somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

কোরআনিক ব্যাখ্যায় দয়াদর্শন : সূরা বাকারা, রুকু-২, আয়াত : ১০, প্রসঙ্গ : মুনাফিক-৩

১৫ ই জুলাই, ২০১৫ রাত ২:২৮
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

কোরআনিক ব্যাখ্যায় দয়াদর্শন : সূরা বাকারা, রুকু-২, আয়াত : ১০
প্রসঙ্গ : মুনাফিক-৩
-------------------------------------------
{১০} فِي قُلُوبِهِم مَّرَضٌ فَزَادَهُمُ اللّهُ مَرَضاً وَلَهُم عَذَابٌ أَلِيمٌ بِمَا كَانُوا يَكْذِبُونَ
উচ্চারণ : ফি কুলুবিহিম মারাযুন ফাযাদাহুমুল্লাহু মারাযাউ ওয়ালাহুম আযাবুন আলিমুম বিমাকানু ইয়াকযিবুন
অর্থ : তাদের অন্তরে ‘ব্যধি’ রয়েছে, উপরন্তু আল্লাহ তাদের ‘ব্যধি’ আরও বাড়িয়ে দিয়েছেন এবং তাদের জন্য যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি রয়েছে যেহেতু তারা মিথ্যা বলতো।

এই আয়াতে মুনাফিকদের অন্তরের ‘মরিয’-এর কথা বলা হয়েছে। অনেকে মরিযের অর্থ করেছেন রোগ। এই অর্থ সমার্থক হলেও পূর্ণাঙ্গ সঠিক বলা যাবে না। রোগ শব্দের আরবি হলো ‘সুকুমুন বা সাকমুন’। এখানে আল্লাহ ব্যবহার করেছেন ‘মরিয’। ‘মরিয’ শব্দের অর্থ ‘ব্যধি’। রোগ আর ব্যধি দুটি শব্দে কিছুটা হলেও ব্যবধান রয়েছে। সুকুমুন অর্থাৎ রোগ, যা সাধারণ বিধান রাখে, এই শব্দ দিয়ে কোন বিশেষ রোগকে বুঝায় না। আর মরিয অথাৎ ব্যধি হলো একটি নির্দিষ্ট রোগ, যা দিয়ে বুঝায় এই রোগ দেহে প্রবেশের পর সে দেহের স্বাভাবিক অবস্থা ব্যাহত করে এবং ক্রমশ সে আক্রান্ত ব্যক্তিকে দুর্বল করে ধ্বংসের দিকে নিয়ে যায়। এখানে বলা হয়েছে, তাদের অন্তরে ব্যধি রয়েছে এবং এই ব্যাধিকে আরো বাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। মরিয বা ব্যধি শব্দই বলে দেয় তা ক্রমাগত বেড়ে চলে। তারপরও কোরআন বিষয়টিকে আরও পরিস্কার করার জন্য আবার বলেছে-‘উপরন্তু আল্লাহ তাদের ‘ব্যধি’ আরও বাড়িয়ে দিয়েছেন।’

এখানে প্রশ্ন হলো, এই আয়াতের মূল বক্তব্যের সাথে রোগ বা ব্যধির সম্পর্ক কি? মহানবী (স.)-এর বিশিষ্ট্য সাহাবীদের যারা কোরআন বিশেষজ্ঞ বলে খ্যাত তাদের মধ্যে হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস, হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ, আব্দুর রহমান ইবনে যায়েদ, রাবি ইবনে আনাস (রা.) প্রমূখ ‘মরিয’ বা ব্যধির যে ব্যাখা দিয়েছেন তা থেকে স্পষ্ট আল্লাহ পাক এখানে ‘মরিয বা ব্যধি’ দিয়ে মুনাফিকদের অন্তরের সন্দেহ, সংশয়, মুনাফিকি ইত্যাদি বুঝায়েছেন।

