এক.
হাতের কাজ শেষ করে যখন চায়ের কাপে শেষ চুমুক দিয়েছি ঠিক সে সময় আমার পিয়ন নয়ন এসে বলল, "স্যার, জামাল সাহেব এসেছে, আপনার সঙ্গে দেখা করতে চায়।" ঘড়িতে প্রায় সাড়ে ৫টা বাজে। অফিস ছুটি হয়ে গেছে ৫টার সময় । সবাই চলে গেছে । আমিও বের হয়ে যেতাম কিন্তু হাতের কাজটুকু শেষ না করে উঠতে পারছিলাম না বলে বের হতে দেরি হয়ে গেছে । এমনিতে শীতকাল তার উপর বেলা ছোট তাই তাড়াতাড়ি সন্ধ্যা হয়ে যায়। এ সময় জামাল মিয়াকে নিয়ে বসার কোন মানে হয় না । হাত ঘড়িতে চোখ বুলিয়ে নয়নে'র দিকে তাকিয়ে বললাম, "এ অসময় জামাল মিয়া আবার কি মনে করে ? ওকে কাল আসতে বল ।”
- সেটাই বলেছিলাম স্যার, কিন্তু সে বলল, আপনার সঙ্গে নাকি খুব জরুরি কথা আছে । আগামী কাল আসলে তো লাভ হবে না স্যার,কারন আগামীকাল হচ্ছে শুক্রবার, অফিস বন্ধ ।
আরে তাই তো , আগামী কাল যে শুক্রবার সেটাই ভুলে গিযেছিলাম । ঠিক আছে, তুমি ওকে আসতে বলো ।
জামাল মিয়া আমাদের অফিসে একজন লোকাল সাপ্লাইয়ার হিসাবে কাজ করে । স্থানীয় বাজার থেকে কাগজ, কলম,লোহা,লক্কড় এটা, সেটা কিনে অফিসে সাপ্লাই দেয়াই তার মূলকাজ ।
মাঝারি আকৃতির মোটা সোটা লোকটার মাঝে সততার বিন্দুমাত্র অবশিষ্ট আছে বলে মনে হয় না । তার উপড়ে প্রচুর মিথ্যা কথা বলে । সারাক্ষণ মুখ পানের পিকে লাল হয়ে থাকে । সেই সঙ্গে আছে জর্দার কড়া গন্ধ । কিন্তু তবুও জামাল মিয়া খুব কাজের লোক । আমার বিশ্বাস জামাল মিয়াকে যদি বাঘের চোখ যোগার করে আনতে বলা হয় তাহলে সে সেটাও যোগার করে এনে দিতে পারবে। এ ধরণের লোক কে নিজের সঙ্গে জুড়ে রাখতে হয় । বলা তো যায় না কখন, কোন কাজে লেগে যায় ।
কিন্তু এখন, এই অসময়ে জামাল মিয়ার আসার কারণটা বুঝতে পারলাম না । যতোটুকু মনে পরে, গত সপ্তাহে ওর বিল টিল যা ছিল সব পরিশোধ করা হয়েছে । অফিসে নতুন করে কিছু লাগবে বলেও তো শুনিনি । তা হলে; হুট করে ব্যাটা এলো কি মনে করে? নিশ্চয় নতুন কোন ধান্ধা আছে । ধান্ধা ছাড়া জামাল এক পা ও হাঁটে না ।
চেয়ারে হেলান দিয়ে আরাম করে বসলাম । মনে মনে ভাবলাম, আগামী কাল যেহেতু বন্ধ আছে। সেহেতু কিছুটা সময় না হোক বসা যাক । দেখা যাক,ও কি বলে । তাছাড়া এমনিতে ও বাসায় গিয়ে এক বই পড়া ছাড়া অন্যকিছু করার নেই। বিয়ে থা করিনি । তাই সাংসারিক ঝুট ঝামেলা নেই । মফস্বল শহরে আছি আজ প্রায় বছর খানেক হলো । একা থাকতে থাকতে অভ্যাস হয়ে গেছে ।
– সেলাম স্যার । দরজায় দাঁড়িয়ে এ কান ও কান হেসে জামাল মিয়া বিরাট করে সালাম দিলো ।
– আপাদমস্তক ওকে একবার দেখে নিয়ে আমি বললাম, ওলাই কুম আস সালাম, তা জামাল মিয়া, "এ অসময়ে কি মনে করে ?"
– স্যার, আপনাকে নিতে এলাম ।
জামালের কথা শুনে অবাক হয়ে, ভ্রু কুচকে ওর দিকে তাকিয়ে বললাম, নিতে এসেছো ! কোথায় ? কোথায় নিতে এসেছো ?
– ওমা স্যার এর মধ্যেই ভুলে গেছেন ? গত সপ্তাহে না আপনি বললেন, ভৌমিক বাড়ীতে যাবেন ! জামালের কথা শুনে আমি আরো অবাক হয়ে বললাম, ভৌমিক বাড়ি ! সেটা আবার কোথায় ? কি আবোল তাবোল বলছো জামাল?
