জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম শুধু একজন কবি নন আমার মতে তিনি একজন দার্শনিকও বটে। আজ থেকে শতবর্ষ আগে তিনি সংকল্প কবিতায় লিখেছিলেন, পাতাল ফেড়ে নামব নীচে, ওঠব আবার আকাশ ফুঁড়ে; বিশ্ব- জগৎ দেখবো আমি আপন হাতের মুঠোয় পুরে’। জীবদ্দশায় কবি আপন হাতের মুঠোয় জগৎ না দেখতে পারলেও তার সেই অভিলাষ আজ শতভাগ সত্যি। তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তিতে বাংলাদেশের অগ্রগতি ও অর্জনে কবির সেই ভবিষ্যতবাণীর প্রতিফলন সর্বত্র। দেশের প্রধান খাত কৃষিও তাতে পিছিয়ে থাকবে কেন? তথ্যপ্রযুক্তির পাখায় ভর করে সে অর্জনের সুফল যাতে দেশের কৃষি ও কৃষক সমভাবে পায় সে লক্ষ্যে নেওয়া হয়েছে নানা উদ্যোগ। কৃষকদের জন্য দরকারি নানা তথ্য ও পরামর্শ যেন সহজেই কৃষকের কাছে পৌঁছতে পারে সে জন্য কৃষিতে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তির যেসব সুবিধা উন্মুক্ত হয়েছে তার মধ্যে ই-কৃষি, কৃষি ডাক্তার, কৃষি কল সেন্টার, বাংলাদেশ রাইস নলেজ ব্যাংকসহ কৃষিভিত্তিক বিভিন্ন মোবাইল অ্যাপ্লিকেশন ও ওয়েবসাইট চালু রয়েছে। এসব উদ্যোগের ফলে কৃষি প্রযুক্তি সংক্রান্ত জ্ঞান ব্যবস্থাপনা এবং কৃষি তথ্য ও পরামর্শ সেবায় এসেছে গতিশীলতা। সাম্প্রতিক কিছু উদ্ভাবনী উদ্যোগ সে গতিশীলতাকে আরও ত্বরান্বিত করেছে। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের একসেস টু ইনফরমেশনের (এটুআই) সার্বিক তত্ত্বাবধানে এবং কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর (ডিএই) কর্তৃক বাস্তবায়িত এই তিন উদ্ভাবনী সেবা হলো- কৃষকের জানালা, কৃষকের ডিজিটাল ঠিকানা ও বালাইনাশক নির্দেশকা। আর এই তিনটি সেবার উদ্ভাবক কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর (ডিএই) এর তিনজন চৌকস কৃষি কর্মকর্তা কৃষিবিদ আবদুল মালেক, কৃষিবিদ শাহাদৎ হোসাইন সিদ্দিকী ও কৃষিবিদ সুকল্প দাস। এই তিনটি অ্যাপস ব্যবহার করে ফসল চাষের নানা সমস্যার সমাধান, কোন রোগে কী ওষুধ ব্যবহার করতে হবে এ রকম নানা দিক-নির্দেশনা ঘরে বসেই পাবেন কৃষক ও সংশ্লিষ্টরা। এসব উদ্যোগের পেছনের গল্প ও সেবার নানাধিক নিয়ে আজকের প্রয়াস।
কৃষকের জানালা
