somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

স্মৃতিসত্ত্বাকণাঃ কারাবাসনামা-২

২০ শে নভেম্বর, ২০২১ ভোর ৪:০৪
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


২.
ভিয়েনাতে সেবার বরফটা যেন একটু বেশিই পড়ছিলো। চারিদিকে সাদা চাদরে ঢাকা। জমাট বান্ধা ঠান্ডা। দূরে একটা পার্কের মাঠে অনেকগুলা কাউয়া ঠুকরায়া ঠুকরায়া কী যেন খায়। ইউরোপের কাউয়ারা আমাদের দেশী কাউয়ার মতো সুইট না। তারা বিশাল দামরা আর কুচকুচে কালা। প্রায়োন্ধকারেও সাদা চাদরে ঢাকা কালো বিন্দুর মতো কাউয়াগুলারে দেইখা মনে হইলো ক্যানভাসে আঁকা কোনো স্যুররিয়াল চিত্রকর্ম দেখতেছি।
সেই ঠান্ডার মধ্যে তারা আমারে এসকর্ট কইরা নিয়া গাড়ির ব্যাকসিটে বসাইলো, আর তাদের মধ্যে দুই ঠোলা আমার দুই পাশে। গাড়ি চলতে লাগলো। আমি তাগো মাঝখানে ঝিম মাইরা বইসা আছি আর তাগো টুকটাক বাক্যালাপ শুনতেছি। বাক্যালাপের বিষয়, ওয়েদার আর অস্ট্রীয়ান বুন্দেসলীগা।
জেলখানাটা ভিয়েনা সিটির একদম চিপায়। ঘোর ঠান্ডায় রাস্তা ফাঁকা। তাই আমাদের পৌছাইতে বেশি সময় লাগলো না। জেলখানার বিশাল মেইন ফটকের ছোট একটা পকেট গেইট দিয়া আমরা ভিতরে ঢুকলাম। কিছুদূর হাইটা গিয়া আসলাম একটা বিশাল রিসেপশান জাতীয় ডেস্কের সামনে। ডেস্কের পিছনে মোছওয়ালা এক ঠোলার সামনে আমারে দাঁড় করানো হইলো। নিজেরে তখন কেন জানি একটা ক্রিমিনাল ক্রিমিনাল লাগতেছিলো। প্রথমেই আমার ওয়ালেট (ওয়ালেট-এ ব্যাংকের কার্ড, আড়াইশ’র মতো ইউরো, Meldezettel সহ দরকারী কিছু ভিসিটিং কার্ড ইত্যাদি), বাসার চাবির গোছা আর মোবাইল জমা দিতে হইলো।
তো সেই মোছুয়া আমার কাগজপত্রের ফাইল দেখতে দেখতে আমারে ইতং বিতং গদবাঁধা কিছু প্রশ্ন করলো। তারপর এক ঠোলা আইসা আমারে একটা চারফুট বাই আট ফুট প্রকোষ্ঠে ঢুকাইয়া দিয়া উধাও হইলো।
প্রকোষ্ঠের মধ্যে বসবার জন্য একটা ছোট্ট বেঞ্চ। আমি গিয়া বসলাম তাতে। আধা ঘন্টা যায়, এক ঘন্টা যায়, দুই ঘন্টা যায়, এমন কী তিন ঘন্টাও পার হইয়া গেলো, কিন্তু তাগো কারও আসবার কোনো নামগন্ধ নাই।
ডর নয়, আতঙ্ক নয়, সামনে কী অপেক্ষা করতেছে-আমার সেই চিন্তাও নাই। নিজেরে শুধু সেলফ কাউন্সেলিং করতেছি- সব ঠিক হইয়া যাবে, সব ঠিক হইয়া যাবে। কিন্তু ঘন্টা তিনেক পার হবার পর ভিতরে ভিতরে আমার এক নিদারুণ অস্থিরতা শুরু হইলো। সেন্ট্রাল হিটিং-এর মধ্যে বইসা বইসা শরীর আমার ঘাইমা একশেষ। গায়ের পুরু লেদার জ্যাকেট আর পুলওভারটা খুইলা ফালাইলাম। জীবনে এই প্রথম যেন দীর্ঘ অপেক্ষার উথাল পাথাল যন্ত্রণা আমারে গিলা খাইতে লাগলো!
আরও কতক্ষণ এইভাবে কাটলো, মনে নাই। হঠাৎ দরজা খোলার আওয়াজ। আমি যেন হাঁপ ছাইড়া বাঁচলাম। এক মামু আমারে নিয়া রওয়ানা হইলো। হাতে ধরায়া দিলো একটা কম্বল, থালা-বাটি আর একটা গ্লাস। আর ধরায়া দিলো স্ন্যাকস্‌-এর একটা প্যাকেট। আমি তখন ছিলাম বিড়িখোর। আমারে শুধু বিড়ির প্যাকেটটা সাথে নিতে দিলো। মানবতা বইলা কথা!
এসব হাতে নিয়া প্রথমেই যা আমার মনে আইলো, তা হইলো, এই দৃশ্য আমি হলিউড মুভিতে অনেকবার দেখছি- লোটা কম্বল হাতে ধরায়া নায়ক বা ক্রিমিনালরে নিয়া জেলের সেল-এ নিয়া যাবার দৃশ্য।
লিফট দিয়া তিন বা চার তলায় আসলাম আমরা। প্রসস্ত প্যাসেজ। আর তার ডান দিকে সারি সারি জেলখানার সেল। একটা সেল খুইলা ঢুকায়া দেয়া হইলো আমারে। সেলটা বর্গাকৃতির, আয়তনে বেশ বড়। এক কোণায় টয়লেট। সেল-এর দুইদিকে দুইটা কইরা মোট চারটা দুইতলা বিশিষ্ট বাঙ্কার। আমার শুইবার যায়গা হইলো একটা বাঙ্কারের দুই তলায়। জেলের নিয়ম অনুযায়ী ঠিক রাত নয়টায় তারা সেল-এর বাত্তি নিভায়া দেয়। তখনও মনে হয় নয়টা বাজে নাই। আমি চারদিকে তাকায়া দেখলাম, চ্যাংড়া আর মধ্য বয়সী মিলায়া মোট ছয়জনের ছয়জোড়া চোখ চিকন দৃষ্টিতে আমারে মাপতেছে। তাদের মধ্যে একজন কালো আর বাকীরা সাদা। আমি তাদের দিকে তাকায়া একটা মাই ডিয়ার মার্কা হাসি দিলাম। এতে তাদের মন গললো কী না, বুঝলাম না।
-“ইন্ডিয়ান?” প্রথমজনের প্রশ্ন।
-“না, বাংলাদেশী।“
-“এইটা আবার কই (ভাঙ্গা জর্মনে)?”
-“ইন্ডিয়ার পাশেই।“
-“অ!”
তারপর নিরবতা।
আমি আমার বাঙ্কারের বিছানায় উইঠা তাদের দেয়া নতুন একটা সাদা চাদর আর ক্ষ্যাতা-কম্বল বিছাইলাম। একজন কী মনে কইরা আগায়া আইসা কইলো, “এইখানে এমনে চাদর পাতে না।“
-এই বইলা সে চাদরের চার কোণায় চারটা গিট্টু মারলো, তারপর কোণার গিট্টুগুলা ম্যাট্রেসের চার কোণায় ভালো মতো ঢুকায়া দিলো। চাদরটা এইবার টান টান হইয়া বিছানায় লাইগা গেলো। বিছানার চাদর পাতার তার এই কৌশলে আমি আক্ষরিক অর্থেই অভিভূত হইলাম। কিন্তু পেটে তখন জম্মের ক্ষুধা। আমি স্ন্যাকস্‌-এর প্যাকেট খুইলা খাওয়া শুরু করলাম। তারপর টয়লেটে যায়া দেখি, টয়লেটের দফারফা অবস্থা! মানে নোংরা। পৃথীবির সকল জেলখানার টয়লেটেরই মনে হয় এই অবস্থা থাকে। বাস্তবতা মাইনা নিয়া কাজ সাইরা ফের বিছানায় আসলাম। তার একটু পরেই সেল-এর বাত্তি নিভলো।
(চলবে)
কারাবাসনামা-১
সর্বশেষ এডিট : ২০ শে নভেম্বর, ২০২১ ভোর ৪:০৪
৭টি মন্তব্য ৩টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

