এক.
গাড়িটার এদিক ওদিক দুলুনি বেশ ভালোভাবেই অনুভব করতে পারছি। কিছুই করার নেই। এটা বাংলাদেশ। তবে অন্য যাত্রীদের মনের অবস্থা এখন কী তা অবশ্য বলতে পারব না। কারণ এই গাড়িতে আমি ছাড়া আর কোনো বাংলাদেশী নেই!
"ভিডিওটা রেডি রাখো জেফ।" কমান্ডারের ভরাট গলার আওয়াজ শুনতে পেলাম আমি। "যথাসময়েই যেন কাজে লাগানো যায়।"
বেশ ভালোভাবেই বুঝতে পারছি ভিডিওটা আমার জন্যই প্রস্তুত রাখা হচ্ছে। তবুও আপাতত বসে থাকা ছাড়া কোনো উপায় নেই। কিছুক্ষণ পরে গাড়ির দুলুনি থেমে গেল ইঞ্জিনের মধুর আওয়াজটাও আর শোনা যাচ্ছে না। বুঝলাম, এসে পড়েছি ওদের আস্তানায়। আমাকে দুজন গার্ড পেছন থেকে রাইফেলের ধাক্কাতে এগিয়ে নিয়ে চলল ওদের কাঙ্খিত স্থানে। এলোমেলো কিছুক্ষণ অন্ধকারে হাঁটার পর সামনে থাকা চারতলা বাড়িটা চোখের সামনে স্পষ্ট হলো। গার্ড দুটো আমাকে বাড়িটার দিকে এগিয়ে নিয়ে যেতে থাকলে নিশ্চিত হয়ে গেলাম এই সুন্দর বাড়িটাতেই আগামী কিছুদিন বা কিছুক্ষণ থাকব আমি।
"জলদি।" রাইফেলের বাঁট দিয়ে আমার পিঠে গুঁতো দিতে দিতে বলল একজন গার্ড।
বাড়িটার ভেতরে আরও তড়িৎগতিতে ঢুকলাম গার্ডের তাড়া খেয়ে। আর গুঁতো খেতে ইচ্ছা করছে না। একসময় আমাকে থামতে বলা হলো। তারপর প্যাসেজের বামপাশের ৩০৩ নম্বর রুমটা খুলে গেল আপনা আপনি। আমি ভীত সন্ত্রস্থ হয়ে ভেতরে ঢুকলাম। একটা রকিং চেয়ারকে দুলতে দেখলাম প্রথমেই। যদিও কেউ নেই সেখানে। অল্প বিস্তর দুলছে সেটা। ওরা আমাকে ওখানে বসাল না, বসাল ওটার ঠিক পেছনে আরেকটা কিম্ভুতকিমাকার দর্শনের চেয়ারে। চেয়ারটার দুই হাতলের স্থলে বসিয়ে রাখা হয়েছে দুইটা গোলাকার ব্লেড মেশিন। প্রত্যেকটাই একটা করে মোটরের সাথে যুক্ত। ইলেকট্রিক তারগুলো মেশিনে যুক্ত হয়ে বোর্ড পর্যন্ত চলে গিয়েছে। গার্ডগুলো চলে গেল। আমাকে একা রেখে চলে যাওয়ার মধ্যে বিস্ময়ের কিছুই নেই। যাওয়ার আগে আমার হাতদুটো ওরা হ্যান্ডকাফ আটকে রেখে গেছে। আর পা দুটো চেয়ারের নিচ অংশের দুই পায়ার সাথে।
বিশ মিনিট মতো অতিক্রান্ত হওয়ার পর কমান্ডারকে আমার রুমে প্রবেশ করতে দেখলাম। ডিম লাইটটা অফ করে উনি রডলাইট জ্বালিয়ে দিলেন। তবুও ঘরটা আলোর বন্যায় ভেসে যাওয়া থেকে বিরত থাকল। কমান্ডার আমার দিকে কুঁতকুঁতে চোখে তাকালেন, তারপর দক্ষিণ দিকের দেওয়ালে তাক করে নিজের হাতে থাকা মিনি রিমোটটার নির্দিষ্ট সুইচে চাপ দিলেন।
