somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

প্রিয় বাবা

০৭ ই এপ্রিল, ২০১৮ বিকাল ৪:৩৫
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :



আমার মা বলেন সারাদিন পর আমি যখন বাড়িতে ঢুকি সঙ্গে করে এক ঝাঁক আনন্দ নিয়ে ঢুকি। আমার মুখ চোখ নাক কপাল চুল হাঁটা কথা বলা সবকিছুতে আনন্দ আনন্দ ভাব থাকে পুরা চেহারাটাই তার চোখে অধিক আনন্দ অধিক সুখ সব কিছুই অতিরিক্ত ভালো কিছু ফিল হয়।

যেদিন ছুটির দিন হয় এবং আমি বাইরে বের হই তখন আমার আম্মু আমার পেছনে ইয়াতিমের মতন ঘুর ঘুর করতে থাকেন আর বলতে থাকেন তুই বাড়ি থাকলে এত ভাললাগে আমার কলিজাটা একদম বড় হয়ে যায়।

আমি চাই আমার বাবা মা ভাইবোন আত্মীয়স্বজন পাড়া প্রতিবেশী সবাই ভালো থাকুক।

কিন্তু আমার অনেক কাজ করতে হয় কাজ করতে করতে আমি কখনো ক্লান্ত হয়ে যাই না, শুধু যখন কাল বৈশাখী ঝড় হয়, সাইক্লোন টর্নেডো এসে আমার ডাল পালা ভেঙ্গে একদম গুড়িয়ে দেয় আমায় তখন সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে সত্যিকার অর্থেই কষ্ট হয়।
সেদিন আমি বাড়িতে ফিরতে ফিরতে বাসে বসে কলিগ আপু যিনি আমার সাথেই তার বাসায় ফিরতে ছিলেন এবং যাওয়ার লোকেশন এক হওয়ায় প্রায়ই আমরা একসাথে ফিরি।

তাকে বলতেছিলাম আপু আজ আমার অনেক ক্লান্ত লাগছে আজ বাসায় যেয়েই ঘুমাবো অনেক ঘুমাবো। সে এই কথায় ধরে নিলো আমি আমার সদ্য বিচ্ছেদ হওয়া (আড়াই মাস হয় তখন মেঝ আপু মারা গেছেন)বোনের জন্য কষ্ট পাচ্ছি, তাই শান্তনা সহ বাসায় গিয়ে কিছু একটা না খেয়ে যেন ঘুমিয়ে না পড়ি সেই উপদেশ দিয়ে তার গন্তব্যে নেমে গেলেন।

তার কয়েক মুহূর্ত পর আমার পাশের সীট খালি হওয়ায় দশ এগারো বছর বয়সের মোটামুটি স্বাস্থ্য ভালো আহ্লাদি মিষ্টি চেহারার এক মেয়ে আমার পাশে বসার কয়েক মুহূর্ত পরই আমার ইহ জীবনের ইতিহাসে যা হয়নাই তাইই হল, মেয়েটি হঠাৎ করে বমি করে আমার শরীর ভাসিয়ে দিলো, হতবাক আমি মেয়েটিকে ধরে জানালার কাছে এগিয়ে দিলাম, সে বমি করেই যাচ্ছে, একই সাথে ড্রাইভার হেল্পার আমাকে চিৎকার করে বিরক্ত হয়ে গালি দেয়ার মতন করে বলতে থাকলো; এই রকম বমি করে বাসে উঠছেন ক্যান, জানালা খুইলা দেননাই ক্যান, পলিথিন সাথে নিয়া আসেন নাই, দিলেন তো পুরা বাসটা নষ্ট কইরা, মেয়েটির বমি শেষ হলো স্বাভাবিক হলো ব্যাগে রাখা পানির বোতল বের করে ওর হাতে দিয়ে পুরা শরীর ভর্তি টক গন্ধওয়ালা বমি নিয়ে হেল্পার এবং ড্রাইভার কে বললাম এই আর একটা কথাও না, একদম চুপ, এই মেয়ে আমার সাথে বাসে উঠে নাই, তাকে আমি চিনি না, সে বাসে উঠলে বমি করে আমি জানবো কীভাবে?
ততোক্ষণে মেয়ের মা এসে মেয়ের পাশে বসছেন উনার পড়নে বোরকা, বমি করা অবস্থায় চলন্ত বাসে বোরকা পড়ে মেয়ে সামলানো কঠিন বলেই হয়তো সে এতক্ষন এগিয়ে আসেন নাই।

আমার কথা শুনে ড্রাইভার হেল্পার বাসের যাত্রীরা একদম চুপ হয়ে গেলো। হয়তো আরেকজনের বমি শরীর ভর্তি অবস্থায় সেই মেয়েরে প্রোটেক্ট এবং ড্রাইভার হেল্পারের ব্লেম দেয়া কথা একটানা হজম করা মেয়ে আর কেউ কোনোদিন দেখে নাই।

