৪.
পরদিন নতুন সেল-এ আইসা দেখি সাত জন ইন্ডিয়ান, আউট অফ এইট! মানে আমি সহ এই সেল ফুল হাউস। মজার ব্যাপার হইলো, এই সাতজনই শিখ ধর্মাবলম্বী। তারা আমারে দেশি ভাই পাইয়া (মানে বৃহত্তর ভারতবর্ষের লোক অর্থে) সাদরে গ্রহন করলো। তার উপ্রে আমি বাংলাদেশী শুইনা তাদের কৌতুহলের শেষ নাই। আমার অস্ট্রীয়া জীবন আর ব্যক্তিজীবন নিয়া নানান প্রশ্ন। আমি বারো বচ্ছর ধইরা এই দেশে আছি, সেরের উপ্রে সোয়া সের হিসাবে আবার এখানকার Vienna University of Economics (Wirtschaftsuniversität Wien) -এর একটা স্নাতক ডিগ্রীও আছে- এগুলা শুইনা তারা কিছুতেই অঙ্ক মিলাইতে পারলো না যে কেন তাইলে আমি আজকে জেলে। আস্তে ধীরে এর জবাব দিমু বইলা আমি প্রথম ধাক্কাটা সামলাইলাম।
এই সাতজনের পাঁচজনই ডাঙ্কি পার্টি। আর এরা প্রত্যেকেই দুই/তিন বার এ্যাসাইলাম প্রার্থনা কইরা প্রত্যাখাত হইছে। তাই তারা এখন হাজতি। যেকোন দিন তাদের এই দেশ থেইকা ডিপোর্ট করা হইতে পারে- এই ভয় আর আতঙ্ক তাদের প্রতিদিনের সঙ্গী।
এই সাতজনের প্রত্যেকেই অল্পশিক্ষিত, না পারে জর্মন, না পারে ইংরাজীতে মোটামুটি কথা কইতে। অতএব, হিন্দী ভাষাটাই তাদের সাথে আমার কথাবার্তার একমাত্র মাধ্যম। আমি হিন্দী বুঝি, কিন্তু কইতে গেলে তোতলাইতে থাকি। “হিন্দী-উর্দু কমু না” টাইপ জাতীবাদী “প্রগতিশীল” মধ্যবিত্ত বাঙালীগো এইসব বায়নাক্কা আমার মধ্যে নাই। পৃথীবির প্রতিটা ভাষাই তার নিজের মত কইরা মধুর। আমার ভাঙ্গা হিন্দীতেই তাই তাদের সাথে বাতচিত চলতো। আর তারা আমারে “বন্ধু” বইলা ডাকা শুরু করলো।
তারা কেউ গ্রামের কৃষকের ছেলে, কেউ বা নিম্নমধ্যবিত্ত থেইকা উইঠা আসা। জমিজমা বেইচা দালালের হাত ধইরা ডাঙ্কি মাইরা আইসা আজ তারা ইউরোপের জেলে। তারা তো ক্রিমিনাল নয়! একটা ফকিন্নি দেশের লোক হিসাবে একটু উন্নত জীবন-জীবিকার উদ্দেশ্যে জীবন বাজী রাইখা আজ তারা এইখানে।
কিছুদিনের মধ্যেই তাদের অজান্তে আমারে তারা এই সেল-এর নেতা হিসাবে ট্রিট করতে শুরু করলো। কি ভাবে? কারণ আমি “শিক্ষিত”, আমি জর্মন পড়তে-লিখতে-বলতে পারি, তাদের আইনী কাগজপত্র আমি ভাঙ্গা হিন্দীতে ইন্টারপ্রেইট কইরা দেই, তাদের কোনো দরকারে বা অসুখ বিসুখে আমি জেল কর্তৃপক্ষের সাথে দোভাষী হিসাবে সহায়তা করি। আর যেইটা করছি, তা হইলো সেল-এর মধ্যে আমি একটা ডিসিপ্লিন আইনা দেই। কে কোনদিন টয়লেট ক্লিন করবো, কে কোনদিন সেল-এর ফ্লোর মপ করবো- এই কাজগুলা আমরা রুটিনমাফিক ভাগ কইরা নেই।
সবচে ইন্টেরেস্টিং ব্যাপারটা হইলো, জেলের সেল-এ আমাদের যে জর্মন পত্রিকা (Die Kurier Zeitung) ফ্রি-তে সরবরাহ করা হইতো, আমার কাজ ছিলো এই সাত অভাগারে পত্রিকাটার “রাশিফল” কলামটা অনুবাদ কইরা শুনানো। তারা উদ্গ্রীব হইয়া প্রতিটা দিনের যার যার ভাগ্যের ফোরকাস্ট শুনতো আমারে ঘিরা গোল হইয়া বইসা। “আপনার আজকের দিনটি খারাপ যাবে” টাইপ ফোরকাস্টগুলা আমি এড়ায়া যাইতাম। ভালো ভালো কথা নিজের মনের মাধুরী মিশায়া মিথ্যা আশ্বাসে তাদের শুনাইতাম। স্পষ্ট দেখতে পাইতাম, মুক্তির আশায় তাদের চোখ তখন একবিন্দু আশার আলোয় চিকচিক কইরা উঠতো। আমার মন তখন আর্দ্র হইতো, আমার চোখ ভিইজা উঠতো।
তারা ছিলো বেশ ধার্মিক। প্রতিদিন দুইবার না জানি তিনবার কইরা মাথায় রুমাল বাইন্ধা লাইন কইরা দাঁড়াইয়া গুরু নানকের স্তোত্র পাঠ করতো। আমি তাকায়া তাকায়া দেখতাম আর জীবনে ভক্তিরসের গুরুত্ব আর মহীমা সেই প্রথম উপলব্ধি করতে পারলাম। আমি তখন ছিলাম Agnostic বা অজ্ঞেয়বাদী। তারা আমারে কখনও নামাজ-কালাম পড়তে দেখতো না।
-“তুমি নামাজ পড় না?”