জামাল গতানুগতিক ভাবে হেসে চেয়ার টেনে বসতে বসতে বলল, " বুঝেছি , স্যার সত্যি সত্যি ই ভুলে গেছেন । তারপর একটু এগিয়ে এসে অনেকটা ফিসফিস করে বলল, গত সপ্তাহে না আপনি বললেন, ভুত দেখতে যাবেন ।"
সঙ্গে সঙ্গে সব মনে পরে গেলো । আরে, তাই তো । গত সপ্তায় বিলে আমার সই নেবার সময় কি এক প্রসঙ্গে জামাল ভৌমিক বাড়ির ভুত নিয়ে কথা তুলে বলেছিল," ভৌমিক বাড়িতে নাকি এখনো ভুত আছে । গেলেই দেখা যায় । "
যেহেতু ভুত-প্রেত, আত্মা, প্রেত আত্মা বিশ্বাস করি না সেহেতু ওর কথায় মজা পেয়ে হেসে বলেছিলাম, তাই নাকি ? ঠিক আছে তবে , তোমার ভৌমিক বাড়িতে ভুত থাকলে একদিন এসে আমাকে নিয়ে যেও । ভুতের সঙ্গে বসে সুখ,দু:খের কথা বলে আসবো । অনেক দিন ভুত দেখার সাধ বুকের ভেতর লালন করে আছি । সেটাও মিটে যাবে ।
আমার ঠেস দেওয়া কথায় জামাল মিয়া একটু আহত হয়ে কিঞ্চিত ব্যথিত চোখে আমার দিকে তাকিয়ে মাথা নেড়ে নেড়ে বলেছিলো, "ঠিক আছে স্যার, আগামী সপ্তাহে এসে আপনাকে নিয়ে যাবনে । তখন কিন্তু মানা করতে পারবেন না ।"
আমি তখন হেসে বলেছিলাম , ঠিক আছে সে দেখা যাবে । কিন্তু সে সব তো ছিল কথার কথা।
– কি স্যার ভুতের কথা শুনতেই ভয় পেয়ে গেলেন নাকি ? আমাকে চুপ করে থাকতে দেখে জামাল মিয়া হেসে প্রশ্ন করলো ।
– না, ভয় পাবো কেন ? তুমি তো দেখছি বিষয়টা নিয়ে খুব সিরিয়াস জামাল ।
অবশ্যই সিরিয়াস স্যার । ১০০ পারসেন্ট সিরিয়াস । এখন আপনার সাহসে কুলালে আমার সাথে চলেন । এবার জামাল আমায় উল্টো ঠেস দিয়ে কথাটা বলল। টিট ফর ট্যাট । খোঁচা দিলে খোঁচা খেতে হয় । জামালের কথার খোঁচা আমার পৌরুষত্বে আঘাত করলো । নিজেকে সংযত করে ওর চোখের দিকে তাকিয়ে রাগত কণ্ঠে বললাম, তুমি কি সত্যিই যেতে চাইছ ?
– জি স্যার, সত্যিই যেতে চাইছি । অবশ্যই যাবো । এই জামাল যে, মিথ্যা বলে না সেটা ভুতের সঙ্গে বসে বাৎচিত করলেই বুঝতে পারবে। মিথ্যাবাদী লোক কখনো সখনো সত্য বলে ফেললে, সেটা সত্য প্রমাণের জন্য উঠে পড়ে লাগে । জামাল ও তাই করছে । আমি ওকে আর একটু খোঁচা দিয়ে বললাম, তা, তোমার ভুত কথাও বলে নাকি ? আমার কথায় জামাল আহত বাঘের মতো ফুসে উঠে বলল, "জি স্যার, "আমার ভূতের, কাউকে পছন্দ হয়ে গেলে তার সঙ্গে কথা,বার্তা বলে শুনেছি । আর পছন্দ না হইলে চড় থাপ্পড় দিয়া বের কইরা দেয়।"
– কি সব আবোল তাবোল বলছ ? মাথাটা কি গেছে নাকি ? আমি জামালের কথায় নড়েচড়ে বসলাম ।
– আবোল-তাবোল না স্যার। চলেন নিজে চোখে দেখে আসবেন । মিথ্যা বললে, আপনার জুতা আমার গাল ।
আমি মনে মনে ঠিক করে ফেললাম জামাল মিয়ার সঙ্গে গেলে মন্দ হয় না । যেহেতু আগামী কাল শুক্রবার । অফিসের ঝামেলা নেই সেহেতু গিয়ে দেখা যাক না, ব্যাটা আসলে কি দেখাতে চাচ্ছে ।
– ঠিক আছে জামাল, আমি যাবো তোমার সাথে । এখন বলো কোথায় যেতে হবে ?
– আপনি সত্যিই যাবেন স্যার ? আমার কথা শুনে জামালের চোখ দু'টো যেন চকচক করে উঠলো ।
– অবশ্যই যাবো । তা, এখান থেকে কতো দূর তোমার ভৌমিক বাড়ি ?
– দূর আছে স্যার । দু ক্রোশ হতো হবেই । এখনই রওনা দিলে ১১টা, ১২ নাগাদ পৌঁছে যাওয়া যাবে ।
– বল কি, তা হলে তো বেশ দূরের রাস্তা ? এতো রাতে গিয়ে কি কিছু দেখা যাবে ?
– ভুত দেখার জন্য তো গভীর রাতই আদর্শ স্যার । জামাল মিয়া খ্যাঁক খ্যাঁক করে শেয়ালের মতো হেসে উঠলো ।
– তোমায় দেখে তো মনে হচ্ছে খুব মজা পাচ্ছে জামাল ?
