- মানুষ হিসেবে আপনি কেমন?
- আর দশজনের মতই। অতি সাধারণের বাইরে অসাধারণ কিছুই আমার মধ্যে খুঁজে পাওয়া যাবেনা।
- উ হু। আমার মোটেও তা মনে হয়না।
- কী মনে হয়?
- আপনি অন্যরকম একজন। একদম অন্যরকম। আমি শিওর কেউ আপনার ভেতরের মানুষটাকে বের করে আনতে পারেনি, আমি কিন্তু এখনই বুঝেছি...
আমি মনে মনে হাসি। মেয়েগুলো এমন-ই। আজ পর্যন্ত অনেকেই আমার ভেতরের আমিটাকে বের করে আনতে চেয়েছে। ফলাফল শূন্য। না, ঠিক শূন্য নয়; অত্যন্ত আনরোমান্টিক-বেরসিক এবং বদমেজাজি মানুষটাকে ছেড়ে পালিয়ে সকলেই হাঁপ ছেড়ে বেঁচেছে।
বিয়ে করা বউ পাক্কা তিনবছর সংসার করার পর আমার অন্দর-সদর সব যখন তার চেনা শেষ, তখন সে ও রণে ক্লান্ত হয়ে ময়দান ত্যাগ করেছে। এ মেয়েকে এসব কে বোঝাবে?
- জানেন, আপনার লেখা পড়েই আমি বুঝতে পেরেছি আপনি মানুষটা খুব একা।
- সে তো সবাই ই একা।
- সেরকম না। আপনি সবার মাঝে থেকেও একা। আচ্ছা, আপনি নিশ্চয়ই এই একাকীত্ব উপভোগ করেন; তাই না?
আমি হাসি। সবাই এই হাসির অর্থ করে ফেলে একাকীত্ব আমার খুব পছন্দের। ব্যাপারটা মোটেও তা নয়। আর স্ত্রী-পরিত্যক্ত, নিঃসন্তান এক লেখক একাকী থাকবে এটা তো নিপাতনে সিদ্ধ ব্যাপার। অথচ এই মেয়ে এটা বুঝে যেন যুদ্ধ জয় করে ফেলেছে।
- আপনাকে বলে বোঝাতে পারবোনা আমার যে কি ভালো লাগছে...
- কেন?
- ও মা, প্রিয় লেখকের সাথে লং ড্রাইভে বেরিয়েছি। ফাঁকা রাস্তা, তার ওপর ঝমঝম বৃষ্টি। উফফ্, ভাবতেই গায়ে কাঁটা দিচ্ছে। আচ্ছা, বৃষ্টি আপনার খুব পছন্দ না?
- হুমম।
এই মুহূর্তে বৃষ্টি নিয়ে কথা বলতে ইচ্ছে করছেনা। ঝমঝম বৃষ্টিতে বরং মেজাজ টা চড়ে যাচ্ছে। এর চেয়ে বরং ঝিরঝির বৃষ্টিতেই জমতো ভালো...
- আচ্ছা, আপনি বুঝলেন কিভাবে যে আজ বৃষ্টি হবে?
- বুঝিনি তো।
- উমমহহ, বললেই হলো। বৃষ্টি হবে এটা না জানলে আজ হঠাৎ লং ড্রাইভের কথা আপনার মাথায় এলো কেন? সেই কবে থেকে আপনাকে বলছি; গভীর রাত, ঝুম বৃষ্টি, বৃষ্টির তোড়ে চারপাশ ঝাপসা, গাড়ির কাঁচ দিয়েও ভাপ বেরোবে- আর এই দুর্যোগের রাতেও আমরা ঘুরবো আর গল্প করবো। উফফফ্।
বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া মেয়ের আহ্লাদ যেন টিনেজ বয়সকে ছুঁয়ে গেছে। গত চার-পাঁচদিনের ভ্যাপসা গরম আর আকাশে বিজলীর অযথা ক্রন্দন মোটামুটি জানিয়ে-ই দিচ্ছিলো আজকের আবহাওয়ার খবর, আর আবহাওয়া সংক্রান্ত মোবাইল ফোনের হরেক অ্যাপ তো আছেই। তবে যে কাজে পথে নেমেছি তার জন্য ঝুম বৃষ্টি একদমই বেমানান। দরকার ঝিরঝিরি বৃষ্টি।
- আপনার বউকে নিয়ে এমন লং-ড্রাইভে অনেক এসেছেন না?
এসব ফালতু প্রশ্নের উত্তর দিতে ভালো লাগেনা। অবশ্য আর কোন উত্তর দেবার প্রয়োজনও বোধহয় নেই। বৃষ্টির ফোঁটাগুলো গুড়ো করা মুড়ির দানার মত ঝরছে। আর আকাশের বিজলীর চমকে চারপাশ হঠাৎ হঠাৎ দিনের মতই পরিস্কার হয়ে পড়ছে।
- জানালার কাঁচ নামিয়ে দাও। এসি অফ করে দিচ্ছি। বৃষ্টির ছাঁট মুখে লাগিয়ে দেখো, দারুণ লাগবে।
মন্ত্রমুগ্দ্ধের মত মেয়েটা খোলা জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে বৃষ্টির গুঁড়ো মাখছে। এই রে, মেয়েটার নামটা যেন কী - তা একদম ভুলে গেছি। সে যাক্ গে, নাম-পরিচয় এসব অবান্তর জিনিস নিয়ে মাথা ঘামিয়ে কী লাভ?
- ওরা কে? ঐ লোকগুলো কে?
মেয়েটি রাজ্যের বিষ্ময় নিয়ে বাইরে তাকিয়ে আছে। আমি গাড়ির গতি একদম কমিয়ে দিয়েছি। তার চোখের বিষ্ময় ধীরে ধীরে আতঙ্কে রূপ নেবে...
ওরা রাস্তা ফুঁড়ে হঠাৎ-ই যেন এসে পড়ে। কোন হেল দোল নেই। কোন বাক্যব্যয় নেই। শুধু পুরো এক কিলোমিটার রাস্তাজুড়ে রাস্তার দুপাশে বিশ-ত্রিশ গজ পরপর চার-পাঁচজন করে বিভিন্ন বয়েসী পাঞ্জাবী পড়া পুরুষ লোক দাঁড়িয়ে থাকে।
দশ বছর আগে এই রাস্তায় প্রথম তাদের দেখার পর অনেক ভেবেও কোন উত্তর পাইনি। পরে উত্তরের চিন্তা বাদে মাথায় আসে লং-ড্রাইভের চিন্তা।
বৃষ্টি মোটামুটি কমে এলেই ওরা নির্বিকার দাঁড়িয়ে থাকে। মেয়েগুলো এতেই ভড়কে যায়। ভয়ে চুপসে গেলেও কেউ এ নিয়ে আর কোন কথা বলতে চায়না। কেন চায়না সেটাও অবশ্য গবেষণার বিষয়।
বউকে নিয়েও অসংখ্যবার এই খেলা খেলেছি। ওর ধারণা... থাক্, যে চলে গেছে তার ধারণা জেনেই বা কী লাভ!!!