(তাফসীরে তাবারী, ইমাম আবু জাফর মুহাম্মদ ইবনে জারীর তাবারী)।

তবে এই ব্যধি যে দৈহিক নয়, তা এই আয়াতের শুরুতেই ‘ ফি কুলুবিহিম মারাযুন’ বলে উল্লেখ করা হয়েছে। যার অর্থ : তাদের অন্তরে ‘ব্যধি’ রয়েছে। এখানে ‘অন্তর' শব্দ পরিস্কার করে বলা হয়েছে। হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) এই আয়াতের ব্যাখ্যায় বলেন, তাদের অন্তরে ব্যাধি আছে, অর্থাৎ তাদের অন্তরে রয়েছে সন্দেহ, নিফাক, বিরুদ্ধাচরণ ও জুলুম। আল্লাহ পাক তাদের অন্তরে এগুলো আরো বৃদ্ধি করে দেন এবং ওদের জন্য দুঃখজনক শাস্তি নির্ধারিত রয়েছে, যা আখিরাতে অত্যন্ত মর্মন্তুদ হবে ও এ বেদনা তাদের অন্তরকে স্পর্শ করবে। (তাফসিরে ইবনে আব্বাস, প্রথম খণ্ড)। হাকিমুল উম্মত মাওলানা আশরাফ আলী থানবি (র.) এ আয়াতের ব্যাখ্যায় লিখেছেন, ব্যধি বলতে তাদের কু ধারণা, হিংসা, সংশয় ও চির দুশ্চিন্তা প্রভৃতি বুঝায়। যেহেতু দৈনন্দিন ইসলামের সৌন্দর্য্য বৃদ্ধি পাচ্ছিলো, তাই সাথে সাথে তাদের অন্তরেও এই ব্যাধিগুলো বৃদ্ধি পেতে থাকে। (তাফসিরে আশরাফী, প্রথম পারা)। কাযি ছানাউল্লাহ পানিপথী (র.) বলেন, মরিজ হলো এই জিনিষ, যা শরীরে প্রবেশ করে স্বাভাবিক অবস্থা ব্যাহত করে এবং ক্রমশ দুর্বল করে ধ্বংসের দিকে নিয়ে যায়। কখনও কখনও মানসিক বিপত্তি যথা-মূর্খতা, হিংসা, কুফর ও খারাপ আকিদাকেও রূপকভাবে মরিজ বলা হয়েছে। কারণ, শারীরিক ব্যধি যেমন মানুষের স্বাস্থ্য নষ্ট করে তাকে ধ্বংস ও মৃত্যুর দিকে নিয়ে যায় তেমনি এই মানসিক বিপত্তিগুলোও সৎগুণাবলি লাবে প্রতিবন্ধক হয়ে চির ধ্বংসের পথ উম্মুক্ত করে। (তাফসিরে মাযহারী, প্রথম খণ্ড)।

ইতোমধ্যে আমাদের জানা হয়েছে, এই আয়াতগুলো দিয়ে মূলত মুনাফিকদেরকে বুঝানো হয়েছে। এখন প্রশ্ন হলো হযরত রাসুল (স.)-এর সময়ে কারা ছিলো এই মুনাফিক, যাদের নিয়ে আল্লাহ কোরআনে এত দীর্ঘ আলোচনা করেছেন? এর উত্তরে হযরত আব্দুল্লাহ ইবানে আব্বাস (রা.)-এর সূত্রে বেশির ভাগ কোরআন বিশেষজ্ঞ লিখেছেন, এই আয়াত অবতীর্ণ হয়েছে আব্দুল্লাহ ইবনে উবাই ইবনে সালূল, মাতাব ইবনে কুশায়র, জাবেদ ইবনে কায়েস প্রমূখদের সম্পর্কে। ওরা বেশির ভাগে ছিলো ইহুদি।

আয়াতের শেষে আল্লাহ বলছেন, ‘তাদের জন্য যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি রয়েছে যেহেতু তারা মিথ্যা বলতো।’ এখানে শাস্তির ঘোষণা করা হয়েছে মিথ্যুকের জন্য। এবং তাদের জন্য সাধারণ শাস্তি নয়, যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি রয়েছে। ইতোমধ্যে আলোচনায় এসেছে, কুফরি থেকেও বেশি মারাত্মক ক্ষতিকর মুনাফিকী। তাই মুনাফিকের শাস্তি কাফির থেকে বেশি যন্ত্রণাদায়ক হবে। মিথ্যা বলার জন্য এই আয়াতে যন্ত্রণাদায় শাস্তির কথা বলা হয়েছে। সেই মুনাফিকরা যে মিথ্যা বলতো তা সাধারণ মিথ্যা নয়, তা ছিলো ঈমান আনার মিথ্যা দাবী। যা সাধারণ মিথ্যা থেকে জঘণ্যতম-যা ছিলো বিশ্বাসগত (ই’তিকাদি) নিফাক।