একটা ভিডিও শুরু হয়ে গেল; ৫০ বাই ৩০ ইঞ্চি স্ক্রিন জুড়ে। বেশ স্বাস্থ্যবান দেখতে এক যুবক বসে আছে ঠিক আমারটারই মতো একটা চেয়ারে। প্রথমে তাকে সহজভাবে কিছু জিজ্ঞাসাবাদ করা হলো। মাথা দুপাশে নাড়িয়ে গোপন তথ্য দিতে অস্বীকার করাতে তাকে জোর করে ধরে একটা ট্যাবলেট খাওয়ানো হলো। ট্যাবলেটের প্রভাবে নেশাগ্রস্থ হওয়ার পরপরই তার হাতের বাঁধন খুলে সামনে রাখা হলো। মেশিনটাও চালু হয়ে গেছে। প্রথম প্রথম যুবক নিজের সর্বোচ্চ দিয়ে চেষ্টা করতে লাগল হাত দুটো মেশিনের ওপর থেকে সরিয়ে রাখতে। কিন্তু নেশা যত তীব্রভাবে বাড়তে লাগল যুবকের শক্তিও তত কমে যেতে থাকল। আস্তে আস্তে তার হাত দুটো মেশিনে পড়ে ছিন্নভিন্ন হয়ে গেল, তারপর একে একে বুক, মাথা কাটা পড়ল যুবকের দেহ সামনের দিকে ঝুঁকে যাওয়ায়। একসময় রক্তাক্ত মেশিনটা ছাড়া কিছুই দেখা গেল না চেয়ারটাতে। যুবকের শতছিন্ন হওয়া দেহটা ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে যত্রতত্র।
"ইউ হেট ইসরায়েল? উই ডোন্ট নিড ইউ" ভিডিওটা শেষ হওয়ার পর এই লেখাটুকু আমি দেখতে পেলাম স্ক্রিনজুড়ে। পাঁচ সেকেন্ড মতো স্থায়ী থেকে একইসাথে লেখাটা এবং কৃত্তিম স্ক্রিনটা অদৃশ্য হয়ে গেল। এতক্ষণ দেওয়ালের দিকে তাকিয়ে ছিলেন কমান্ডার। ভিডিওটা শেষ হওয়ার পর আমার দিকে ফিরে তাকালেন। তারপর সরল ভঙ্গিমায় নির্দেশ করলেন, "সিআইবি সম্পর্কে যা যা জানো বলো।"
"দুঃখিত কমান্ডার।" হতাশ ভঙ্গিতে মাথা নাড়লাম আমি। "আমার পক্ষে কিছুই বলা সম্ভব নয়।"
"সরল প্রশ্ন এবং সরল নির্দেশনার সরল উত্তর পাওয়া যায় জানোতো?" আমাকে উদ্দেশ্য করে প্রশ্ন করলেন কমান্ডার।
"হুম, জানি।"
"তাহলে আমি গরল উত্তর পেলাম কেন?" কণ্ঠ শীতল হয়ে এল কমান্ডারের।
"উত্তর দেবে?"
"অসম্ভব।"
"অসম্ভবকে আমরা সম্ভব করতে জানি।" মুখে শযতানি হাসিটা ফুটিয়ে তুললেন তিনি। "স্যামিনা, ট্যাবলেটটা নিয়ে আসো।"
অসাধারণ দেখতে একটা মেয়ে রুমে প্রবেশ করল প্রায় সাথে সাথেই। বোধহয় কমান্ডারের নির্দেশের অপেক্ষা করছিল। এমন পরিস্থিতিতে না থাকলে মনে হয় দৌড়ে গিয়ে প্রপোজ করতাম। লাভ এট ফার্স্ট সাইট বলতে যা বোঝায় আর কি!
"এই নিন স্যার।" ট্যাবলেটটা স্যামিনা কমান্ডারের হাতে দিল। কমান্ডার আমাকে ট্যাবলেটটা খাইয়ে দিলেন স্বাভাবিকভাবেই আমি কোনো অসুবিধা সৃষ্টি না করায়।
"এখন থেকে প্রতি মিনিটে তোমার নিজের শরীরের ওপর থেকে দশ শতাংশ নিয়ন্ত্রণ কমে যাবে তোমার নিজেরই।" শীতল কণ্ঠে বলতে থাকলেন কমান্ডার। "তাহলে তোমার হাতে আর কত মিনিট আছে?"
