সুর করে ভিক্ষা চাইছেন। অন্যজন নিতান্ত বলতে হবে দেখে গলা মেলাচ্ছেন। সুর মিলছে না দুইজনের। দু'জনের বেশভুষণ বেশ পরিপাটি। এত কিছু খেয়াল করতাম না। এরও খানিক আগে আরেক জোড়া ভিক্ষুক এসেছিলেন। যাদের গানে বেশ বললে কম হবে অনেক বেশি দরদ। গলায় এত চমৎকার সুর খেলা করছে। আর দুইজনই বেশ সুন্দর সুর মিলিয়ে গাইছেন। মনে হচ্ছে একজন না গাইলে কেমন ফাঁকা থেকে যাবে সুরটা। গানের কথাতেও ঝরে পড়ছে হাহাকার। আরেকজন এলেন লাফাতে লাফাতে। বাম হাত আর ডান পা গোড়া থেকেই নেই। অদ্ভুত একটা লাফ দিয়ে প্রতিটা সিটের কাছে থামে। এমন শব্দ হয় যে কারও পিলে চমকে যাবে। তার এই পদ্ধতি মানুষজনের খুব একটা পছন্দ হয় নাই। মোটামুটি ভর্ৎসনা করেই তাকে বগি থেকে বিদায় করে দিলো কয়েকজন। সবাই এই ব্যাপারটা নিয়ে কথা বলা শুরু করলো।

অবশ্য জার্নির শুরু থেকেই প্রচুর কথা ( বকবক) শুনতে হচ্ছে আমার। পাশের সিটে যে ভদ্রলোক বসেছেন প্রচুর কথা বলছেন ফোনে। এত কথা জমে থাকে একজনের ভেতরে। এখন অবশ্য ঘুমাচ্ছেন। ট্রেন চললে ফোনে নেটওয়ার্ক পায় না। হয়তো তাই।

বনের গাছগুলো কেমন জবুথবু হয়ে আছে। এখনই কুয়াশা পড়তে শুরু করেছে। মেঘের মতন রূপসী কুয়াশা দেখতাম ছেলেবেলায় মাঠে খেলার সময় সন্ধ্যার আগে আগে। কেমন অদ্ভুত লাগতো। মনে হতো মাথার কাছে মেঘ চলে এসেছে। সেই কুয়াশার শরীর ছুঁয়ে দেখবার সেকি প্রাণান্তকর চেষ্টা।
সেই ছেলেবেলার পর অনেক অনেক দিন বাদে মেঘেরও উপরে উঠেছিলাম। মেঘ ছুঁয়ে দেখেছিলাম। আমাকেও ছুঁয়ে গিয়েছিল মেঘ। কেমন যেন ছেলেবেলার একটা ঘ্রাণ পেয়েছিলাম অনুভবে।

কেমন অগোছালো চিন্তাভাবনা লিখে যাচ্ছি। আমার রোজনামচার খাতাগুলোতে এমন সব লেখায় ভর্তি৷ কলেজ অবধি নিয়মিত রোজনামচা লিখতাম। তারপর আর লেখা হয় না৷ খাতাগুলো খুলেও দেখা হয়না। এই দুইদিন অতীতে ফিরে যাব। আমার শৈশবে যেমন কাটতো দিন সেই জায়গাগুলোতে, সেই বিকেলগুলোতে নিয়ে যাব নিজেকে। যদিও জগতের কঠিন একটা সত্য হলো-
বড় হলে ছেলেবেলা মরে যায়। শুধু মরে যায় না, মরে ভুত হয়ে যায়।

ট্রেন ছুটছে। একটা নয়-দশ বছরের ছেলে ট্রেনের সাথে পাল্লা দিয়ে ছুটছে। অল্পক্ষণের জন্য ছেলেটার মায়া মায়া চোখ দুটো দেখতে পেলাম। খুব পরিচিত একজোড়া চোখের মতন। মনে পড়ছে না কার চোখ এমন। বন পেরিয়ে ট্রেন এখন একটা গ্রামের ভেতর দিয়ে যাচ্ছে। পরিপাটি আর গোছানো মনে হচ্ছে গ্রামটাকে৷ দীঘল একটা রাস্তা ঢুকে গেছে গ্রামের ভেতর। রাস্তার দু'পাশে ধানখেত। সবুজ আর সবুজ। পাশেই একটু উঁচু জমি। সেখানে ক্রিকেট মাঠ বানিয়ে খেলছে একদল কিশোর। ঠিক আমার সোনালী শৈশবের গল্পটা যেন। আহ্ ! সেইসব হিরণ্ময় মুহূর্তরা বড় বেশি তাড়া দেয় ভালো কিছু করার, সুন্দর কিছু সৃষ্টির।

দীর্ঘ একটা দূরত্বের যাত্রা। ঢাকা বিমানবন্দর স্টেশন থেকে গফরগাঁও এর মধ্যে আর কোন স্টেশনে থামবে না এই ট্রেন। এরপর ময়মনসিংহ। পরে অবশ্য একটু পরপর স্টেশন৷ একটা স্টেশন আছে আমার খুব প্রিয়। অতীতপুর স্টেশন। আমাদের মোহনগঞ্জের আগের স্টেশন। আমার দেখা সবচেয়ে নির্জন একটা রেলস্টেশন। নির্জন আর সুন্দর। কেউ যদি একটা বিকেল এই স্টেশনে বসে থাকে নির্মল সৌন্দর্যে তার চোখ জুড়াবেই।