– মজা ! মজা তো কিছুটা পাচ্ছি ই স্যার । আপনাদের মতো শহুরে মানুষের ধারণা আমাদের মতো জামাল মিয়ারা সারাক্ষণ মিথ্যা কথা বলে বেড়ায় । আজ ভৌমিক বাড়ি গিয়ে ভুতের কবলে পরে যখন হাউমাউ করে কাঁদবেন তখন এই জামাল মিয়াই আপনাকে উদ্ধার করতে এগিয়ে যাবে স্যার ।
– ঠিক আছে , ঠিক আসে সে দেখা যাবে । তাহলে এখন চলো যাওয়া যাক ।
– শিতের কাপড় নিতে হবে স্যার । রাতে খুব ঠাণ্ডা পরে । জামাল চেয়ার ছেড়ে উঠতে উঠতে বলল ।
– যাবার সময় বাসা থেকে নিয়ে যাবো ।
– ঠিক আছে স্যার, তাহলে চলেন জামাল হেসে বলল ।
এমন সময় নয়ন এসে দরজার দাড়িয়ে বলল, স্যার আমিও যাবো আপনার সঙ্গে । ওকে দেখে বুঝলাম, দরজার ওপাশে দাড়িয়ে নয়ন এতক্ষণ আমাদের কথা শুনছিলো ।
– তুমি ও যেতে চাও ?
আমি নয়নের দিকে তাকিয়ে কথাটা বলে, জামালের দিকে তাকিয়ে বললাম, কি জামাল নয়ন গেলে কোন অসুবিধা হবে না তো ?
না স্যার, অসুবিধা আবার কি । যেতে যখন চাইছে, তখন চলুক । জামাল যে অনিচ্ছা সত্ত্বেও সম্মতি দিলো। সেটা ওর বলার ধরন দেখেই বেশ স্পষ্টতই বুঝা গেল ।
- তা হলে, যাও নয়ন । তাড়াতাড়ি রেডি হয়ে নাও । বেশি করে শীতের কাপড় পরে নিয়ো । অনেকটা পথ যেতে হবে । বেশ ঠাণ্ডা পরবে বলে মনে হচ্ছে ।
– জী স্যার,আমি তৈরি হয়ে নিচ্ছি । বলেই নয়ন চট করে বের হয়ে গেল ।
– আমিও তাহলে একটু বাথরুম থেকে ঘুরে আসি কি বলেন স্যার ? জামাল খ্যাঁক খ্যাঁক করে হেসে বলল ।
– যাও । বলে আমি ড্রয়ার থেকে মোবাইল আর মানিব্যাগ বের করে পকেটে নিলাম । মনের ভেতর কেমন যেন একটু অস্বস্তি লাগতে শুরু করেছে । আমার অবচেতন মন বারংবার আমাকে যেতে নিষেধ করছে । বিষয়টাকে পাত্তা দিতে চাইলাম না । ফুস করে নিশ্বাস ছেড়ে আপন মনেই বললাম, "বনের বাঘে খায় না , মনের বাঘে খায় ।"
ঠিক সে সময় শরীরে লাল রংয়ের একটা সোয়েটার চাপিয়ে নয়ন রুমে এসে ঢুকল।
ওকে দেখে ভ্রু নাচিয়ে আমি জিজ্ঞাসা করলাম , কি রেডি ?
– নয়ন মাথা নেড়ে উত্তর দিলো, জি স্যার, আমি রেডি । তবে একটা কথা আছে স্যার ।
– কি কথা,বলে ফেলো ?
– স্যার, জামাল মিয়ার সঙ্গে যাওয়াটা কি ঠিক হবে ? লোকটা কিন্তু সুবিধার না ।
– এর মধ্যে তুমি আবার বেঠিকের কি দেখলে ?
– চারদিকে ওর কিন্তু বড্ড দুর্নাম স্যার । কেউ ওকে খুব একটা পছন্দ করে না। নেশা, পানিও করে শুনেছি।
– ভয় নেই নয়ন । জামাল অনেক বছর যাবত আমাদের সঙ্গে কাজ করছে । তাই, আমাদের ক্ষতি হবে, এমন কোন কাজ ও কখনো করবে না । ওর উপরে সে বিশ্বাস আমার রয়েছে । তারপর একটু থেমে বললাম, গত সপ্তাহে কথা প্রসঙ্গে আমি ওকে বলেছিলাম ভুত বলে কিছু নেই। ও বলেছিল আছে । এখন সেটাই প্রমাণ করতে আমাকে নিয়ে যেতে চাইছে ।
– কোথায় নিয়ে যাচ্ছে স্যার ?
– কোন এক, ভৌমিক বাড়ি ।
আমার জবাব শুনে নয়ন প্রায় চিৎকার করে উঠলো, "নিশি ভৌমিকের বাড়ি স্যার?"
নয়ন'কে চমকে উঠতে দেখে কিছুটা অবাক হয়ে, মাথা নেড়ে বললাম,হ্যা সেরকম ই তো বলল। কেন, তুমি চেন নাকি জায়গাটা ?
– চিনি স্যার। খুব ভাল করে চিনি । ওখানে নিশি ভৌমিকের কোন বাড়ীটারি নেই স্যার। একটা ছাড়া মাঠ আর কয়েক'টা ভাঙ্গা দেয়ালের অংশ ছাড়া কিছুই নেই ওখানে। জায়গাটাও ভালো না স্যার। লোকজন খুব একটা যায় না ওদিকে ।
– বল কি! কোন বাড়ি নেই ? আমি বেশ অবাক হলাম।
– জ্বি স্যার, কিচ্ছু নেই ওখানে। আমি নিজের চোখে দেখে এসেছি, তবে .............
