আমাদের নগর প্রধানের হঠাৎ মনে হলো শহরে একজন গল্পখোর দরকার ।
২
নগর সভার সবাই ভাবচ্যাকা খেয়ে গেলো । গল্পখোর আবার কি ?? কেউ কখনও এমন শোনেনি । নগর প্রধান গোঁফের তলায় মুচকি হাসলেন । বললেন , গল্পখোর হলো গল্প খাদক । সবার ভ্রু প্রশ্নবোধক, নগর প্রধান আবার মুচকি হাসি দিলেন । ষড়যন্ত্র করার ভঙ্গিতে বললেন, “আমাদের সবার পেটভর্তি নানারকম গল্প । গোপন গোপন গল্প । কাউকে বলা যায় না এমন গল্প” । বলে দ্রুত নিঃশ্বাস ফেললেন নগর প্রধান, “গল্পখোরদের আমরা সে গল্পগুলোই বলবো । কিন্তু গল্পখোরেরা কাউকে সে গল্প বলতে পারবে না” । সবাই বলে উঠলো, বাহ বাহ নগর প্রধানের কি বুদ্ধি ! নগর প্রধান তৃপ্তির হাসি হাসলেন ।
৩
বিরোধী দল শুনেই আঁতকে উঠলো ! একি সর্বনাশের কথা । নগর প্রধান কি এর মাধ্যমে বিরোধী দলের গোপন পরিকল্পনা জানতে চাচ্ছে ?? তারা রাজপথ থেকে বিকেলের রোদ পড়া ছাদে আওয়াজ তুলল, এতে নগরের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ হবে । বাহিরের লোকেরা বলবে , এই শহরের লোকেরা গোপন কথাটি রাখতে জানে না গোপন । শহরের একদল বুদ্ধিজীবী , গাছের হলুদ পাতায় লিখলো, অতি চমৎকার উদ্যোগ । এর মাধ্যমে শহরের লোকের মানসিক শান্তি ফিরে আসবে! আরেক দল পাতার উপরে নীল রঙ দিলো । তারপরে বিকল্প প্রতিবাদী নামে লিখলো, ব্যক্তিস্বাধীনতার এমন হস্তক্ষেপ মেনে নেওয়া যায় না, শহরে বেড়ে যাবে অবিশ্বাস ! ব্যথিত, ভঙ্গুর গাছগুলো ক্লান্ত পলক মেলে দেখলো, শহরের জোকারেরা নতুন রঙ্গে মেতে উঠেছে । কেউ তা দেখছে, কেউ দেখছে না । তাতে কারই কিছু আসছে না, যাচ্ছে না ।
৪
এক শুভদিন দেখে ঘোষণা করা হলো, গল্পখোরের মনোনয়নপত্র জমা নেওয়া হবে কাল থেকে । মনোনয়নপত্র থেকে বাছাই করা হবে সাত জন প্রাথমিক গল্পখোরকে । তাদের এক মাস পর্যবেক্ষণ করে চূড়ান্তভাবে একজনকে নিয়োগ দেওয়া হবে, নাগরিক গল্পখোর । সবাই প্রবল উৎসাহে মনোনয়নপত্র যোগাড় করতে লাগলো । এমনকি বিকল্প প্রতিবাদীরাও ঘুষ দিয়ে কিনে নিলো কিছু পত্র, তারপর মুখ উদাস করে বলল, এটা তাদের নতুন ধরনের প্রতিবাদের প্রাথমিক ধাপ । এক দিনেই শেষ হয়ে গেলো সব , অন্যের গোপন কথা শোনার আগ্রহ সবারই অপরিসীম !
