গায়ে ঢিলেঢালা লম্বা জামা।মাথায় সফেদ টুপি।মুখে লম্বা দাড়ি। সদা হাস্বজ্জ্বল একজন মানুষ তিনি ।চেহারায় আভিজাত্যের ছাপ লেগেই থাকে সবসময়।
" আচ্ছা, এপোশাক পড়েই আপনি মেডিকেল কলেজে ক্লাস নেন। চেম্বারে বসেন।মিটিং, কনফারেন্সে অংশগ্রহণ করেন। এজন্য কখনো ক বিব্রতকর পরিস্থিতিতে পড়েননি?"
"না।এ পোশাকের কারনে আমি কখন বিব্রতকর অবস্থায় পড়িনি।এ পোশাক সম্মানের।এ পোশাক অনেক জায়গায় আমার সম্মানকে বৃদ্ধি করেছে।যারা হিনমন্যতায় ভুগে তারা এ পোশাকের কারনে বিব্রতকর পরিস্থিতি পড়ে।"
বলছিলাম একজন হাফেজ মাওলানা ডাক্তারের গল্প।তিনি আব্দুল বারী। ময়মনসিংহ CBMCB(কমিউনিটি বেজ্ড মেডিকেল কলেজ বাংলাদেশ)এর এসোসিয়েট প্রফেসর (ইন্টার্নাল মেডিসিন) আমাদের জানামতে বাংলাদেশে দ্বিতীয় এমন কেউ নেই যিনি হাফেজ মাওলানা হওয়ার পর পুনরায় মেডিকেলে পড়ে ডাক্তার হয়েছেন।
শৈশবের দুরন্তপনা,দুষ্টুমি, ডাংগুলি, ক্রিকেট সবকিছুতেই ফাস্ট হতেন তিনি। মাদরাসায় যখন হেফজখানায় পড়তেন তখন তার স্কুলের বন্ধুরা তাকে মাদরাসায় পড়ে বলে নাক সিটকাতো।সেই থেকে তার জিদ চেপে বসে।লেখা পড়াতেও সে তাদের থেকে এগিয়ে যাবে।সেই থেকে তার শুরু স্বপ্ন জয়ের পেছনে ছোটা। আর পেছনে ফিরে তাকাননি। হিফজ শেষ করে ভর্তি হোন মিরপুর ৬ নাম্বারের দারুল উলুমে।এরপর পাঁচ বছর পড়া লেখা করেন ঢাকার ঐতিহ্যবাহী জামিয়া শারইয়্যাহ মালিবাগে।এরপর চলে আসেন ময়মনসিংহে। ময়মনসিংহের জামিয়া ইসলামিয়া থেকে ভালো রেজাল্ট করে দাওরায়ে হাদীস উত্তীর্ণ হলেন ১৯৯১সনে।১৯৯০ এ এসএসসি। ১৯৯২ তে আনন্দমোহন কলেজ ময়মনসিংহ থেকে এইস এস সি তে স্টার মার্কস পেয়ে উত্তীর্ণ হোন। এরপর ভর্তি হোন ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজে।সেখান থেকে ২০০০ সনে MBBS এবং ঢাকা ভার্সিটি থেকে ২০১২ সনে MD(doctor of medicine in internal) করেন।
তিনি হাফেজ হোন ১৯৮২ সনে। সেই সময় থেকে ৩৭ বৎসর যাবত তিনি খতমে তারাবির ইমাম।হাফেজ হওয়ার পর থেকে ২০০০সন পর্যন্ত আসাদ গেইটের কাছাকাছি নিউ কলোনিতে তারাবির ইমামতি করতেন। ২০০০সন থেকে বাসাতেই বাবা মা পরিবারকে নিয়ে তারাবির ইমামতি করছেন।
তারাবীকে কেন্দ্র করে বাসায় মাগরিবের পর থেকেই তৈরী হয় নুরানী এক পরিবেশ। তিনি কুরআন তেলাওয়াতে মগ্ন থাকেন। মার তর্জনী ঘুরতে থাকে তাসবির দানায়। শিশুরা জায়নামাজে বসে থাকেন তারাবির অপেক্ষায়।তারাবির পর পঠিত আয়াতগুলোর ওপর সংক্ষিপ্ত তাফসীরও পেশ করেন।আলোচনা করেন বিভিন্ন মাসআলা মাসায়িল নিয়েও।
তার বাবা ইন্তেকাল করেছেন। ৯৫ বৎসর বয়সী বৃদ্ধা মা এখনো হাফেজ, আলেম ছেলের পেছনে তারাবি আদায় করেন।আব্দুল বারী পহেলা রমজানে তার মাকে নিয়ে একটি আবেগঘন স্ট্যাটাস দেন,
"আলহামদুলিল্লাহ।৯৫ বছরের বৃদ্ধা আম্মা কে সাথে নিয়ে ঘরোয়া খতম তারাবীহর নামাজ আদায় করতে পারার প্রশান্তি অন্য রকমের.....
