আমি বাড়ী পালানো ছেলে
আমি বেশ কয়েকবার বাড়ী থেকে পালিয়েছি। বাড়ী থেকে পালানোটা আমার কাছে বেশ রোমাঞ্চকর মনে হতো। আমি ব্যপারটা তাড়িয়ে তাড়িয়ে উপভোগ করতাম। আমি খুব ছোট বেলা থেকে বাড়ী পালানো শুরু করেছি। প্রথম প্রথম ছোট খাট পালানো পালাতাম। যেমন আব্বুর ভয়ে আসরের দিকে আমি আর নেই। সবাই খোঁজাখুজি শুরু। আর আমি সেটা দেখে বেশ পজা পেতাম। তখন যেটা হলো আমি পালাতাম আমাদের বাড়ীর আসপাশের কোন আত্মিয় স্বজনের বাড়ীতে। আব্বু বা আমার কোন চাচা বা চাচাতো ভাই আমাকে গিয়ে নিয়ে আসতেন এই প্রতিশ্র“তি দিয়ে যে- আমি যে অন্যায় করে পালিয়েছি সেই অন্যায় ভবিশ্যতে যদি আর না করি তা হয়ে এবারের জন্য মাফ করে দেয়া হবে আর এই যে সন্ধার পরে পড়তে না বসে এতক্ষন যে এই বাড়ীতে লুকিয়ে ছিলাম তার জন্য কিছু বলা হবে না যদি আমি গিয়েই পড়তে বসি। কখনও কখনও মা এই তথ্যটা আবার কাউকে দিয়ে পাঠিয়ে দিতেন আমার কাছে। তখন ঘরে যেতাম। আব্বু কিছু বলতেন না। আবার যদি কখনও কখনও অনেক দিনের জমানো রাগ থাকতো তা হলে আবার মাইরও খেতে হতো। খুবই স্বাভাবিক আব্বু যখন বাড়ীতে না থাকতেন তখন একমাত্র আমি আমিই হতাম বাড়ীর রাজা। একমাত্র আমার সেঝ চাচা রুস্তম কে ছাড়া কাউকে তোয়াজ করতাম না। তবে উনি কোন দিনই আমার গায়ে হাত তোলেন নি। তবে এক দিন তুলেছিলেন সেই গল্প আরো পরে পলব। তো আব্বু যখন বাড়ীতে থাকতেন না তখন আমি আমার ইচ্ছা মতো ইচ্ছা গুলো পুরন করতাম। খুব সম্ভবত ১৯৯৪ সালে আব্বু ঢাকায় গেলেন বিএড করতে। দশ মাসের জন্য। আমার খুশি দেখে কে। তখন আমি আমার বাড়ীর রাজা আমার প্রজা সবাই। উজির এ আজম বলেন প্রধান সেনাপ্রতি কিংবা প্রধান মন্ত্রিই বলেন তা ছিলো আমার ছোট ভাই সাইফুর রহমান শিশির। ওর আরেকটা সুন্দর নাম আছে, কচি। আমার দাদী রেখেছিলেন। তো আব্বু যখন পড়তে গেলেন তখন আমি প্রায়ই স্কুলে যাওয়ার প্রয়োজন বোধ করতাম না। খালে মাছ ধরতে যাওয়াটা কিংবা কাইচ্চা খেলানোটাই আমার কাছে বেশী গুরুত্বপূর্ন মনে হতো। বিকেলে পাতাকাটা গ্রামে যেতাম হাডু-ডু খেলা দেখতে। তখন আমি নিজেও বেশ হাডু-ডু খেলতাম। তো সে সময়ের এক বর্ষা কালের কথা। কি একটা বিষয় নিয়ে এমন হয়েছে যে আমি ঘরে ঢুকলেই মা ঝাপিয়ে পড়বেন। আমি আর খেলা শেষে ঘরে না ফিরে পাতাকাটাতেই আমার এক দূর সম্পর্কের নানির বাড়ীতে গিয়ে উঠলাম। নানির মুখে একটাও দাঁত ছিলো না। বাঁশের চোং আর বাটাল দিয়ে অনেক