আমার মধ্যে সম্ভাবনা খুঁজা শুরু হয়েছিল সেই ছোটকাল থেকেই। মা ব্যতিত অন্য কেউ কোলে নিতে চাইলে চেঁচিয়ে কাঁদি দেখে চাচা আমার মাঝে প্রথম সম্ভাবনা দেখেছিলেন। তাঁর অভিব্যক্তি ছিল এরকম- 'এই ছেলের পছন্দ-অপছন্দবোধ প্রখর। এটা প্রতিভার স্পষ্ট লক্ষণ।'
তারপর যখন বসতে শিখলাম, হাতের কাছে যা পাই ধরি দেখে আরেক চাচা বললেন- 'দেখেছো ছেলের কৌতুহল! যা হাতে পায় পরখ করে দেখে। এই কৌতুহল জ্ঞানের পূর্বশর্ত।'
সেই বয়সে একদিন নাকি সামনে রাখা অনেকগুলো বস্তুর মধ্যে একটি কলম হাতে তুলে নিয়েছিলাম। আর যায় কই! মায়ের সে কি চিৎকার! যেন তার ছেলে বিশ্বজয় করে ফেলছে। তিনি স্বদর্পে বলতে থাকলেন - 'ছেলে আমার মস্ত শিক্ষিত হবে, মাষ্টারষ্টার হবে- কোন সন্ধেহ নাই। না হলে এত এত খেলার সরঞ্জাম থাকতে কলম তুলবে কেন!'
খুবই স্বাভাবিক কারনে ছোটবেলা থেকেই আমার হাতের লেখা সুন্দর। স্লেটে সুন্দর ও স্পষ্ট হস্তাক্ষর দেখে হাউজ টিউটর আমার মধ্যে বিশাল এক সম্ভাবনা আবিষ্কার করলেন। তিনি ভবিষ্যত দেখে ফেললেন -আমি বড় কেরানীর চাকুরী পাবো।
ক্লাস টুতে যখন পড়ি বাড়িতে খেলাধুলার জন্য একটা ছোট ফুটবল দেওয়া হলো। 'তিন নম্বরি' বল। বলের গায়ে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র দানা ছিল বলে একটু জোরে লাথি দিলে পায়ে চোট লাগতো। তাই বলে লাথি দেওয়ার চেয়ে পেছনে দৌড়ানোর মধ্যে আনন্দ স্থির করলাম। স্কুলটাইম বাদে প্রায় সারাদিন ফুটবল নিয়ে থাকি। খাওয়ার সময়ও ফুটবলটি কোলে নিয়ে খেতে বসি। আমার ফুটবল প্রীতি পড়ালেখার অন্তরায় ভেবে পরিবারের সবাই বিরক্ত হলেও ফুটবলের প্রতি ভবিষ্যত যোগসাজশ আবিষ্কার করলেন আমার মামা। তিনি আমার মাঝে আগামীর কায়সার হামিদকে দেখলেন।
আমি যখন ক্লাস এইট অথবা নাইনে পড়ি তখন বার্ষিক ক্রীড়া প্রতিযোগীতার ধারাবর্ণনায় স্যারদের ফাঁকে ফাঁকে একটু অাধুট নিজেও বলতে শিখি। এলাকারও সবগুলো ক্রীড়ামঞ্চে কমেন্টট্রি দিতে যাই। এই দেখে আমার এলাকার কেউ কেউ এর মধ্যে সম্ভাবনা আবিষ্কার করেই ক্ষান্ত হন নি। আমাকে ফ্রীতে পরামর্শ বিতরণ করেন- 'আমি যেন এ বিষয়ে ট্রেনিং নেই। জাতীয় পর্যায়ে ধারাভাষ্যকার হওয়া নাকি অসম্ভব না আমার জন্য।'
সামাজিক ও রাজনৈতিক সভা সমাবেশেও অগুছালো বক্তব্য দেই দেখে (আমার বক্তব্য পক্ষে যায় এমন) লোকগুলো আমার এই সম্ভাবনায় বিমোহিতই হলেন না বরং আমার মধ্যে আগামীর একজন প্রাজ্ঞ বক্তা দেখতে পেলেন।
