১২ ফেব্র“য়ারী ২০১২
৩০ মাঘ ১৪১৮, রবিবার
বাংলাদেশ কোরিয়া টেকনিক্যাল ট্রেনিং সেন্টার
মিরপুর, ঢাকা।
আজ ঘুম ভাংললো আউয়াল সুমন সিরাজদের মনিপুরি পারার মেসে। ঘুম থেকে উঠে দেখি সকাল প্রায় যায় যায়। কাল রাতে ঘুমিয়েছি বেশ দেরীতে। ওদের ওখানে রাত কাটালে আমার ঘুম হয়না। ঘন্টা খানেকের মধ্যে সুমন আউয়াল বেরিয়ে গেলো। রুমে থাকলাম আমি আর সিরাজ। কিছুক্ষন পর সিরাজও বাইরে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত হতে লাগলো। শেষে আমিও বের হলাম সিরাজের সাথে। কিছুদুর এগোনোর পর মনে পরলো আজ আমার সাথে শোভন ভাই গুলশান যাবে। উনি এখন আছেন মিরপুর দশনম্বরে। দশ নম্বর থেকে বাসে উঠলে উনি খুব সহজেই আমার কাছে অর্থাৎ মনিপুরি পারায় চলে আসতে পারেন। আমি সিরাজের কাছ থেকে চাবি রেখে আবার ওদের মেসের উদ্দেশ্যে ফিরতি পথ ধরলাম। রাস্তায় শোভন ভাইকে কয়েববার ফোন করলাম উনি ধরলেন না। শেষে একটা এসএমএস করলাম। উনি ফোন করে জানালেন একটা অতি জরুরি কাজে ওনাকে ফরিদপুর যেতে হচ্ছে। ফিরবেন তিনচারদিন পর। এখন আমার হলে ফিরে যাওয়া ছাড়া আমার হাতে আর কোন কাজ নেই। আমি আবার মেসে তালা দিয়ে রাস্তায় নামলাম। মেসের চাবিটা পুর্ব পরিচিত এক নরসুন্দরের দোকানে দিয়ে খেজুর বাগান হয়ে সংসদ ভবনকে হাতের ডানপাশে রেখে হাঁটা শুরু করলাম। চারদিকে বেশ ঝকঝকে রোদ। আমি হাঁটছি গাছের ছায়ায়। এই যায়গার দিনে এক চেহারা রাতে আরেক চেহারা। একটু আঁধার ঘনালেই এখানে জমে জমজমাট ভ্রাম্যমান পতিতাদের মেলা। নানা বয়সের, নানা চেহারার, নানা স্বাভাবের দুই ধরনের পতিতা এখানে খদ্দের খুঁজতে আসে। এক ধরনের মেয়ে পতিতা আর একধরনের ছেলে পতিতা। আমি সন্ধার পরে এখানে বেশ কয়েক বার এসেছি। সব মিলিয়ে যা দেখলাম তাতে হিজড়াদের পরিমানই বেশী। আর খদ্দেররাও এদের কৃত্রিম স্তন, লম্বা ফিগার, মুখের সাদা রং দেখে খেয়াল করেছি বেশী আকৃষ্ট হয়। সন্ধায় যে কেনাবেচাটা বেশী হয় তা হলো রিক্সায় নিশি কন্যা সহ ঘোরা, দুয়েকবার স্তনে হাত বোলানো, উরুতে হাত দেয়া, জোর করে একটু চুমা চাটি দেয়ার চেষ্টা। এতে একেক জনের রেট একেক রকম। আর একটা আছে খদ্দেরের সাথে বাসায় যাওয়া। চেহারা, বয়স, সৌন্দর্য্য ভেদে এদের দামের তারতম্য হয়। বর্তমানে এদের দাম চলছে এক হাজার থেকে তিন হাজার পর্যন্ত। মাঝে মধ্যে খদ্দের যে সমস্যায় পরে তা হলো তারা হুরা হরে এক নিশি কন্যাকে বাসায় নিয়ে শুতে গিয়ে দেখে আসলে সে তারই লিঙ্গের। অর্থাৎ সমকামী হিজড়া। তখন বাধে মহা ঝামেলা। অবশ্য সেই ঝামেলা দেখার সৌভাগ্য বা দুর্ভাগ্য কোনটাই আমার হয়নি এখনও। এখন দিন ঝক ঝকে রোদ চারদিকে। এখানকার চেহারা সম্পূর্ণ ভিন্ন। গাছের নিচে বসে আছে কেউ আপনার ওজন মাপার জন্য, কেউ বসেছে বাদাম নিয়ে, ভিক্ষুকও দেখবেন বেশ কয়েক জন। কেউবা কাঁথা গায়ে দিয়ে আরামে ঘুমাচ্ছে। দুয়েকজন ডিউটিরত পুলিশ ঘোরাফেরা করছে বিসন্ন চিত্তে, বেলুন বেলুন বলে চিৎকার করছে কেউ। আমি হাঁটতে হাঁতে আড়ং মোড় পার হয়ে মিরপুর রোডের ডান পাশ ধরে টেকনিক্যালের উদ্দেশ্যে হাঁটছি। আমার ব্যাগে রয়েছে এই খাতাটা, কালো একটা শীতের কাপড়, কয়েকটা কলম। রাস্তায় কিছুক্ষন পর পর জ্যামে আটকে যাচ্ছে নানা ধরনের গাড়ী। আমি যখন রাস্তায় হাঁটি তখন যদি কোথাও দেখি জ্যামে কোন সুন্দর গাড়ী আটকে আছে আর তার মধ্যে কেউ বসে আছে তখন তার জন্য আমার মায় হয়। আহা বেচারা..! এত সুন্দর গাড়ীতে চড়েও স্থীর হয়ে আছে আর আমি চলছি। একটু আগে বোধ হয় স্কুল ছুটি হয়েছে। কারন কিছু সময় পরপর মায়েরা গাড়ীতে করে তার ফার্মের বাচ্চাটাকে নিয়ে বাসায় যাচ্ছে। যদি কখনও জ্যামে জ্যামে আটকা গাড়ীতে আমি অতি সুন্দরী কিশোরী দেখি তাহলে কেন জানিনা আমার হাঁটার গতি এমনিতেই কমে আসে। মাঝে মধ্যে কারো কারো সাথে চোখাচোখি হয়ে যায়। কখনও কখনও টুকটাক মুচকি হাসিও বিনিময় হয় কারো কারো সাথে। একবার গনভবনের সামনের একটি ঘটনা বলি। চারদিকে প্রচন্ড রোদ। প্যাপো, ঘড় ঘ্যাড় শব্দ করে নানা রকম গাড়ী যাচ্ছে। হঠাৎ জ্যামে সব থেমে গেলো। আমার বা পাশে খেলাম একটা মেরুন রংএর নিশান সানি গাড়ীতে ২৪/২৫ বছরের এক অতিসুন্দরী মা তার ৫/৬ বছরের ছেলেকে নিয়ে স্কুল থেকে ফিরছে। ফুটফুটে ছেলেটি মায়ের কোলে মাথা রেখে শান্তিতে ঘুমাচ্ছে। ড্রাইভিং সিটে বসে ৪০/৪৫ বছর বয়সের যে লোকটি ষ্টিয়ারিং ঘোরেচ্ছে সে বেতন ভুক্ত ড্রাইভার ছাড়া অন্য কিছু নয়। আমি কিছু দুরে গিয়ে দাঁড়ালাম। আমি তাকিয়ে আছি গাড়ীর মধ্যে আর মনে মনে জ্যাম আরো কিছু সময় থাকার জন্য প্রার্থনা করছি। হঠাৎ আরোহীনির সাথে আমার চোখাচোখি হলো। আমি কেমন যেন একটু লজ্জা পেলাম। চোখ ফিরিয়ে নেয়র সময় একটু মুচকি হেসেছিলাম। প্রতি উত্তরে মেয়েটিও হাসল। আমার সারা শরিরে বিদ্যুৎ খেলে গেলো। মূহুর্তেই আমি আবার সামনের দিকে তাকালাম, দেখি গাড়ীটা চলে যাচ্ছে। মেয়েটির ঠোটে হাসি ঝুলে আছে। আবার একটু ছোট্ট জ্যাম পরল। চারদিকে প্রচন্ড হর্ন আর