এক.
তারিখটা ২৩ মার্চ ২০০৭। আমি তখন দৈনিক মানবজমিন পত্রিকায় স্টাফ রিপোর্টার। খবর পেলাম সাভারে ১৫ হাজার মুরগি কালিং করা হবে। দেশে তখন বার্ড ফ্লু আতংক। এর আগের দিন সাভারে বিমান বাংলাদেশের মালিকানাধীন পোল্ট্রি ফার্মে দেশে প্রথমবারের মতো বার্ড ফ্লু ভাইরাস এইচ-৫ এন-১ শনাক্ত হয়। ওই দিনই ফার্মের ৩০ হাজার মুরগি কালিং করা হয়। কালিং মানে বিরাট গর্ত খুড়ে মাটি চাপা দেয়া হয়। মিডিয়া তখন বিশ্বের অন্য দেশে এই ফ্লুতে কত জন মারা যাচ্ছে সেই খবর দিচ্ছিল। আমার মনে আছে ওই সময়ও বার্ড ফ্লুতে ইটালিতে শতাধিক লোক মারা যায়। এমন একটা ভাইরাসের উপস্থিতি বাংলাদেশে পাওয়া যাওয়ায় খবরটা তখন হট কেক। অফিস থেকে বললো আমাকেই সাভারে যেতে হবে। যদিও সাভারের প্রতিনিধি রয়েছে। ভালো করে লিখতে হবে। কারণ সংবাদটা বড়। খোঁজ খবর নিলাম। জানলাম, বিমান বাংলাদেশের মালিকানাধীন ফার্মের এক কিলোমিটারের মধ্যে পাঁচটি ফার্মের ১৫ হাজার মুরগি কালিং করা হবে।
সকালেই সাভারের দিকে রওয়ানা দিলাম। প্রথমে গেলাম বিমান বাংলাদেশের মুরগির ফার্মে। বহু দূর থেকে ওই এলাকায় যাতায়াত বন্ধ করা হয়েছে। তখন আর্মির যুগ। কিছু সেনাসদস্যও পাহারায় রয়েছেন। আমার হাতে পাঁচটি ফার্মের ঠিকানা। যেগেুলোতে মুরগি কালিং করা হবে। সেখান থেকে লোকজনকে জিজ্ঞাসা করে ওই সব ফার্মের উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিলাম। আমি মানবজমিনের তখনকার সাভার প্রতিনিধি গোলাম মোস্তফার মটর সাইকেলের পেছনে। একপর্যায়ে গিয়ে একটা ফার্মের সামনে উপস্থিত হলাম। বিমানের ফার্ম থেকে জায়গাটার দূরত্ব আটশ মিটারের কম হবেনা। ফার্মটার নাম মনে নেই। তবে মনে আছে দুই ভাই পাশাপাশি দুটি পোল্ট্রি ফার্মের মালিক। বিদেশ থেকে ফিরে সর্বস্ব দিয়ে তারা ফার্ম দুটি করেছেন। দূর থেক দেখলাম, প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা সাদা পোষাকে রয়েছেন। যেই পোষাককে আমরা এখন পিপিটি নামে চিনি। ফার্মের পাশেই গভীর গর্ত করা হয়েছে। তারা ঢাকা থেকে আসা সংবাদকর্মীদের জন্য অপেক্ষা করছিলেন। মালিকের বাড়ি পাশেই। বাড়িতে কান্নাকাটি চলছে। মহিলারা চিৎকার দিয়ে কান্নাকাটি করছেন। বলছেন, বিমানের ফার্মের দূরত্ব এক কিলোমিটারের বেশি। অথচ তাদের ভালো মুরগিগুলো মাটিচাপা দিতে আসছেন। আল্লাহ সইবেনা। তারা নিঃস্ব হয়ে যাবেন। চারিদিকে কয়েক হাজার মানুষ জড়ো হয়েছেন। ভাইরাস সংক্রমণের ভয়ে অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা পোষাক পড়ে আছেন। অথচ জনতার ভাইরাসে ভয় নেই। পারলে তারা মুরগি নিয়ে দৌড়ে পালায়। আমরাও একটু দূরত্বে দাড়িয়ে আছি। কোন প্রটেকশন নেই। আমাদের পাশে মালিক দুই ভাই।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের কর্মকর্তাদের নির্দেশ পেয়েই মুরগিগুলো ধরে গর্তে ফেলতে শুরু করে সাদা অ্যাপ্রন পড়া কর্মীরা। তা দেখে আমার পাশে দাড়ানো মালিকরাও কাঁদতে শুরু করছেন। আবেগে ভারাক্রান্ত হই আমিও। সরকার তখন ১২ সপ্তাহের বেশি প্রতিটি বয়সী মুরগির জন্য ৮০ টাকা এবং ১২ সপ্তাহের নিচে প্রতি মুরগির জন্য ১৫ টাকা প্রদানের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে। অমানবিক দৃশ্য দেখলাম দাড়িয়ে দাড়িয়ে। একেকটা লেয়ার মুরগির বাজার দর তখন কম করে হলেও চার পাঁচশ টাকা ছিল। তিন চারটা পরিবারের পথে নামার সাক্ষী হয়ে গেলাম।
দুই.