২০০৩-৪ সালের কথা। যতসামান্য লেখালেখির সুবাদে সারাদেশে অসংখ্য কলমী বন্ধু জুটলো। কখনো ইনভ্লোপে কখনো পোস্টকার্ডে প্রতিদিন চিটি আসে বিভিন্ন জায়গা থেকে। আমিও তাদের প্রতিউত্তর দেই, খোঁজখবর নেই একই পন্থায়। আজকের ফেসবুকের কল্যানে মুহূর্তেই বিশ্বের সর্বত্র ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা বন্ধুদের সাথে যোগাযোগ করা গেলেও হলুদ খামের ইনভ্লোপের সেই আনন্দ নেই। আহা, চিটিতে যেন কথিত সেই অদেখা বন্ধুটির গায়ের সৌরভ লেগে থাকতো। একদিনে আঠারোটি চিটি গ্রহন করেছিলাম সর্বোচ্চ। মুন্সি (তৎকালীন ডাকপিয়ন) রসিকতা করে প্রায়ই বলতেন - 'যদি অবসরের আগে চাকুরী ছাড়ি, তবে তোদের (তোর আর দেলোয়ার) জ্বালায় ছাড়বো।'
তো অসংখ্য কলমী বন্ধুর ভীড়ে মেয়েবন্ধুও নেহায়েত কম ছিলনা। কাকতালীয়ভাবে কোন একদিনে পাঁচ পাঁচটি মেয়েবন্ধুর চিটি পাই। আর যায় কই! শুরু হয় মুন্সি মিয়ার মুন্সিগিরি - 'ব্যাটা আমি তোর মধ্যে যে সম্ভাবনা দেখছি, তুই তো বিশ্বপ্রমিক হবি। দেবদাসরে তুই পথে বসাবি।'
আমাদের মুন্সির ভবিষ্যত দর্শনে তখনও আমার নূন্যতম একিন ছিলনা। যদিও সেদিন তার কথাগুলোর বিপরীতে মৃদুহাসি ছুড়ে দেওয়া ছাড়া আর কিছুই করিনি। কারন আর যাই হোক, আমি আমাকে ভাল করে জানতাম ও জানি।
এভাবে এই জীবনে কতজন যে কত সম্ভাবনা দেখেছিলেন তার শেষ নেই। বেশিরভাগ সম্ভাবনা দ্রষ্টাদের দেখা সম্ভাবনা আদতে কথার কথা ছিল। তাই তারা আশাহত হননি সম্ভাবনার নৈঃশব্দ পতনে। আমিও এই নিয়ে কোনভাবেই হতাশ ছিলাম না। কারন আমি যা আছি হয়তো তাই হতে চেয়েছিলাম! তবে মা-বাবাসহ পরিবারের লোকগুলোর দেখা সম্ভাবনা কাজে লাগেনি দেখে মাঝে মাঝে মন খারাপ হয়। তা অবশ্য সাময়িক। মায়ের দেখা সম্ভাবনাটাই আমাকে তাড়িত করেছিল দীর্ঘদিন। এসএসসি পরীক্ষা দেওয়ার পর পর্যন্ত এজন্যই হয়তো আমি শিক্ষক হতে চাইতাম বলে মনে হত। পরে তা অন্যসব নিত্য নতুন 'সম্ভাবনা'র ভীড়ে কোথায় যে উধাও হয় মনে নাই।
হতে পারে একটা বয়সে এসে মায়ের দেখা সম্ভাবনা গুড়েবালি হয়ে যাচ্ছে দেখে আমি খানিকটা মনোপীড়ায় ভুগছিলাম। তাই হয়তো বাউন্ডুলে জীবনে একটা রীতিমত কঠিন সিদ্ধান্ত নিয়ে বসলাম। একটি (উচ্চ মাধ্যমিক লেভেল পর্যন্ত) মাদ্রাসায় অনারারী (ইংরেজি ও গনিত) পড়াতে শুরু করলাম। সেখানে বছর দুইয়ের পর আরো একটি মাদ্রাসায় বছরখানেক পড়াই।
শিক্ষকতা যখন করেছি বা করতে উদ্ধত হয়েছি ঠিক ঐ বয়সে আমি যে শিক্ষক হতে চাইছিলাম তা কিন্তু নয়। অবচেতন মনে হয়তো মায়ের দেখা সম্ভাবনার বাস্তবায়নকল্প খেলা করছিল।
শুধুমাত্র এই একটি পয়েন্টে (সম্ভাবনার সিকিভাগেরও এক দশমাংশ ক্ষেত্রে) মায়ের দেখা সম্ভাবনা সহিহ হয়েছে।
সংসারে কতজনে কত স্বপন দেখলো, কতো সম্ভাবনা আবিষ্কার করলো! আমি তাদের কারো সম্ভাবনার কিছু হলাম না- এটা একটা কথা হলো! সম্ভাবনা আবিষ্কারের পেছনে তাদের জ্ঞান-গরিমা, গবেষনা ইত্যাদির যে একটা বিশাল অপচয় হলো তার কি হবে! আর আমি কেনই বা কারো দেখা সম্ভবপর কিছু হলাম না হতে চাইলাম না?