জনপ্রিয় কৃষি অ্যাপস কৃষকের জানালা। কৃষকদের ফসলের নানা সমস্যার দ্রুত ও কার্যকরভাবে সমাধান দেওয়ার একটি ডিজিটাল প্রয়াস। ফসলভিত্তিক নানা সমস্যার চিত্র যৌক্তিকভাবে সাজিয়ে তৈরী করা হয়েছে এটি। যেখানে ছবি দেখে কৃষক নিজেই তার সমস্যাটি চিহ্নিত করতে পারেন এবং চিহ্নিত ছবিতে ক্লিক করলেই সমস্যার সমাধান মনিটরে ভেসে ওঠে। এখানে মাঠ ফসল, শাক-সব্জি, ফল-মূল ও অন্যান্য গাছের রোগ-বালাই, পোকা-মাকড়, সারের ঘাটতি বা অন্যান্য কারণে যেসব সমস্যা হয়; সেসব সমস্যা ও তার সমাধান যুক্ত করা হয়েছে। প্রতিটি সমস্যার একাধিক ছবি এবং কমপক্ষে একটি প্রতিনিধিত্বপূর্ণ ছবি যুক্ত করা হয়েছে; যাতে কৃষক সহজেই তার সমস্যাটি চিহ্নিত করতে পারে। স্মার্টফোন, ল্যাপটপ অথবা ডেস্কটপের মাধ্যমে ‘কৃষকের জানালা’য় প্রবেশ করে ফসল চাষে চিহ্নিত সমস্যায় ক্লিক করলেই মিলবে সমাধানের বার্তা। ১২০টি ফসলের এক হাজার সমস্যার সমাধানের এই মোবাইল অ্যাপসটি বিশ্বের স্বীকৃতি ও সুনামও অর্জন করেছে। সম্প্রতি তথ্যপ্রযুক্তি খাতের মর্যাদাপূর্ণ সম্মাননা বলে বিবেচিত ওয়ার্ল্ড সামিট অন দ্য ইনফরমেশন সোসাইটি (ডব্লিউএসআইএস) পুরস্কারে ভূষিত হয় ‘কৃষকের জানালা’। ১৮ টি ক্যাটাগরিতে এই পুরস্কার দেওয়া হয়েছে। কৃষকের জানালা ক্যাটাগরি ১৩ এ (ই-কৃষি) ডব্লিউএসআইএস পুরস্কার ২০১৬ এর চ্যাম্পিয়ন প্রজেক্ট হিসাবে পুরস্কিত হয়েছে । কৃষকের জানালা ওয়েবসাইটটিতে প্রবেশ করলে পাওয়া যাবে মাঠ ফসল, ফল, শাক-সবজি, মসলা, ফুল ও বিভিন্ন ধরনের ফসলের নাম ও এসব ফসল চাষ সম্পর্কিত নানা সমস্যার সমাধান।
কৃষকের জানালার মূল উদ্ভাবক ও পরিকল্পনাকারী সিলেটের বালাগঞ্জের উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা আবদুল মালেক। এই উদ্ভাবনের পেছনে তাঁর অভিজ্ঞতা সর্ম্পকে বলেন, কৃষি পরামর্শ সেবা নিতে এসে যেসব কৃষক তাদের ফসলের সমস্যাটি ভালভাবে বলতে পারেন না, তাদেরকে তাদের ফসলের সমস্যা বলতে সহযোগিতা করার জন্য মাঠে সচরাচর হয় এমন কিছু সমস্যার ছবি তুলে কম্পিউটারে রাখা হয়। এরপর কৃষক কোন সমস্যা নিয়ে আসলে যারা সমস্যার কোন নমুনা নিয়ে আসেন না, তাদের সে ছবিগুলো দেখানো হয়। দেখা গেল এটি খুব ভাল কাজ করছে। কৃষক ছবি দেখে নিজেই তার ফসলের সমস্যাটি চিহ্নিত করতে পারছেন। এরপর ছবিগুলোর সাথে সমস্যার সমাধান যুক্ত করা হল। এবার এটি ফসলের সমস্যার সমাধান দেওয়ার ক্ষেত্রে কৃষক ও কৃষি সম্প্রসারণ কর্মী উভয়ের জন্যই সহায়ক হল। কৃষকদের মতামত নেবার জন্য একাধিক জরিপ পরিচালনা করা হয়। এতে দেখা যায়, যেসব কৃষক তখনও এ পদ্ধতিতে সেবা নেননি তাদের মধ্যে ৭৬% এবং যারা এ পদ্ধতিতে সেবা নিয়েছেন তাদের মধ্যে ১০০% কৃষক মনে করেন পদ্ধতিটি তাদের জন্য সহায়ক। পরবর্তীতে এই