somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

জ্ঞান বিজ্ঞানে এগিয়ে থাকা মুসলমানদের পিছিয়ে পড়ার ইতিহাস (২য় এবং শেষ পর্ব)

১৯ শে নভেম্বর, ২০২০ দুপুর ২:০৪
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

বাগদাদে তথা তৎকালীন বিশ্বের শ্রেষ্ট জ্ঞান চর্চা কেন্দ্র বাইতুল হিকমা।

যারা প্রথম পর্ব পড়েন নাই, তারা আগেই এখানে ক্লিক করে প্রথম পর্ব পড়ে আসতে পারেন।

মোঙ্গলরা বিশাল সমর প্রস্তুতি নিয়ে এগিয়ে আসছে বাগদাদের দিকে। এক লাখ মোঙ্গল যোদ্ধার সাথে তাতার, উইঘুর, কিরগিজ, এবং কিপচাক যোদ্ধা রয়েছে আরো একলাখ। এদের সাথে যুক্ত হয়েছে আর্মেনিয়া এবং জর্জিয়া হতে আসা আশি হাজার ক্রুসেডার আর কিছু চীনা সৈন্য। সব মিলিয়ে সেনাবাহিনীটির আকার দাঁড়াল তিন লাখে। এক লাখ রিজার্ভে রেখে বাকি দুই লাখ নিয়ে বাগদাদের দিকে এগিয়ে গেলেন হালাকু খান। বাগদাদের প্রতিরক্ষা দেয়াল ভাংতে তার সাথে রাখলো এক হাজার চিনা প্রকৌশলী এবং দশ হাজার কারিগর।

মোঙ্গল বাহিনী যখন বাগদাদের কাছাকাছি এসে গেলো, তখন খলিফার সেনাপ্রধান দাওয়াতদার সিধান্ত নিলেন, তিনি মোঙ্গলদের প্রতিরোধ করবেন। কিন্তু খলিফা মুস্তাসিম শাহস পাচ্ছিলেন না এবং উজির ইবনে আলকামিও বাঁধা দিলেন। শহরের উলামারা এ সময় সেনাপ্রধানের পক্ষে শক্তিশালী মত পেশ করলেন। ফলে খলিফা লড়াইয়ের অনুমুতি দিলেন।

সেনাপ্রধান দাওয়াতদারের ছিলো বিশ হাজার সৈন্য এবং খলিফার নিজস্ব দশ হাজার দাশ সৈনিক। সব মিলিয়ে ত্রিশ হাজার সৈন্য, অর্থাৎ মোঙ্গল বাহিনীর দশ ভাগের এক ভাগ১২৫৮ সালের ১১ জানুয়ারি দজলা নদীর তীরে মোঙ্গলদের দশ ভাগের এক ভাগ যোদ্ধা নিয়েই লড়াইয়ে নামলেন দাওয়াতদার। এতো কম সংখ্যক সৈন্য নিয়েও দফায় দফায় হামলা করে মোঙ্গলদের পিছু হটাতে বাধ্য করলো দাওয়াতদারের বাহিনী। এরপর বিজয়ের উল্লাস মেতে উঠল তারা, রাতভর চলল ভোজ। সকালে উঠে দেখে তাদের পায়ের নিচের মাটি কাঁপছে! তারা যে চরে ক্যাম্প করেছে মোঙ্গলরা তার তিন দিকে পরিখা খনন করে রাতের মধ্যেই চরটাকে নদীর মধ্যে নিয়ে গেছে। নদীর স্রোতে ভেসে যেতে লাগলো দাওয়াতদারের ক্যাম্প! যারা সাঁতরে তীরে উঠলো তাদের হত্যা করল মোঙ্গলরা, তবে দাওয়াতদার সহ মাত্র চারজন পালাতে পেরেছিলো।

যুদ্ধের ময়দান

এরপর আর খলিফার পক্ষ হতে প্রতিরোধের কোনো সুযোগ ছিল না। শেষ রক্ষা পেতে খলিফা শহরের নিরাপত্তা দেয়াল মেরামতের নির্দেশ দিলেন, কিন্তু ততোক্ষনে অনেক দেরি হয়ে গেছে। উপায় না পেয়ে খলিফা তখন আউয়ূবি এবং মামলুকদের কাছে সাহায্য চেয়ে চিঠি পাঠালেন। কিন্তু অন্যের বিপদে যে পাশে থাকে না, নিজের বিপদেও সে কাউকে পাশে পায় না

