কৃষি ট্যুরিজমঃ শেষ কবে খালি পায়ে ঘাসে হেটেছেন? শেষ কবে নিজ হাতে গাছ থেকে ফল পেড়ে খেয়েছেন? আপনার নাগরিক জীবনে সেই সুযোগইবা পাবেন কোথায়। সামনে ঈদ, নাড়ীর টানে বাড়ির পানে ছুটছেন নাগরিক মানুষ। ঈদে বাড়ি যাওয়া মানে আত্মীয়-স্বজন নিয়ে ঈদ উদ্যাপন করা। আপনার সেই উদ্যাপনে ভিন্নতার ছোয়া এনে দিতে পারে কৃষি পর্যটন। শহরের পরিবেশে বেড়ে ওঠা ইংলিশ ও বাংলা মিডিয়াম স্কুলের ছেলে মেয়েরা ভাত খায় ঠিকই কিন্তু কিভাবে ধান হয় তা হয়তো তা কখনো দেখেনি। কিভাবে কৃষক মাথার ঘাম পায়ে ফেলে ঝড়-বৃষ্টি, রোদ-বাদল উপেক্ষা করে ফসল ফলাচ্ছেন তা শুধু টিভিতে দেখলেও বাস্তবে উপলদ্ধি করেনি কখনোই। তাই ঈদের ছুটি হতে পারে তাদের দেশের বৈচিত্র্যময় কৃষি ও কৃষ্টির সাথে পরিচিত করার একটি সূবর্ণ সুযোগ।
বাংলাদেশ একটি কৃষি প্রধান দেশ। এদেশের যেদিকে চোখ যায় শুধু সবুজ আর আর মনকাড়া চিত্র বৈচিত্রে ভরা। যে মৌসুমই আসুক না কেন সবুজ আর সজীবতার যেনো শেষ নেই। আর এর মাঝেও আছে নানান বৈচিত্র্যের সমাহার। কেউ কি আমরা খুঁজে দেখেছি সে সব বৈচিত্র্যময় বিচিত্রতাকে। কতো জন চোখ মেলে দেখেছি ধানের ক্ষেতে ঢেউ খেলে যায় বাতাস কাহার দেশে, কোথায় এমন হরিৎ ক্ষেত্র আকাশ তলে মেশে। কিংবা সকালের দিকে ধানের ফুল ফোটার শব্দ কেউ কি কান পেতে শুনেছি? কেউ কি দেখেছি সকালের সূর্যোদয়ের সময় ধান ক্ষেতের পশ্চিমে দাঁড়িয়ে পূবের দিকে মাকড়শার জালের অপূর্ব কারুকার্য্য! কিংবা শীতকালীন সবজি ক্ষেতে সকালের শিশির বিন্দু। হয়তো দেখেছি আসা-যাওয়ার পথে। কিন্তু দেখিনি দেখার মতো করে। মনের মাধুরী মিশিয়ে কল্পনা করিনি কোন কিছুর সাথে। কৃষি বলতে আমরা ধান, পাট, আখ ইত্যাদি দানাদার শস্যের সাথে ফুল, ফল, শাকসবজির চাষ, মৎস্য চাষ ও গবাদি পশুপালনকে বুঝি। কিন্তু আধুনিক কৃষি গতানুগতিক চাষাবাদ থেকে ভিন্ন কিছু। বাংলাদেশে ৩০টি এগ্রোইকোলজিকাল জোন (অঊত, অমৎড় ঊপড়ষড়মরপধষ তড়হব) একেকটি বা একাধিক ফসল বা কৃষি পরিবেশের জন্য বিখ্যাত। দিনাজপুরের লিচু ভালো, রাজশাহীর আম, সিলেটের চা ভালো, পার্বত্য চট্টগ্রামের জাম। নরসিংদীর কলা ভালে, বগুড়ার দই। একেক অঞ্চল একেকটি ঐতিহ্যবাহী ফসল নিয়ে কৃষি পর্যটন হতে পারে। শহরের তরুণরাও এসব স্পটে দল বেঁেধ ভ্রমণ করতে পারে। এতে তারা কৃষির সাথে পরিচিত হতে পারবে পাশাপাশি, প্রকৃতির সাথে সময় কাটিয়ে নির্মল আনন্দ পাবে।
