ট্রাফিক সিগন্যালে গাড়ি থামতেই বিরক্তিটা বেড়ে গেলো । আজকাল সব কিছুতে বিরক্তি বেড়ে যায় । দেশের মানুষগুলো রাতারাতি আন কালচার, মূর্খ, গোয়ার হয়ে উঠছে । কোথাও একটু সুন্দর সিস্টেম নাই । সর্বত্র দূষণ, করাপশন, পলিউশন মিলেমিশে একাকার অবস্থা । গত মাসে ছেলে, মেয়ে বউকে কানাডায় পাঠিয়ে দিয়েছি । এই দেশে কি মানুষ থাকতে পারে নাকি ? যত্তসব,ময়লা, আবর্জনা, নোংরা কাদার ভাগার ।
কত গুরুত্বপূর্ণ একজন ব্যক্তির সাথে দেখা করতে যাচ্ছি । অথচ জ্যামের মধ্যে আটকে থেকে নাকাল হতে হচ্ছে । জ্যামের অবস্থা দেখে মনে হচ্ছে পয়েন্টমেন্টটা মিস করতে হবে। কথা দিয়ে কথা না রাখার লোক আমি না । তা ছাড়া যেখানে স্বার্থের লেনদেন আছে সেখানে তো একেবারে না । মস্ত বড় পার্টি , পলিটিকাল কানেকশন হাই । অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে এ্যপোয়নমেন্ট পেয়েছি। মিস হয়ে গেলে মাথার চুল ছিঁড়তে হবে । কয়েক'শ কোটি টাকার কাজ । যদি ব্যাটে বলে হয়ে যায়, তাহলে সারা জীবন বসে খাওয়ার ব্যবস্থা হয়ে যাবে । টুয়েন্টি পারসেন্ট থেকে শুরু করতে হবে । পার্টি যতো বড় রেট ততো বেশি । ফোরটি - সিক্সটিতে দফারফা হয়ে গেলে খুব ভালো ।
নিজেই ড্রাইভ করছি । এ সব ক্ষেত্রে ড্রাইভারদের বিশ্বাস করতে নাই । কখন কে, কি লিক করে দেয় তা তো আর বলা যায় না । তাই যতোটা পারা যায় সাবধানে থাকতে হয় । পাশে সিটের উপর রাখা গাড়ির ক্যাটালগগুলো ঠিকঠাক করে রাখলাম । সদ্য ইমপোটেড নতুন নতুন সব গাড়ির ক্যাটালগ । দাম ৫০ লাখের উপরে । না, গাড়ি বেঁচতে যাচ্ছি না । গাড়ি বেচা আমার পেশা না । গাড়ির দাম শুনে যারা আমারে গাড়ির ব্যবসায়ী ভাবছেন তাদের জন্য বলছি , গাড়ি বেচার মতো ছোটখাটো ব্যবসা আমার সাথে যায় না ।
আপনাদের সকলের দোয়ায় ছোটখাটো একটা ঠিকাদারি ব্যবসা প্রতিষ্ঠান আছে আমার । কয়েক'টা ক্যাটাগরিতে লাইসেন্স নেওয়া আছে । টয়লেট থেকে ফুটপাত, ফুটপাত থেকে বিমান বন্দর সবই বানাতে পারি । একবার মূল টেন্ডারটা হাতিয়ে নিতে পারলে ছোট ছোট অংশে পুরো কাজটাকে অন্যান্য কনট্রাকটরদের মধ্যে ভাগ, ঝোঁক করে দেওয়াই আমার মূল ব্যবসা । অবশ্য এ পর্যন্ত আসতে দীর্ঘ লাইন,ঘাট মেন্টেন করে যেতে হয় । তবুও ঝামেলা যে হয় না । তা কিন্তু নয় । নিত্য নতুন ঝামেলা লেগেই থাকে। যাত্রীবাহী পরিবহনের মতো স্টেশনে থেমে থেমে যাত্রী সেবা দিয়ে তবেই মাছ জালে তুলা যায় ।