নয়ন কথা শেষ করতে পারলো না । এমন সময় জামাল রুমের ভেতরে ঢুকতে ঢুকতে বলল, "দেখার জন্য চোখের দরকার হয় নয়ন মিয়া । তোমার সেই চোখ নাই । তাই কিছু দেখো নাই। চোখ থাকলে ঠিক ই দেখতে পেতে। "
জামাল কথাটা যেন, স্রেফ মজা করার জন্য বলেছে। সেটা বুঝাবার জন্য খেঁক খেঁক খেঁক করে হাসতে লাগলো।
নয়ন প্রতিবাদ করে বলে উঠলো, "আমি নিজের চোখে দেখে এসেছি। কোন বাড়ি, ঘর নেই ওখানে।
– আছে, কি নাই। সেইটা তো গেলেই দেখন যাইবো । কি বলেন স্যার ? ধূর্ত জামাল কথাটা বলে আমার দিক তাকাল সমর্থন লাভের আশায় ।
আমি আমতা আমতা করে বললাম, তা তো ঠিকই। গিয়ে দেখলেই বুঝা যাবে, কি আছে , আর কি নেই ।
– তাহলে আর দেরি কইরেন না স্যার । চলেন, চলেন তাড়াতাড়ি বের হয়ে পরি । আমি চেয়ার থেকে উঠে দাড়াতে দাড়াতে বললাম, চলো তাহলে।
– স্যার, টর্চটা নিয়ে নেই ? নয়ন আমার মুখের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞাসা করলো।
– টর্চ লাগবো কেন ? আমি কিছু বলার আগেই জামাল খেঁকিয়ে উঠে বলল ।
– টর্চ থাকলে নিয়ে নাও । গ্রামের অন্ধকারাচ্ছন্ন পথ,ঘাট সঙ্গে টর্চ থাকলে তো ভালই হবে। আমার সম্মতি পেয়ে নয়ন জামালের দিকে তাকিয়ে একটা হাসি দিয়ে টর্চ আনতে ছুটলো । জামাল আর কিছু না বলে দরজা দিয়ে বের হয়ে গেলো ।
দুই.
অফিস থেকে বের হয়ে প্রায় ঘণ্টা দু’য়ে-ক ভ্যান আর হাঁটার পর আমরা একটা নদীর ঘাটে এসে দাঁড়ালাম । সন্ধ্যা পেরিয়ে গেছে অনেকক্ষণ । গ্রাম, গঞ্জে সন্ধ্যা রাতকেই গভীর রাত বলে মনে হয় । হাত ঘড়ি দেখলাম পৌনে আটটা বাজে । খুব একটা ঠাণ্ডা না লাগলেও বেশ কুয়াশা পরেছে। নদীটার অবস্থাও মরো মরো । শুকোতে শুকোতে গলা পানিতে গিয়ে ঠেকেছে । এটাই উত্তর বঙ্গের বিখ্যাত "কালনী নদী ।" বর্ষায় ফুলে ফেঁপে উর্বশী হয়ে উঠলেও শীতকালে বয়স্ক মানুষের ঝুলে পরা চামড়ার মতো চুপসে যায় ।
নদীর ঢাল বেয়ে নেমে ঘাট থেকে কিছুটা দূরে হাঁটু পানিতে অন্ধকারে একটা লোককে মাছ ধরতে দেখলাম । কুয়াশার চাদর ভেদ করে লোকটার পেছনের অংশটুকু আবছা দেখা যাচ্ছে । গ্রামে এটা খুবই স্বাভাবিক দৃশ্য । কিন্তু অন্ধকার, খালি শরীরে লোকটাকে দেখে বেশ অবাক হলাম । শীতের রাত্রিরে এভাবে কেউ মাছ ধরে নাকি ? কথাটা নিজের মনে মনেই বললাম । কিন্তু আমার সেই মনের কথা , কিভাবে যেন বুঝতে পেরে , জামাল পাশ থেকে বলল,"ধরে স্যার, ধরে। পেটে ক্ষুধা থাকলে মানুষ সবই করে, সবই ধরে।"
রওনা হবার পর জামাল কথাবার্তা খুব একটা বলেনি । আপন মনে নিমগ্ন থেকে পথ দেখিয়ে নিয়ে এসেছে । হঠাৎ ওর নিজ থেকে কথা বলে উঠায় আমি ওর দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞাসা করলাম, আর কতো দূর ?