আগের সীট বমিতে বসার অযোগ্য হওয়ায় এক সাথে বেশ কয়জন স্বসন্মানে উঠে দাঁড়িয়ে বসার জন্য সীট ছেড়ে দিলো, বসেই এতক্ষন ভাইব্রেট হওয়া মোবাইল হাতে নিয়া চব্বিশ পঁচিশটা কল দেখে কল ব্যাক করে জানলাম; আব্বুর ব্রেন স্ট্রোক হয়েছে তাকে নিউরোলজি হসপিটালে নেয়া হয়েছে দুপুর একটায়, আমার সিঙ্গাপুর থেকে পাঁচ দিনের জন্য দেশে আসা চাচার সাথে থাকাকালিন সময়ে বাইরে দাঁড়িয়ে সবার সাথে কথা বার্তা বলা অবস্থায় স্ট্রোক হয়েছে, চাচা সাথে সাথে তাকে হসপিটালে নিয়ে গেছেন, ঘটনার কিছু আম্মুকে জানানো হয় নাই, স্ট্রোকের ৭ ঘণ্টা হয়ে গেছে এখনো জ্ঞান ফিরে নাই, মুখ বাঁকা হয়ে আছে, বাম পাস পুরাটা অবশ।

আমি মোটামুটি চলন্ত বাস থেকে তক্ষুনি নেমে হসপিটালে যাবার জন্য সিএনজী খুঁজতে লাগলাম, তখন রাত ৮টা, জায়গাটা কাউলার একটু এইদিকে, কোন কিছু জোগাড় করতে পারছিনা, আসলে এইখানে কোন গাড়িই থামেনা, অস্থির হয়ে ভুল জায়গায় না নেমে একটু ধৈর্য ধরে এয়ারপোর্ট নামা উচিৎ ছিল।
ওখান থেকে খিলক্ষেতের দিকে হাঁটলে বাস স্ট্যান্ড যেমন দূর, এয়ারপোর্ট সেই তুলনায় এগিয়ে, এয়ারপোর্টের দিকে হাটা দিলাম, বমিতে ভেজা পা পিছলে যাচ্ছে, শরীর চ্যাটচ্যাট করছে বমির গন্ধে চারপাশ ভরপুর। এইরকম সময়ে সিএনজী পেলাম।

যখন আব্বুর কাছে পৌছালাম তখন রাত ১০টা। সদ্য জ্ঞান ফিরেছে, রুগ্ন শুকনা, পুরো শরীর পাথরের মতন একটুও নরছে না, মুখ বাঁকা লালা পড়ছে; এরকম আমার মেঝ আপুরও হয়েছিলো, আমি চোখ মুখ শক্ত করে দাঁড়িয়েছি, চেহারায় ভাব এটা এমন কিছু না। আমার বাবা আমায় দেখে অদ্ভুত আচরন করলেন উঠে বসার চেষ্টা করলেন পারলেন না, এক হাতে স্যালাইন চলছে, তাই অপর হাতটি উঠাতে চাইলেন পারলেন না, এরপর তার সর্বস্ব শক্তি দিয়ে এক গাল দিয়ে অর্ধেক জিহ্বা নেড়ে আমার নাম ধরে বললেন আ মা র কি ছু হ হ য় না আ আ ই এই কথাটা দুইবার বললেন, আমি জবাবে মাথা নেড়ে বার বার বলছিলাম হ্যাঁ আমি জানিতো আব্বু কিছু হয় নাই আমি জানিতো আমি জানি কিচ্ছু হয়নাই। আমার কথা শুনে স্বস্তিতে চোখ বন্ধ করলো, সে আমাকে আশ্বস্ত করে নিশ্চিত হয়েছেন।

তার সাথে গত অনেক বছর ধরে বিশাল গ্যাপ, এক সাথে খাই না, টিভি দেখিনা, কোন গল্প গুজব করিনা, কিছু জিজ্ঞেস করলে মাথা নিচু করে উত্তর দেই মুখের দিকে তাকাই না, আমি যেই খানে সেইখানে আব্বু গেলে আমি উঠে যাই, আব্বু ভাই বোন নিয়ে মিটিং করতে ভালোবাসতো আমাকে লক্ষ্য কোটি বার ডাকা সত্ত্বেও আমি সেই সব কিছুতে থাকতাম না, লাস্ট মিটিং এ মেঝ আপু ছিল, সেদিন ও আমাকে ডাকা হয়েছিলো আর আমি যাইনি, আব্বুর মতে আমি বিশ্ব ঘাড় ত্যাড়া এবং জেদি এবং হয়তো তাই হয়ে থাকতে পারে।

