পাহাড় প্রেম ও প্রেম-ভালোবাসা বা সংসারিক দায়বদ্ধতা নিয়ে একটি কাল্পনিক লেখা। কারো জীবনের সাথে মিলে গেলে কেউ দায়ী নয়। আর এই লেখা পড়ে কোন রকম পরবর্তী প্রভাবের জন্য লেখক কোন ভাবেই দায়ী নয়। সুতরাং নিজ নিজ দায়িত্ব নিয়ে পড়বেন।
ঘোরাঘুরি বা এখানে ওখানে চলে যাওয়াটা আগেও ছিল তার ভিতরে। কিন্তু এই পাহাড়-বন-জঙ্গল বা সমুদ্রে যাওয়া, এটা বেশ ধীরে আর পরিপক্ক বয়সেই ধরা দিয়েছে। অনেকটা বাঁধন হারা পরকীয়ার মতন! আসলে তখন পকেটে পয়সা ছিলনা। দিনের তিন বেলা খাবার জোটাতেই যেখানে হিমশিম খেত, সেখানে এইসব পাহাড় বা সমুদ্রে কিভাবে যাবে? তাই পড়াশুনা শেষ করে, একটি চাকুরী জুটিয়ে, দুইটার পয়সার মুখ দেখাতেই, এইসব ছাই চাপা পাগলামি মাথা চাড়া দিয়ে উঠেছে আজকাল। তাই ছুটে পালায় এদিক ওদিক, দুটি পয়সা আর দুই দিনের ছুটি বা অবসর পেলেই।
কিন্তু প্রথম প্রথম পরিবারের লোকজন এই পাহাড়ে পাহাড়ে গড়িয়ে বেড়ানোর ব্যাপারটাকে সাময়িক বিনোদনের চোখে দেখলেও, একসময় এটাকে সবার কাছে অসহ্য আর অগ্রহণযোগ্য হয়ে উঠলো। যে কারণে হয়তো সব কিছু তুচ্ছ করে পাহাড়ে গেলেও, মানসিক শান্তি নিয়ে খুব একটা যেতে পারতোনা। কারণ, যতক্ষণ মোবাইল নেটওয়ার্ক থাকতো ততক্ষণই চলতি অমানুষিক মানসিক অত্যাচার! যেন এর চেয়ে নিজেকে শেষ করে দেয়াটাও শ্রেয়তর মনে হত, কখনো কখনো। তাই উপভোগটাও কমে যেত অনেকাংশে।
এরপর থেকে পরবর্তী কোথাও যাবার প্ল্যান করার আগেই বাসায় প্রস্তাব দিত, সবাই যাবে কিনা পাহাড়ে বা সমুদ্রে? গেলে সেভাবে ব্যাবস্থা করবে। কিন্তু না কেউই যেতে আগ্রহী নয়। আবার সে যে নিজে যাবে সেটাতেও চরম আপত্তি! অদ্ভুত, সাথেও যাবেনা আর একা একাও যেতে দেবেনা! হয়তো কখনো দেখা যেত কোথাও যাবেনা বলে একা একাই নিজের দুঃখ-কষ্ট আর যন্ত্রণা বুকে চেপে রেখেছে, সেটাতেও সমস্যা! কোথাও যাওনা কেন? ঘোরের কোনায় বসে আছো কেন? যাও কোথাও ঘুরে আসো। ইত্যাদি ইত্যাদি। এসব শুনে হয়তো বেরিয়েও যেত কোন অজানার উদ্দেশ্যে, কিন্তু কিছু দূর যাবার পর থেকেই শুরু হত সেই মানসিক অমানুষিক অত্যাচার! যেটা কাউকে বলে বোঝানো সম্ভবনয় আদৌ।
আর সেই অত্যাচারটাও এমন সময় শুরু করতো যেখান থেকে আর ফিরে আসাও সম্ভব হতনা। তাই অবশেষে না পারতো ঠিকঠাক ভ্রমনকে উপভোগ করতে আর না পারতো ফিরে গিয়ে স্বাভাবিক ভাবে সব কিছু মেনে নিতে।