– এই তো এসে পরেছি স্যার। নদীটা পেরিয়ে কিছুটা গেলেই ভৌমিক বাড়ি ।
– তা, নদীটা পারাবো কি করে? কোন নৌকা টোকা তো দেখছি না ।
নৌকা আছে স্যার, অবশ্যই আছে । কালনী কখনো কাউকে ফিরিয়ে দেয় না । কথাটা শেষ করেই, জামাল দু হাতে তালি দিয়ে হাঁক দিয়ে বলল, "এই কে আছো মাঝি ? ভৌমিক বাড়ি যামু। আছোনি কেউ ? মাঝি ও মাঝি । ভৌমিক বাড়ি যাবো নিয়ে যাও । "
নদীর ঘাটে আসার পর থেকে একটা বিষয় খেয়াল করেছি, নয়ন আমার শরীরের সঙ্গে শরীর ঘেঁষে দাড়িয়ে আছে। বুঝতে পারছি , অজানা কোন কিছুর শঙ্কায় বেশ ভয় পাচ্ছে । আমি ওর দিকে তাকিয়ে একটু সরে যেতে ও আমার দিকে তাকিয়ে ,কানের কাছে মুখ এনে ফিসফিস করে বলল, "স্যার চলেন ফিরে যাই। দিনের বেলায় একদিন এসে ভৌমিক বাড়ি দেখে যাবো ।
– কেন ভয় খাইছোনি ? জামাল নয়নের উদ্দেশ্যে কথাটা বলেই খ্যাঁকখ্যাঁক করে হেসে উঠল । ওর এই হাসির ধরনটা আমার কাছে অনেকক্ষন যাবৎ অসহ্য লাগছে । তবে আমি কিছু বলার আগেই দেখলাম অন্ধকারের ভেতর থেকে একটা ডিঙ্গি নৌকা এসে ঘাটে ভিড়ল।
– চলেন স্যার,চলেন ওই যে নৌকা এসে গেছে । বলেই জামাল প্রায় দৌড়ে গিয়ে নৌকায় উঠল । আমি ওর পেছন পেছন গেলাম। নয়ন যেন অনেকটা অনিচ্ছা স্বত্বে এসে নৌকায় আমার পাশে দাঁড়াল ।
নৌকায় উঠার সময় নদীতে মাছ ধরতে থাকা লোকটাকে আরো কাছ থেকে দেখতে পেলাম । লোকটার শরীরে কোন কাপড় নেই । কোমরের নীচে ধূতির মতো কিছু একটা জড়িয়ে রেখেছে । রুগ্ন ছিপছিপে কালো শরীরটা যেন প্রাচীন অশ্বথের শিকড়ের মতো মুচড়ে আছে । শুকনো কাঠির মতো লকেলকে হাত দু'টো লোকটা ঝপাৎ ঝপাৎ শব্দ করে করে পানিতে ডুবিয়ে দিচ্ছে আর একটু পর পর তুলে আনছে মাছ । লোকটার মাছ ধরার দক্ষতা দেখে অবাক না হয়ে পারলাম না ।
মন স্থির করে ফেললাম ফেরার সময় লোকটা যদি থাকে তাহলে কিছু মাছ কিনে নিয়ে যাবো । ঠিক সে সময়ই নাকে মাছের আঁশটে গন্ধ এসে লাগল । আমি নাক কুচকে এদিক সেদিক তাকালাম । জামাল আমাকে দেখে ব্যাপারটা বুঝতে পারে ইশারায় মাঝির সামনে নৌকার খলইটা দেখিয়ে দিলো । সেখানে তাকাতেই দেখি, সাদা সাদা কয়েক'টা মাছ ছটফট করতে করতে লাফাচ্ছে । মাছগুলো দেখে আমি বেশ অবাক হলাম । নৌকায় উঠার সময়ও তো ওখানে মাছগুলো ছিলো না । তাহলে এখন এলো কোথা থেকে?
– এরা স্যার, মাছ’টাচ ধরেই দিন কাটায় । আমি কিছু বলার আগেই জামাল বলে উঠল । লোকটার পাশ দিয়ে যাবার সময় সে আমার দিকে তাকিয়ে পাণ্ডুর হাসি হাসলো । রক্তশূন্য,ফেকাসে মুখের সে হাসিতে আমার ভেতরটা যেন এক মুহূর্তের জন্য কেঁপে উঠল । সহ্য করতে না পেরে আমি চোখ সরিয়ে নিলাম ।
নদীটা পাড় হতে খুব একটা সময় লাগল না । কোন রকম শব্দ না করে বৈঠা চালিয়ে মাঝি আমাদের এপারে নামিয়ে দিয়ে অন্ধকারে মিশে গেল । জামালের পেছন পেছন আমরা হাঁটতে লাগলাম । কারো মুখে কোন কথা নেই । সবাই একরকম নি:শব্দে হাঁটছি ।
নদীর এ পাড়ের গ্রামটা যেন অতিমাত্রায় নির্জন । চারিদিকে গাছ পালা ছাড়া জনমানবের কোন চিহ্ন দেখা যাচ্ছে না । শীতটা যেন হঠাৎ করেই ঝাঁকিয়ে বসেছে । আমি হাত দু’টো প্যান্টর পকেটে ঢুকিয়ে রেখেছি । সুরু রাস্তা ধরে হাটতে হাটতে নদী থেকে অনেকটা সরে এসে একটা খোলা জায়গায় আসতেই খালি গায়ে একটা লোককে রাস্তার ঠিক মাঝখানে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখলাম ।
লোকটার এক হাতে কয়েকটা মাছ ঝুলছে । কাছাকাছি আসতেই লোকটাকে দেখে আমি অবাক হয়ে গেলাম । আরে এটা তো সেই লোক । যাকে নদীর ওপারে মাছ ধরতে দেখে এলাম । সে কি করে আমাদের আগে এখানে এসে উপস্থিত হলো, এটা কি করে সম্ভব ?