অথবা আমি আদতে হতে চাইতামটা কি?
সমস্ত প্রশ্নের সোজা উত্তর - আমি যা আছি তাই হতে চেয়েছিলাম।
অথবা আমি কখনো কিছুই হতে চাইনি। হওয়াহওয়িতে অরুচি আমার আজন্মের।
কিছু হয়ে উঠা আমার কাছে কোনকালেই (বাল্যকাল বাদে) বিশেষ গুরুত্ব রাখেনা। এর চেয়ে 'আমি' হয়ে থাকাটা শ্রেয় মনে হতো। এজন্য প্রায়ই ভাবি এই মর্মে একটা কঠিন কিন্তু সত্য ঘোষনা দিয়ে রাখি যে- 'এই মধ্য বয়সেও আমার মাঝে কারো কোন সম্ভাবনা খোজার থাকলে- সাধু সাবধান। এই কাতারে যে লম্বা লাইন। তারচেয়ে বরং আমার মাঝে 'সাদিক তাজিন' অর্থাৎ 'আমি' হয়ে উঠার সম্ভাবনা দেখুন এবং আপনার মাঝে আপনাকে আপনি হয়ে উঠার সম্ভাবনা দেখুন। সুফল পাবেন।'
আমার মধ্যে 'আমার আমি' হয়ে উঠাকে অনেকেই ভালো চোখে নেননি। তুলনামূলক উগ্র ধর্মবাদীরা আমার আওয়ামীলীগ ও তথাকথিত বাম বিরোধীতা দেখে ভাবত তাদের মতের সাফাই গাইবো। কিন্তু আদতে তা না পেয়ে তারা নাস্তিক ব্লগার ট্যাগ লাগাতে ভুলেনি। সরকারী মতের লোকেরা জামাতি বলতে পিছ পা হয় নি। সমাজের অসঙ্গতির বিরোদ্ধে বলতে যেয়ে বা কিছু করতে যেয়ে হত্যার হুমকিও গিলেছি স্বসাহসে। সব গোস্টি পুজারীদের রক্তচক্ষুর কারন হতে হতে একসময় মনে হয়েছে আর রক্ষা পাবো না। অসংগতির বিরোদ্ধে বলতে হলেও বেঁচে থাকাটা আগে দরকার। তাই দেশ ছেড়েছি। ছাড়তে বাধ্য হয়েছি।
এই লেখাটি যখন লিখছি মনোকষ্টের মধ্যেও- আমার বিশেষ ধন্যবাদ দিতে মন চাইছে তাদেরকে, যারা আমার মাঝে সম্ভাবনার কোন ছিটেফোটাও খুঁজে পায়নি কোনকালে। তারা দূরের কেউনা, আমার ভাই-বোনগুলো। আমার ভাইবোনগুলো না বলে আমরা ভাইবোনগুলো বলা উচিত। কারন শুধু যে তারা আমার মাঝে সম্ভাবনা পায়নি তা নয়। আমিও তাদের কারো মাঝে কোন সম্ভাবনার রেশমাত্র পাইনি। আমরা পারিবারিক পরিবেশে একে অন্যের ভুলগুলো নিয়ে রসিকতা করতে করতে আমাদের সময় কাটতো। কারো কোন প্রতিভা বা সৃষ্টিকে স্বীকার করাতো দুরের আলাপ আমরা বরং এমন আচরন করতাম যেন মহাপাগলামো হচ্ছে। এমনও হয়েছে- এই রকম পরিস্থিতি শান্ত করতে মায়ের হস্তক্ষেপ অবধারিত হয়ে পড়তো। এই কথাটি আমার ছোটবোনও (মাসুদা রুলি) তার ফেসবুকে লিখেছিল একবার। আসলে আমরা হয়তো সম্ভাবনার ভয়ে ভীত জনগোষ্ঠী। এজন্য বরাবর সম্ভাবনার নিকুচি করে এসেছি।