অবশেষে ২৯ জানুয়ারি মোঙ্গলরা বাগদাদ অবরোধ করলো। অসংখ্য সিজ ইঞ্জিন, র্যাম, ক্যাটাপুল্ট, আর গানপাউডার দিয়ে বাগদাদের দেয়ালে আঘাত হানলো। বাগদাদের কিছু শাহসী তরুন প্রাণপণ লড়াইয়ে নামলো। এই তরুনদের কারণে শক্তিশালী প্রযুক্তি ব্যবহার করেও মঙ্গলরা প্রথম তিন দিন দেয়ালের উপর উঠতে হিমশিম খাচ্ছিলো। তিন্তু ক্রমেই শহরের অবস্থা খারাপ হচ্ছিলো। গানপাউডারের আঘাতে দেয়ালের বিভিন্ন জায়াগায় ফাটল ধরতে শুরু করলো। অন্যদিকে মোঙ্গলদের অগ্নি তীর বৃষ্টিতে দেয়ালে দাড়িয়ে লড়াই করাও অসম্ভব হয়ে পড়ছিলো।

বাগদাদের দেওয়াল।

বাগদাদবাসীর উচিত ছিলো দাঁতে দাঁত লাগিয়ে লড়াই করা, কিন্তু তা না করে মাত্র দশদিন লড়াই করার পর তারা আত্মসমর্পণ করে সন্ধি করার সিধান্ত নিল। দরবারের সেই অপদার্থ উজির আলকামির নেতৃত্বে প্রায় তিন হাজার বিশিষ্ট ব্যক্তির একটা দল হালাকু খানের কাছে গেল সন্ধির প্রস্তাব নিয়ে। হালাকু খান সবাইকে মেরে বস্তায় ভরে লাশ বাগদাদে পাঠিয়ে দিলো!

দেওয়াল ভাঙ্গছে মোঙ্গলরা

১০ ফেব্রুয়ারি মোঙ্গল বাহিনী বাগদাদে প্রবেশ করলো। চেঙ্গিস খানের নাতি হালাকু খানও দাদার মতোই প্রতারনার আশ্রয় নিল। এর আগেও মোঙ্গলরা মধ্য এশিয়ার উরগঞ্জ, বুখারা, সমরখন্দ সহ অনেক শহরে লাখ লাখ মানুষকে 'আত্মসমর্পণ করলে ক্ষতি করবে না' বললেও আত্মসমর্পণের পর নির্মম ভাবে হত্যা করেছে। এখানেও তাই হলো, ঘোষণা দেয়া হল শহরের বাহাসের মাঠ দজলা নদীর তীরে যারা সমবেত হবে তাদের হত্যা করা হবে না। এ ঘোষণার পর নেতৃত্বহীন বাগদাদবাসী প্রাণ বাঁচাতে সমবেত হল ময়দানে। নিরস্র বাগদাদবাসীর উপর হিংস্র জানোয়ারের মতো ঝাঁপিয়ে পড়ল মিথ্যাবাদী মোঙ্গল বাহিনী, তলোয়ারের ঘূর্ণিতে মুসলিমদের কাটা মুন্ডু ছিটকে ছিটকে পূর্ন হতে থাকলো দজলা নদীর তীর!

তবে এর মধ্যেও সামান্য কিছু শাহসী তরুন সিধান্ত নিল, মরতে হলে লড়াই করেই মরব। তারা বীরের বেশে মোঙ্গলদের সাথে লড়াই করে শহীদ হল, তবে সাথে কিছু মঙ্গলকেও খতম করলো। এটাই কাপুরুষ আর বীরদের মৃত্যুর পার্থক্য। মোঙ্গল বাহিনী কাউকেই ছাড় দেয়নি, যাকে যেখানে পেয়েছে সেখানেই মস্তক আলাদা করেছে। শহরের মেয়েদের ইচ্ছেমতো ধর্ষণ করা হয়েছিল । ধর্ষণ শেষে যাদের ভালো লেগেছে তাদের মঙ্গল শিবিরে নিয়ে যাওয়া হল, অন্য মেয়েদের দেহ হতে মস্তক আলাদা করে দেয়া হল। মোঙ্গলদের দাসী হওয়ার চেয়ে মৃত্যুই উত্তম ছিলো।