ব্যাপারটা অন্যদের বুঝতে না দিয়ে চুপচাপ হাঁটার সিদ্ধান্ত নিলাম । লোকটাকে অতিক্রম করে যাবার সময় সে আমাদের পথ আগলে দাড়িয়ে, মাছ ধরা হাতটা আমার মুখের সামনে তুলে ধরে বলল, "মাছ নেবেন বাবু, মাছ নেবেন,মাছ ? একদম টাটকা মাছ। এইমাত্র জল থেকে তুলে এনেছি ।"
লোকটার বলার মধ্যে এমন কিছু একটা ছিল, আমি চমকে উঠে পিছিয়ে এলাম । শরীরটা মনে হলো ঝাঁকি দিয়ে উঠলো । জামাল চট করে পেছন থেকে আমার সামনে এসে দাড়িয়ে লোকটার উদ্দেশ্যে বলল, যা, যা , ভাগ, ভাগ, ভাগ এখান থেকে ।
কিন্তু কে, শুনে কার কথা । লোকটা একেবারে নাছরবান্ধা । আমার পেছন পেছন আসতে আসতে বলল, "নেন না বাবু, নেন না একটা মাছ । কালীন নদীর টাটকা মাছ ! নেন না বাবু, নেন না।"
জামাল এবার রুখে দাড়িয়ে বলল, যা ভাগ, ভাগ বলছি । তারপর আমার হাত ধরে টান দিয়ে বলল, স্যার, আপনি আসুন আমার সঙ্গে। এরপরেও লোকটা অনেকটা পথ আমাদের পিছু পিছু এসে একসময় অন্ধকারে মিলিয়ে গেল। কত সামান্য একটা ঘটনা অথচ সবাই বেশ ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম দেখে এখন নিজের মনেই হেসে উঠলাম।
আরও ঘণ্টা খানেক হাটার পর বিশাল এক মাঠের শেষ প্রান্তে একটা বাড়ির সামনে এসে দাঁড়ালাম । বাড়ি না বলে ছোট খাটো একটা প্রাসাদ বলাই ভাল। নিকষকালো অন্ধকারের মাঝে দানবের মতো মাথা তুলে দাঁড়িয়ে আছে। বাড়িটা দেখা যেতেই , জামাল আমার পাশে এসে বলল, এই যে স্যার, এসে পড়েছি । এটাই হচ্ছে, আপনার সেই "নিশি ভৌমিকের বাড়ি ।"
জামালের কথা শেষ না হতেই , নয়ন আমার গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে বলল, "স্যার ওখানে কয়েক দিন আগেও কোন বাড়ি ছিলো না । আমরা যা দেখছি সেটা চোখের ভুল ছাড়া আর কিছুই না। এখনো সময় আছে স্যার, চলুন ফিরে যাই। অনর্থক বিপদে পরার কোন মানে হয় না । "
নয়নের কথায় এবার আমি বেশ বিরক্ত হলাম ।
চোখের সামনে জল জ্যান্ত একটা বাড়ি দেখেও কি সব আবোলতাবোল বকছে । বিরক্তিটা চেপে রেখে বললাম, পাগলের মতো কথা বলো না তো, নয়ন? দেখতে পাচ্ছ না কতো বড় একটা বাড়ি দাঁড়িয়ে আছে ? নয়ন এবার
হাত, পা নেড়ে প্রতিবাদ করে বলল, "আমার কথা বিশ্বাস করেন স্যার, যা দেখছেন সব চোখের ভুল । মায়া , মরীচিকা ।"
– এতো বড় বাড়িটাকেও তোমার চোখের ভুল,মায়া,মরীচিকা বলে মনে হচ্ছে ? তোমার তো দেখি চশমা লাগবে ।
কথাটা বলে জামালের দিকে দেখি সেও অবাক হয়ে বড় বড় চোখ করে বাড়িটার দিকে তাকিয়ে আছে । হঠাৎ কেন যেন আমার ভেতরটা কেঁপে কেঁপে উঠলো। মনে হলো, শরীরের পোশাক, চামড়া ভেদ করে হাড়ের ভেতর পর্যন্ত শীত ঢুকে পরেছে । থরথর করে কেপে উঠলাম।
জামাল আমার দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসি হাসে বলল, "স্যার, যান ভেতর থেকে ঘুরে আসেন ।"
জামালের কথায় আমি ভয় পেয়ে গেলাম । টের পেলাম মাথার চুলগুলো একটা একটা করে দাঁড়িয়ে যাচ্ছে । দু'হাত ঘষতে ঘষতে বললাম, " তুমি যাবে না ?"
– না স্যার, আমি যাবো না । তেনারা আমারে পছন্দ করেন না ।
– আপনি যান । দেখা সাক্ষাৎ করে আসেন ।
এবার নয়নের দিকে তাকিয়ে বললাম, কি নয়ন, তুমি যাবে তো ?
মনে মনে ভয় পাচ্ছিলাম এই ভেবে যে, নয়ন ও হয়তো না বলবে । কিন্তু আমাকে অবাক করে দিয়ে, সে বলল, চলেন স্যার । নয়ন রাজি হতেই চলো বলে, পা বাড়ালাম ।
বাড়ির দেয়ালটা দেখে বোঝা যায় এক সময় কি যত্ন করে তৈরি করা হয়েছিল । শক্ত ইটের গাঁথুনির মাঝে প্রাচীন শিল্পের কারুকার্য করা । কালের বির্বতনে খসে যাচ্ছে সব । বাড়ির ভেতরে পা রাখতেই শরীরের ভেতরটা যেন ক্যামন করে উঠলো । অজানা নানা আশংকায় কেপে কেপে উঠতে লাগলো পুরো শরীর । মনে হতে লাগলো , সত্যিই অপার্থিব কিছু লুকিয়ে রয়েছে এ বাড়ির প্রতিটি অংশে।