-“না”, ক্ষমাসুলভ হাসি দিয়া উত্তর দিতাম।
-“নামাজটা পইড়ো, বুঝছো? মনে শান্তি আর বল পাইবা।“
-“চেষ্টা করুম”, আমার আবার হাসি।
আমার আরেকটা ব্যাপারে তারা বেশ আশ্চর্য হইতো। আমার স্বল্প সময়ের জেল জীবনে আমি হাতে গোণা ২/৩ বার শুধু নীচের লন-এ ঘুরাঘুরি করতে বার হইছিলাম। বাকী দিনগুলার প্রায় চব্বিশ ঘন্টাই আমার কাটতো লাইব্রেরী থেইকা আনানো Stefan Zweig, Elfriede Jelinek, Peter Drucker, Bohumil Hrabal, Heinrich Heine ইত্যাদি জর্মন উপন্যাসিক আর কবিদের বই পইড়া আর দরকার মতো গ্রোসারিতে গিয়া বিড়ি, টুকটাক খাবার কিনা আনার মধ্যে। একটা মানুষ হাগা-মুতা-খাওয়া বাদে কেমনে দিনের পর দিন বিছানায় শুইয়া বইসা বই পড়ে- এইটা নিয়া তাদের গবেষনার অন্ত ছিলো না।
এই প্রসঙ্গে একটা কথা উল্লেখ করার লোভ সামলাইতে পারতেছি না। ২০০১/২০০২ এর দিকে আমি প্রথম নারীবাদী লেখক Kate Millett -এর Sexual Politics বইটা পড়ি। ঘটনাচক্রে আমার কারাবাসের মধ্যে একদিন আমার এক বাঙালী ছোট ভাই (তার কথা আমি পরে বলুমনে) হুমায়ুন আজাদের “নারী” বইটা পৌঁছাইয়া দেয়। “নারী” বইটা পরার পর আশ্চর্য হইয়া বুঝতে পাড়লাম, বইটা Sexual Politics -এর হুবহু বঙ্গানুবাদ, মানে চৌর্যবৃত্তি আর কী! আজাদ শুধু “নারী’ বইটার দুয়েকটা অধ্যায় (যেমন, বেগম রোকেয়ারে নিয়া) নিজে লিখছেন মাত্র। আজাদপ্রেমীরা এই কথা শুইনা গোস্বা করলেও কইতে বাধ্য হইতেছি, সেদিন থেইকা এই ইসলামফোবিক বিশাল চোর পন্ডিতের প্রতি শ্রদ্ধা আমার উইঠা গেছিলো।
সে যাই হোক, এদিকে আমি শুইয়া বইসা বই পইড়া আর রোজনামচা লিইখা আর তিন বেলা খাইয়া খাইয়া শুয়োরের মতো মোটা হইতেছি। ইন্ডিয়ান ভাইদের এন্টারটেইনমেন্ট বলতে দুপুর-সন্ধ্যা তাস পিটানো আর ব্যায়াম করা। ফ্রি হ্যান্ড ব্যায়াম ছাড়াও তারা আরেকটা অদ্ভুত ব্যায়াম করতো। বাঙ্কারের মাঝারি সাইজের ছোট একটা রড ক্যামনে জানি জোগার কইরা পানি ভর্তি দুইটা প্লাস্টিকের বাকেট (টয়লেটে ছিলো) রডের দুই মাথায় দড়ি দিয়া কইসা বাইন্ধা কাধে আর হাতে নিয়া উঠবস করতো। এই টেকনিক দেইখা অভিভূত হইয়া আমিও বিসমিল্লাহ বইলা সেই ব্যায়াম উৎসাহের সাথে শুরু কইরা দিলাম।
এইভাবে দিন যায়। ইতিমধ্যে প্রি-পেইড কার্ড কিন্যা ফোন বুথ থেইকা চার-পাঁচজন জরুরী ব্যক্তিরে আমি ফোন দিলাম- আমার আব্বা-আম্মারে (চাপা মারলাম যে কিছুদিনের জন্য আমি ভিয়েনার বাইরে আছি), আমার অতি অতি ঘনিষ্ট এক বন্ধুরে (নাম Werner Aichhorn), আমার ঘনিষ্ট এক বাঙালি ছোটভাই (ভিয়েনায় থাকতো), আমার আরেক বন্ধু মুন্সিয়ানা-রে (ছদ্মনাম, তিনি তখন লন্ডন থাকতেন), আর আমারে এই গজব থেইকা উদ্ধারকারী আমার দুঁদে Rechtsanwalt অর্থাৎ ল’ইয়াররে।
এরপর শুরু হইলো আমার আইনী লড়াই আর কারাকর্তৃপক্ষের সাথে কাইজা। সেইসব সংগ্রামের ঘটনা বাকী কিস্তিতে…
(চলবে)
কারাবাসনামা-৩
সর্বশেষ এডিট : ২২ শে নভেম্বর, ২০২১ সন্ধ্যা ৭:৪৯