ড্রাইভারদের খিস্তি চলছে। রোদে পুড়ছে রাস্তাঘাট। আমি আবার তাকালাম গাড়ীর দিকে। মেয়েটি হাসি মুখে তাকিয়ে আছে আমার দিকে। আমার কি হয়ে গেলো বুঝতে পারলাম না। আমি ওকে চোখটিপে দিলাম। আর সে আমাকে ভয়াভহ রকমের বিষ্মিত করে দিতে প্রতি উত্তরে আমাকেও চোখটিপে দিলো। আমি থান্ডার্ড হয়ে দাড়িয়ে রইলাম আগুন ঝড়া রোদে। গাড়ীটি হুস করে বেরিয়ে গেলো। গাড়ীর প্যাপুু আর খিস্তি ক্রমশ জোড়ালো হচ্ছে আর গাড়ীর ঘড় ঘড় বেড়েই চলছে, আর হারিয়ে যাচ্ছে আমার এক মূহুর্তের ভালো লাগা।
যাই হোক আজকের দিনে ফিরে আসি। আমি আবার হাঁটতে শুরু করলাম। আমার ব্যাগে সিগারেট রয়েছে, আমি চাইলেই জালাতে পারি কিন্তু আমার এখন হাঁটতেই ভালো লাগছে। আবার জ্যাম পরল। প্রত্যেকটি গাড়ীর মানুষ গুলোর আলাদা আলাদা আচরন। যে সকল গৃহবধুরা গাড়ীতে করে তাদের বাচ্চাদের নিয়ে ছুটছে তার চিন্তা এক রকম, আবার যে তার অফিসের বসকে নিয়ে ছুটতে তার চিন্তা আচরন এক রকম। তবে বাচ্চারা এই জ্যামটা বেশ উপভোগ করে। তারা কেউ সিডি প্লেয়ারে সিনেমা দেখে কেউবা ভিডিও গেম খেলে। আবার কেউ কেউ ল্যাপটপে নেট ঘাটে। আমি এক সময় চলে এলাম শেরে বাংলা নগর আসাদ গেটের যেখানে আরবরি কালচার অবস্থিত সেখানে, অর্থাৎ আসাদ গেটের কেয়ার হসপিটালের ঠিক বিপরিত দিকে। আরবরি কালচার প্রকৃত পক্ষে সরকারী পুস্প খামার। বাংলাদের সরকারের যত অনুষ্ঠান আয়োজন করা হয় তা ফুলে ফুলে ফুলেল করতে যত ফুল লাগে তা এখান থেকে দেয়া হয়। বিশাল বড় এরিয়া। কত বিঘা তা আমি যানি না। চিন্তা করুন আমরা কত বড় লোক। ঢাকার সেন্ট্রাল পয়েন্টে এত জমি নিয়ে সরকারকে সাজানোর খামার আমরা করতে পারি। এখানে রয়েছে নানা রংএর হাজার রকমের পুস্প। ভালো তো ভালো না? ফুলে ফুলে ঢলে......!!! কত মানুষ বস্তিতে মানবেতর জীবন যাপন করছে আহারে...!!! এই আরবরি কালচারের সামনে ছোট্ট একটা ঘর রয়েছে। অনেকেই হয়তো খেয়াল করেছেন এখানে সাদা চুলদাড়ী ওয়ালা এক পা ভাঙা বৃদ্ধ থাকেন। আমি সেই বৃদ্ধকে ক্রস করে ৮/১০ পা সামনে চলে এলাম। হঠাৎ আমার মাথায় চিন্তা এলো আচ্ছা এই বৃদ্ধ কি খেয়েছেন? আমার পকেটে একটা দৃই টাকার নোট আর দুইটা দশ টাকার নোট রয়েছে। এটা দিয়ে ওনার দুপুরে কি কিছু একটা খাওয়া হবে না? আমি পিছনে ফিরলাম। এসে বসলাম বৃদ্ধের পাশে। বয়স ৬০ হতে পারে আবার ৭০/৮০ ও হতে পারে। চুল দাড়ী সব ধবধবে সাদা। দেখতে অনেকটা অনেকটা অভিনেতা মাসুম আজিজের মতো। খুবই জীর্ন শীর্ন ভাঙা