"প্রায় দশ মিনিট।" কণ্ঠ যতটা সম্ভব স্বাভাবিক করে উত্তর দিলাম আমি।
"স্যামিনা, সাত মিনিট পার হয়ে গেলে তুমি ওর হ্যান্ডকাফটা খুলে দিও। যদিও অন্যদের বেলায় ছয় মিনিটের সময়ই বাঁধন খুলে দি আমরা। কিন্তু এটুকু সম্মান ওর প্রাপ্য।" আমার হাতের পেছন দিকটা নির্দেশ করলেন কমান্ডার, একইসাথে আমাকেও।
"ওকে, স্যার।" সম্মতি জ্ঞাপন করল স্যামিনা। "সবকিছুই ঠিকঠাকভাবে হবে আশা করি।"
"আর হ্যাঁ, তথ্য প্রদান করতে উৎসাহী থাকলে স্যামিনাকে বললেই হবে। আমি সংবাদ পেয়ে যাব। গুড লাক মিস্টার এক্স।"
স্যামিনা উত্তর দিকে অর্থাৎ আমার পেছন দিকে চলে গেল। তারপর সুইচবোর্ডের নির্দিষ্ট সুইচে চাপ দিয়ে মেশিনটা চালু করল। মৃদু সাঁ সাঁ আওয়াজে মেশিনটা প্রচণ্ড স্পিডে ঘুরতে থাকল। এদিকে আমার শরীর কেমন যেন করছে। আমার মস্তিস্কের কমান্ড শুনতে চাইছে না যেন। একটু পর স্যামিনা আমার হ্যান্ডকাফ খুলে দিল। শরীরটা নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছে তবুও আমি কিছুই করতে পারছি না। হাতের পশম ভেদ করে চামড়াতে একটু আচড় লাগল মেশিনটার সাথে। এটাই লাস্ট চান্স, মনে মনে অতি কষ্টে চিন্তা করলাম আমি। শরীরের সর্বশক্তি দিয়ে নিঃশব্দে হাত দুটো মেশিনটা থেকে সরিয়ে নিজ কোলের উপর রাখলাম। পায়ের বাঁধন খুলে ফেললাম সাথে সাথে। সর্বশক্তি দিয়ে দরজার প্রায় কাছাকাছি চলে যাওয়া স্যামিনার ঘাড়ের বিশেষ স্থানে হাত দিয়ে কোপ মারলাম। নিঃশব্দে অজ্ঞান হয়ে গেল মেয়েটা। এছাড়া আর কোনো উপায় ছিল না। মেয়েটা নির্ঘাত গিয়ে বলে দিত আমি মারা যাইনি। আস্তে আস্তে বুঝতে পারলাম আমার অবস্থাও খুব বেশি সুবিধার না। দুই মিনিটের মধ্যেই আমি আমার নিয়ন্ত্রণ সম্পূর্ণরুপে হারিয়ে ফেলব। জানিনা, তখন কি হবে। আর কতক্ষণ ঐ অবস্থায় থাকব। আস্তে আস্তে আমি আমার জ্ঞান হারালাম।
দুই.
জ্ঞান ফিরতেই কেমন একটা মৃদু বিপ বিপ আওয়াজ শুনতে পেলাম। কমান্ডো ট্রেনিং করতে করতে মাথায় একটা জিনিস ঢুকে গেছে বিপ বিপ আওয়াজ মানেই খারাপ কিছু সামনে অপেক্ষা করছে। মাথার ভেতরটা আস্তে আস্তে পরিস্কার হতে শুরু করল। কতক্ষণ অজ্ঞান অবস্থায় ছিলাম জানিনা। দরজার দোড়গোড়ায় এখনো স্যামিনাকে দেখা যাচ্ছে। অবশ্য অজ্ঞান। তার মানে খুব বেশিক্ষণ অজ্ঞান অবস্থায় থাকার সৌভাগ্য হয়নি। তার আগেই ব্রেন বিপ বিপ শব্দ শুনে আমাকে জাগিয়ে দিয়েছে। তবে একটা ব্যাপার আমাকে অবাক করছে। আমি এখনো মারা যাইনি কেন? তাহলে ওরা সবাই চলে গেছে? একটা টাইম বোমা ফিট করে রেখে যাতে আমি বেঁচে গেলেও মারা যাই?
"নাহ, এর কোনোটাই না।" নিজ মনকে নিজেই সান্ত্বনা দিলাম আমি।
তাহলে স্যামিনাকে ওরা নিয়ে গেল না কেন? ব্যাপারটা সম্পূর্ণরুপে বুঝতে হলে আমার স্যামিনার সাহায্য প্রয়োজন। চারিদিকে পানি খুঁজতে লাগলাম। কিন্তু বেশিক্ষণ খুঁজতে হলো না। কমান্ডার যে রকিং চেয়ারে বসে ছিল ওটার পায়ার গোড়াতেই একটা মামের বোতল দেখতে পেলাম। বোতলটা থেকে কিছু পরিমাণ পানি নিয়ে স্যামিনার মুখে ছিটিয়ে দিলাম। কিছুক্ষণের মধ্যেই ও চোখ খুলল। প্রথমে ভড়কে গেলেও আস্তে আস্তে স্বাভাবিক হয়ে এল ও। পুরো ব্যাপারটা ওকে খুলে বললাম। ওর কপালে চিন্তার ভাজ দেখতে পেলাম আমি। একইসাথে চোখেমুখে অসহায়ত্বের ছাপও।
"আমরা এভাবে শুধু শুধু বসে না থেকে কিছু একটা করতে পারি।" পরিস্থিতি স্বাভাবিক করার জন্য বললাম আমি।
"কি করব?" অসহায় মুখখানা বাঁকিয়ে প্রশ্ন করল স্যামিনা।
"এক কাজ কর, তুমি আওয়াজটার উৎপত্তিস্থল বের করার চেষ্টা করো। আর আমি দেখছি রুমটা থেকে কীভাবে বের হওয়া যায়।" স্যামিনাকে কথাগুলো বললাম আমি।
"ঠিক আছে।" মাথা নাড়িয়ে সায় দিল ও।
রুমটার স্পেশালিটি বলতে তেমন কিছুই নেই। অন্যান্য দশটা সাধারণ রুমের মতোই। সুইচ বোর্ডের কাছে চলে এলাম আমি। এখান থেকেই বোধহয় কিছু করতে পারব। অসংখ্য সুইচ গিজগিজ করছে এখানে।
"ইউরেকা।" চেঁচিয়ে উঠল স্যামিনা।
"কী হয়েছে?" জিজ্ঞাসা করলাম আমি।
"এই দেখো," বলে আমাকে রুমটার পেছনের একটা গোপন দরজার দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ করাল স্যামিনা।
"আমরা মেশিনটা ইউজ করছি না কেন?"
