২.
ভিয়েনাতে সেবার বরফটা যেন একটু বেশিই পড়ছিলো। চারিদিকে সাদা চাদরে ঢাকা। জমাট বান্ধা ঠান্ডা। দূরে একটা পার্কের মাঠে অনেকগুলা কাউয়া ঠুকরায়া ঠুকরায়া কী যেন খায়। ইউরোপের কাউয়ারা আমাদের দেশী কাউয়ার মতো সুইট না। তারা বিশাল দামরা আর কুচকুচে কালা। প্রায়োন্ধকারেও সাদা চাদরে ঢাকা কালো বিন্দুর মতো কাউয়াগুলারে দেইখা মনে হইলো ক্যানভাসে আঁকা কোনো স্যুররিয়াল চিত্রকর্ম দেখতেছি।
সেই ঠান্ডার মধ্যে তারা আমারে এসকর্ট কইরা নিয়া গাড়ির ব্যাকসিটে বসাইলো, আর তাদের মধ্যে দুই ঠোলা আমার দুই পাশে। গাড়ি চলতে লাগলো। আমি তাগো মাঝখানে ঝিম মাইরা বইসা আছি আর তাগো টুকটাক বাক্যালাপ শুনতেছি। বাক্যালাপের বিষয়, ওয়েদার আর অস্ট্রীয়ান বুন্দেসলীগা।
জেলখানাটা ভিয়েনা সিটির একদম চিপায়। ঘোর ঠান্ডায় রাস্তা ফাঁকা। তাই আমাদের পৌছাইতে বেশি সময় লাগলো না। জেলখানার বিশাল মেইন ফটকের ছোট একটা পকেট গেইট দিয়া আমরা ভিতরে ঢুকলাম। কিছুদূর হাইটা গিয়া আসলাম একটা বিশাল রিসেপশান জাতীয় ডেস্কের সামনে। ডেস্কের পিছনে মোছওয়ালা এক ঠোলার সামনে আমারে দাঁড় করানো হইলো। নিজেরে তখন কেন জানি একটা ক্রিমিনাল ক্রিমিনাল লাগতেছিলো। প্রথমেই আমার ওয়ালেট (ওয়ালেট-এ ব্যাংকের কার্ড, আড়াইশ’র মতো ইউরো, Meldezettel সহ দরকারী কিছু ভিসিটিং কার্ড ইত্যাদি), বাসার চাবির গোছা আর মোবাইল জমা দিতে হইলো।
তো সেই মোছুয়া আমার কাগজপত্রের ফাইল দেখতে দেখতে আমারে ইতং বিতং গদবাঁধা কিছু প্রশ্ন করলো। তারপর এক ঠোলা আইসা আমারে একটা চারফুট বাই আট ফুট প্রকোষ্ঠে ঢুকাইয়া দিয়া উধাও হইলো।
প্রকোষ্ঠের মধ্যে বসবার জন্য একটা ছোট্ট বেঞ্চ। আমি গিয়া বসলাম তাতে। আধা ঘন্টা যায়, এক ঘন্টা যায়, দুই ঘন্টা যায়, এমন কী তিন ঘন্টাও পার হইয়া গেলো, কিন্তু তাগো কারও আসবার কোনো নামগন্ধ নাই।
ডর নয়, আতঙ্ক নয়, সামনে কী অপেক্ষা করতেছে-আমার সেই চিন্তাও নাই। নিজেরে শুধু সেলফ কাউন্সেলিং করতেছি- সব ঠিক হইয়া যাবে, সব ঠিক হইয়া যাবে। কিন্তু ঘন্টা তিনেক পার হবার পর ভিতরে ভিতরে আমার এক নিদারুণ অস্থিরতা শুরু হইলো। সেন্ট্রাল হিটিং-এর মধ্যে বইসা বইসা শরীর আমার ঘাইমা একশেষ। গায়ের পুরু লেদার জ্যাকেট আর পুলওভারটা খুইলা ফালাইলাম। জীবনে এই প্রথম যেন দীর্ঘ অপেক্ষার উথাল পাথাল যন্ত্রণা আমারে গিলা খাইতে লাগলো!