আজ আমরা যারা ইসলামের বিভিন্ন বিধানের বিরোধীতা করি, কিংবা বিরোধীতাকারীদের সাহিয্য-সহযোগিতা কিংবা সমর্থন করি, তাদের এই বিষয়গুলো ভাবতে হবে-আমরা সংজ্ঞানুসারে কতটুকু ঈমানদার আর কতটুকু মুনাফিক। নিজকে ঈমানদার ভাবার আগে ভাবতে হবে প্রকৃত অর্থে ঈমান জিনিষটা কি? সুরা বাকারার প্রথম দিকে ঈমান বিষয়ক আলোচনা রয়েছে, আমাদের ভাবতে হবে সেই অনুযায়ি আমাদের ঈমান কতটুকু পূর্ণাঙ্গ হয়েছে? সেকালের মুনাফিকদের কর্ম ও চিন্তার সাথে যদি আমাদের কর্ম ও চিন্তার ভিন্নতা পাওয়া না যায় তবে কি আমাদেরকে মুনাফিক শ্রেণীর অন্তর্ভূক্ত করা যাবে না? এই বিষয়গুলো আমাদের ভাবতে হবে ইহকাল-পরকালের সুখ-শান্তি ও মুক্তির স্বার্থে। ভাবতে হবে জ্ঞান, বুদ্ধি, কর্ম ও প্রেমের সমন্বয়ে।
সর্বশেষ এডিট : ১৫ ই জুলাই, ২০১৫ রাত ২:২৮
০টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

সবুজের মাঝে বড় হলেন, বাচ্চার জন্যে সবুজ রাখবেন না?

লিখেছেন অপলক , ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ৯:১৮

যাদের বয়স ৩০এর বেশি, তারা যতনা সবুজ গাছপালা দেখেছে শৈশবে, তার ৫ বছরের কম বয়সী শিশুও ১০% সবুজ দেখেনা। এটা বাংলাদেশের বর্তমান অবস্থা।



নব্বয়ের দশকে দেশের বনভূমি ছিল ১৬... ...বাকিটুকু পড়ুন

আইডেন্টিটি ক্রাইসিসে লীগ আইডেন্টিটি ক্রাইসিসে জামাত

লিখেছেন আরেফিন৩৩৬, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ৯:৪৬


বাংলাদেশে রাজনৈতিক ছদ্মবেশের প্রথম কারিগর জামাত-শিবির। নিরাপত্তার অজুহাতে উনারা এটি করে থাকেন। আইনী কোন বাঁধা নেই এতে,তবে নৈতিক ব্যাপারটা তো অবশ্যই থাকে, রাজনৈতিক সংহিতার কারণেই এটি বেশি হয়ে থাকে। বাংলাদেশে... ...বাকিটুকু পড়ুন

বাঙ্গালির আরব হওয়ার প্রাণান্ত চেষ্টা!

লিখেছেন কাল্পনিক সত্ত্বা, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১১:১০



কিছুদিন আগে এক হুজুরকে বলতে শুনলাম ২০৪০ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে নাকি তারা আমূল বদলে ফেলবেন। প্রধানমন্ত্রী হতে হলে সূরা ফাতেহার তরজমা করতে জানতে হবে,থানার ওসি হতে হলে জানতে হবে... ...বাকিটুকু পড়ুন

সেকালের পাঠকপ্রিয় রম্য গল্প "অদ্ভূত চা খোর" প্রসঙ্গে

লিখেছেন নতুন নকিব, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১১:৪৩

সেকালের পাঠকপ্রিয় রম্য গল্প "অদ্ভূত চা খোর" প্রসঙ্গে

চা বাগানের ছবি কৃতজ্ঞতা: http://www.peakpx.com এর প্রতি।

আমাদের সময় একাডেমিক পড়াশোনার একটা আলাদা বৈশিষ্ট্য ছিল। চয়নিকা বইয়ের গল্পগুলো বেশ আনন্দদায়ক ছিল। যেমন, চাষীর... ...বাকিটুকু পড়ুন

অবিশ্বাসের কি প্রমাণ আছে?

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:৩১



এক অবিশ্বাসী বলল, বিশ্বাসের প্রমাণ নাই, বিজ্ঞানের প্রমাণ আছে।কিন্তু অবিশ্বাসের প্রমাণ আছে কি? যদি অবিশ্বাসের প্রমাণ না থাকে তাহলে বিজ্ঞানের প্রমাণ থেকে অবিশ্বাসীর লাভ কি? এক স্যার... ...বাকিটুকু পড়ুন

×