অন্ধকার অনেকটা চোখে সয়ে এসেছে । নয়ন এর হাতে জ্বলতে থাকা টর্চের আলোয় বাকিটুকু অন্ধকারও দূর করে দিচ্ছিল । আমি ঘড়ি দেখলাম, সেই পৌনে আটটা বাজে । বুঝতে পারলাম ঘড়িটা কি নষ্ট হয়ে গেছে । একটু আগেও পৌনে আটটাই দেখেছি ।
বাড়ির সীমানা প্রাচীরের ভেতর থেকে সরু একটা পথ একে বেকে চলে গেছে বাড়ির ভেতরের দিকে । সেটা ধরে হাটতে হাটতে আমরা অনেকটা ভেতরে চলে এলাম । নিঝুম, নিশুতি রাত । চারপাশে ঘা ছমছম করা একটা পরিবেশ । যতই এগুচ্ছি অন্ধকারটা যেন গুটিগুটি পায়ে এগিয়ে এসে আমাদের জড়িয়ে ধরতে চাইছে । চারপাশে চোখ বুলাতে বুলাতে সর্তক ভাবে হাঁটছি । নিজেদের হাটার মচর মচর শব্দ ছাড়া আর কোন শব্দ নেই ।
মাঝে মাঝে সরসর শব্দ করে এপাশ ওপাশ হতে কোন প্রাণী দৈড়ে যাচ্ছে । তাতে বেশ ভয় ভয় লাগছে । সাপ, টাপ হবে হয়তো । সাপ চলাচলের সময় এরকম সরসর শব্দ হয় । যে প্রাচীন বাড়ি, তাতে সাপ থাকাটা অস্বাভাবিক কিছু না ।
নয়ন আমার শরীরের সঙ্গে শরীর ঘেঁষে ঘেঁষে হাঁটছে । আরো কিছুটা এগুবার পর নয়ন ফিসফিস করে বলল, "স্যার আমার ক্যামন ভয় ভয় লাগছে ।"
– আমি বললাম, ভয়ের কিছু নাই । হাটতে থাকো । যা হবার হবে । চল ভেতরটা দেখে আসি ।
– স্যার, এ জায়গাটার খুব বদনাম আছে শুনেছি । নয়নের কণ্ঠ কেপে কেপে উঠছে ।
– শুনাতে কিছু আসে যায় না, নয়ন । জগতে দেখার মাঝেই সবকিছু। এখন চলো ভেতরে যাই ।
কথাগুলো নয়নের উদ্দেশ্যে বললেও ভেতরে ভেতরে যেন নিজেরই সাহস যোগাচ্ছিলাম । পেছন ফিরে দেখলাম জামাল বুকের উপর দু’হাত রেখে অদ্ভুত ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে আছে। আমাকে তাকাতে দেখে কেমন বিশ্রী ভাবে হাসল ।
আমি চোখ সরিয়ে নিয়ে সামনের দিকে হাঁটতে লাগলাম । নয়ন আবার আমার গাঁ ঘেঁষে ঘেঁষে হাটছে । বাড়ির প্রাচীরটা পেছনে ফেলে এসে মূল বাড়ির ভেতরে ঢুকার সিঁড়িতে পা রাখার সঙ্গে সঙ্গে নয়নের হাতে থাকা টর্চটা নিভে গেল ।
-কি হল ? টর্চ নেভালে কেন ? আমি প্রায় চিৎকার করে উঠলাম ।
নয়ন বলল, "স্যার আমি নিভাইনি । টর্চ আপনা আপনিই নিভে গেছে ।"
নিভে গেলে আবার জ্বালাও ।
চেষ্টা করছি কিন্তু জ্বলছে না স্যার ।
– জ্বলছে না কেন ? ব্যাটার নেই ? ব্যাটারি চেক করো ।
– নতুন ব্যাটারি স্যার, গতকালই কিনে লাগিয়েছি ।
তাহলে জ্বলছে না কেন ? জ্বালাও চেষ্ঠা করো । আমার তাড়া খেয়ে নয়ন টর্চটা মোচড়াতে মোচড়াতে ঠিক করার চেষ্টা করলো। কিন্তু পারল না ।
অগত্যা টর্চের আলো ছাড়াই আমরা বাড়ির ভেতরে ঢুকে পড়লাম ।
দম বন্ধ গুমোট একটা বাতাস এসে চোখে মুখে লাগল । চারপাশে পোড়া, পোড়া গন্ধ । চামড়া পোড়ালে যেমন গন্ধ হয় অনেকটা সে রকম । সদর দরজা দিয়ে ভেতরে ঢুকে বড় একটা কামড়ায় এসে দাঁড়ালাম । আবছা আলোয় চারপাশের দেয়ালগুলোকে কালো কালো ক্ষত বলে মনে হচ্ছে । মনে হচ্ছে , শত শত অশরীরী আত্মা এসে আমাদের চারপাশ থেকে ঘিরে ধরেছে । আমাদের পায়ে পায়ে হাঁটছে তারা । ওত পেতে আছে । সুযোগ পেলেই মটকে দেবে ঘাড় ।
নয়ন আরো কয়েক'বার টর্চটা হাতের তালুতে ঝাঁকাতেই জ্বলে উঠলো । তবে সে আলোয় তীব্রতা নেই । কোন রকম নিভু নিভু হয়ে জ্বলছে । তবুও সেটা কাজ চলে যাবার জন্য যথেষ্ট । আমি ভূতের ভয়ের চেয়েও সাপের ভয়ে কুঁকড়ে আছি । নয়নের কাঁধে হাত রেখে খুব সাবধানে দেখে দেখে পা ফেলে ভেতরের দিকে অগ্রসর হচ্ছি ।
হঠাৎ বাড়ির ভেতর থেকে কাসার শব্দের সঙ্গে ঢাকে'র ঘুরুম ঘুরুম শব্দ ভেসে এলো । খুব ক্ষীণ সে শব্দ । ভাল করে কান না পাতলে শোনা যায় না । দাড়িয়ে খুব মনোযোগ দিয়ে শব্দটা শোনার চেষ্ঠা করে নয়নের দিকে তাকালাম । নয়নও তাকালো আমার দিকে ।
- কিছু কি শুনতে পাচ্ছ ?
