সুধা অনেকক্ষণ ধরে তার সদ্য আঁকা পেইন্টিংটার দিকে তাকিয়ে আছে। জল রং আঁকা সাদামাটা সাধারণ একটি ছবি । সাবজেকটাও খুব সরল । গ্রাম্য পরিবেশ, পুকুর,গাছ পালা ইত্যাদি, ইত্যাদি । পুরোটাই তার ছোট বেলার সর্বক্ষণের খেলার সাথী পুতুলগুলোকে কল্পনা করে আকা। ছেলেবেলায় মা সুধাকে কাপড় আর তুলো দিয়ে এ ধরনের পুতুল বানিয়ে দিতেন । সুধার সারাদিন কাটতো সেগুলো নিয়ে ।
আজ এতোগুলি বছর পর স্মৃতির গহীনে সাতার কেটে কেটে ছোটবেলার সেই প্রিয় পুতুলগুলোকে নরম তুলির আচরে,পরম যত্নে হুবহু তুলে আনার চেষ্টা করছে ক্যানভাসে। কিন্তু ছবিটা মন মতো হচ্ছে না । কোথায় যেন একটু খুত থেকেই যাচ্ছে । পুরো ছবি শেষ হওয়ার পর একটু একটু করে খুতগুলো চোখে পরতে শুরু করে। পরপর তিন'টি ছবি আকার পর ছিঁড়ে ফেলাছে ও । সেগুলো'র টুকরো অংশ এখনো ঘরময় ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে আছে । সংখ্যার বিবেচনায় চার নম্বরটা ছবিটা এইমাত্র শেষ হলো ।
দু'কদম পিছিয়ে এসে, তুলি'র পেছনের অংশটা দাতে কামড়ে ছবিটার দিকে তাকায় সুধা। খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে থাকে ছবির প্রতিটি অংশ । ক্যানভাসের পাড় থেকে শুরু করে রং,পুতুলগুলোর অবয়ব হাত,পা,পোষাক ,চারপাশের পরিবেশ কিছুই বাদ যায় না । শেষমেষ বিরক্ত হয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে,না! এটিও হয়নি ।
আগেরগুলোর মতো এ ছবিটিরও কোথাও খুব সূক্ষ্ম অসামঞ্জস্য বা খুত রয়ে রয়ে গেছে । কিন্তু সেটি কোথায় তা ধরা যাচ্ছে না। অথচ ছবিটির দিকে তাকালেই মনটা খচখচ করছে। এ ধরনের অনুভুতি থেকে সুধার বিরক্তি বাড়তে শুরু করে, ধীরে ধীরে সেটা রাগে পরিনত হয় । এখন সে রকম রাগ লাগছে । ছবিটা একটানে ছিড়ে ফেলতে ইচ্ছে করছে । আজ হাত যেন কিছুতেই মনের কথা শুনছে না । কল্পনার চোখের সাথে হাতের মিতালি না হলে ছবি ফুটে উঠে না, রং তখন আর তুলির ছোঁয়া'য় কথা বলে না ।
ছবিতে তিনটি মেয়ে পুতুল গাছের নিচে বসে একাগ্রচিত্তে রান্না, রান্না খেলছে । পুতুলগুলোর সামনে কলা পাতার উপর ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে তাদের খেলার হাড়ি,পাতিল,প্লেট,বাটি,পাটা, পুঁতো,চুলো । সকলের চোখ মুখ থেকে ঠিকরে বের হচ্ছে, খুশির ঝিলিক । গাছ পালার ছায়াগুলো এমন ভাবে পুতুলগুলোর উপর ফেলা হয়েছে, তাতে তাদের শরীরের ছায়া গিয়ে পরেছে পুকুরের জলে । ফলে ছবিগুলো একবারে জীবন্ত হয়ে উঠেছে । মনে হচ্ছে, ইশারা করলেই নেমে আসবে ক্যানভাস থেকে ।