কৃষি ট্যুরিজমের ধারনাঃ প্রথমতঃ কৃষি ট্যুরিজম ব্যাপারটি আমাদের দেশে নতুন হলেও উন্নত দেশে যথেষ্ট জনপ্রিয়তা রয়েছে। ব্যাপারটি সহজ করে ব্যাখ্যা করলে এমন দাঁড়ায় শহরের ছেলে মেয়েরা স্ট্রবেরি পছন্দ করে কিন্তু কিভাবে কোন গাছে স্ট্রবেরি উৎপন্ন হয় তা জানে না। আলু কিভাবে ধরে, মাটির নিচে না ওপরে তা দেখেনি। তাছাড়া প্রত্যেক গ্রামেই কিছু কৃষক ও তরুণ রয়েছেন, যারা কীটনাশক বিহীন ফসল উৎপাদন করে ও ফসল বিক্রি করতে পারছেন না অথবা কম দামে বিক্রি করছেন শুধুমাত্র প্রচারের পাদপ্রদীপের নিচে রা আসতে পেরে। তাছাড়া উন্নত দেশের মত আমাদের দেশে বিশাল আকৃতির কৃষি ফার্মও গড়ে ওঠছে না, কৃষি পর্যটনের অভাবে। একটি উদাহরণ বিষয়টি আরো স্পষ্ট করবে। আমের রাজধানী রাজশাহী, লিচুর জন্য বিখ্যাত দিনাজপুর। এখন আম ও লিচুর ভরা মওসুম। এই ছুটিতে বিষমুক্ত টাটকা আম ও লিচু খেতে দল বেঁধে চলে যেতে পারেন রাজশাহী ও দিনাজপুর। এতে করে একদিকে যেমন টাটকা আম বা লিচু খাওয়া হবে অন্যদিকে এগুলোর চাষবাদ সম্পর্কে সম্যক জ্ঞান লাভ হবে। ব্যাপারটি অনেকটা রথে গিয়ে কলা বেচা আর মেলা দেখার মতো। আর নিজ হাতে বাগান থেকে পাকা আম ছিড়ে খাওয়ার আনন্দ যে কেমন কেবল সেই জানে যে বাগানে গিয়ে পছন্দ মতো টসটসে পাকা আম ছিড়ে খেয়েছে। আবার ধরুন কালিজিরা ধানের চাষ কুমিল্লায় ভালো হয় আবার কাটারি চাল দিনাজপুরে। ঈদের ছুটিতে কুমিল্লা বা দিনাজপুরে দর্শনীয় স্থান ঘুরে আসুন। জেনে ও দেখে আসুন কালিজিরার চাষাবাদ ও উৎপাদন পদ্ধতি। ফেরার সময় উপটোকন হিসেবে পরিবারের সদস্যদের জন্য বা শহুরে বন্ধু ও স্বজনের জন্য কয়েক কেজি নিয়ে আসুন সাথে করে। দেখবেন এর চেয়ে খুশি আর কিছুতেই হবেনা তারা। অনেক বন্ধু ও ছোট ভাইকে দেখেছি ইলিশের ভরা মৌসুমে পদ্মার চর, মাওয়া ঘাট ও চাঁদপুরে চলে যেতে টাটকা ইলিশ খেতে। তারচেয়ে ভাল উপায় কী আছে। বাসায় যতই সরষে ইলিশ খান, পদ্মার ধারে মাওয়া ঘাটে বসে পছন্দসই ইলিশ পছন্দের মশলায় রান্না বা ভাঁজা খাওয়ার মজাটাই অন্য রকম। এটি শুধু ইলিশ খাওয়া নয়, দেশের একটি ঐতিহ্যেও সঙ্গে পরিচিত হওয়া। বর্তমানে অনেক ইনোভেটিভ কৃষক অর্গানিক ও কীটনাশক বিহীন প্রযুক্তিতে ধান, শাক সবজি, ফুল, ফসল ও মৌমাছি চাষ করছে। অনেক কৃষক ও তরুণ আধুনিক কৃষি ফার্ম গড়ে তুলেছেন। এসব ফার্ম ভ্রমনের মাধ্যমে ক্ষেত থেকে সদ্য তোলা বা সদ্য পাড়া কৃষিপণ্য বা ফল ফলাদি খাওয়ার ও ক্রয়ের আনন্দ পাবেন উৎসুক পর্যটকরা। এতে দেশে কৃষি ও কৃষক লাভবান হবে। সর্বোপরি কৃষক ও দেশের প্রতি তরুণ সমাজের ভালবাসা জন্মাবে।
কৃষি পর্যটনের স্পটঃ কৃষি মন্ত্রলালয়ের অধীন বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট, ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট, ইক্ষু গবেষণা ইনস্টিটিউট, মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউট, মশলা গবেষণা ইনস্টিটিউট, আম গবেষণা ইনস্টিটিউট, কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর নয়নাভিরাম