somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

স্মৃতিসত্ত্বাকণাঃ কারাবাসনামা-৩

২০ শে নভেম্বর, ২০২১ দুপুর ১২:০৮
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

৩.
খুব ভোরে কার জানি চিল্লা ফাল্লায় ঘুম ভাঙলো। দেয়ালে ঝুলানো একটা বড় ওয়াল ক্লক-এ দেখি সকাল সাড়ে সাতটা বাজে। নাস্তা আইছে, আমারে তাই নাস্তা করতে ডাকে। সেল-এর ঠিক মাঝখানে বিশাল আলম্ব একটা কাঠের টেবিল। তাতেই ফ্লোরে বইসা সারাদিনের খাবার খাওনের ব্যবস্থা।
জেলখানায় ঘড়ি ধইরা সকালের নাস্তা সাতটা থেইকা সাড়ে সাতটার মধ্যে, দুপুরের লাঞ্চ সাড়ে বারোটা থেইকা একটার মধ্যে, আর রাতের ডিনার সন্ধ্যা সাড়ে সাতটা থেইকা আটটার মধ্যে দেয়া হয়। সকাল নয়টার মধ্যে গণগোসলখানায় গোসল, তারপর নীচতলার বিশাল একটা লাইব্রেরীতে ইচ্ছামাফিক বই পড়ার ও বই নিয়া আসার সুযোগ, বিকাল চারটা থেইকা এক ঘন্টার জন্য নীচের বড় লন-এ ঘুরাঘুরি, সাথে আছে বাস্কেট বল আর টেবিল টেনিস খেলার চত্বর। ঠিক বিকাল পাঁচটায় সবাইরে সেল-এ ফিরায়া নিয়া লক আপ করা- এই হইলো সারা দিনের রুটিন।
আর হাঁ, প্রতি ফ্লোরে আছে ছয়টা কইরা ফোন বুথ আর এক তলায় একটা Kiosk/Grocery বা মুদিখানা। নিয়ম হইলো, জেলের বাইরে থেইকা টাকা আনাইয়া জেল সুপারের কাছে নিজ নিজ একাউন্টে টাকা জমা রাখা যায়। সেই টাকা থেইকা প্রত্যেকে সপ্তাহে ৬০ ইউরো তুলতে পারবো। এর বেশী না। মুদিখানা থেইকা চা-কফি, বিড়ি, সফট ড্রিঙ্কস, বিস্কুট, চিপস সহ আরও নানা প্রকার মুদি দ্রব্য কিনা যাইবো তাতে। আর পাওয়া যাইতো প্রি-পেইড ফোন কার্ড। বলাই বাহুল্য, সেই সময় ফ্রি ফ্রি কথা কওনের বিভিন্ন এ্যাপস ছিলো না। স্মার্ট ফোনের যুগ আরও বছরখানেক পরে শুরু হইছিলো।
যাইহোক, আমি দাত ব্রাশ কইরা নাস্তা সারলাম। নাস্তা, লাঞ্চ আর ডিনারের মেন্যুর বিস্তারিত বিবরণ আর দিলাম না, তবে সেগুলা মোটামুটি খাইবার যোগ্য এবং সহজ পাচ্য। যেহেতু আমি এই সেল-এর একমাত্র মুসলমান, তাই পোর্কযুক্ত নন-মুসলিম আর পোর্ক বর্জিত মুসলিম হালাল খাবার সরবরাহের চয়েজ আমারে দেয়া হইলো। আমি দ্বিতীয়টাই চয়েজ করলাম।
বিশাল এই সেল-এ দুইটা মাত্র জানালা, কিন্তু তিন স্তরের লোহার গ্রীল দিয়া এমন ভাবে আটকানো যে কারো বাপের সাধ্যি নাই সেই জানালা হাতের শক্তিতে খুলে। আর আছে প্রায় দশ ফুট উঁচু সিলিং বরাবর একটা ছোট্ট স্কাইলাইট। সেল-এর ফটক বন্ধ থাকলে দিনের বেলা যা এক চিলতে আলো আসে, ওই স্কাইলাইট দিয়াই আসে।
হঠাৎ লক্ষ করলাম, এক হাড্ডিসার চ্যাংড়া পোলা তার বিছানায় চিত হইয়া চোখ উল্টায়া পইরা আছে। খোঁজ নিয়া জানলাম সে নাকি আজ ১৬ দিন হইলো হাঙ্গার স্ট্রাইকে আছে। পানি ছাড়া আর কিছুই খায় না। এই স্ট্রাইকের কারণটা কি, একজনরে জিগায়া যা শুনলাম তাতে আমার চক্ষু মাথায় উঠলো!
কোনো কয়েদী যদি হাঙ্গার স্ট্রাইক করে, তবে দিনে দিনে তার নাকি রক্তের প্ল্যাটিলেট বা ওই জাতীয় কিছু কমতে শুরু করে। অস্ট্রীয়ার জেল আইন মোতাবেক (সম্ভবতঃ এই আইন ইউরোপের ধনী দেশগুলার সকল কারাগারের কয়েদীদের জন্যই প্রযোজ্য) তার রক্তের প্ল্যাটিলেট একটা নির্দিষ্ট মাত্রার নীচে চইলা আসলে মৃত্যু ঝুঁকি নাকি বাইরা যায়। সেই ক্ষেত্রে জেল কর্তৃপক্ষ তারে বিনা প্রশ্নে মুক্তি দিতে বাধ্য। প্রতি দুই দিন অন্তর ডাক্তার আইসা রক্ত নিয়া পরীক্ষা করে তার প্ল্যাটিলেট নির্দিষ্ট মাত্রার নীচে চইলা গেলো কী না। চইলা গেলেই বেকসুর খালাস!
তো সেই পোলার হাঙ্গার স্ট্রাইকের এইটাই কারণ। আর কাছুদিন না খাইয়া থাকলেই নাকি ডাক্তার তারে খালাসের জন্য সার্টিফাই করবো। সে মুক্তি চায়! চার দেয়ালের দম বন্ধ করা মানসিক যন্ত্রণা থেইকা মুক্তি চায়! মুক্তির স্বাদ আস্বাদনের এই তরিকার কথা চিন্তা কইরা আমার গা শিউরিয়া উঠলো, চোখ অশ্রুসিক্ত হইলো। আমি বিমর্ষ মুখে বিড়ি টানতে টানতে তার মৃতপ্রায় মুখের দিকে তাকায়া রইলাম।
আমার সেল-মেটদের দুইজন হইলো রুমানিয়ান, চুরির দায়ে ধরা খাইছে। একজন পেরুভিয়ান, একজন বুরকিনা ফাসো’র, একজন আলবেনিয়ান আর অন্যজন কসভোর। শেষের চারজন ডাঙ্কি মাইরা ভিয়েনাতে ঢুইকা পোলিশের হাতে ধরা খাইয়া এই জেল হাজতে। আপনারা “ডাঙ্কি” শব্দের আসল মজেজা জানেন কী না, জানি না। তবে অবৈধ ভাবে নদী পার হইয়া বা পাহাড় ডিঙ্গায়া যারা ইউরোপে প্রবেশ করে-সেইটারে কয় “ডাঙ্গি মারা”। কী একটা অবস্থা!
আমার কয়েদ জীবনের একদিন দুই দিন তিন দিন কইরা কাটতে লাগলো। ইতিমধ্যে জেলখানায় আমার জমাকৃত আড়াই শ ইউরো থেইকা সপ্তাহের বরাদ্দ ৬০ ইউরো উঠায়া বিড়ি আর কিছু খাবার কিনলাম। পাঁচ বা ছয় দিনের মাথায় একদিন সকালে উইঠা খেয়াল করলাম আমার বালিশের তলায় গুজানো বিড়ির প্যাকেট আর Semmel (এক ধরনের ট্র্যাডিশানাল ভিয়েনিজ রুটি) উধাও। সেল-এর ছয় জনরে সবাইরে জিগাইলাম। তারা উলটা ঝারি মাইরা কইলো, আমরা চোর নাকি! সেদিনই সিদ্ধান্ত নিলাম, এই সেল চেঞ্জ করার জন্য আবেদন করুম। চোর বাটপারদের সাথে থাকুম না- আবেদনে এই কারণ লিখবার পর আমার আবেদন মঞ্জুর হইলো। তারা কইলো, যেহেতু তুমি সাউথ এশিয়ান, তাই ইন্ডিয়ান কয়েদিদের একটা সেল আছে- সেখানে তোমারে স্থানান্তর করা হইবো কাল সকালে। মনে মনে কইলাম, ইন্ডিয়ান মাল না জানি কেমন হয়। মুখে কইলাম, তথাস্তু!
পরদিন সকালে ইন্ডিয়ানদের একটা সেল-এ আমারে পাঠানো হইলো। সে এক আরেক নতুন অভিজ্ঞতা। সেই গল্প পরের কিস্তির জন্য তুইলা রাখলাম।
(চলবে)