"সত্যিই আমি একটা গ্রেট বোকা।" স্যামিনাকে শুনিয়ে শুনিয়ে বললাম আমি।
"কাজ শুরু করো।" নির্দেশ দিল মেয়েটা আমাকে।
আমি চেয়ারের হাতলের স্থান থেকে একটা মেশিন খুলে নিলাম। স্ক্রু দিয়ে আটকানো থাকলেও তেমন টাইট করে লাগানো ছিল না ওগুলো। ধারালো ব্লেডের আঘাতে মৃদু শব্দে দরজাটা আয়তাকারে কেটে যেতে থাকলো। একসময় সম্পূর্ণভাবে একজন মানুষ বের হওয়ার মতো জায়গার সৃষ্টি হলো। মেশিনটা একপাশে রেখে বাইরে বেরিয়ে এলাম। মাটিতে পা রাখার পরপরই খসখসে কিছু একটাতে পা পড়ল। খেয়াল করে দেখলাম, ওটা একটা কাগজ। অপরিচিত একটা ভাষায় কিছু লেখা আছে এতে।
"স্যামিনা, চলে আসো। আমরা যা খুঁজছি তা মনে হয় পেয়ে গেছি।" ডাক দিলাম মেয়েটাকে।
"এটা পড়ে আমাকে শোনাও।" কাছে আসতে কাগজটা ওর হাতে দিয়ে বললাম আমি।
"আচ্ছা, ঠিক আছে।" রাজি হলো ও।
"স্যামিনা, কনগ্রেটস। আজ থেকে তুমি মোসাদের এলিট অফিসারদের লিস্টভুক্ত হলে। তুমি নিজেকে মুক্ত করে নিজের বুদ্ধিমত্তার পরিচয় দিয়েছ। কাগজটা থেকে দশ পা সামনে এগোলেই একটা রিমোট পাবে। ওটার প্লে বাটনে চাপ দিলেই বিল্ডিংটা উড়ে যাবে। আমরা বাংলাদেশ শাখার হেডকোয়ার্টারে তোমার জন্য অপেক্ষা করব।" একবারে পড়ে শেষ করল স্যামিনা।
"তোমার তো কপাল খুলে গেছে।" মুচকি হাসি ফুটিয়ে তুললাম মুখে।
"তোমাকে এখন থেকে অন্যেরা ম্যাডাম বলে সম্বোধন করবে।"
"ব্যাপারটা মোটেও সুখকর নয়। আমি 'মোসাদে' যোগ দিয়েছিলাম নিতান্তই শখের বসে। আমি কখনোই চাইনি যে আমি এলিট অফিসার হব।"
"কেন?" চোখেমুখে বিস্ময় ছড়িয়ে পড়ল আমার।
"আমি একজন ফিলিস্তিনি। আমার নাম স্যামিনা নয়, সামিরা আরদালি।"
মেয়েটার উত্তর শুনে আমার ঠোঁট দুটোর মাঝের ফাঁক এবং একইসাথে চোখ দুটো যতটুকু বড় হওয়া যায় হয়ে গেল।
"এবং আমি মোসাদের ধ্বংস চাই, চাই ইসরায়েলের ধ্বংস। যারা আমার মাতৃভূমি দখল করে নিতে চাইছে।"
হঠাৎ পাতার মড়মড় শব্দের মৃদু আওয়াজ শুনতে পেলাম। বুঝলাম, বিপদ আসন্ন। বিপদ, বড় বিপদ।
সমাপ্ত