স্টেশন লাগোয়া একটা বিল। এর একটু আগে অবশ্য আরেকটা বিল আছে তাতে লাল শাপলা ফুটে। শরতে দূর থেকে মনে হয় বিল না যেন কোন গোলাপী মাঠ।
সমান্তরাল রেললাইন ধরে হাঁটতে বেশ তৃপ্তি পাওয়া যায়। নামটাও কী সুন্দর! অতীতপুর৷

বিকেলের আলো মরে এসেছে। ট্রেনের ভেতরে বাতি জ্বলে উঠেছে। বগির অন্য মাথায় কোন একটা বিষয় নিয়ে বেশ তর্ক হচ্ছে। কু ঝিক ঝিক কু ঝিক ঝিক শব্দের ফাঁকে ফাঁকে ভেসে আসছে তর্কের চিৎকার, হাসি।

আমি জানালা দিয়ে তাকিয়ে আছি। বিশাল একটা মাঠ। অনেক দূরে মাঠের মাঝখানে একটা খেজুর গাছ দাঁড়িয়ে আছে। একা। নিঃসঙ্গ। ট্রেন আরেকটু আগাতেই চোখে পড়লো একটা গ্রামীন বাজার। খোলা একটু মাঠের মতন জায়গা। দুইটা বড় গাছ তার নিচেই বসেছে বাজার৷ একজন সফেদ শ্মশ্রুধারী বৃদ্ধ মাথায় একটা ঝাঁকা নিয়ে যাচ্ছেন। ট্রেনের জানালার কাছে আসতেই দেখা গেল অনেকগুলো জলপাই। জলপাই আমার প্রিয়। ইচ্ছে করছে বৃদ্ধকে বলি কয়েকটা জলপাই দিয়ে দিতে।

চিন্তাটা করেই হাসি পেয়ে গেল।

ট্রেন ছুটছে। সন্ধ্যা নামছে। আমার চোখ জুড়ে নেমে আসছে ঘুম। ট্রেনের ঝাঁকুনিতে যদি ঘুমই না এলো তবে সেটা কোন ট্রেন ভ্রমণই না।
সর্বশেষ এডিট : ২৭ শে সেপ্টেম্বর, ২০২৩ রাত ১০:০৬
৩টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

লালনের বাংলাদেশ থেকে শফি হুজুরের বাংলাদেশ : কোথায় যাচ্ছি আমরা?

লিখেছেন কাল্পনিক সত্ত্বা, ০৫ ই মে, ২০২৪ দুপুর ১:১৪



মেটাল গান আমার নিত্যসঙ্গী। সস্তা, ভ্যাপিড পপ মিউজিক কখনোই আমার কাপ অফ টি না। ক্রিয়েটর, ক্যানিবল কর্পস, ব্লাডবাথ, ডাইং ফিটাস, ভাইটাল রিমেইনস, ইনফ্যান্ট এনাইহিলেটর এর গানে তারা মৃত্যু, রাজনীতি,... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমেরিকার গ্র্যান্ড কেনিয়ন পৃথিবীর বুকে এক বিস্ময়

লিখেছেন কাছের-মানুষ, ০৫ ই মে, ২০২৪ দুপুর ১:৪১


প্রচলিত কিংবদন্তি অনুসারে হাতে গাছের ডাল আর পরনে সাধা পোশাক পরিহিত এক মহিলার ভাটাকতে হুয়ে আতমা গ্র্যান্ড কেনিয়নের নীচে ঘুরে বেড়ায়। লোকমুখে প্রচলিত এই কেনিয়নের গভীরেই মহিলাটি তার... ...বাকিটুকু পড়ুন

চুরি! চুরি! সুপারি চুরি। স্মৃতি থেকে(১০)

লিখেছেন নূর আলম হিরণ, ০৫ ই মে, ২০২৪ দুপুর ২:৩৪


সে অনেকদিন আগের কথা, আমি তখন প্রাইমারি স্কুলে পড়ি। স্কুলে যাওয়ার সময় আব্বা ৩ টাকা দিতো। আসলে দিতো ৫ টাকা, আমরা ভাই বোন দুইজনে মিলে স্কুলে যেতাম। আপা আব্বার... ...বাকিটুকু পড়ুন

যেকোন বাংগালীর ইন্টারভিউর সময়, 'লাই-ডিটেক্টটর' যোগ করে ইন্টারভিউ নেয়ার দরকার।

লিখেছেন সোনাগাজী, ০৫ ই মে, ২০২৪ বিকাল ৫:০৭



আপনার এনলাকার এমপি, প্রাক্তন অর্থমন্ত্রী কামাল সাহেব, যেকোন সেক্রেটারী, যেকোন মেয়র, বসুন্ধরা গ্রুপের চেয়ারম্যান, বিএনপি'র রিজভী, আওয়ামী লীগের ওয়ায়দুল কাদের, আপনার থানার ওসি, সীমান্তের একজন বিজিবি সদস্য, ঢাকার... ...বাকিটুকু পড়ুন

তাবলীগ এর ভয়ে ফরজ নামাজ পড়ে দৌড় দিয়েছেন কখনো?

লিখেছেন লেখার খাতা, ০৫ ই মে, ২০২৪ রাত ৯:২৬


আমাদের দেশের অনেক মসজিদে তাবলীগ এর ভাইরা দ্বীন ইসলামের দাওয়াত দিয়ে থাকেন। তাবলীগ এর সাদামাটাভাবে জীবনযাপন খারাপ কিছু মনে হয়না। জামাত শেষ হলে তাদের একজন দাঁড়িয়ে বলেন - °নামাজের... ...বাকিটুকু পড়ুন

×