ইফ ইন্ডিয়া ওয়াজ নট ডিভাইডেড, জিন্নাহ উড বি অনলি ফাদার অব হিজ ওন চিল্ড্রেন
আমি কোরিয়ার একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে ইন্ডাষ্ট্রি অ্যান্ড ট্রেড পলিসি বিষয়ে পড়ছি। একই বিষয়ের আগের ব্যাচের আফগান ছাত্র আবদুল হামিদ নজরি। তিনিও আফগানিস্তানের সরকারি কর্মকর্তা। আমাদের দেখা হয় ডরমিটরির হালাল কিচেনে। কথায় কথায় পাকিস্তান সম্পর্কে আফগানদের মনোভাব তার থেকেই জানতে পারি। আমার চেয়েও পাকিস্তান বিরোধীতায় তিনি এক ডিগ্রী ওপরে। একদিন আমরা আলোচনা করছিলাম, ভারত পাকিস্তান ভাগ না হলে কী হতো। প্রশ্নটা করেছিলাম আমি। ইফ ইন্ডিয়ান সাব কন্টিনেন্ট ওয়াজ নট ডিভাইডেড ইনটু ইন্ডিয়া অ্যান্ড পাকিস্তান হোয়াট উড বি হ্যাপেনড? আমাকে অবাক করে দিয়ে হামিদ বলেছিলেন, দেন জিন্না উড বি অনলি ফাদার অব হিজ চিলড্রেন। আমিতো হাসতে হাসতে খতম। পরে ভাবলাম, কথাটা আসলেই সঠিক। অনেক তাৎপর্যপূর্ণ। হিসেবটা আমি আমার হায়দরাবাদে সরকারি সফরের সময় করেছিলাম। একজন ভারতীয় মুসলিম আমাকে এ হিসেবটা দিয়েছিলেন। তিনি বলেছিলেন, ভারত পাকিস্তান ভাগ না হলে দিল্লীর মসনদে এখন মুসলমানরাই থাকতো। কীভাবে! এটাই যদি প্রমাণিত হয়, তাহলে বলতে হবে জিন্নাহর চেয়ে মুসলমানদের এতবড় ক্ষতি আর কেউ করতে পারেননি।
মুসলমানদের মধ্যে একটা চরম কুসংস্কার আছে। সেটা হলো এরা গাছ মাছ থেকে শুরু করে হেন কোন বস্তু নাই যেখানে ধর্ম খুঁজে ফেরেনা। পারলে জড় পদার্থকেও মুসলমান বানায়। এ কারণে তাদেরকে সহজেই রাষ্ট্রধর্ম গেলানো গেছে। জিন্নাহ নিজে ধর্ম পালন না করলেও এটা জানতেন। যখনি জিন্নাহ রাষ্ট্রকে মুসলমান বানোনোর শ্লোগান দিয়েছিলেন, সেটা লুফে নিতে এ অঞ্চলের মুসলমানরা দেরি করেনি। এখন ভারতীয় হিন্দুরা সেখানকার মুসলমানদের মারধরের সময় একটি কথাই বলে থাকে, তোদের সাধের পাকিস্তানে চলে যা! এদেশ তোদের না। কথাটা হয়ত মানবতা আর সভ্যতার দৃষ্টিতে ঠিক নয়। কিন্তু বাস্তবতায় কথাটা কতটা ঠিক তা একটু ভাবলেই পরিস্কার হয়ে যায়। মুসলমানদের এহেন পরিণতির জন্য দায়ী আর কেউ না। মুসলমনারাই। কীভাবে! সেটাই বলছি।
তবে পাকিস্তান বানানোর পেছনে একমাত্র মুসলমানদেরকে দায়ী করা ঠিক হবেনা। হিন্দু নেতারা জানতেন- ভারত পাকিস্তান এক থাকলে মুসলমানরা ক্ষমতায় থাকবে। এজন্য তারা সব ধরণের প্রস্তাব মানতে রাজি ছিলেন। পাকিস্তানও তারা এ কারণে মেনে গেছেন। ওই সময় পরিস্থিতি তাদেরই অনুকূলে ছিল। যা চেয়েছেন ইংরেজদের কাছে, সেটাই পেয়েছেন। পাকিস্তান এমনিতেই ছেড়ে দিয়েছেন, এটা সহজে বুঝলে বড় ভুল হবে। জিন্নাহর যতটা কৃতিত্ব ছিল, তার চেয়ে বেশি ছিল হিন্দু নেতাদের মুসলমান বিদায় দেয়ার বাসনা। জমিয়তে ওলামায়ে হিন্দের সভাপতি মাওলানা হুসাইন আহমেদ মাদানী দেশভাগের পরে আফসোস করেছেন। বলেছেন, আমি প্রস্তাব করেছিলাম এসেম্বলির ৪৫% হিন্দু, ৪৫% মুসলমান আর ১০% অন্যান্য সম্প্রদায়ের হবে ! গান্ধী মেনে নিয়েছিলেন। জিন্নাহ মানেন নি! এ কারণেই ভারত বিভক্তির আগেকার দিনগুলোতে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা লাগানো হয়েছিল। দাঙ্গা লাগিয়ে ডেমোগ্রাফিক জিওগ্রাফি পাল্টে দেয়া হয়। কারণ একটাই। সেই ডেমোগ্রাফিতে ভারতের বেশিরভাগ সংসদীয় আসনে মুসলমানরা জিতে যেতো। মুসলমানরা চাল বুঝতে পারেনি। এ নিয়ে আমি অনেক খোঁজ খবর নিয়েছি। ১৯৪৭ সালের আগে ভারতের বিভিন্ন স্থানের মুসলমানদের পরিসংখ্যান দেখেছি। তাতে এটাই আমার মনে হয়েছে।
