মসুল, বাগদাদ হতে প্রায় ৪০০ কিঃমিঃ দূরে দজলা নদীর তীরে অবস্থিত একটি শহর। ত্রয়োদশ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ের ঘটনা। এই মসুলের আমির বদরুদ্দিনের কাছে দুটো চিঠি এসেছে। একটা বাগদাদের খলিফা আল মুস্তাসিমের কাছ থেকে, অন্যটা মোঙ্গল শাসক ইলখানের কাছ থেকে।
মাসুল শহরে ছিল হাজার হাজার দক্ষ কারিগর। তৎকালীন সময়ে জুতোর ফিতা থেকে শুরু করে বড় বড় সিজ ইঞ্জিনও এখানে তৈরি করা হতো।
মসুলের আমির চিঠি দুটি পড়লেন। বাগদাদের খলিফা তাকে কিছু উন্নত মানের সেতার আর বেহালা পাঠাতে অনুরোধ করেছে, আর মোঙ্গল শাসক ইলখান চেয়েছে সিজ ইঞ্জিন, যেটি যুদ্ধ ক্ষেত্রে বড় বড় পাথর ছুড়তে ব্যাবহৃত হয়।
সিজ ইঞ্জিন
আমিরের আর বুঝতে বাকি রইলো না, কে কি উদ্দেশ্যে চিঠি পাঠিয়েছে। মোঙ্গল শাসক ইলখান বাগদাদ হামলার প্লান করেছে অন্যদিকে বাগদাদের খলিফা আল মুস্তাসিম চান সংগীতের আসর আরো জমজমাট করতে! তখন মাসুলের আমির আফসোস করে বললেন, হায় ইসলামি জাহান! তোমার নেতৃত্ব আজ কাদের হাতে!
বাগদাদের খলিফার তখন প্রধান দুটি কাজ ছিলো বাহাসের ময়দানে গিয়ে ইসমাইলি আর আশয়ারিদের বাহাস শোনা এবং নর্তকীদের সঙ্গে গান আর মদে ডুবে থাকা। বাগদাদের সমাজ তখন ছিলো বিভক্ত। বিভিন্ন বিষয়ে তারা হাজার মতে বিভক্ত হয়ে যেতো। মাজহাব আর ফেরকা তাদের এতই আচ্ছন্ন করে রেখেছিল যে, ঘাড়ের উপর আটত্রিশ বছর ধরে নিশ্বাস ফেলা মোঙ্গল বিপদকে তারা অনুধাবনই করতে পারেরি!
খলিফার দরবার ছিল তখন ভাঁড়, কবি আর গল্পকথকদের আড্ডাখানা। দরবারের আলেমদের কাজ ছিলো যেকোনো বিষয়ে খলিফার মতকে কুরআন-হাদিসের আলোকে জায়েজ বলে ব্যাখ্যা দাড় করানো, তা যতই মনগড়া হোক না কেনো। এছাড়াও বিশ্ব রাজনীতি সম্পর্কে খলিফার তেমন ধারণাও ছিলো না। তার রাজনৈতিক সিধান্ত নির্ভর করতো উজির ইবনে আল আলকামির পরামর্শের উপর। যুদ্ধের কোনো অভিজ্ঞতাই ছিল না খলিফার।
এমনটা নয় যে, বাগদাদের সমাজকে হুঁশিয়ার করার চেষ্টা করা হয়নি। বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন স্থান হতে মুজাহিদরা এসে মোঙ্গল বাহিনী সম্পর্কে অবহিত করে যাচ্ছিল বাগদাদকে। কিন্তু যে সমাজের পচন ধরে, যারা ভাঁড়ামোতে মেতে থাকে, তাদের পতন আর কে ঠেকাতে পারে।
মোঙ্গল সাম্রাজ্য
চেঙ্গিস খানের সেঝো সন্তান ওগেদাই খানের আমল থেকেই মোঙ্গলরা চাচ্ছিল বাগদাদের খলিফাকে তাদের বশ্যতা স্বীকার করাতে। খলিফা ভাবলেন, কিছু উপহার পাঠিয়ে বিপদ হতে রক্ষা পাবে। কিন্তু মঙ্কি খান (চেঙ্গিস খানের নাতি) খলিফাকে সাফ জানিয়ে দিলেন, তোমাকে আবশ্যই আমার বশ্যতা স্বীকার করতে হবে। অন্যথায় তোমাদের ধ্বংস করতে আমি হালাকু খানকে (মঙ্কি খানের ভাই) পাঠাচ্ছি।
হালাকু খান বাগদাদ জয় করতে আসছে শুনে অপদার্থ খলিফা আল মুস্তাসিম তার দরবারের উজির ইবনে আল আলকামির মত মতামত চাইলেন। অপদার্থ উজির 'আলকামি' বললেন, মোঙ্গলরা বাগদাদে হামলা করলে বিশ্বের প্রতিটি প্রান্ত হতে মুসলিমরা এগিয়ে আসবে বাগদাদ রক্ষা করতে। সুতরং আপনার ভয়ের কিছু নেই।
কিন্তু বাস্তবতা ছিল ভিন্ন। পশ্চিমের আইয়ুবি শাহজাদারা তখন নিজেদের আন্ত কোন্দল নিয়েই ব্যাস্ত, ইতিমধ্যেই মিশরে তারা ক্ষমতা হারিয়েছে। উত্তর পশ্চিমের সেলজুক সাম্রাজ্য ভেঙ্গে যাওয়ার পর আলাতোলিয়ায় (বর্তমান তুরস্ক) টিকে থাকা সেলজুক রুমেরও পতন হয়েছে। আর পূর্বের দিল্লির দরবার থেকে সাহায্য আসার একমাত্র পথ ইরান এবং আফগানিস্তান মঙ্গল বাহিনীর দখলে। সুতারং পৃথিবীর অন্য প্রান্তের মুসলিমদের নিকট হতে সাহায্য আসার কোনো সম্ভাবনাই নেই। সব জানা সত্তেও খলিফাকে মিথ্যা আশ্বাস দিয়েছিলো উজির ইবনে আল আলকামি! প্রকৃত পক্ষে আলকামির পরিকল্পনা ছিল সেচ্ছায় বাগদাদকে মোঙ্গলদের হাতে তুলে দিয়ে সমোঝতার মাধ্যমে শিয়াদের রক্ষা করা।
হালাকু খান।
হায়রে নিয়তি! ক্ষমতার দন্দে খলিফা আন নাসির (খলিফা আল মুস্তাসিমের পূর্বসূরি) একদিন যেই মোঙ্গলদের কাছে চিঠি পাঠিয়ে মধ্য এশিয়ার খাওয়ারিজম সাম্রাজ্যে আক্রমনের জন্য অনুরোধ করেছিলেন। সেই মোঙ্গলরাই আজ তার বংশকে ধ্বংস করতে আসছে।
বলে রাখা দরকার, খলিফা আন নাসিরের সময়ে মধ্য এশিয়ায় সারে চার লাখ যোদ্ধা নিয়ে খাওয়ারিজম সাম্রাজ্য ছিলো বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিশালী সাম্রাজ্যগুলোর একটি। সাম্রাজ্যটি ছিল মুসলিম সাম্রাজ্য।
দুই পর্বের দ্বিতীয় পর্ব আগামিকাল পোস্ট করা হবে, ইনশা আল্লাহ!
তথ্যসূত্রঃ সানজাক-ই উসমান, The history of the Mongol conquests, The death of last Abbasid caliph. উইকিপিডিয়া।
সর্বশেষ এডিট : ১৮ ই নভেম্বর, ২০২০ দুপুর ১:১৬