শাবান হিজরি বছরের অষ্টম ও পবিত্র রমযানের পূর্ববর্তী মাস। রজব এবং পবিত্র রমজান মাসের মাঝে থাকা এ মাসটি ফযীলত ও মহত্ত্বের দিক দিয়ে অসীম গুরুত্বের দাবিদার। কেননা রমজান মাস ব্যতীত মহানবী হযরত মোহাম্মদ (সা.)শাবান মাসেই সবচেয়ে বেশি রোজা রাখতেন । আর এ জন্য আমরা শাবান মাসকে রমজান পূর্ববর্তী প্রশিক্ষনের মাস হিসেবে ধরতে পারি । অনেক মুসলমান ১৫তম শাবানের রাত পবিত্র “শব ই বরাত" হিসেবে পালন করে থাকে । ‘শব’ ফার্সী শব্দ। অর্থ-রজনী। বরাত অর্থ মুক্তি, নিষ্কৃতি। এ রাতকে লাইলাতুল বরাতও বলা হয়।
শাবানের মধ্যবর্তী রাত অর্থাৎ শব ই বরাতের ফজিলত বণর্না করতে গিয়ে অনেক আলেমগণ সূরা দুখানের (২-৪) আয়াতগুলোর উল্লেখ করেন; মহান আল্লাহ বলেন, “সুস্পষ্ট কিতাবের শপথ। আমি একে নাজিল করেছি এক ‘বরকতময় রজনী’তে, কারণ আমি মানুষকে সতর্ক করতে চেয়েছিলাম। এ রাতে প্রতিটি প্রজ্ঞাপূর্ণ বিষয় স্থীরকৃত হয় ।" পবিত্র কোরআনে সূরা দুখান এ "লাইলাতুল মুবারাকা" বলতে আসলে শবে কদরকে বুঝানো হয়েছে । কেননা কুরআন যে লাইলাতুল কদরে অবতীর্ণ হয়েছে এবং এ রাতেই মানুষের তাকদির নির্ধারিত হয় তা সূরা কদর দ্বারা প্রমাণিত। আর এর দ্বারা যে শবে বরাত অর্থহীন হয়ে গেল এটা বোঝা ভুল হবে কেননা “শব ই বরাত" এর রাতও যে নিজ গুনে মহিমান্বিত এ সম্পর্কে কোন সন্দেহ নেই ।
কেননা আমরা যদি শব ই বরাত এবং শব ই কদর সম্পর্কে পবিত্র কোরআনের তাফসির নিয়ে আলোচনা করি তবে শেষ পর্যন্ত একটি সিদ্ধান্তে উপনীত হতে পারি যে , ফজিলতপূর্ণ এ মুহূর্ত ১৫ তম শাবানের রাত থেকে শুরু হয় এবং পবিত্র শব ই কদরের রাতে গিয়ে সমাপ্ত হয় ।তাফসীরে খাযেন, ৪র্থ খন্ড, পৃষ্ঠা - ১১২ থেকে হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস রাদ্বিয়াল্লাহু তা’আলা আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন- আল্লাহ তা’আলা শা’বানের পনরতম রাতে সিদ্ধান্তসমূহ চূড়ান্ত করেন এবং শবেক্বদরে তা বাস্তবায়নকারী ফেরেশতাদের সোপর্দ করেন। এখানে একটি রহস্য থেকে যায় – তাহলে কেন শাবান থেকে পবিত্র রমজান মাস পর্যন্ত এই দীর্ঘ মেয়াদি প্রক্রিয়া ? এর উত্তর মহান আল্লাহ তায়ালা নিজেই ভাল জানেন ।কারণ মহান আল্লাহ তায়ালার দর্শন আমাদের কাছে সম্পূর্ণ অজানা । উদাহরণ হিসেবে বলা যেতে পারে আমাদের মধ্যে কেউ জানে না আল্লাহ তায়ালা কিভাবে ৬ দিনে পৃথিবী সৃষ্টি করেছেন ? আর এজন্য আমাদের উচিৎ এসব বিষয় নিয়ে তর্কে না গিয়ে আল্লাহর ইবাদত করা এবং নিজেদের সাধ্য অনুযায়ী আল্লাহকে জানার চেষ্টা করা । কেননা ইসলাম কখনোও আবেগের বশবর্তী হয়ে তর্কবাজদের ধর্ম হতে পারে না ।উপরের আলোচনা গুলোর ভাবার্থ নিম্নক্তো বই গুলো থেকে নেয়া হয়েছে ==