ধারনাটি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেইসবুকে একসেস টু ইনফরমেশন (এটুআই) কর্মসূচি পরিচালিত “পাবলিক সার্ভিস ইনোভেশন বাংলাদেশ” নামক ফেসবুক গ্রুপে পোস্ট করা হয়। এতে উৎসাহব্যঞ্জক সাড়া পাওয়া যায়। অসংখ্য মন্তব্য ও পরামর্শ আসে বিশিষ্ট্যজনদের কাছ থেকে। সে আলোকেই এর নামকরণ করা হয় “কৃষকের জানালা”। জানালা দিয়ে উঁকি দিয়ে যেমন কৃষক তার ক্ষেত/ফসল দেখতে পায়, তেমনি এই কৃষকের জানালায় উঁকি দিয়েও কৃষক তার ক্ষেতের বা ফসলের সমস্যা ও তার সমাধান দেখতে পাবে।
বালাইনাশক নির্দেশিকা
বালাইনাশক বা পেস্টিসাইড ব্যবহারে নানান সমস্যায় পড়েন কৃষক। কোন জমিতে কখন কতটুকু বালাইনাশক কখন প্রয়োগ করবেন সম্পর্কিত বিস্তারিত তথ্যাদি কৃষকসহ সকলের দোরগোড়ায় পৌঁছে দিতে ডিজিটালাইজড ‘বালাইনাশক নির্দেশিকা’ নামক ওয়েবপেজ ও মোবাইল অ্যাপ্লিকেশন তৈরি করেছেন ময়মনসিংহের ফুলপুর উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা সুকল্প দাস। এই অ্যাপস তৈরীর পেছনের গল্প সম্পর্কে কৃষি কর্মকর্তা সুকল্প দাস জানান, দেশের অধিকাংশ কৃষকের স্বাভাবিক প্রবণতা হলো ফসলে রোগ বা পোকা-মাকড়ের আক্রমণ হলে স্থানীয় কোনো বালাইনাশকের দোকান থেকে ওষুধ কিনে মাঠে স্প্রে করা। সঠিক রোগ চিহ্নিত না করে অনুমান নির্ভর বালাইনাশক ওষুধ প্রয়োগ করে অনেক সময় কাঙ্খিত ফল পাওয়া যায়না। এতে কৃষক আর্থিক ক্ষতির সম্মুখিন হন। অনেক সময় কৃষকরা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের ইউনিয়ন পর্যায়ের কৃষি কর্মকর্তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করলেও তারা তাৎক্ষণিক কোনো সমাধান দিতে পারেন না। যথোপযুক্ত বালাইনাশক শনাক্ত করতে কৃষি কর্মকর্তাদেরকেও অনেক ক্ষেত্রে বই-পুস্তক দেখতে হয়, বালাইনাশক কোম্পানির প্রতিনিধিদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে হয়। এতে সময় নষ্ট হয়, সরকারি কর্মকর্তাদের ওপর কৃষকের আস্থা নষ্ট হয়।
কিভাবে কাজ করে এই অ্যাপস: ‘বালাইনাশক নির্দেশিকা’ অ্যাপসে প্রবেশ করে ক্ষতিকর পোকার নাম লেখার সঙ্গে সঙ্গেই এর বিপরীতে কার্যকরী সকল বালাইনাশকের গ্রুপের নাম স্ক্রিনে আসবে। আর গ্রুপে ক্লিক করলেই ওই গ্রুপের বিভিন্ন কোম্পানির বাজারজাতকৃত সকল বালাইনাশকের বাণিজ্যিক নামের তালিকা আসবে। সেটি দেখে বালাইনাশকের দোকানে গিয়ে পছন্দমতো কোম্পানির বালাইনাশক ওষুধ কিনতে পারবেন কৃষকরা। এভাবে ওয়েব অ্যাপসের মাধ্যমে তৈরি অটোপ্রেসক্রিপশন