ক্যাম্পাস, জার্মপ্লাজম সেন্টার, জিনব্যাংকসহ বিভিন্ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন ও সর্বশেষ উদ্ভাবিত কৃষি কলাকৌশল ও জাতের সাথে পরিচিত হওয়া; বিভিন্ন কৃষিভিত্তিক শিল্প প্রতিষ্ঠান (যেমনঃ প্রাণ) কৃষি প্রক্রিয়াজাতকরণ প্লান্ট পরিদর্শন করা কৃষি পর্যটনের সম্ভাবনাময় স্পট হতে পারে। আমাদের সারাদেশে ছড়িয়ে আছে প্রায় পাঁচশ’র কাছাকাছি হাওড়-বাওড়, হাজারো বিল-ঝিল দীঘি জলসাগর। এসব জলাশয়ে আধুনিক জলযানে ঘুরে বেড়ানো, পাখি দেখার ব্যবস্থা, মাছ ধরার সুবিধা, জেলেদের সাথে মাছ ধরার সুযোগ, নৌকা বাইচের ব্যবস্থা, নৌকা চালানো এসব; মৌমাছি পালনকারীদের মধু সংগ্রহ দেখা ও টাটকা মধু খাওয়া, স্বল্পমূল্যে পর্যটকদের কাছে বিক্রির ব্যবস্থা করা পর্যটকদেও আকৃষ্ট করবে এতে কোন সন্দেহ নাই। ফল ধরার মৌসুমে ভাগ ভাগ করে ফুল ফোটা বা মুকুল ধরা দেখা, পাকা ফলের বাগানে ঘুরে বেড়ানো, এমনকি মৌসুমের একটি নির্দিষ্ট দিনে নির্দিষ্ট সময়ের জন্য নির্দিষ্ট অংকের টাকার বিনিময়ে বাগানেই যতো খুশি ফল খাওয়ার সুযোগ করে দেয়া; রকমারি সুন্দর সুন্দর ফুল ফোটা সবজিক্ষেত পরিদর্শন করা, আন্তঃপরিচর্যা, সংগ্রহ ও সবজির চাষ কৌশল দেখা; নিজে সংগৃহীত সবজি পুষ্টিসম্মত উপায়ে রান্না করে খাওয়ার ব্যবস্থা রাখা; দেশের বিভিন্ন স্থানের হর্টিকালচার সেন্টার-এর জার্মপ্লাজম সংগ্রহ ও অন্যান্য চলমান কার্যক্রম পরিদর্শন করা; চরের কৃষি ও চরের সংগ্রামী মানুষের কৃষি কর্মকান্ড পরিদর্শন করা এবং তাদের সাথে কাজে অংশগ্রহণ করা। বিশেষ করে বন্যার পরে চরে পলিপড়া মাটিতে হেঁটে বেড়ানো; চা বাগান পরিদর্শন ও চা প্রক্রিয়াজাতকরণ পদ্ধতি দেখা, যেকোন বড় বিশেষ উল্লেযোগ্য কৃষিখামার পরিদর্শন; পাহাড়িদের কৃষির সাথে পরিচিত হওয়া ও তাদের কাজের সাথে অংশগ্রহণ করা; অটোমেটিক রাইস মিল, হিমাগার, চিনিকারখানা, মুড়ির কারখানা, চিড়ার কারখানা পরিদর্শন; কোন সফল কৃষকের কর্মকান্ড পরিদর্শন, তার সফলতার কাহিনীর বর্ণনা শোনা।
প্রয়োজন উদ্যোগঃ কৃষি পর্যটনের বাংলাদেশ এই ধারনাটি বাস্তবায়নে কৃষি মন্ত্রনালয়, পর্যটন মন্ত্রনালয় ও আইসিটি মন্ত্রনালয়ের সমন্বয়ে কৃষি ট্যুরিজম নামক একটি ওয়েবসাইট ও মোবাইল অ্যাপস তৈরি করা যেতে পারে। কৃষি মন্ত্রণালয় তাদের উপজেলা কৃষি অফিসার ও প্রত্যেক গ্রামের উপ-সহকারী কৃষি কর্মকর্তা বা ব্লক সুপারভাইজারের মাধ্যমে কোন এলাকায় কি ভালো হয়, কোন এলাকায় কে অর্গানিক বা বিষমুক্ত চাষাবাদ করছে তার একটা ডাটাবেজ তৈরী করতে পারে। যেমন; রাজশাহীতে কবে আম পাড়া শুরু হবে, বিল বা হাওড়ে কোন দিন মাছ ধরার উৎসব হবে, কোন মাসে বা সময়ে পদ্মায় ইলিশের ভর মওসুম থাকবে এসব তথ্য পূর্বেই ওয়েবসাইটে