এবার আসি বর্তমান পরিস্থিতিতে জনসংখ্যার হিসেব নিয়ে। ভারতের বর্তমান জনসংখ্যা ১৩২ কোটি। এর মধ্যে মুসলমানদের সংখ্যা ২০ কোটি। বাংলাদেশে ১৭ কোটি। পাকিস্তানে ২১ কোটি। আফগানিস্তানে ৪ কোটি। সব মিলিয়ে এ অঞ্চলে মুসলমানদের সংখ্যা হতো- ৬২ কোটি। অন্যদিকে হিন্দুধর্মাবলম্বীদের সংখ্যা হতো ১১২ কোটি। প্রায় দ্বিগুণের কাছাকাছি। তাহলে আমার কথার অসারতা প্রমাণ হয় বৈকি। হায়দরাবাদ ভ্রমণের আগে এটা নিয়ে মনের একটা সান্ত্বণা ছিলো। যাক বাঁচা গেছে। এখন একটা দেশে মুসলমানরা বিপদে আছে। তখন সবাই বিপদে থাকতো। কিন্তু ভারতের হায়দরাবাদে গিয়ে দেখি পরিস্থিতি ভিন্ন। সেখানে সর্বভারতীয় মজলিসে-ই-ইত্তেহাদুল মুসলেমিন বা এম আই এম বা মীম নামের একটি ইসলামি দল আছে। ওয়াইসি এখন যে দলের প্রধান। একদিন তাদের একটা সমাবেশ দেখেতো আমার চক্ষু চড়াক। মিছিলে অনেক হিন্দু। এটা কীভাবে সম্ভব। একজনকে প্রশ্ন করলাম, হিন্দুরা কেন মীমের সমাবেশে যোগ দিচ্ছে। ভারতীয় একজন আমাকে জানালেন, শুধু মীম না, মধ্য প্রদেশ থেকে শুরু করে যেখানেই মুসলমানরা লোকসভার প্রতিনিধি নির্বাচিত হচ্ছে, তারা শুধু মুসলমানের ভোটে পাস করতে পারতো না। তারা হিন্দুদের ভোট পায় বলেই নির্বাচিত হয়। এ হিন্দুদের দেখলে বুঝা যায়না। তবে এরা দলিত বা নিম্ন শ্রেণির হিন্দু। ভারতে এদের সংখ্যা ১৬ কোটি। এরা সবাই মুসলমানদের ভোট দেয়। এটা ভারতও জানে। সে কারণে তাদের একজন কে. আর নারায়নানকে বহু বছর ধরে রাষ্ট্রপতি বানিয়েও ভারত রাষ্ট্র দলিত শ্রেণির মন পায়নি। কারণ যেসব হিন্দু মুসলমানদের সাথে খারাপ ব্যবহার করে, এদের সাথে ব্যবহার তার চেয়েও ভয়াবহ। তাদের মানুষই মনে করা হয়না। দলিত ছাড়াও নিম্নবর্ণের হিন্দু আছে। তারাও থাকতো মুসলমানদের পক্ষে। অনেকটা এদেশে হিন্দু বৌদ্ধ খ্রীস্টান সম্প্রদায়ের মতো। সংখ্যলঘুরা সবসময়ই একসাথে থাকেন। নয়তো খ্রীস্টানদের থাকার কথা ছিল মুসলমানদের সাথে। কারণ কোরআন বাইেবল মিলে অনেকাংশে। দুটো ধর্মই ঐশীগ্রন্থের ভিত্তিতে। অথচ তারা থাকেন ঐক্য পরিষদে। এবার মুসলিম সংখ্যার সাথে দলিত যোগ করি। সব মিলিয়ে মুসলমানের পক্ষে সংখ্যা হতো ৭৮ কোটি। আর হিন্দু হতো ৯৬ কোটি। নিম্নবর্ণের হিন্দুরা আসলে পুরা ব্যালেন্স হয়ে যেতো। অর্থ্যাৎ হিন্দু মুসলমানরা কেউ কাউকে আঘাত করার আগে দশবার চিন্তা করতো।
বাংলাদেশের একজন নারী প্রতি সংন্তানের সংখ্যা বর্তমানে আড়াই জনের মতো। ১৯৬২ সালে এ সংখ্যা ছিল ৬.৭ জন। ২০০৩ সালে সেটা ২.৯ এ নেমে আসে। বিখ্যাত অর্থনীতিবিদ হ্যানস রোসলিং এটাকে বলছেন, মিরাকল অব বাংলাদেশ। ভারত পাকিস্তান এক সাথে থাকলে এই মিরাকল ঘটার সুযোগ ছিলনা। এঅঞ্চলেই জনসংখ্যা হতো ত্রিশ কোটির ঘরে। কোন একদিন সময় নিয়ে আসন ভিত্তিক হিসেব দিয়ে আরেকটা লেখা পোস্ট করবো। সেখানে বিষয়টা পরিস্কার হয়ে যাবে। কীভাবে পাকিস্তান তৈরি করে জিন্নাহ মুসলমানদের ক্ষতি করেছেন।