সুম্মা আলহামদুলিল্লাহ।"তার আম্মাও খুব গর্ববোধ করেন ছেলের পেছনে তারাবির নামাজ পড়তে পেরে।
"সেই সকাল থেকে বিকাল পর্যন্ত হাসপাতালের ডিউটি ক্লাস,অফিস,চেম্বার এত ব্যস্ততার মাঝেও তারাবি পড়ান কীভাবে?"
"সারা বছর কুরআন তেলাওয়াতের যেভাবে হক আদায় করা উচিত সেভাবে তেলাওয়াত করতে পারি না। তাই শত ব্যস্ততার মাঝেও রমযানে খতমে কুরআনের তারাবিহ পড়াই, যাতে এ উসিলায় কুরআন তেলাওয়াতের কিছুটা হক আদায় হয়। এতে কুরআনের হিফজটাও ঠিক থাকে।
এর দ্বারা বাসায় একটা কুরআনী পরিবেশও তৈরি হয়।এ সময়টাতে সত্যিকারের অর্থে আত্মিক একটা প্রশান্তি পাই। যা ভাষায় প্রকাশ করার মত না।"
তিনি কিছু দিন আগে খুব আবেগ আপ্লুত হয়ে আমাদেরকে শোনান,আরেকটি খুশির সংবাদ। করোনায় ছেলে সাদ আবদুল্লাহর স্কুল বন্ধ থাকায় বাসাতে যেনো তার সময়ের সঠিক ব্যবহার হয় তাই তাকে কুরআন হিফজ করাতে শুরু করেন,আলহামদুলিল্লাহ, এক বছরেই ছেলে সাদ আবদুল্লাহ বাসাতে পড়েই হিফজ সম্পন্ন করেন।এবং রমজানে কয়েক রাকাত করে তারাবীর নামাজও পড়ান।
তিনি ২০১৮ এর অক্টোবরে দক্ষিণ আফ্রিকায় WICM (ওয়ার্ল্ড কংগ্রেস অফ ইন্টার্নাল মেডিসিন)এর একটি আন্তর্জাতিক সম্মেলনে অংশ গ্রহণ করেন। তিনি দক্ষিন আফ্রিকারকেপটাউন,জোহানসবার্গ,প্রিটোরিয়া,সানসিটি সহ ভারতের বেশ কয়েকটি রাজ্য, আমেরিকা ও সৌদি আরবে একদিকবার সফর করেন।স্ত্রীকে সাথে নিয়ে হজ্জব্রতও পালন করেন একাধিক বার।
তিনি প্রতি বৎসর তার CBMCB কলেজের ছাত্র শিক্ষকদের নিয়ে সীরাত ও বৈচিত্র্যময় ইসলামী প্রতিযোগিতার আয়োজন করেন।ছাত্র ছাত্রীরা ব্যপক উৎসাহের সাথে এতে অংশগ্রহণ করেন।
আব্দুল বারী মেডিকেলের শিক্ষক হলেও শিকড় তাঁর কওমীতে।তিনি মনে করেন,তাঁর মত শত শত মেধাবী ছাত্র আছে কওমীতে।দাওরার পর তাদের একটা অংশ যদি মেডিকেল সাইন্স, ইঞ্জিনিয়ারিং, আইন ইত্যাদিতে পড়া লেখা করে তাহলে তারা দেশ ও জাতির আরো ব্যপকভাবে কল্যাণ বয়ে আনতে সক্ষম হবে।
তিনি মনে করেন,বর্তমান মুসলিম প্রজন্মের বিশাল একটি অংশ পরিপুর্ণ কুরআন সুন্নাহ অনুযায়ী জীবন যাপন করছে না। জীবনে প্রকৃত সফল হতে হলে আমাদেরকে কুরআন সুন্নার কাছে ফিরে আসতে হবে।
আব্দুল বারী সারাদিনের কর্ম ব্যস্ততার মাঝেও ময়মনসিংহের স্বনামধন্য এক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পার্ট টাইম হাদীসের দরস দেন।
একজন ডাক্তার আলেমের কন্ঠে তখন "কালা হাদ্দাসানা" র সুর জীবন্ত থেকে আরো জীবন্ত হয়ে উঠে।আব্দুল বারীর ভ্রমণ খুব প্রিয়।অবসর পেলে বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় লেখা লেখিও করেন।
মুজীব রাহমান।
সর্বশেষ এডিট : ২৯ শে নভেম্বর, ২০২১ দুপুর ১:৪৪