কারাবাসনামা-২
সর্বশেষ এডিট : ২০ শে নভেম্বর, ২০২১ দুপুর ১২:১৪
৭টি মন্তব্য ৬টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

তীব্র তাপদাহ চলছে : আমরা কি মানবিক হতে পেরেছি ???

লিখেছেন স্বপ্নের শঙ্খচিল, ২৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ২:১৯

তীব্র তাপদাহ চলছে : আমরা কি মানবিক হতে পেরেছি ???



আমরা জলবায়ু পরিবর্তনের হুমকির মুখে আছি,
আমাদেরও যার যার অবস্হান থেকে করণীয় ছিল অনেক ।
বলা হয়ে থাকে গাছ না কেটে... ...বাকিটুকু পড়ুন

ব্যবহারে বংশের পরিচয় নয় ব্যক্তিক পরিচয়।

লিখেছেন এম ডি মুসা, ২৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১০:১৫

১ম ধাপঃ

দৈনন্দিন জীবনে চলার পথে কত মানুষের সাথে দেখা হয়। মানুষের প্রকৃত বৈশিষ্ট্য আসলেই লুকিয়ে রাখে। এভাবেই চলাফেরা করে। মানুষের আভিজাত্য বৈশিষ্ট্য তার বৈশিষ্ট্য। সময়ের সাথে সাথে কেউ কেউ সম্পূর্ণ... ...বাকিটুকু পড়ুন

মহিলা আম্পায়ার, কিছু খেলোয়ারদের নারী বিদ্বেষী মনোভাব লুকানো যায় নি

লিখেছেন হাসান কালবৈশাখী, ২৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১১:০৯



গত বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল প্রাইম ব্যাংক ও মোহামেডানের ম্যাচে আম্পায়ার হিসেবে ছিলেন সাথিরা জাকির জেসি। অভিযোগ উঠেছে, লিগে দুইয়ে থাকা মোহামেডান ও পাঁচে থাকা প্রাইমের মধ্যকার ম্যাচে নারী আম্পায়ার... ...বাকিটুকু পড়ুন

জানা আপুর আপডেট

লিখেছেন আরাফআহনাফ, ২৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১১:৫৭

জানা আপুর কোন আপডেট পাচ্ছি না অনেকদিন!
কেমন আছেন তিনি - জানলে কেউ কী জানবেন -প্লিজ?
প্রিয় আপুর জন্য অজস্র শুভ কামনা।



বি:দ্র:
নেটে খুঁজে পেলাম এই লিন্ক টা - সবার প্রোফাইল... ...বাকিটুকু পড়ুন

বন্ধুর বউ কে শাড়ি উপহার দিলেন ব্যারিস্টার সুমন। বাটার প্লাই এফেক্ট এর সুন্দর উদাহারন।

লিখেছেন নাহল তরকারি, ২৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৪:০৭



এক দেশে ছিলো এক ছেলে। তিনি ছিলেন ব্যারিস্টার। তার নাম ব্যারিস্টার সুমন। তিনি একজন সম্মানিত আইনসভার সদস্য। তিনি সরকার কতৃক কিছু শাড়ি পায়, তার জনগণের মাঝে বিলি করার জন্য।... ...বাকিটুকু পড়ুন

×