জেনারেল নিয়াজি একটা বই লিখেছেন। নাম বিট্রেয়াল অব ইস্ট পাকিস্তান। তিনি এতে সহজ হিসেব দিয়েছেন। তিনি বলতে চেয়েছেন, যুদ্ধে হারার জন্য তাকে দোষারোপ করে লাভ নেই। যুদ্ধ লাগানো আর হারাটা ছিল পাকিস্তানের নেতাদের রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত। কারণ একবার ক্ষমতা বাঙালিদের কাছে চলে গেলে তাদের জাতীয়তাবাদ তুঙ্গে থাকায় ক্ষমতা আর পাকিস্তানিদের কাছে ফেরত আসতো না। কারণ তারাই ছিল সংখ্যা গুরু। যাই হোক তার কথাটা ঠিক। কারণ ততদিনে ধর্মের ভাই তত্ত্বটা হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছেন বাংলার মানুষ। ভুট্টো কখনোই পুরা পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হতে পারতেন না। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর পশ্চিম পাকিস্তানের যে ব্যক্তিটি সবচেয়ে খুশী হয়েছিলেন তিনি ভুট্টো৷ মাইকে বাংলাদেশের উদ্দেশ্যে চিৎকার দিয়ে বলতেন, তালাক তালাক৷ আখেরে তিনি লাভবান। নির্বাচনে হেরে যাওয়ার পরেও তিনি পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী৷ এ ভাবেই তিনি পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হওয়ার সাধ মিটিয়েছিলেন। এত মানুষ হত্যার মাধ্যমে তার সাধ পূরণ হয়েছিল। আল্লাহ সে বিচারটা প্রকৃতিগতভাবে করেছেন। নিজে মরেছেন ফাঁসিতে। ছেলেকে মেরেছে মেয়ে। আর মেয়ে মরেছে ঘাতকের গুলিতে। বংশ নির্বংশ। আমার মনে হয়, পাকিস্তান জিন্নাহ’র দর্শনই একাত্তরে প্রয়োগ করেছিল। পাকিস্তান না হলে জিন্নাহ হয়ত ভারতের প্রধানমন্ত্রী হতে পারতেন। কিন্তু গান্ধীর ব্যক্তিত্বের সামনে তার অবস্থান কী! গান্ধিই হতেন ভারতের জনক। আর জিন্নাহ হতেন তার সন্তানদের জনক। আমার সিনিয়র ক্লাসমেট আফগানি আবদুল হামিদ কত সুন্দর করেই না বিষয়টা বলে ফেললেন।
পরিশেষে আলহামদুলিল্লাহ। আমরা স্বাধীন বাংলাদেশের অধিবাসি।আমরা ইতিহাসে কখনোই স্বাধীন ছিলাম না। অন্যরা এসে শাসন করে গেছে। এটাই হাজার বছরে আমাদের বড় প্রাপ্তি। এখানে হয়ত আইনের শাসনের দূর্বলতার কারণে দুর্বল ব্যক্তিরা সবলদের কাছ থেকে আঘাতটা পেয়ে থাকে। কিন্তু কেউ বলতে পারবেনা, ধর্মের কারণে পরীক্ষায় কম নম্বর দেয়া হয়েছে। ভাইভায় ফেল করানো হয়েছে। তাকে পরিবহনে উঠতে দেয়া হয়নি। অফিসে ঢুকতে দেয়া হয়নি। এখানে যেটা আছে, সেটা দুর্বল মাত্রই শিকার হয়ে যাচ্ছে। সেখানে হিন্দু মুসলমান বলতে কিছু নেই। কিছু যে ঘটনা ঘটছেনা তা না। এটা হুজুগের কারণে। ভারত পাকিস্তানে আকিদাগত ত্রুটি নিয়ে জন্ম গ্রহণ করায় তার ফল ভোগ করছে। আমরা এসবে নেই। আামদের জন্মটা অসাম্প্রদায়িকতার ভিত্তিতে। সেই দ্বিজাতিতত্ত্বকে আমরা অসার প্রমাণ করেই জন্ম নিয়েছি। আমাদের এটা মনে রাখতে হবে। প্রমাণ করতে হবে। আমাদের দেশে কোন সংখ্যালঘু নেই।
কাজী সায়েমুজ্জামান
সাউথ কোরিয়া
১২ ডিসেম্বর ২০১৯