আপলোড করবেন। অন্যদিকে পর্যটন মন্ত্রনালয় উক্ত এলাকায় কিভাবে কম খরচে বা স্বাচ্ছন্দে মানুষজন যাবে, কোথায় থাকার ব্যাবস্থা আছে, ভাড়া কত ইত্যাদি তথ্যাদি ওয়েবসাইটে লিপিবদ্ধ করবে। আর আইসিটি মন্ত্রনালয় ঐসব এলাকা থেকে ছবি ও ভিডিও এনে একটি সুন্দর ইভেন্ট ভিত্তিক ওয়েবসাইট ও মোবাইল অ্যাপস ডেভেলপ করবে। এতে শুধু সিলেট বা পার্বত্য চট্টগ্রাম নয়, কৃষি পর্যটন এলাকা হবে পুরো বাংলাদেশ। সেইসাথে ওয়েবসাইটে প্রত্যেক এলাকার আধুনিক ফার্ম ও সেখানে একদিন থাকার মত ব্যবস্থা থাকলে তা উল্লেখ থাকবে। অথবা এই ওয়েবসাইটে একটি পূর্ব ঘোষণা দিয়ে নির্দিষ্ট তারিখ ঠিক করে দিবে যে, আগামী জ্যৈষ্ঠ্য বা মধু মাসের ২,৩ ও ৪ তারিখ আমরা আমের রাজ্য চাপাইনবাবগঞ্জ ও রাজশাহী আম বাগান পরিদর্শনে যাব। আগ্রহীরা রেজিস্ট্রেশন করে যোগ দিতে পারেন। এভাবে দিনাজপুরের ঐতিহ্যবাহী কাটারিভোগ চাল চাষ। পাবনার পেপে বাদশার পেপে বাগান। যশোহরের গদখালীর ফুল চাষের বিস্তৃতি এলাকা। পাহাড়ি এলাকার জুম ও মাল্টা চাষ। হবিগঞ্জ, ব্রাক্ষণবাড়িয়া, ফরিদপুর ইত্যাদি এলাকার গভীর জলের ধান চাষ। মুন্সিগঞ্জে রবি মৌসুমে আলু চাষ। হাওরে জোৎস্না দেখা ও মাছ মারা ইত্যাদি ইভেন্ট খোলা যেতে পারে।
কৃষি পর্যটনের সম্ভাবনাঃ সকল বয়সী মানুষের মধ্যেই গ্রাম ও প্রকৃতির প্রতি আলাদা আকর্ষন আছে। তাছাড়া তথ্য প্রযুক্তির কল্যাণে কৃষির প্রাকৃতিক সৌন্দর্য অবলোকনের স্পৃহা বাড়ছে দিন দিন। মানুষ শিকড়মুখী হতে চায়, পুকুরে সাতার কাটতে চায়, নিজ হাতে মাছ ধরতে চায়, গাছ থেকে ফল-ফলাদি পেড়ে খেতে চায়। যতই দিন যাবে মানুষ অর্গানিক আর বিষমুক্ত কৃষিপণ্যের চাহিদা বাড়বে। এই কারণে অদূর ভবিষ্যতে মানুষ ওয়েবসাইট বা অ্যাপস ঘেটে তার আশেপাশের কৃষি ও কৃষ্টির দর্শনীয় স্থান ভ্রমণ করতে চাইবে। আর তরুণ উদ্যোক্তারা এই সুযোগটি লুফে নিবেন ব্যবসার জন্য। একটি সম্পূর্ণ প্রাকৃতিক পরিবেশকে ঘিরে ব্যবসায়িক কার্যক্রম ও বিনোদন আবর্তিত হবে। এতে ক্রেতা ও কৃষক উভয়ই উপকৃত হবেন। যেমন-ভোক্তার কাছে সরাসরি পণ্য বিক্রি করতে পারলে কৃষক ন্যায্যমূল্য পাবেন। আশা করা যায় কৃষি পর্যটনের ধানাটি বাস্তবায়িত হলে আগামী ৫-১০ বছরে দেশের কৃষি ও কৃষকের অবস্থার একটা বৈপ্লবিক পরিবর্তন ঘটবে। কৃষির বাণিজ্যিকীকরণ হবে। এ ধারনা বাস্তবায়িত হলে অনেকেই চাকুরী শেষে অবসরকালীন সময়ে গ্রামে চলে গিয়ে কৃষি ফার্ম গড়ে তোলায় মনযোগী হবেন। এতে মানসিক ও শারিরীক প্রশান্তির পাশাপাশি জীবন ধারনের অভ্যাসজনিত কিছু রোগবালাই যেমন; বয়স্কদের ডায়বেটিক ও হৃদরোগের হার কমে আসবে। পাশাপাশি গ্রামীণ এলাকার মানুষের কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হবে।