দুপুরবেলা শপিংমলটা প্রায় খালি চুপচাপ, সবাই যে যার মত লাঞ্চ করতে গিয়েছে। এসির ঠান্ডা বাতাস থাকতেও একরকম অলস গরমের আস্তরণ লেগে আছে চারপাশে। কাঁচের দেয়ালের ওপাশে রোদের ঝলকানি দেখে বোঝা যায় বাইরে রীতিমতো রোদের দাপট।
শপিং মলটির তিনতলার কোণায় ছোট্ট একটা ডেস্ক।সাদা-নীল বোর্ডে লেখা 'কাস্টমার কেয়ার'। ডেস্কের পেছনে বসে আছে তিতির। ছিমছাম পরিপাটি মেয়ে, আজ পরেছে হালকা গোলাপি সালোয়ার কামিজ। হাতে মাউস, চোখ মনিটরের স্ক্রিনে, কাস্টমার ফিডব্যাক রিপোর্ট আপডেট করছে একা একা, ওর সাথে কাজ করে নুরিয়া নামে মধ্য বয়স্ক আরেক মহিলা সে লাঞ্চে গিয়েছে, লাঞ্চ আওয়ারে ওরা আগে পরে একজন একজন করে ডাইনিং এ যায়, হেল্প ডেস্ক খালি রাখা একদম নিষিদ্ধ কাউকে না কাউকে অবশ্যই থাকতে হয়।
তিতির এই শপিংমলে কাজ করে পার্ট টাইম, সপ্তাহে পাঁচ দিন, দিনে পাঁচ ঘণ্টা করে। চাকরিটা পেতে খুব বেগ পোহাতে হয়নি, ওর স্বভাব একটু শান্ত, কেউ কিছু না বললে নিজে থেকে কোনো ঝামেলায় যায় না। তারপরও কিভাবে কিভাবে যেনো ওকে অনেকেই খুব একটা পছন্দ করে না অবশ্য বলা যায় এখানে কেউ কাউকেই পছন্দ করেনা অথচ উপরে উপরে মধুর সম্পর্ক।
হঠাৎ স্ক্রিন থেকে চোখ তুলে তিতির দেখে;
একজন বিদেশি মেয়ে তার সামনে দাঁড়িয়ে। লম্বা, সোনালি চুল; গায়ে হালকা অফ-হোয়াইট ফ্রক, সানগ্লাস তুলে কপালে ঠেকিয়ে রেখেছে, হাতে চকচকে একটা ব্যাগ, আর অন্য হাতে ধরা খাকি রঙের একটা প্লাজো।
- হাই, এক্সকিউজ মি... আই নিড হেল্প, মেয়েটির মুখ থেকে ভেসে এল স্পষ্ট উচ্চারণ।
তিতির একটু চমকে গেল, বিদেশি কাস্টমার মানেই সতর্ক আচরণ করতে হয়, এটা তাদের ম্যানেজমেন্টের কড়া নির্দেশ। তিতির উঠে দাঁড়াল
- ইয়েস ম্যাম, হাউ মে আই হেল্প ইউ?
মেয়েটি বলল,
- থ্রি ডেইজ এগো আই বট টু প্লাজোজ ফ্রম হিয়ার। ওয়ান ইজ ফাইন, বাট দিস ওয়ান হ্যাজ আ টিয়ার ইন দ্য সিম... আই ডিডন’ট নোটিস আর্লিয়ার। আই ওয়ান্ট টু চেঞ্জ ইট
তিতির প্লাজোটা হাতে নিয়ে দেখল, সত্যিই সেলাইয়ের জায়গায় ছিঁড়ে গেছে। সমস্যা হলো, তিতিরের একার কোনো অথরিটি নেই এক্সচেঞ্জ প্রসেস করার, এই বিষয়ে ম্যানেজার বা শপের সেলস টিমের কেউই দায়িত্বে থাকলে ভালো হতো।
- অ্যাকচুয়ালি... আই আন্ডারস্ট্যান্ড দ্য ইস্যু, বাট আই’ম নট অথরাইজড টু প্রসেস এক্সচেঞ্জেস। ইউজুয়ালি আওয়ার ম্যানেজার অর সামওয়ান ফ্রম সেলস হ্যান্ডলস দ্যাট। অ্যান্ড...তিতির চারপাশে তাকাল, বলা বাহুল্য, দুপুরবেলা লাঞ্চ আওয়ারের জন্য পুরো ফ্লোরটাই প্রায় ফাঁকা।
দে’আর নট হিয়ার অ্যাট দ্য মোমেন্ট, বলল সে একটু অসহায়ভাবে।
মেয়েটির মুখে অস্বস্তি আর বিরক্তি জমে উঠল।
- বাট ইট’স নট মাই ফল্ট আই ডিডন’ট ড্যামেজ ইট, আই রিয়েলি নিড আ রিপ্লেসমেন্ট, আই’ম লিভিং ঢাকা টুমরো মর্নিং।
এইবার তিতিরের ভিতরটা কেমন যেন ধক করে উঠল। কাস্টমারটা ভুল কিছু বলছে না, মেয়েটির চোখে হতাশা।
তিতির এক গভীর নিঃশ্বাস নিয়ে মনে মনে একটা সিদ্ধান্ত নিল, বললো
- জাস্ট ওয়েইট হিয়ার ফর আ ফিউ মিনিটস, বলেই সে প্লাজোটা হাতে নিয়ে ডেস্ক ছেড়ে বেরিয়ে পড়ল। খুব কাছেই একটা দর্জির দোকান আছে, সেখানে গিয়ে ছেঁড়া জায়গাটা নিজের টাকা দিয়ে সুন্দরভাবে সেলাই করিয়ে দৌড়াতে দৌড়াতে দ্রুত ফিরে এলো, কাজটা করলো ওর দায়িত্ববোধ থেকে।
এটা করতে ওর সময় লাগলো মাত্র পনেরো মিনিট। সেলাইটা এত নিখুঁত ছিল যে বোঝার উপায় নেই এখন।
- হিয়ার ইট ইজ। ফিক্সড। আই হোপ দিস ওয়ার্কস ফর ইউ,তিতির বলল।
মেয়েটির চোখ বিস্ময়ে বড় হয়ে গেল, তারপর হেসে বলল, - ইউ রিয়েলি ডিড দিস… ইয়োরসেলফ?