শরীর। কিন্তু শরীরের হাড়ের গঠন বেশ মজবুত। আমি ওনার এখানে প্রথম বসেছিলাম ২০০৩ তিন সালে। তখন উনি কোন কথাই বলতেন না। এর পর নানা সময় বসেছি। এর পর ওনার সাথে এক রাত কটিয়েছিনাম ২০০৭ সালে। তখন আমার সাথে বাদল জাতীয় একটি ছেলে ছিলো। নাম আবির। সেদিন ওনার কাছ থেকে যা যেনেছিলাম তা হলো ওনার বাড়ী ধামরাই। এক সময় ট্রাক চালাতেন। উনি এখন এখানে বসে কারো জন্য অপেক্ষা করছেন। তা আমি তখনই যেনেছি। উনি চলাফেরা করতে পারেন না। প্রস্রাব পায়খানা উনি যেখানে শোয় তার কাছেই করে। গন্ধে বসা মুশকিল। মাছি উড়ছে। ভালো পাটির হাটুতে থুতনি রেখে ভাঙা পা খানা মাটিতে রেখে বসে আছে চুপ চাপ। প্রখর রোদে এখানে কেউ বেশী সময় বসলে হিটষ্ট্রোক করার কথা। তার কিছুই হচ্ছেনা। গায়ে একটা শার্ট এত ময়লা যে তার প্রকৃত রং উদ্ধার করা প্রায় অসম্ভব একটি কাজ। চুলদাড়ী কত দিন কাটেনি তা আন্দাজ করা কঠিন। উনি আমাকে দেখে বেশ বিরক্ত হলেন।
- কি চান? এই হানে আইছে ক্যালা? যান যান।
- কেমন আছেন?
- ফাইজলামি করেন নাকি? দেহেন না একটা পাও ভাইংগা গেছে। পাও ভাইঙা গেলে কেউ ভালো থাহে? যান ভাই যান। মেজাজটা খারাপ কইরেন না।
খুবই যৌক্তিক কথা। কিন্তু ওনার দুঃখ কি শুধু ওনার ভাঙা পা নিয়ে না কি আরো অনেক গভির কোন দুঃখ আছে যা বোঝার সাধ্য হয়তো কারোই নেই।
- সকাল থেকে কিছু খাইছেন?
- খাইছি না না খাইছি আপনারে কইতে হইব? যান না ল্যাওড়া। কি দেহেন বইয়া বইয়া?
বুঝলাম বৃদ্ধ বেশ ক্ষেপে আছেন। আমি আরবরি কালচারের ভিতরে ঢুকলাম এর সম্পর্কে আরো কিছু জানার আশায়। আমি এর সম্পর্কে এমনিতেই অনেক কিছু জানি। আরবরি কালচার থেকে অনেক কিছু নতুন করে জেনে বের হলাম। বেশ বিষ্মিত হলাম সব কিছু জানার পর। এখানবার গার্ড বিল্লাল, পিওন দুলাল সহ আরো অনেকের কাছ থেকে অনেক কিছু জানলাম। এরা মাঝে মধ্যে এই বৃদ্ধকে দেখাশুনা করে। আমি এই বৃদ্ধকে নিয়ে অবশ্যই একটা সিনেমা বানাবো। এই বৃদ্ধের চরিত্রে অভিনয় করবেন মাসুম আজিজ। আর ভিলেন চরিত্রে অভিনয় করবেন বাংলাদেশের সর্ব কালের শ্রেষ্ট অভিনেতা (আমার দৃষ্টিতে) হুমায়ুন ফরিদী।
(এবার চিন্তা করুন হুমায়ুন ফরিদী কত্ত বড় স্বার্থপর, নিজের সুখের কথা ভেবে আমার এই লেখার পরেরদিন কাউকে কিছু না বলে চলে গেলেন। আমি আজো কেঁদে চলেছি)
সাইফুল বাতেন টিটো
১২ ফেব্র“য়ারী ২০১২
৩০ মাঘ ১৪১৮, রবিবার
বাংলাদেশ কোরিয়া টেকনিক্যাল ট্রেনিং সেন্টার
মিরপুর, ঢাকা।
(সাইফুল বাতেন টিটো’র ডাইরীর পাতা থেকে)