কথাবার্তা ঠিকঠাক হয়ে গেলে, পিএস এর কাছে বিকেলে পৌঁছে যাবে তার পছন্দ করা গাড়িটি । তবে আজকাল সবাই গাড়ি নিতে চায় না ফেঁসে যাবার ভয়ে । কথায় আছে, কাকে কাকের মাংস খায় না । কিন্তু এই লাইনে গু ছাড়া সবাই কিছু সবাই খায় । বনিবনা না হলেই ফাস করে ভাইরাল করে দাও । তারপর বসে বসে মজা দেখো । ব্যাস সব শেষ । এই তো গতমাসে, আমাদের এই লাইনের গুরু'র একটা অডিও ফাঁস হয়ে কি কেলেঙ্কারিটাই হলো । তবে, গুরু বলে, সবকিছু সামলে দিয়ে রক্ষা পেয়েছেন । আমরা হলে, হাসপাতালে চিৎ হয়ে পরে থাকতে হতো ।
এই মুর্হুতে কমিশন ব্যবস্যা হচ্ছে, বর্তমান বিশ্বের এক নাম্বার ব্যবসা । আমি নাম দিয়েছি, "ধরো মাছ না ছুঁই পানি ।" চোখকান খোলা রেখে লিয়াজো মেন্টেন করে ঠিক জায়গায় হাত ঢুকাতে পারলেই পকেট উপচে পরে টাকা । গাড়িতে ফুল এসি চলছে । তবুও দরদর করে ঘামছি । ইদানীং এই নতুন যন্ত্রনা হয়েছে, অল্পতেই টেনশনে পড়ে যাই । বুকের ভেতরটা ধুপধুপ করতে থাকে । আগে এমনটা হতো না । কোন কারণ ছাড়াই ঘেমে যাই ।
জানালা দিয়ে বাহিরে তাকিয়ে দেখলাম , উল্টো দিক দিয়ে কোন ভিআইপি যাচ্ছে, তাই এই লাইনটা বন্ধ করে রাখা হয়েছে । ট্রাফিক সার্জেন্টগুলো একটু পর পর ঠুক ঠুক করে কালো কাচের গাড়িগুলোর দিকে মুখ করে করে সালাম ঠুকছে । সকাল ও সন্ধ্যায় এই সময়গুলোতে খুব কষ্ট হয় বেচারাদের । কয়েক বছরের মধ্যে দেশে এতো এতো ভিআইপি বেড়ে যাওয়ায় বেচারারা পরেছে ঘ্যারাকলে । সকাল সন্ধ্যা ঠুসঠাস । সেই রেশ গিয়ে পরে অন্য যান বহনের চালকদের উপর । চলে মামলা দেওয়ার মহা উৎসব ।
বেশ কিছুক্ষন সিগনালে ঝুলে থাকার পরে হঠাৎ একটা শোরগোল উঠলো । ডান পাশের জানালা দিয়ে তাকিয়ে দেখি, লুঙ্গির উপর কালো কোট পড়া একটা লোক দৌড়চ্ছে আর হাত নেড়ে নেড়ে চিৎকার করে কিছু বলছে । জানালার গ্লাসটা একটু নামাতেই শুনতে পেলাম , লোকটা আগুন, আগুন বলে চিৎকার করতে করতে আমার পাশেই দাড়িয়ে থাকা একটা নিশান পাজারো'র সামনে গিয়ে দাড়িয়ে নানান অঙ্গভঙ্গি করে চিৎকার করতে করতে বলছে, আগুন লাগছে , আগুন লাগছে । পাজারোর ভেতরে বসে থাকা যাত্রীদের দেখা যাচ্ছে না । ড্রাইভারকে দেখলাম, জানালা খুলে একশ টাকার একটা নোট বের করে লোকটাকে সাধছে । কিন্তু পাগল লোকটা সেদিকে তাকিয়েও দেখছে না । তার দৃষ্টি পেছনের সিটে বসে থাকা যাত্রীর উপর ।
