আবদুল ওয়াহিদ সরদার। প্রাথমিক বিদ্যালয়ের গন্ডি পেরোতে পারেননি। নেমেছেন বিরল এক অভিযানে। সাথে আছে একটি বাইসাইকেল। সাইকেলের সামনে বৃক্ষ সম্পর্কে কিছু তথ্যসংবলিত বড় একটা ব্যানার, আরও আছে অনেকগুলো পেরেক তোলার যন্ত্রাংশ আর সেই পেরেক সংগ্রহের জন্য রয়েছে ব্যাগ।
নিজ উদ্যোগে ওয়াহিদ সরদার এমনিভাবে নেমেছেন বৃক্ষ রক্ষার এমন বিরল অভিযানে। গাছের গায়ে পেরেক লাগানো থাকলে তিনি সেগুলো তুলে ফেলেন। বৃক্ষের প্রতি ভালোবাসা থেকে গত ০৪/০৭/২০১৮ তারিখ হতে যশোর-ঝিনাইদহ-খুলনা সড়কের ৫০০ কিলোমিটার জুড়ে বিভিন্ন সড়কের পাশে গাছ থেকে এ পর্যন্ত ১৩০ কেজির বেশি পেরেক তুলেছেন ওয়াহিদ সরদার।
গাছবন্ধু খ্যাত আব্দুল ওয়াহিদ সরদার যশোরে সদর উপজেলার সাড়াপোল গ্রামের বাসিন্দা। দুই ছেলে ও এক মেয়ের বাবা ওয়াহিদ সরদার বৃক্ষের প্রতি ভালোবাসা থেকে এই উদ্যোগ গ্রহণ করেছেন। পেশায় রাজমিস্ত্রি ওয়াহিদ কাজের পাশাপাশি গত ১৩ বছরে যশোর জেলার বিভিন্ন এলাকায় রাস্তার পাশে ও সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে তিনি প্রায় ৩০ হাজার গাছ লাগিয়েছেন।
গত ৪ জুলাই থেকে তিনি গাছ থেকে পেরেক তোলা শুরু করেছেন। বিভিন্ন সভা-সমাবেশ ও উৎসব উপলে ব্যানার, ফেস্টুন বা বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের বিলবোর্ড ও সাইনবোর্ড লাগানোর জন্য অনেকে গাছের শরীরে পেরেক ঠোকেন। সেই সব পেরেক ওয়াহিদ সরদার তুলছেন। কারণ,গাছে পেরেক ঠোকার বিষয়টি তাঁকে কষ্ট দেয়। ওয়াহিদ সরদারের এ উদ্যোগ নজিরবিহীন এবং নিঃসন্দেহে প্রশংসার দাবিদার।
গাছ কোনো জড়বস্তু নয়। গাছেরও প্রাণ আছে। একেকটা গাছ একেকটা অক্সিজেনের কারখানা। কিন্তু তারপরও মানুষের নিষ্ঠুরতার হাত থেকে গাছেরা রেহাই পাচ্ছে না।
মানুষ নিজেদের স্বার্থে যখন-তখন বিলবোর্ড, সাইনবোর্ড লাগানোর জন্য গাছে পেরেক ঠুঁকছেন। এটা এখন স্বাভাবিক ঘটনায় পরিণত হয়েছে। অথচ পরিবেশবিদদের মতে, পেরেক লাগানোর কারণে গাছের গায়ে যে ছিদ্র হয়, তা দিয়ে পানি ও এর সঙ্গে বিভিন্ন ব্যাকটেরিয়া ও অণুজীব ঢোকে। এতে গাছের ওই জায়গায় দ্রুত পচন ধরে। ফলে তার খাদ্য ও পানি শোষণপ্রক্রিয়া ব্যাহত হয়। এতে গাছ মরেও যেতে পারে। তাই কোনো গাছে পেরেক ঠোকা মানে ওই গাছের চরম ক্ষতি করা। যেখানে আমাদের বেশি করে গাছ লাগানো এবং গাছের পরিচর্যা করা প্রয়োজন, সেখানে আমরা উল্টো গাছের ক্ষতি করে চলেছি।