তিতির হাসল,
- ওয়েল, উইথ আ লিটল হেল্প ফ্রম দ্য টেইলর নেক্সট ব্লক।
মেয়েটির মুখভরা প্রাণখোলা হাসি,
- থ্যাংক ইউ। ইউ ডিডন’ট হ্যাভ টু... বাট ইউ ডিড। হোয়াট’স ইয়োর নেম?"
- তিতির।
- থ্যাংক ইউ, তিতির। ইউ’ভ মেইড মাই ডে। আই উইল রিমেম্বার ইউ হোয়েন আই ওয়্যার দিস ইন সিডনি।
মেয়েটি চলে যাওয়ার পর তিতির চুপচাপ ডেস্কে ফিরে এল।
তিতির একটা জিনিস সবসময় লক্ষ্য করেছে যে ওর পরিবার অথবা আত্মীয়-স্বজন লোকজনের থেকে অপরিচিত লোকজনের সাথে কথা বলতে বেশি স্বাচ্ছন্দ্যবোধ বা শান্তি লাগে এবং তারাও ওকে বেশ পছন্দ করে। এটার কারণ হতে পারে যে অপরিচিতরা বেশিক্ষণ সময় জীবনে স্টে করে না, অথবা অপরিচিত মানুষ ব্যক্তিগত ব্যাপারে আঘাত করে না; জানেও না; অযথা বাড়তি কথা বলে না।
শপিং মলটা এখন একটু একটু করে জমতে শুরু করেছে। মৃদু আলো আর শব্দে ভরে উঠছে চারপাশ। নুরিয়া আপা ফিরে এল একটু পর। চোখেমুখে বিরক্তি।
- কাউন্টার খালি রেখে তুমি বাইরে গিয়েছিলে নাকি?
- একটা কাস্টমার এসেছিল ছেঁড়া প্লাজো চেঞ্জ করতে, কিন্তু ঐ শপের দোকানে রবিন ভাই তো ছিল না, মেয়েটাও চেঞ্জ না করে যাবেই না পরে আমি মিঠু ভাইয়ের দোকান থেকে সেলাই করে নিয়ে এসে দিয়েছি মেয়েটি অনেক খুশি হয়েছে,
- মেয়েটিকে খুশি করা তোমার দায়িত্ব না, তোমার দায়িত্ব এই কাস্টমার ডেস্কে সব সময় উপস্থিত থাকা।
তিতির মাথা নিচু করে চুপ করে কাজ করতে লাগলো, সে যে লাঞ্চ আওয়ারে দু'ঘণ্টা কাটিয়ে আসলো সেটা নিয়ে কথা বলার সাহস ওইটুকুন তিতির মেয়েটির বলার সাহস আর হলো না।
এর মাঝে ওদের ল্যান্ডফোনটা বেজে উঠল। নুরিয়া ফোনটা কানে নিয়েই তিতিরের দিকে এগিয়ে দিল
তিতির কানে ধরতেই, ওপাশে বাদল ভাইয়ের কড়া গলা
- তিতির, ম্যানেজার স্যারের কেবিনে আসো এখনই।
তিতিরের বুকের ভেতরটা ধড়াস করে উঠল। মনে হলো হয়তো আজই চাকরিটা যাবে। নুরিয়ার দিকে ফিরলো সে কিছু বলল না, মুখ ঘুরিয়ে অন্যদিকে তাকিয়ে রইল।
ধীরে ধীরে হাঁটতে হাঁটতে অফিস রুমের দিকে এগোল তিতির। কাঁচের দরজার ও পাশ থেকে একটু উঁকি দিয়ে দেখল...
ভেতরে ভীষণ হইচই!
দুইজন নিরাপত্তাকর্মী একজন লম্বা ছিপছিপে ছেলেকে ধরে রেখেছে। ছেলেটির চেহারায় হতবুদ্ধি ভাব, পাশে দাঁড়িয়ে একজন লোক প্রচণ্ড রেগে কিছু বলছে, আর ম্যানেজার স্যার সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে পরিস্থিতি সামলানোর চেষ্টা করছেন।
তিতির বাদলের পাশে গিয়ে ফিসফিসিয়ে জিজ্ঞেস করল,
- কি হয়েছে?
সে বলল,
- চোর ধরছে। ছেলেটা একটা দামি ওয়াচ পকেটে ভরে পালানোর চেষ্টা করেছিল। ক্যামেরায় ধরা পড়েছে। (চলবে)
সর্বশেষ এডিট : ২০ শে মে, ২০২৫ রাত ৯:৫৮