এবার খলিফা মুস্তাসিমের পালা। তাকে বন্দি করে নিয়ে আসা হল হালাকু খানের সামনে, এবং তার চোখের সামনেই তার মা, মেয়ে, স্ত্রী ও দাসীদের গণধর্ষন করে হত্যা করা হল। কিন্তু খলিফাকে কি করবে তা নিয়ে চিন্তায় পড়ে গেলো হালাকু খান। কারণ তাকে বলা হলো, রাসূল (সঃ) এর আত্মীয়র রক্ত মাটিতে পড়লে দূর্যোগ নেমে আসতে পারে। খলিফাকে তার বিপুল ধন-সম্পদ সহ সোনার খাঁচায় আটকে রাখা হল। খাঁচায় বন্দি মুস্তাসিম চোখের সামনেই পরিবারের নারীদের লাঞ্ছনা দেখছিল আর হাত পা ছোড়াছুড়ি করছিল, এ ছাড়া তার আর কিছুই করার ছিলো না!

খাঁচায় বন্দি খলিফা মুস্তাসিমকে হালকু খান জিজ্ঞেস করলেন, 'কি, ক্ষুধা পেয়েছে?'
খলিফা বললেন, 'হ্যা, পেয়েছে।'
হালাকু বললেন, 'তাহলে খাও!'
খলিফা বললেন, 'কী খাব? কোনো খাবারই তো দেয়া হয়নি।'
হালাকু বললেন, এতো বছর ধরে যে সম্পদ জমিয়েছো, তা খাও। সম্পদ না জমিয়ে যদি সেনাবাহিনীর পেছনে খরচ করতে তাহলে আজ আমার দয়ার ভিখারি হতে হত না। খাও, এবার তোমার সম্পদই তুমি খাও

ইতিমধ্যে খলিফাকে হত্যা করা নিয়ে হালাকুর চিন্তা দূর করতে এগিয়ে এলো কিছু শিয়া মুনাফিক। তারা আশ্বস্ত করলো, খোদ রাসূল (সঃ)-এর নাতি ইমাম হুসাইন (রাঃ)-কে যখন হত্যা করা হয়েছিল তখন পৃথিবীতে কোনো দুর্যোগ হয়নি। এ কথা শুনে হালাকু খুশি হলেন ঠিকই কিন্তু তার মনের ভয় দূর হয়নি। কারণ মোঙ্গলরা বিশ্বাস করতো, সম্ভ্রান্ত পরিবারের সন্তানদের রক্ত মাটিতে পড়লে অমঙ্গল নেমে আসে। এজন্যই চেঙ্গিস খান তার নিজ পুত্র (বড় পুত্র) জেসি খানকে দু হাত পেছনে বেঁধে চাপ দিয়ে মেরুদণ্ডের হাড় ভেঙ্গে হত্যা করেয়েছিলো। যদিও চেঙ্গিস খানই নিজ পুত্রকে হত্যা করিয়েছে এমন কোনো প্রমান নেই, এটা যাস্ট ধারণা করা হয়।
যাইহোক, অবশেষে হালাকু খান সিধান্ত নিল খলিফা মুস্তাসিমকে গালিচায় পেঁচিয়ে তার উপর দিয়ে একশো ঘোড়া চালিয়ে দেয়া হবে। এতে রক্ত গালিচায় মাখবে, মাটিতে পড়বে না। তাতে করে আর কোনো দুর্যোগের ভয়ও থাকবে না।