=তুমি সুলতান সুলেমান-আমি হুররাম=

লিখেছেন কাজী ফাতেমা ছবি, ২৮ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৮:৩৬



©কাজী ফাতেমা ছবি

মন প্রাসাদের রাজা তুমি, রাণী তোমার আমি
সোনার প্রাসাদ নাই বা গড়লে, প্রেমের প্রাসাদ দামী।

হও সুলেমান তুমি আমার , হুররাম আমি হবো
মন হেরেমে সংগোপনে, তুমি আমি রবো।

ছোট্ট প্রাসাদ দেবে... ...বাকিটুকু পড়ুন

মৃত্যুর আগে ইবলিশ ঈমান নিয়ে টানাটানি করে

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ২৮ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১১:০২



ইউটিউব হুজুর বললেন, মৃত্যুর আগে ইবলিশ ঈমান নিয়ে টানাটানি করে। তখন নাকি নিজ যোগ্যতায় ঈমান রক্ষা করতে হয়। আল্লাহ নাকি তখন মুমিনের সহায়তায় এগিয়ে আসেন না। তাই শুনে... ...বাকিটুকু পড়ুন

মহিলা আম্পায়ার, কিছু খেলোয়ারদের নারী বিদ্বেষী মনোভাব লুকানো যায় নি

লিখেছেন হাসান কালবৈশাখী, ২৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১১:০৯



গত বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল প্রাইম ব্যাংক ও মোহামেডানের ম্যাচে আম্পায়ার হিসেবে ছিলেন সাথিরা জাকির জেসি। অভিযোগ উঠেছে, লিগে দুইয়ে থাকা মোহামেডান ও পাঁচে থাকা প্রাইমের মধ্যকার ম্যাচে নারী আম্পায়ার... ...বাকিটুকু পড়ুন

জানা আপুর আপডেট

লিখেছেন আরাফআহনাফ, ২৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১১:৫৭

জানা আপুর কোন আপডেট পাচ্ছি না অনেকদিন!
কেমন আছেন তিনি - জানলে কেউ কী জানবেন -প্লিজ?
প্রিয় আপুর জন্য অজস্র শুভ কামনা।



বি:দ্র:
নেটে খুঁজে পেলাম এই লিন্ক টা - সবার প্রোফাইল... ...বাকিটুকু পড়ুন

বন্ধুর বউ কে শাড়ি উপহার দিলেন ব্যারিস্টার সুমন। বাটার প্লাই এফেক্ট এর সুন্দর উদাহারন।

লিখেছেন নাহল তরকারি, ২৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৪:০৭



এক দেশে ছিলো এক ছেলে। তিনি ছিলেন ব্যারিস্টার। তার নাম ব্যারিস্টার সুমন। তিনি একজন সম্মানিত আইনসভার সদস্য। তিনি সরকার কতৃক কিছু শাড়ি পায়, তার জনগণের মাঝে বিলি করার জন্য।... ...বাকিটুকু পড়ুন

×