(Tafsir Tabari, Fathul Qadeer by Qadi Shawkani, Tafsir Qurtabi, Tafsir Bagawi, Tafsir Mazhari, Tafsir Ma’ah riyful Qur’an, Tafsir Ibn Kathir, Tafsir Zia-ul-Qur’an under the verse of Surah Al- Dokhan verse 1 to 5”)
আবার হযরত আয়শা সিদ্দীকা (রা.) বলেছেন, এক রাতে আমি রাসূল (সা.)-কে পেলাম না। তখন খুঁজে দেখলাম, তিনি জান্নাতুল বাকী কবরস্থানে গিয়ে মৃত ব্যক্তিদের রূহের মাগফিরাত কামনা করে দোয়া করছেন। তখন রাসূল (সা.) আমাকে দেখে বললেন, হে আয়শা! তুমি কি মনে করছো যে, আল্লাহ ও আল্লাহর রাসূল তোমার প্রতি অবিচার করেছেন? তখন আয়শা (রা.) বললেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ (সা.)! আমি ধারণা করেছিলাম আপনি অপর কোন স্ত্রীর ঘরে গেছেন। তখর রাসূল (সা.) বললেন, অর্ধ শা’বানের রাতে (শব-ই-বরাতে) আল্লাহপাক নিকটতর আসমানে অবতীর্ণ হন এবং বনি কলব গোত্রের ছাগলের পালের পশমের চেয়ে অধিক সংখ্যক ব্যক্তিকে ক্ষমা করেন (তিরমিযী, ইব্ন মাজাহ্)।
আর এ কারণেই শব ই বরাত আল্লাহর সাথে সম্পর্ক গভীর করার রাত। সুতরাং, আল্লাহকে খুশি করার জন্যে সারা রাত ইবাদতে নিমগ্ন থেকে গোনাহ থেকে মাফ চাওয়া, রিযিক প্রার্থনা করা, রোগ মুক্তি ও ইত্যাদি কামনা করা উচিৎ। এ রাতে প্রচুর পরিমাণ নফল নামায আদায়, যিকর-আযকার, কুরআন তিলাওয়াত, দরূদ পাঠ, দান-খায়রাত করা, ফকীর-মিসকীনকে খানা দান করা, আমাদের পূর্বপুরুষসহ অসংখ্য আত্মীয়-স্বজন ও প্রিয়জন কবরে শায়িত রয়েছেন, তাদের জন্যে কবর যিয়ারত, জীবনের অসংখ্য গুনাহ ক্ষমা চেয়ে আল্লাহর দরবারে কান্নাকাটি, ইস্তিগফার, পিতা-মাতা, আত্মীয়-স্বজন, ওস্তাদ ও বিশ্বের সকল মুসলিম-মুসলিমাত ও মু’মিন-মু’মিনাতের জন্যে দোয়া করা উচিত।
কুরআন ও হাদীসের আলোকে যে কোনো নেক আমল বা ইবাদত আল্লাহর দরবারে কবুল হওয়ার জন্য তিনটি মৌলিক শর্ত রয়েছে:
বিশুদ্ধ ঈমান ও ইখলাস: শির্ক, কুফ্র ও নিফাক-মুক্ত বিশুদ্ধ ঈমান সকল ইবাদত কবুল হওয়ার পূর্ব শর্ত। উপরন্তু ইবাদতটি পরিপূর্ণ ইখলাসের সাথে একমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য হতে হবে। আল্লাহর সন্তুষ্টি ছাড়া অন্য কোনো রকম উদ্দেশ্যর সামান্যতম সংমিশ্রণ থাকলে সে ইবাদত আল্লাহ কবুল করবেন না। (২) সুন্নাতের অনুসরণ: কর্মটি অবশ্যই রাসূলুল্লাহ এর সুন্নাত বা পদ্ধতি ও রীতি অনুসারে পালিত হতে হবে। যদি কোনো ইবাদত তাঁর শেখানো ও আচরিত পদ্ধতিতে পালিত না হয়, তাহলে যত ইখলাস বা আন্তরিকতাই থাক না কেন, তা আল্লাহর দরবারে কোনো অবস্থাতেই গৃহীত বা কবুল হয় না।