খলিফা মুস্তাকিমের মৃত্যুতে পাঁচশো বছর ধরে টিকে থাকা আব্বাসিয়া খেলাফতের কফিনে শেষ পেরেক ঠেকা ছাড়া জগতের তেমন কিছু আসে যায়নি। কিন্তু সভ্যতার ইতিহাসে মুসলিম জাতিকে অনেক পিছিয়ে দেয়া হয়েছিলো। প্রাচীন যুগ ও মধ্যযুগের পৃথিবীর সমস্ত জ্ঞান-বিজ্ঞানের এক সংগ্রহশালা ছিল বাগদাদের বায়তুল হিকমাহখলিফা হারুন উর রশিদের আমল থেকেই গ্রিস, রোম, মিশর, ইরাক, ইরান, আফগানিস্তান, সিরিয়া, তুর্কিস্তান, প্রাচীন ভারত ও চীনের যাবতীয় জ্ঞান ভান্ডার আব্বাসিয়া খলিফারা প্রায় সাড়ে চারশো বছর ধরে জমা করেছিলেন বায়তুল হিকমাহতে। এখান থেকেই মধ্যযুগে মানব ইতিহাসের সেরা সেরা আবিষ্কারগুলো হয়েছিলো। ধারণা করা হয়, পৃথিবীর দশটি বইয়ের নয়টি'ই ছিলো বাইতুল হিকমাহতে। মোঙ্গলরা সব পুস্তক পুড়িয়ে দিলো! প্রায় দশ লাখ বাগদাদবাসীর রক্তে লাল হওয়া দজলার পানি কালো হয়ে গেলো বায়তুল হিকমাহর পুড়ে যাওয়া বইয়ের ছাইয়ে! আটশো বছর পেরিয়ে গেলেও মুসলিম জাতী জ্ঞান বিজ্ঞানের সেই ধারায় আজও ফিরে আসতে পারেনি!

ছবিঃ গুগল
তথ্যসূত্রঃ সানজাক-ই উসমান, The history of the Mongol conquests, The death of last Abbasid caliph. উইকিপিডিয়া।
সর্বশেষ এডিট : ১৯ শে নভেম্বর, ২০২০ দুপুর ২:০৬
৫টি মন্তব্য ৫টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

আমার প্রফেশনাল জীবনের ত্যাক্ত কথন :(

লিখেছেন সোহানী, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ সকাল ৯:৫৪



আমার প্রফেশনাল জীবন বরাবরেই ভয়াবহ চ্যালেন্জর ছিল। প্রায় প্রতিটা চাকরীতে আমি রীতিমত যুদ্ধ করে গেছি। আমার সেই প্রফেশনাল জীবন নিয়ে বেশ কিছু লিখাও লিখেছিলাম। অনেকদিন পর আবারো এমন কিছু নিয়ে... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমি হাসান মাহবুবের তাতিন নই।

লিখেছেন ৎৎৎঘূৎৎ, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ দুপুর ১:৩৩



ছোটবেলা পদার্থবিজ্ঞান বইয়ের ভেতরে করে রাত জেগে তিন গোয়েন্দা পড়তাম। মামনি ভাবতেন ছেলেটা আড়াইটা পর্যন্ত পড়ছে ইদানীং। এতো দিনে পড়ায় মনযোগ এসেছে তাহলে। যেদিন আমি তার থেকে টাকা নিয়ে একটা... ...বাকিটুকু পড়ুন

মুক্তিযোদ্ধাদের বিবিধ গ্রুপে বিভক্ত করার বেকুবী প্রয়াস ( মুমিন, কমিন, জমিন )

লিখেছেন সোনাগাজী, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ বিকাল ৫:৩০



যাঁরা মুক্তিযদ্ধ করেননি, মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে লেখা তাঁদের পক্ষে মোটামুটি অসম্ভব কাজ। ১৯৭১ সালের মার্চে, কৃষকের যেই ছেলেটি কলেজ, ইউনিভার্সিতে পড়ছিলো, কিংবা চাষ নিয়ে ব্যস্ত ছিলো, সেই ছেলেটি... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। সাংঘাতিক উস্কানি মুলক আচরন

লিখেছেন শাহ আজিজ, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ সন্ধ্যা ৭:০৪



কি সাঙ্ঘাতিক উস্কানিমুলক আচরন আমাদের রাষ্ট্রের প্রধানমন্ত্রীর । নাহ আমি তার এই আচরনে ক্ষুব্ধ । ...বাকিটুকু পড়ুন

একটি ছবি ব্লগ ও ছবির মতো সুন্দর চট্টগ্রাম।

লিখেছেন মোহাম্মদ গোফরান, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ রাত ৮:৩৮


এটি উন্নত বিশ্বের কোন দেশ বা কোন বিদেশী মেয়ের ছবি নয় - ছবিতে চট্টগ্রামের কাপ্তাই সংলগ্ন রাঙামাটির পাহাড়ি প্রকৃতির একটি ছবি।

ব্লগার চাঁদগাজী আমাকে মাঝে মাঝে বলেন চট্টগ্রাম ও... ...বাকিটুকু পড়ুন

×