সময় ধরে পান কুচি কুচি করে তার পর খেতেন। আমি তার সেই পান খুব খেতাম। আমার ঠোট রাঙা হতো দেখে উনি খুব মজা পেতেন। তো আমি সেই নানীর বাড়ীতে গিয়ে লুকালাম। ভাবলাম মা এখানকার খোঁজ কোন মতেই পাবেন না। আর যদি কোন ভাবে ধারনাও করতে পারেন যে আমি এই নানির বাড়ীতে আছি তাহলেও আমাকে ধরে নিয়ে যাওয়ার মতো জন শক্তি মায়ের কাছে এখন নেই। কিন্তু রাত যত বাড়ছিলো আমার ধরে নিয়ে যাওয়ার ভয় তত বাড়ছিলো। আমাদের গ্রাম ফুলঝুড়ী আর পাশের গ্রাম পাতাকাটায় তখন তো বিদ্যুত ছিলোই না এখনও নেই। তো সন্ধা, চার দিকে বেশ ঘুট ঘুটে অন্ধকার। আমি আর নানি বসে আছি। নানী চান সওদাগরের কিচ্চা বলা শুরু করলেন। আমি সেই পরিবেশটার বর্ননা দেয়ার লোভ সামলাতে পারছিনা। নানী তার স্বামীর পুড়ানো কাঠের একটা প্রাসাদ তুল্য বাড়ীতে থাকতেন। থাকেন দোতলা পাটাতনে। ঘরে আলো বলতে হারিকন। সেই আলোর বিপরীতে বলে দন্তহীন এক বুড়ী পান ছেঁচতে ছেঁচতে নেশাতুর গল্প বলছে আর আমি মুগ্ধ হয়ে শুনছি। হঠাৎ আমার কানে বুড়ীর গল্পের সাথে একটা চিকন বাশীর সুর ভেষে আসতে লাগল। আমার কলিজাটা যেনো উল্টে গেলো। এই বাঁশী বিষের বাঁশী। এ বাশী আমার জন্য ভালো নয়। বাঁশী ধীরে ধীরে আরো কাছে আসতে শুরু করলো। আমার প্রান আরো উতলা হয়ে উঠলো। বাঁশী আরো কাছে আসলো, আরো কাছে। আমি তো মেয়ে নই তবে কেন এই বাঁশী শুনে এত উতলা? কারনটা হলো আমি বংশি বাদককে চিনি। এই বংশি বাদক আসলে আমার মায়ের পাঠানো কোতোয়াল। বাশী বাজতে বাজতে আস্তে আস্তে নানীর দরজায় এসে কড়া নাড়ল। যা ভেবে ছিলাম তাই। আমার মায়ের কোতয়াল, দুজন কোতয়ার। একজনের নাম আফজাল আরেক জনের নাম শহিদুল। এরা আমার চেয়ে বয়সে গায়ে পায়ে অনেক বড়। এরা দুজনেই অসম্ভর ভালো বাঁশি বাজায়। দুজনই বেশ ভালো বন্ধু। আফজাল আমার প্রতিবেশী ভাই আর শহিদুল দুর সম্পর্কের ফুফাতো ভাইয়ের ছেলে। মানে আমার ভাতিজা। বয়সে বড় দেখে আমি আপাতত চাচা ডাকি। একদিন তো বড় হব তখন শহিদুইল্লা বলে ডাকব। যাই হোক এদের সাথে যুদ্ধে যাওয়াটা বোকামী ভেবে সুবোধ ছেলের মতো ঘরের ছেলে ঘরে রওনা দিলাম। বুড়ীর গল্পের বাকী অংশ পরে স্কুল ফাঁকি দিয়ে শোনা যাবে। এটাই ছিলো আমার প্রথম বড় বাড়ী পালানোর গল্প। আর আমার বাড়ী আসার পর কি হলো তাতো নিশ্চই জানতে ইচ্ছে করছে তাই না? চোখ রাখুন এই পাতায় একদিন ঠিকই পেয়ে যাবেন।
Saiful Baten Tito সাইফুল বাতেন টিটো
৫ এপ্রিল, রবি বার
ঢাকা।