প্রিন্টও করা যাবে। সুকল্প দাস বলেন, এ ওয়েবপেজ ও বালাইনাশক নির্দেশিকার মাধ্যমে শুধু কৃষকরাই নন, কৃষি সেবাদানকারী বিভিন্ন কোম্পানি, গবেষক, কৃষিশিক্ষায় নিয়োজিত ছাত্র-শিক্ষক সবাই উপকৃত হবেন। ফসলের যাবতীয় বালাইনাশকের চিকিৎসায় সঠিক ওষুধের দিক-নির্দেশনা পাওয়া যাবে বালাইনাশক নির্দেশিকা নামের অ্যাপসটি ব্যবহার করে।
কৃষকের ডিজিটাল ঠিকানা
এই অ্যাপসটির মূল উদ্ভাবক জাতীয় কৃষি প্রশিক্ষণ একাডেমীর সিনিয়র সহকারী পরিচালক মুহাম্মদ শাহাদৎ হোসাইন সিদ্দিকী। তিনি জানালেন অ্যাপসটি তৈরির পেছনের গল্প। তখন তিনি বেলকুচিতে উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা পদে কর্মরত। বেলকুচি সদর এবং বড়ধূল ইউনিয়ন আয়তনে বেশ বড়। নদী পার হয়ে উপজেলা সদরে আসতে অনেক কৃষকের আধাবেলা ফুরিয়ে যায়। কোন এক রবিবারে তিনি দাপ্তরিক কাজে গিয়েছিলেন জেলা সদরে। বেলকুচি ফিরে অফিস সহকারীর কাছে জানতে পারলেন স্থানীয় বড়ধূলের কৃষক শাহ আলম এসেছিলেন পরামর্শের জন্য। অনেকক্ষণ বসে ছিলেন। পরে চলে গেছেন। পরদিন তিনি নদী, মেঠোপথ আর চরের ঢাল পেরিয়ে শাহ আলমের বাড়ি যান। শাহ আলমের জমি ও ফসল দেখে ফেরার পথে এক বৃদ্ধের সঙ্গে দেখা হলো। তিনি জানালেন, এক সপ্তাহে তিন দিন কৃষি অফিসে গেলেও অফিসারের দেখা পাননি। যেতে অনেক কষ্ট হয়েছে আর খরচও হয়েছে অনেক। বাসায় ফিরে ভাবতে বসলেন কী করা যায়। এমন একটি সফটওয়্যার তৈরির কথা ভাবলেন, যার মাধ্যমে কৃষক ঘরে বসেই সেবা পায়। সে চিন্তার বাস্তব রূপ এই কৃষকের ডিজিটাল ঠিকানা। ফসল চাষাবাদে সব ধরনের সমস্যার সমাধান পাওয়া যায় ‘কৃষকের ডিজিটাল ঠিকানা’ নামক অ্যাপসে। এতে মিলবে ১২০ ফসলটি উৎপাদনের যাবতীয় তথ্য। রোগ, পোকামাকড় দমন, যুগপোযোগী ও আধুনিক প্রযুক্তির উদ্ভাবনসহ নানা তথ্যে ভরপুর এই আ্যাপস। এই অ্যাপসের একটা অফলাইন ভার্সন করা হবে। যা মোবাইলে রাখতে পারবেন কৃষকরা। এতে ইন্টারনেট ছাড়া এলাকার কৃষকরাও ব্যবহার করতে পারবেন। গুগল প্লে স্টোর থাকবে সেখান থেকে অ্যাপসটি পাওয়া যাবে। এছাড়া কেউ ইচ্ছে করলে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের ওয়েবসাইট থেকেও অ্যাপসটি ডাউনলোড করতে পারবেন। শাহাদৎ হোসাইন জানালেন, তাঁর এই প্রযুক্তি ইতিমধ্যেই জাতীয় পর্যায়ে স্বীকৃতি পেয়েছে। স্বীকৃতি স্বরূপ ইতিমধ্যে পেয়েছেন জনপ্রশাসন পদক ও কেআইবি কৃষি পদক।
লেখকঃ ঊর্ধ্বতন যোগাযোগ কর্মকর্তা, ব্রি, গাজীপুর।
হাতের মুঠোয় কৃষি তথ্যসেবা