এইসব যে ভালোবাসার বাঁধন বা বাঁধা সেটা সে বুঝত। কিন্তু তার নিজেরও তো আছে কিছু একান্ত ভালোলাগা বা ভালোবাসা যেটা সে মন থেকে উপভোগ করে। যেটা করে সে মানসিক ও শারীরিক সব রকম ভাবে উৎফুল্ল থাকে। যেটা করলে সে প্রেরণা আর জীবনীশক্তি খুঁজে পায়, অন্য রকম এক আনন্দ নিয়ে বেঁচে থাকার। জীবনকে যখন মনে হয় অন্য রকম এক বর্ণিলতায় আঁকা।
তবে পরিবারের মানুষেরা কেন বোঝেনা? সে তো সব সময় তাদের কাছে, পাশে আর ঘিরেই আছে। মাঝে মাঝে বছরে দুই একবার, কখনো কখনো ৫-৭ বা ১০ দিনের জন্য একটু পেরিয়ে পরে নিজের একান্ত সুখ আর অন্য ভাবে জীবনকে দেখার ও উপভোগের খোঁজে। এই টুকুতেই এতো এতো বাঁধা? আরে অন্য কিছু তো করছেনা, মদ-গাঁজা-সিগারেট-মেয়ে মানুষ-চুরি-ডাকাতি-ছিনতাই বা নোংরা রাজনীতি করে তো জীবন ও সামাজিকতাকে হুমকির মুখে ফেলছেনা। একটু পাহাড়েই তো যায় মাত্র। তাও কয়েকটি দিনের জন্যই তো? এতুকুও কি মেনে নেয়া যায়না। কোন অপরাধ বা অসামাজিক কিছু তো করছেনা। তবে?
তাই সে সিন্ধান্ত নিল। কে কি, কেন আর কিভাবে বলছে কোন পরোয়া করবেনা আর। সময়-সুযোগ আর অর্থের যোগান হলেই সে পালাবে। না ধারবে কারো ধাঁর না নেবে কারো কাছ থেকে কোন অনুমতি। না আগে থেকে বলবে যে যাচ্ছে কোথাও। যে ভাবা সেই কাজ। এভাবে শুরু করলো তার নিজস্ব জীবন যাপন আর উদযাপন ও উপভোগ। যেটা তার পরিবারের কাছে আরও অসহনীয় আর অমার্জনীয় হয়ে উঠলো স্বাভাবিক ভাবেই।
তাই একবার। কোন এক পাহাড়-বন-জঙ্গল মাড়িয়ে ক্লান্ত আর পরিশ্রান্ত হয়ে বাড়ি ফেরার পরে মুখোমুখি হতে হল এক চরম বাস্তবতার। তার সঙ্গী তাকে বলে দিল। এই যে এলে এবারই শেষ। আর কোথাও যাওয়া হবেনা কখনো। একসাথেও না আর একাও না। মনে থাকে যেন? তাহলে তোমাকে যে কোন একটাকে বেছে নিতে হবে... “হয় পাহাড়, নয়তো আমি...!” খুবই নির্মম কিন্তু কঠিন সত্যের মুখোমুখি আজ সে। কিন্তু চুপ করেই রইলো, কোন কথা না বলে। কারণ এই মুহূর্তে তো আর কোথাও যাচ্ছেনা অন্তত।
ছয় মাস পরে আবারো এলো একটি ভ্রমন সময়, কিছু উপলক্ষ আর একটু সুযোগও। আছে কিছু টাকা পয়সাও জমা। যাবে কোথাও পরিকল্পনা করছে। পেয়েও গেল কিছু সঙ্গী। ব্যাস আবারো মাথায় পাগলামি করেছে ভর। পাহাড়ে যাবে সব কিছুই এখন পর। বাসায় গিয়ে ব্যাগ গোছাতে লাগলো। আর স্বাভাবিক ভাবেই আবারো বাঁধা, কি দরকার যাবার, কেন যাবে, কে আছে পাহাড়ে? এসব বাদ দিতে হবে, মনযোগী হয়ে হবে সংসারে, ইত্যাদি, ইত্যাদি।