৫
আরেক শুভদিনে ঘোষণা করা হলো, প্রাথমিক ভাবে নির্বাচিত সাত জনের নাম । তাদের মুখে আকাশগঙ্গা জয়ী সম হাসি । জানানো হলো, কাল থেকে সাত জনের কাছে জানানো যাবে আমাদের গোপনতম গল্প । গল্পখোরদের হাসি বিস্তৃত হলো ।
৬
আমরা পরের দিন থেকে দলে দলে যেতে শুরু করলাম গল্পখোরদের কাছে । সেজে গুজে সবচেয়ে সুন্দর কাপড় পরে আমরা গেলাম আমাদের গোপন গল্পগুলো শুনাতে । তারপর লম্বা ভিড়, দীর্ঘ অপেক্ষা । সবার গল্পই অনেক বড় । অপেক্ষা আমাদের ক্লান্ত করে কিন্তু ফিরিয়ে নেয় না । আস্তে আস্তে সেখানে এসে গেলো পাখার ব্যবসায়ী , পানির ব্যবসায়ী, খাবারের ব্যবসায়ী । হরেকরকম প্রয়োজনে হরেকরকম সমাধান । শহর যেনও মেলার শহর । নগর প্রধানের কোষাগার ভরে উঠছে তাই তিনি তৃপ্ত । বিরোধী দল সেই কোষাগার দেখে শঙ্কিত । আর আমরা আমাদের গোপনতম কথাটি সুযোগ মতো উগড়ে দিয়ে মুক্তো , হঠাৎ স্বাধীন হয়ে যাওয়ার মতো আনন্দিত ।
৭
কিন্তু আমাদের গল্পখোরদের দিকে আমরা অবাক তাকিয়ে রই । যত দিন যাচ্ছে তারা তত নিস্তেজ হয়ে যাচ্ছে । ক্লান্তি তাদের চোখজুড়ে । ফ্যাকাসে চামড়ায় কিসের যেনও আকুতি । নির্মম আর্তনাদ প্রতিটা পায়ের পদক্ষেপে । তাদের জন্য মেডিক্যাল বোর্ড বসলো , শহরে গুজব, মানুষের গোপন কথা গোপন রাখার চাপে তাদের এই পরিণতি । তবে গল্প খাওয়া থামলো না । গল্প শেষে আমরা সুখী হয়ে বের হয়ে আসি । আর গল্পখোরেরা আরও বিবর্ণ হয় । এমনকি শহরের সেরা মেকআপ বিশেষজ্ঞরাও তা লুকাতে পারে না । অথচ আমাদের গল্প ফুরায় না ।
৮
অবশেষে এলো সেই দিন । ঘোষণা হবে, নগরের প্রথম নাগরিক গল্পখোর । নগর প্রধান এসে দাঁড়ালেন নগরের সবচেয়ে উঁচু জায়গায় । তিনি বললেন, কিভাবে তিনি ভাবলেন, একজন গল্পখোরের কথা । আমরা তার বুদ্ধির প্রশংসা করলাম । তিনি দুঃখ ভরা কণ্ঠে বললেন, কতভাবে বাঁধা দেওয়া হয়েছে । আমরা দুঃখিত হলাম । তিনি বললেন, আমাদের সুখী মুখ দেখে তিনি কত সুখী । আমরা অপেক্ষা করি। সবশেষে নগর প্রধান বললেন , তিনি প্রত্যেক গল্পখোরের কাজেই সন্তুষ্ট । তাই জনগণের চাহিদা অনুসারে সাতজনকেই নাগরিক গল্পখোর ঘোষণা করা হলো । আমরা আনন্দধ্বনি করে উঠলাম । আর গল্পখোরেরা করে উঠলো আর্তনাদ ! আমরা অবাক হয়ে তাদের দিকে তাকাই । নগর প্রধান বিরক্ত হলেন । তিনি জোরে জোরে হেসে বললেন, ফুর্তি ফুর্তি ! আমরাও দুই হাত তুলে বললাম, ফুর্তি ফুর্তি ! আমাদের সম্মলিত উচ্ছ্বাসের নিচে চাপা পরে গেলো গল্পখোরদের অস্ফুটতা ।
৯
পরের দিন সকালে ঘুম থেকে উঠে আমরা চমকে গেলাম । শুনলাম, গতরাতে আমাদের নাগরিক গল্পখোরেরা একসাথে আত্মহত্যা করেছে !