আরও কতক্ষণ এইভাবে কাটলো, মনে নাই। হঠাৎ দরজা খোলার আওয়াজ। আমি যেন হাঁপ ছাইড়া বাঁচলাম। এক মামু আমারে নিয়া রওয়ানা হইলো। হাতে ধরায়া দিলো একটা কম্বল, থালা-বাটি আর একটা গ্লাস। আর ধরায়া দিলো স্ন্যাকস্-এর একটা প্যাকেট। আমি তখন ছিলাম বিড়িখোর। আমারে শুধু বিড়ির প্যাকেটটা সাথে নিতে দিলো। মানবতা বইলা কথা!
এসব হাতে নিয়া প্রথমেই যা আমার মনে আইলো, তা হইলো, এই দৃশ্য আমি হলিউড মুভিতে অনেকবার দেখছি- লোটা কম্বল হাতে ধরায়া নায়ক বা ক্রিমিনালরে নিয়া জেলের সেল-এ নিয়া যাবার দৃশ্য।
লিফট দিয়া তিন বা চার তলায় আসলাম আমরা। প্রসস্ত প্যাসেজ। আর তার ডান দিকে সারি সারি জেলখানার সেল। একটা সেল খুইলা ঢুকায়া দেয়া হইলো আমারে। সেলটা বর্গাকৃতির, আয়তনে বেশ বড়। এক কোণায় টয়লেট। সেল-এর দুইদিকে দুইটা কইরা মোট চারটা দুইতলা বিশিষ্ট বাঙ্কার। আমার শুইবার যায়গা হইলো একটা বাঙ্কারের দুই তলায়। জেলের নিয়ম অনুযায়ী ঠিক রাত নয়টায় তারা সেল-এর বাত্তি নিভায়া দেয়। তখনও মনে হয় নয়টা বাজে নাই। আমি চারদিকে তাকায়া দেখলাম, চ্যাংড়া আর মধ্য বয়সী মিলায়া মোট ছয়জনের ছয়জোড়া চোখ চিকন দৃষ্টিতে আমারে মাপতেছে। তাদের মধ্যে একজন কালো আর বাকীরা সাদা। আমি তাদের দিকে তাকায়া একটা মাই ডিয়ার মার্কা হাসি দিলাম। এতে তাদের মন গললো কী না, বুঝলাম না।
-“ইন্ডিয়ান?” প্রথমজনের প্রশ্ন।
-“না, বাংলাদেশী।“
-“এইটা আবার কই (ভাঙ্গা জর্মনে)?”
-“ইন্ডিয়ার পাশেই।“
-“অ!”
তারপর নিরবতা।
আমি আমার বাঙ্কারের বিছানায় উইঠা তাদের দেয়া নতুন একটা সাদা চাদর আর ক্ষ্যাতা-কম্বল বিছাইলাম। একজন কী মনে কইরা আগায়া আইসা কইলো, “এইখানে এমনে চাদর পাতে না।“
-এই বইলা সে চাদরের চার কোণায় চারটা গিট্টু মারলো, তারপর কোণার গিট্টুগুলা ম্যাট্রেসের চার কোণায় ভালো মতো ঢুকায়া দিলো। চাদরটা এইবার টান টান হইয়া বিছানায় লাইগা গেলো। বিছানার চাদর পাতার তার এই কৌশলে আমি আক্ষরিক অর্থেই অভিভূত হইলাম। কিন্তু পেটে তখন জম্মের ক্ষুধা। আমি স্ন্যাকস্-এর প্যাকেট খুইলা খাওয়া শুরু করলাম। তারপর টয়লেটে যায়া দেখি, টয়লেটের দফারফা অবস্থা! মানে নোংরা। পৃথীবির সকল জেলখানার টয়লেটেরই মনে হয় এই অবস্থা থাকে। বাস্তবতা মাইনা নিয়া কাজ সাইরা ফের বিছানায় আসলাম। তার একটু পরেই সেল-এর বাত্তি নিভলো।
(চলবে)
কারাবাসনামা-১
সর্বশেষ এডিট : ২০ শে নভেম্বর, ২০২১ ভোর ৪:০৪