গাছ ধ্বংস করা মানে নিজেকে ধ্বংস করা এই কথাটা বোধ হয় ওয়াহিদ সরদারের চেয়ে ভালো আর কেউ বেশি বোঝেন না। তাইতো তিনি গাছ রোপণের পাশাপাশি গাছ থেকে পেরেক অপসারণের কাজ শুরু করেছেন। শুধু বৃক্ষ রোপনের মধ্যে নয়, লড়ে যাচ্ছেন বৃক্ষ রক্ষার জন্য।
সম্প্রতি বিবিসি বাংলায় দেয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন:
“আমি মিনিমাম ৫০০ কিলোমিটার জুড়ে পেরেক তুলেছি। আমি পেশায় রাজমিস্ত্রি। পাশাপাশি আমি পেরেক, ব্যানার এসব গাছের শরীর থেকে অপসারণ করে গাছকে আংশিক স্বস্তি দেওয়ার চেষ্টা করছি। যারা এসব করছে তারা সব শিক্ষিত, পয়সাওয়ালা, যার জন্য নিরাপত্তার একটা হুমকি ছিল। ভিতরে ভয় কিন্তু মুখে সাহস ছিল, এটা নিয়ে ওদেরকে বোঝাতে বোঝাতে আমি পেরেক তুলেছি।
গাছকে আমি অতি ভালোবাসি, গাছ নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে, গাছ মারা যাচ্ছে তারকাঁটার আঘাতে। বিজ্ঞান বলছে গাছের জীবন আছে, যেহেতু জীবন আছে তার মানে তার যন্ত্রণা, ব্যথা আছে। এ কারণে আমি এ কাজটি করছি।"
পেরেক তুলতে গিয়ে মানুষের তিরস্কারের আর মুখোমুখিও হতে হয় ওয়াহিদ সরকারকে। ওয়াহিদ জানালেন, “প্রথম দেখাতে মানুষ জিজ্ঞাস করে কে অর্ডার করেছে, বেতন কতো। বলি আমি স্বেচ্ছাসেবক, বলে এটা অসম্ভব, ‘কিন্তু’ আছে ভিতরে।”
সন্দেহও করে কেউ কেউ, “পেরেকগুলো কী করেন? বলি সংরক্ষণ করি। বলে- না, বিক্রি করেন। এখানে তো অনেক পয়সা আছে।”
এ প্রসঙ্গে ওয়াহিদ বললেন, “এটা হচ্ছে আপনি ভালো কাজ করলে এমন সমালোচনার ভেতর দিয়ে যেতে হবে, তাই এটার দিকে আমি দৃষ্টি দেই না।” আর্থিক অনটনের কারণে তার এই স্বেছাসেবী কাজে সম্মতি ছিল না পরিবারের। “প্রথমে আমার প্রতি তাদের একটা ক্ষোভ ছিল যে আমাদের ভবিষ্যতটা নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। যখন দেখলো যে আব্বার এটা নেশা, তখন তারা এ সঙ্কটের ভেতর দিয়ে সসম্মানে গড়ে উঠেছে।”
গাছ থেকে পেরেক তোলার এই কাজকে তার যুদ্ধ বলে অভিহিত করলেন ওয়াহিদ সরকার, “আমি যুদ্ধ ঘোষণা করেছি। যতক্ষণ পর্যন্ত সরকার একটি সু-পরিকল্পনার মাধ্যমে ব্যানারকে জাদুঘরে না নিবে ততক্ষণ আমি এটা চালু রাখবো।”
বৃক্ষরোপণ ও সংরক্ষণে হাদীসের ঘোষণা:
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন,
مَا مِنْ مُسْلِمٍ يَغْرِسُ غَرْسًا، أَوْ يَزْرَعُ زَرْعًا، فَيَأْكُلُ مِنْهُ طَيْرٌ أَوْ إِنْسَانٌ أَوْ بَهِيمَةٌ، إِلَّا كَانَ لَهُ بِه صَدَقَةٌ.