ঘটনার পনেরো দিন পর আব্বু এক পা দুই পা করে হাঁটতে পারেন, এবং সে অতি চঞ্চল বলেই এত তাড়াতাড়ি সেটা সম্ভব হয়েছে এবং সে বাচ্চাদের মতন অর্ধেকটা এসে টলমল পায়ে পড়ে যাবার উপক্রম হলেন, আমি কোথাও যেতে যেতে এই দৃশ্য দেখে তার দিকে দৌড়ে যেতে থাকলাম, আব্বু যে হাত নাড়াতে পারে সেই হাত উঁচু করে দিলেন পরম নির্ভরতায়! আব্বুর ঘাড় ত্যাড়া মেয়েটি কবে তাদের এত বেশি নিশ্চিত আর নির্ভরতা বিশ্বাস অর্জন করেছে মনে করতে পারিনা।


বাবা,

আমি তোমাকে অনেক ভালোবাসি যতটা ভালোবাসি মাকে।
বাবা আমি আজীবন এভাবেই পাশে থাকতে চাই, এমনি নিশ্চিত আর শান্তিতে রাখতে চাই তোমাদের।
তোমাদের পৃথিবীর সব থেকে সুখী বাবা মা করতে চাই।
আমি এমনি ভাবে সব বাবা মা এর সমস্ত ভার বহন করে পাশে দাঁড়াতে চাই।
যতদিন বেঁচে থাকি ততদিন। আর যদি মরে যাই, আর যদি মরে যাবার কারণে কথা না রাখতে পারি তবে ক্ষমা করে দিও।
সর্বশেষ এডিট : ০৭ ই এপ্রিল, ২০১৮ বিকাল ৪:৫৩
১৬টি মন্তব্য ১৬টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

সবুজের মাঝে বড় হলেন, বাচ্চার জন্যে সবুজ রাখবেন না?

লিখেছেন অপলক , ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ৯:১৮

যাদের বয়স ৩০এর বেশি, তারা যতনা সবুজ গাছপালা দেখেছে শৈশবে, তার ৫ বছরের কম বয়সী শিশুও ১০% সবুজ দেখেনা। এটা বাংলাদেশের বর্তমান অবস্থা।



নব্বয়ের দশকে দেশের বনভূমি ছিল ১৬... ...বাকিটুকু পড়ুন

আইডেন্টিটি ক্রাইসিসে লীগ আইডেন্টিটি ক্রাইসিসে জামাত

লিখেছেন আরেফিন৩৩৬, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ৯:৪৬


বাংলাদেশে রাজনৈতিক ছদ্মবেশের প্রথম কারিগর জামাত-শিবির। নিরাপত্তার অজুহাতে উনারা এটি করে থাকেন। আইনী কোন বাঁধা নেই এতে,তবে নৈতিক ব্যাপারটা তো অবশ্যই থাকে, রাজনৈতিক সংহিতার কারণেই এটি বেশি হয়ে থাকে। বাংলাদেশে... ...বাকিটুকু পড়ুন

বাঙ্গালির আরব হওয়ার প্রাণান্ত চেষ্টা!

লিখেছেন কাল্পনিক সত্ত্বা, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১১:১০



কিছুদিন আগে এক হুজুরকে বলতে শুনলাম ২০৪০ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে নাকি তারা আমূল বদলে ফেলবেন। প্রধানমন্ত্রী হতে হলে সূরা ফাতেহার তরজমা করতে জানতে হবে,থানার ওসি হতে হলে জানতে হবে... ...বাকিটুকু পড়ুন

সেকালের পাঠকপ্রিয় রম্য গল্প "অদ্ভূত চা খোর" প্রসঙ্গে

লিখেছেন নতুন নকিব, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১১:৪৩

সেকালের পাঠকপ্রিয় রম্য গল্প "অদ্ভূত চা খোর" প্রসঙ্গে

চা বাগানের ছবি কৃতজ্ঞতা: http://www.peakpx.com এর প্রতি।

আমাদের সময় একাডেমিক পড়াশোনার একটা আলাদা বৈশিষ্ট্য ছিল। চয়নিকা বইয়ের গল্পগুলো বেশ আনন্দদায়ক ছিল। যেমন, চাষীর... ...বাকিটুকু পড়ুন

অবিশ্বাসের কি প্রমাণ আছে?

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:৩১



এক অবিশ্বাসী বলল, বিশ্বাসের প্রমাণ নাই, বিজ্ঞানের প্রমাণ আছে।কিন্তু অবিশ্বাসের প্রমাণ আছে কি? যদি অবিশ্বাসের প্রমাণ না থাকে তাহলে বিজ্ঞানের প্রমাণ থেকে অবিশ্বাসীর লাভ কি? এক স্যার... ...বাকিটুকু পড়ুন

×