মাঝখানের পুতুলটির পড়নে লাল রং এর কামিজ । কাঁধের দু’পাশে ঝুলছে টান টান করে বাঁধা বেণি । এ পুতুলটি আকার সময় সুধা বারবার ছোটবেলার নিজেকে কল্পনা করেছে। আকার সময় বারংবার মনে হচ্ছিল সে যেন নিজেকে আঁকতে বসেছে। যদিও লাল রং তার একেবারে পছন্দ না তবুও সে পুতুলটিকে লাল রং এর জামা পড়িয়েছে । যত্ন করে বেণিগুলো এঁকেছে। ডান পাশের পুতুলটির পড়নে সবুজ রং এর কামিজ আর বা পাশের পুতুলটির পড়নে হালকা কমলা রং এর জামা তার উপর লাল লাল ফুল । তিনজনের মাথাতেই লাল জবা ফুলে শোভা পাচ্ছে । ছবিটা সাধারণ চোখে দেখলে, যে কেউ এক কথায় বলবে,অসাধারণ । মা দেখলে বলতেন, হা রে সুধা, খুব সুন্দর হয়েছে তো ছবিটা। ছবিটার দিকে তাকিয়ে তোর ছোটবেলার পুতুলগুলোর কথা মনে পরে যাচ্ছে।
সুধার পেইন্টিংটা ভাল লাগছে না । ছিঁড়ে কুটি কুটি করে ফেলতে ইচ্ছে করছে । কোথায় যে খুতটা থেকে যাচ্ছে বুঝতে পারছে না । একবার মনে হচ্ছে চেহারাগুলো মিলছে না । আবার মনে হচ্ছে , রং ঠিক ঠিক হচ্ছে না।
আরো কিছুক্ষণ ছবিটার দিকে তাকিয়ে থেকে হাতের তুলিটা টেবিলটার উপর ছুড়ে ফেলে দিয়ে সুধা আলতো পায়ে জানালার কাছে গিয়ে দাঁড়ায় । পর্দা ফাক করে দাড়াতেই খুব স্নিগ্ধ শীতল হালকা এক রাশ বাতাসে শরীর মন জুড়িয়ে দেয়। আবেশে চোখ বুঝে আসে সুধার।
বেশ রাত হয়েছে । ছবি আকতে বসেলে সময় জ্ঞান থাকে না । কোথা দিয়ে যে সময় চলে যায় বুঝা যায় না । দূরে কোথাও কয়েক'টি কুকুর ডাকছে। জানালায় দাড়ালে বহুদূর পর্যন্ত আকাশ দেখা যায়। রাতের আকাশে মিটমিট করে তারা জ্বলছে। বাড়ির বাউন্ডারির শেষ মাথায় রাস্তার গা ঘেঁষে দাড়িয়ে থাকা নারকেল গাছগুলোর নুয়ে পড়া পাতাগুলো বাতাসে দোল খাচ্ছে । হালকা অথচ খুব মিষ্টি একটা গন্ধ এসে নাকে লাগে। সুধা চোখ বুঝে ফুলের গন্ধটা ধরতে চেষ্টা করে। চাপা ফুলের গন্ধ বলে মনে হয় । হয়তো বাড়িওয়ালা চাচার গাছগুলোতে ফুল ফুটতে শুরু করেছে । বাহ! ভারি মিষ্টি গন্ধ তো । সুধা বুক ভরে নিতে চাইলো সে গন্ধ । ফুলের গন্ধে মুহূর্তে যেন মনটা ভাল হয়ে যায়। ও গুনগুন করে গান গাইতে শুরু করে, ঘরেতে ভ্রমর এলো গুনগুনিয়ে / আমারে কার কথা সে যায় শুনিয়ে ....
জানালার পর্দাগুলো ঠিক করে পেছন ফিরে ক্যানভাসের দিকে চোখ যেতেই চমকে উঠে সুধা। ছবি কোথায়? ক্যানভাস থেকে সদ্য আঁকা পুতুলগুলো ঘায়েব হয়ে গেছে । সফেত ক্যানভাসটা নিজেই হতবিহবল হয়ে সুধার দিকে তাকিয়ে আছে। বিস্ফারিত চোখে ক্যানভাসটির দিকে অপলোক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে ও ।
হঠাৎ খিলখিল হাসির শব্দে সুধার চোখ যায় পেইন্টিং স্টান্ডের পায়ার নিচে ফ্লোরের দিকে, সঙ্গে সঙ্গে "ও মাগো" বলে মুখ দিয়ে অস্পষ্ট একটা শব্দ বের হয়ে আসে । মাথাটা ঘুরে যায়। শরীরটা ঝিমঝিম করে উঠে । সুধার কাছে মনে হয় মাথা ঘুরে পড়ে যাবে । বুকের ভেতরটা ডাঙ্গায় তোলা মাছের মতো লাফাতে থাকে। এক মুর্হুতও দেরি না করে ছুটে বেরিয়ে যায় ঘর থেকে।
সুধার বেরিয়ে যাওয়ার শব্দে পেইন্টিং স্টান্ড এর নিচে খেলায় ব্যস্ত তিনটি শিশু মুখ তুলে তাকিয়ে থাকে সুধার চলে যাওয়া পথের দিকে। পায়ের শব্দ মিলিয়ে যেতেই তারা আবার খেলায় মগ্ন হয়ে পরে।
শেষ .......।
ছবি : বীথি জোদ্দার
সর্বশেষ এডিট : ২৫ শে জুলাই, ২০২২ সকাল ১০:৪১