কয়েকদিনের মধ্যেই সোর্স খবর দিলো, রাজধানীর মিরপুরে প্রাণি সম্পদ অধিদপ্তরের কেন্দ্রীয় পোল্ট্রি ফার্মের মুরগিরও বার্ড ফ্লুতে আক্রান্ত হয়েছে। মুরগি কালিং করা হবে। আমি ছুটে গেলাম। একই পদ্ধতি। মুরগি কালিং করা হচ্ছে। সাদা প্রটেকটিভ অ্যাপ্রোণ জড়িয়ে প্রাণি সম্পদ অধিদপ্তরের লোকজন মুরগি মাটি চাপা দিচ্ছে। তবে একটা প্রশ্ন মাথার ভেতর উঁকি দিচ্ছে। মিরপুরের কেন্দ্রীয় পোট্রি ফার্মটি চিরিয়াখানার গেট সংলগ্ন। হাতের বাম পাশে। চিরিয়াখানা আর ফার্মের শেডের মাঝখানে শুধু লেক। নিয়ম অনুযায়ী এক কিলোমিটারের মধ্যে সকল পাখি জাতীয় প্রাণি কালিং করতে হলে চিরিয়াখানার একটা পাখিও রক্ষা পাবেনা। অধিদপ্তরের মহাপরিচালককে ধরলাম। চিরিয়াখানার পাখিগুলো ধ্বংস করা হবে কী না? তিনি বললেন, তা কী করে সম্ভব? সব জায়গায় নিয়ম মানা যায়না। আমি বললাম, জনস্বস্থ্যের বিষয় বলে কথা। আর চিরিয়াখানার পাখি ও মুরগিগুলো সাধারণ কোন পোল্ট্রি ফার্মের না। সাধারণ পোল্ট্রি ফার্মে লোকজনের যাতায়াত নেই। অথচ এসব পাখি আর বিভিন্ন জাতের মুরগি দেখতে প্রতিদিন হাজার হাজার মানুষ চিরিয়াখানায় যাচ্ছে। আপনারা তো তাদের জীবন ঝুঁকির মুখে ফেলে দিলেন। অথচ সাভারে প্রায় আটশ মিটার দূরেরও মুরগি নিধন করেছেন।
তিনি আমাকে বলিছলেন, নিয়ম মানতে হয় বলে নিধন করতে হয়েছে। দেখবেন, চিরিয়াখানার মুরগি আর পাখি কাছাকাছি থাকলেও কিছু হবেনা। একটাও মরবেনা। কেউ আক্রান্ত হবেনা। সত্যি ব্যাপার হলো-চিরিয়াখানার কোন মুরগি বা পাখি আক্রান্ত হয়নি। কোন দর্শনার্থীও আক্রান্ত হয়নি।
তিন.
এবার মরণঘাতী করোনা ভাইরাস এসেছে। মানে প্রবাসিরা নিয়ে দেশে ঢুকেছেন। বেশিরভাগকে কোয়ারিন্টিনে আনা যায়নি। তবে একটা বিষয় মনে রাখতে হবে। যারা কোয়ারিন্টিন না করে পালিয়েছে, তারা যে সবাই আক্রান্ত তা বলা যাবেনা। আজকে ওই মহাপরিচালকের কথা মনে পড়ে গেলা- নিয়মের ব্যত্যয় হলে সব সময় তাতে ক্ষতি হয়না। অনেক সময় ভাগ্যগুণে রেহাইও পাওয়া যায়। করোনায় আমাদের ভাগ্যগুণে রেহাই ছাড়া অন্য কোন পথ খোলা আছে কী!
আগামী দুই সপ্তাহ অপেক্ষা ছাড়া কী ই বা করার আছে। তবে আমার যেটা মনে হয়, কখনোই এটা সম্ভব হবেনা।
দক্ষিণ কোরিয়া
২৩ মার্চ ২০২০
সর্বশেষ এডিট : ১৭ ই এপ্রিল, ২০২০ সকাল ১০:১৮