সকাল বেলা রাস্তায় অফিস মুখী মানুষের বড্ড চাপ । সির্গনালে থেমে থাকা লোকজন বিষয়টাতে মজা পেয়ে দেখছে আর দাঁত বেড় করে হাসছে । বাঙ্গালিকে হাসির জন্য বিশ্বকাপ দেওয়া উচিত । মান,অভিমান, রোগ,শোক সব কিছু ভুলে খুব সহজেই হাসতে পারে । সেদিন নিউজে দেখলাম, সারারাত প্রসব বেদনায় ছটফট করে , সকালেই পরীক্ষায় বসেছে এক নারী । পরীক্ষা শেষে সাংবাদিকেরা তাকে ঘিরে ধরলে ,সে দাঁত বের করে হাসতে হাসতে বলছে, পরীক্ষা ভালো হয়েছে, দোয়া করবেন ।
মোটরসাইকেলে বসা একজন পাগলের উদ্দ্যেশে , প্রশ্ন ছুড়ে দিলো , মামা কোথায় আগুন লাগছে ? প্রশ্ন পেয়ে পাগলের উদ্দোমে বেড়ে যায়, সে নতুন উদ্দোমে চিৎকার করে বলতে থাকে, আগুন , আগুন । সর্বত্র আগুন। তেলে আগুন , জলে আগুন , মনে আগুন , পেটে আগুন । বাজারে আগুন, ঘরে আগুন । চারিদিকে আগুন আর আগুন । আগুন খা, আগুন হাগ । আগুন খেয়ে খেয়ে আগুনের মানুষ হয়ে যা ।
পাগলের কথা বার্তার ফিলোসফি ধরতে পারছি না । ব্যাটা আগুন বলতে কি বুঝাতে চাইছে । দেখে তো ভাবের পাগল বলে তো মনে হচ্ছে না । ভাবের পাগল হলে পাজারোর জানালা দিয়ে বের হওয়া নোটটা নিয়ে লাপাত্তা হয়ে যেতো । তাহলে ! ব্যাটার উদ্দেশ্য কি ? শুনেছি আজকাল সরকারী গোয়েন্দা সংস্থার লোকজন পাগল,টাগল সেজে রেকি টেকি করে । একে দেখে তো কিছুই বুঝা যাচ্ছে না ।
এই দ্যাখো ; কোন কারণ ছাড়াই ভয় পাচ্ছি । না , সব কিছু নিয়ে এতো ভাবতে নাই । ভালোয় ভালোয় মিটিংটা হয়ে গেলে রাতে রেডিসনে পার্টি দিবো । দেশের গুরুত্বপূর্ণ লোকজন থাকবে সেখানে । রাত্রি জমে উঠলেই জমে উঠবে পার্টি । আহ! কি শান্তি, শুধু পার্টি আর পার্টি ।
সিগনাল ছাড়তেই মোবাইলটা বেজে উঠলো দেখে মেজাজটা আবার খারাপ হয়ে গেলো । মা...টারে কতবার বলেছি , ফোন না করতে । দরকার হলে আমি নিজে ফোন দিবো । কে শুনে কার কথা , তবুও মা...টা ফোন দিবে । ফোনটা ধরতেই , অপর প্রান্ত থেকে ভেসে এলো পরিচিত মোলায়েম নারী কণ্ঠ, "ভাইজান আজ কত পিস পাঠাবো।? নতুন,ফ্রেশ কিছু পাখি এসেছে । আপনার জন্য একটা টিয়া পাখি আমি নিজে বেছে রেখেছি । সাবধানে থাকবেন তা না হলে , কামড় দিবে কিন্তু .........।["
খিলখিল হাসির শব্দে কানটা ঝা ঝা করে উঠলো । "সঙ্গে সঙ্গে বিদ্যুতের চমকের মতো হালকা একটা হাসির রেখা খেলে গেলো ঠোটের কোণে । ভেতরে লুকিয়ে থাকা পুশুটা একটু একটু করে নড়েচড়ে উঠলো নরম তুলতুলে মাংসের স্বাদ নেবার জন্যে । আপন মনেই বিরবির করে বলে উঠলাম, পাখি ......পাখি ........টিয়া পাখি , দেখবো তুই কত কামড়াতে পারিস রাঙ্গা ঠোটে ।
বি।দ্র : এই গল্পের চরিত্রের সাথে জীবিত কিংবা মৃত কোন ব্যক্তির মিল নাই । একান্তই কোন মিল খুঁজে পাওয়া গেলে নেহাতই তা কাকতালীয় ।