হালাল ভক্ষণ : ইবাদত পালনকারীকে অবশ্যই হালাল-জীবিকা-নির্ভর হতে হবে। হারাম ভক্ষণকারীর ইবাদত আল্লাহর দরবারে কবুল হয় না।
শিরক বর্জন : আমরা দেখেছি যে, মধ্য-শাবানের রাত্রি বা লাইলাতুল বারাতের ক্ষমা ও বরকত লাভের জন্য সহীহ হাদীসে দুটি শর্ত উল্লেখ করা হয়েছে: (১) শিরক থেকে মুক্ত হওয়া ও (২) হিংসা-বিদ্বেষ থেকে মুক্ত হওয়া। মানুষের জীবনের ভয়াবহতম পাপ হলো শিরক। অন্যান্য সকল পাপের সাথে এর পার্থক্য হলো: (১) সকল পাপই আল্লাহ ইচ্ছা করলে তাওবা ছাড়াও ক্ষমা কতে পারেন, কিন্তু পরিপূর্ণ তাওবার মাধ্যমে শিরক বর্জন ছাড়া শিরকের পাপ তিনি ক্ষমা করেন না। (২) সাধারণ পাপের কারণে মানুষের নেক কর্ম ধ্বংস হয় না, কিন্তু শিরকের কারণে মানুষের সকল নেক কর্ম বিনষ্ট হয়ে যায়। (৩) সকল পাপে লিপ্ত মানষেরই জান্নাতে যাওয়ার আশা থাকে, কিন্তু শিরকে লিপ্ত মানুষের জন্য আল্লাহতায়ালা তার জান্নাতকে চিরতরে হারাম করেছেন এবং তার চিরস্থায়ী নিবাস জাহান্নাম।
এবার একটু অন্য দিকে দৃষ্টি দেয়া যাক মর্যাদাপূর্ণ হওয়ার কারণে এ রাতকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে অনেক বিদআত ও অন্ধ বিশ্বাস। রাসুল (সা.) বলেছেন, যে আমার এই দ্বীনের মধ্যে যা নেই তার আবিষ্কার করে তা হল বেদআত ( আল হাদীস)। বিদআত সম্পর্কে বলতে গেলে বলতে হয় যে সমস্ত কুসংস্কার মুর্খতা বশত মুসলমান সমাজে ঢুকে গেছে ( যেমন - যেদিন ধান বুনে সেদিন খৈ ভাজে না , যে হাঁড়িতে তেল বুনে সে হাঁড়ি বাড়িতে আনলে মাটিতে রাখে না, দরগায় আতশ বাজি, মেলা ,ওরশ করা প্রয়োজনের বেশি খরচ অর্থাৎ অপচয় করা ইত্যাদি )।
আমাদের দেশের দিকে লক্ষ্য করলে দেখা যাবে শবে বরাত আজ একটা ফ্যাশনে পরিণত হয়েছে । খাওয়া-দাওয়া ,পটকা, রাতভর নফল নামাজের নামে আড্ডা , সব মিলিয়ে এক ধরণের উৎসব । এই রাতে ইবাদাতকারীদের একটা বড় অংশকে বছরের অন্য সময় নামাজ কালাম পড়তেও দেখা যায় না । আবার এদের অনেকে শবে বরাতে রাতভর পেট পূজা করে হাপিয়ে পড়ে এবং সবশেষে ফজরের ফরজ নামাজ মিস করে। নির্মম হলেও এটা সত্য এবং অদ্ভুত ব্যাপার। কারণ এ রাত আনন্দ-উল্লাসের কোনো অনুষ্ঠান নয়; বরং আত্মসমালোচনা ও ব্যক্তিগত ইবাদত-সাধনার একটি রাত।
আমার ছোট্ট মাথা দিয়ে এতবড় কথা গুলো লেখা ঠিক হল কিনা জানি না । তবে লেখাটির মধ্যে যদি কোন বড় ভুল থেকে থাকে তাহলে আল্লাহ আমাকে ক্ষমা করুন ।আল্লাহ আমাদের সবাইকে তওফিক দান করুন। আমিন ।
সাইয়েদুল আরেফিন (সৈকত)
আংকারা , তুরস্ক ।

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।