তার যুক্তি কেন, সে কি সংসারে কম মনযোগী, কোন অভাব রেখেছে কি যেটা ছিল বা আছে সাধ্যের মধ্যে? কোন কমতি দেখেছে কারো প্রতি কোন রকম আচার-আচরনে বা মনোযোগে? তবে কেন এতো বাঁধা, কিসের এতো বাঁধা। সে যে পারবেনা সইতে। আর পারবেনা ভ্রমনে না গিয়ে বাসায় বসে বসে খেতে আর ঘুমোতে এই অখণ্ড অবসর। সে যাবে, যাবেই যাবে। যা হয় হোক। সে যাচ্ছে। বেরিয়ে পরলো তার মত করে। কাঁধে ব্যাগ আর মাথায় ক্যাপ পরে।
পিছন থেকে শুধু শুনতে পেল... এভাবে সব কিছু উপেক্ষা করে যেহেতু চলে যেতে পারছে কেবল মাত্র নিজের আনন্দের জন্য, তবে তাই হোক আর ফিরে আসার দরকার নাই। থেকে যেন যায় ওই পাহাড়েই!
চলে গেল কোন এক অজানা পাহাড়ে। অতি আধুনিক সময় আর উচ্চ প্রযুক্তির কারণে আজকাল সব জায়গাতেই কম বেশী মোবাইল নেটওয়ার্ক পাওয়া যায়। সে উঠেছিল এক পাহাড়ের চুড়ায়। চোখ ভরে দেখছিল সারি সারি উঁচু নিচু পাহাড় আর পাহাড়, সবুজ আর সবুজ। গন্ধ নিচ্ছিল মন-প্রান ভরে, কাঁচা মাটির, সবুজ ঘাস আর পোড়া জুম খেতের। আর নিচ্ছিল বুক ভরে নিশ্বাস, বিশুদ্ধ আর নির্মল বাতাসের। কে জানতো এটাই, এই পাহাড়েই সে নেবে এমন বুক ভরে তার শেষ নিশ্বাস!
সেই পাহাড়ের চুড়ায় মোবাইল বেজে উঠলো। বাসার ফোন। স্বাভাবিক ভাবেই ফোন ধরার সাথে সাথেই ওপাশ থেকে শুরু হল কথার আর মনকে সার্বিক ভাবে বিষিয়ে তোলা ঝড়ের মত বাক্যবান! যা সে আর সইতে পারলো না কোন ভাবেই। অসহ্য হয়ে উঠলো সব সব সব কিছুই। তাই সেও সেই পাহাড়ের চুড়া থেকে জানিয়ে দিল। ঠিক আছে সে আর ফিরবেনা। সে আর ক্ষণে ক্ষণে কাউকে কষ্ট আর যন্ত্রণা দেবেনা। এমনকি সে নিজেও আর উপভোগ করবেনা এই পাহাড়-প্রকৃতি আর সবুজ নির্মলতাকে। ভালো থেকো তোমারা, তোমাদের মত করে।
ফোনটা না কেটে, লাউড স্পীকার দিয়ে, অন্যান ভ্রমন সঙ্গীদের পাশ কাটিয়ে চলে গেল চুড়ার একেবারে শেষ সীমানায়। সবাই দেখে সাবধান করতে না করতেই সেই পাখির মত উড়ে যেতে চাইলো, সেই পাহাড়ের চুড়া থেকে অন্য পাহাড়ের চূড়াতে............!
করে দিয়ে নিজেকে বিলীন এই সমাজ, সভ্যতা, সংসার আর কঠিন বাস্তবতাকে। করে উপেক্ষা পাহাড়ের মায়া আর টানকে।
তার তার শেষ বাক্যটি ছিল...... “না, আমি পাহাড়েরও নয়, নয় তোমাদেরও...”
সর্বশেষ এডিট : ০৬ ই ডিসেম্বর, ২০১৫ দুপুর ১:৪৪