আমার সংগীতের প্রেমে পড়ার শুরুর দিকের কথা। আমি কণিকা দির কাছে হারমোনিয়াম শিখতে যাই। (কণিকা সুত্রাধর আমার প্রথম ও শেষ গান শেখার প্রাতিষ্টানিক শিক্ষিকা ও গুরু। তিনি আমাকে তাঁর ভাই মনে করতেন, এখনো করেন। আমিও তাঁকে আমার বোন মনে করি অদ্যবদি।) স্বরলিপিগুলো শিখে যখন জাতীয় সংগীত হারমনিয়ানের কর্ডে তুলতে শিখলাম, আমার সে কী আনন্দ! কি সকাল, কি দুপুর- বাড়িতে বসে পড়ি সল্পমূল্যের একটা কেসিও কিবোর্ড নিয়ে। জড়ো করি ভাইবোনগুলোকে। আমি বাজাতে থাকি-
আমার সোনার বাংলা....
সঞ্চারীটি শেষ করার আগেই কপাল কুচকায় রুলি। বলে- এটা নাকি মোটেও জাতীয় সংগীত হয়নি। এর চে নাকি বেগানা কাকগুলোর গলার স্বর বহুলাংশে উত্তম। তাকে সাপোর্ট দিয়ে হেসে ওঠে অন্যরা। আমার মন খারাপ হয় কিঞ্চিত। পরক্ষণে নিজেকে সামলে নেই। কেননা তাদের কাজ নিয়ে আমিও এমনটি প্রায়ই করি।
আমি বাড়িতে বসে কিংবা কণিকা দির বাসায় বসে হারমোনিয়াম সাধন চর্চা অব্যাহত রাখি। একদিন বাড়িতে বসে হারমোনিয়াম বাজাচ্ছিলাম। মা এসে পাশে দাড়ালেন। ধীর গলায় বললেন - এটা যে জাতীয় সংগীত তা ভালো মতোই ধরা যাচ্ছে। আমার চোখে জল আসে। এই সার্টিফিকেটের পর আমার আর কি চাই!
মায়ের সার্টিফাই হয়তো আমাকে লিরিক্স রাইটিং এ ঠেলে দিয়েছে। টিউন নিয়ে ভাবতে উদ্দীপনা প্রদান করেছে পরবর্তীতে।
মুল কথায় আসি। আমরা ভাইবোনগুলো পরষ্পরের 'সম্ভাবনা নাই' ঘোষণা দিয়ে যে জেদ আমাদের মন মননে জিইয়ে রাখতে পেরেছিলাম, তা আমাদের দৌড়কে ত্বরান্বিত করেছে এবং করছে প্রতিনিয়ত। এটা যে স্রেফ জেদ তৈরী করার জন্য করা তা আমরা সবাই বুঝি। তবু সম্ভাবনাকে দ্বারে কাছে ভীড়তে দেইনা। তাই একথা অনায়সে বলা যায়- সম্ভাবনা সবকালেই আমাদের পরিবারে এসে নির্যাতিত ও অপমানিত হয়ে গেছেন স্বপদে। সম্ভাবনার আর এ পথ ধরার মত মুখ অন্তত নাই।
আমি সম্ভাবনার সংসারত্যাগী বৈষ্ণব। আমার হওয়াহওয়িতে চলে না। 'সাধের লাউ'য়েও আমার চলে না। আমার আসলে চলে টা কি তাও আমি জানিনা। তাই হয়তো সাইজির আশ্রয় নিয়ে দিনরাত আমি খোদ আমাকেই বলি-
'আপন ঘরের খবর নে না।'