যখন কোনো মুসলিম গাছ লাগায়, অথবা কোনো ফসল বোনে, আর মানুষ, পাখি বা পশু তা থেকে খায়, এটা রোপণকারীর জন্য সদাকা হিসেবে গণ্য হয়। (সহীহ বুখারী, হাদীস ২৩২০; সহীহ মুসলিম, হাদীস ১৫৫৩) আরেক বর্ণনায় এসেছে “কিয়ামত পর্যন্ত (অর্থাৎ যতদিন গাছটি বেঁচে থাকবে বা তা থেকে উপকার গ্রহণ করা হবে) সে গাছ তার জন্য সদাকায়ে জারিয়া হিসেবে গণ্য হবে।” (সহীহ মুসলিম, হাদীস ১৫৫২)
আমার লাগানো গাছ থেকে যে কেউ উপকার গ্রহণ করুক তা আমার জন্য সদাকা হিসেবে গণ্য হবে। এমন কি কেউ যদি আমার লাগানো গাছ থেকে চুরি করে খায়, সেটাও বিফলে যাবে না। হাঁ, চুরির কারণে তার গোনাহ হবে, কিন্তু আমি সওয়াব পেয়ে যাবো।
হাদীসে এসেছে:
مَا مِنْ مُسْلِمٍ يَغْرِسُ غَرْسًا إِلَّا كَانَ مَا أُكِلَ مِنْهُ لَهُ صَدَقَة، وَمَا سُرِقَ مِنْهُ لَهُ صَدَقَةٌ، وَمَا أَكَلَ السَّبُعُ مِنْهُ فَهُوَ لَهُ صَدَقَةٌ، وَمَا أَكَلَتِ الطَّيْرُ فَهُوَ لَهُ صَدَقَةٌ، وَلَا يَرْزَؤُهُ أَحَدٌ إِلَّا كَانَ لَهُ صَدَقَةٌ.
মুসলিম যখন কোনো গাছ রোপণ করে, তো এর যে ফল খাওয়া হবে এটা তার জন্য সদাকা হিসেবে গণ্য হবে। এ থেকে যা চুরি যাবে তাও সদাকা হিসেবে গণ্য হবে। হিংস্র প্রাণীও যদি তা থেকে খায় তাও সদাকা হবে। পাখি খেলে সদাকা হবে। (এমন কি) যে কেউ যে কোনোভাবে এ থেকে (উপকার) গ্রহণ করবে তা সদাকা হিসেবে গণ্য হবে। (সহীহ মুসলিম, হাদীস ১৫৫২)।
বৃক্ষরোপণের বিভিন্ন ফযীলতের ঘোষণার সাথে সাথে নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর সর্বোচ্চ গুরুত্বের বিষয়টিও তুলে ধরেছেন। এক হাদীসে তিনি ইরশাদ করেন
إِنْ قَامَتْ عَلَى أَحَدِكُمُ الْقِيَامَةُ، وَفِي يَدِهِ فَسِيلَةٌ فَلْيَغْرِسْهَا.
যদি কিয়ামত সংঘটিত হওয়ার আগ মুহূর্তেও তোমাদের কারো হাতে একটি চারাগাছ থাকে, তাহলে সে যেন তা রোপণ করে দেয়। (মুসনাদে আহমাদ, হাদীস ১২৯০২; আল-আদাবুল মুফরাদ, বুখারী, হাদীস ৪৭৯)
তথ্যসূত্র:
১)গাছ বন্ধু ওয়াহিদ সরদার: গাছ বাঁচাতে পেরেক তুলছেন যিনি
২)গাছবন্ধু ওয়াহেদ সরদারের বিরল অভিযান
৩)হিরো খুঁজছেন? কে হিরো? ঐ উচ্চমাত্রার বিলাসী, ঘুষখোর, দুর্নীতিবাজ কি হিরো?
৪)৫০০ কিলো জুড়ে থাকা গাছ থেকে ১২৭ কেজি পেরেক তুললেন যশোরের রাজমিস্ত্রি
৫) পরিবেশ বাঁচাতে ইসলামে বনায়নের গুরুত্ব
৬)গাছ লাগানো সওয়াবের কাজ
৭)গাছ লাগান সওয়াব অর্জন করুন
সর্বশেষ এডিট : ২০ শে জানুয়ারি, ২০১৯ রাত ৮:১৩