নয়ন মাথা নেড়ে বলল, "হ্যা স্যার শুনতে পারছি, মনে হচ্ছে দূরে কোথাও বাদ্য বাজছে।"
– ঠিকই শুনেছ । কিন্তু এখানে বাদ্য বাজাবে কে ? চলো ওই পাশটায় গিয়ে দেখি । কথাটা বলে নয়নের জন্য অপেক্ষা না করে হাঁটতে লাগলাম ।
শরীরটা ছমছম করছে । মনে হচ্ছে, শরীরের ওজন কয়েক মন বেড়ে গেছে । পুরো শরীর ঠাণ্ডায় জমে বরফ হয়ে যাচ্ছে । দাঁতের সঙ্গে দাঁত বারি খাওয়ার শব্দ শুনতে পাচ্ছি ।
ঠিক সে সময় খুব কাছ থেকে স্পষ্ট মেয়েলি হাসির শব্দ ভেসে এলো। আমরা চমকে উঠলাম থমকে দাঁড়ালাম। কয়েক মুহূর্ত নিস্তব্ধতা নেমে এলো । তারপরেই খিল খিল হাসির হিল্লোল তুলে হুট করে একটি মেয়ে দৌড়ে আমাদের সামনে এসে দাঁড়িয়ে পড়লো। আবছা অন্ধকারে হতবাক হয়ে আমরা তার দিকে তাকিয়ে রইলাম। সে আমাদেরকে অবাক হয়ে দেখতে লাগলো । মুহূর্ত কাল পর ঠোটের কোণে হালকা হাসির রেখা ফুটিয়ে নূপুরের ছনছন,চুড়ির মর্মর শব্দ ছড়িয়ে মেয়েটি দৌড়ে চলে গেল অন্দর মহলের দিকে । ঘটনার আকস্মিকতায় চমকে গিয়ে ভয়ে, আতংকে আমি আর নয়ন কাঠ পুতুলের মতো ঠায় দাড়িয়ে রইলাম।
একটু স্থির হয়ে, কাপাকাপা কণ্ঠে নয়ন বলল, "স্যার, উনিই মনে হচ্ছে,নিশি ভৌমিক ।"
– নিশি ভৌমিক! সে কে ? আমি ফিসফিস করেই প্রশ্ন করলাম ।
– তিনি ছিলেন, উত্তর বঙ্গের জমিদার "নারায়ণ ভৌমিক এর ছোট বউ ।"
– তাই নাকি ?
– জী স্যার , ওনাকেই নাকি এ বাড়িতে দেখা যায় ।
– আজ আমরাও দেখলাম । কথাটা বলতে গিয়ে বুঝতে পারছি গলা শুকিয়ে গেছে । এই শীতের রাত্রিরেও পানির পিপাসায় ভেতরটা ছটফট করে উঠলো । লক্ষ্য করে দেখলাম হাত, পাগুলো ঠকঠক করে কাঁপছে। তবে সেটা শীতের দাপটে না ভুতের ভয়ে বুঝতে পারলাম না ।
– স্যার, নিশি ভৌমিক'কে নায়ায়ন ভৌমিক মেরে ফেলেছিলেন ।
– বল কি ? খুন ?
– জী স্যার, তেমনটাই শুনা যায় । নয়ন তার কথা শেষ হতে পারলো না হঠাৎ ঘরের দরজা, জানালাগুলো ধুমধাম শব্দ করে আপনা আপনি একবার খুলে যেতে লাগলো আবার বন্ধ হতে লাগলো । প্রচণ্ড শব্দে চমকে উঠে আমরা হিস্টিরিয়ায় আক্রান্ত রোগীর মতো চিৎকার করে উঠলাম । মনে হল দৌড় দিয়ে পালিয়ে যাই এই প্রেতপুরী হতে ।
নয়ন কিছু একটা বলতে গিয়েও বলতে পারলাম না । কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম । এক সময় শব্দটা কমতে কমতে একেবারে থেমে গেল । নয়ন বলল," স্যার চলেন এখান থেকে বের হয়ে যাই ।
আমি আর আপত্তি তুললাম না । যেটুক অভিজ্ঞতা হয়েছে সেটাই যথেষ্ট । কোন রকম সামলে নিয়ে বলতে যাচ্ছিলাম, চলো ফিরে যাই । এমন সময় কান্নার শব্দ শুনতে পেলাম । কে যেন গুমরে গুমরে বিলাপ করছে। গগন বিদারী সেই বিলাপের প্রতিটি শব্দ হৃদয়ে গিয়ে আঘাত করলো ।
আমি ব্যগ্র হয়ে চিৎকার করে বলে উঠলাম, "কে কাঁদে ? কে কাঁদে ?
নয়ন আমার চিৎকারে হতবিহবল হয়ে আমার হাত টেনে ধরে বলল, "স্যার, চলুন ফিরে যাই । "
আমি ওর ধরে থাকা হাতটা ঝামটা দিয়ে ছাড়িয়ে দিয়ে বললাম, "দাঁড়াও, আগে দেখি নেই কে কাঁদে ?
তারপর কান্নার শব্দ অনুসরণ করে দৌড়ে গিয়ে দাঁড়ালাম, দরজা বন্ধ করা এক ঘরের কাছে । মেহগনি কাঠের ভারি দরজা ভেদ করে ভেতর থেকে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কান্নার শব্দ ভেসে আসছে।
হঠাৎ আমার ভয়,ডর, অনুভূতি সব যেন লোপ পেলো । ব্যাকুল হয়ে উঠলাম ভেতরে যে কাঁদছে তাকে দেখার জন্য । দরজা খুলে ফেলার জন্য শরীরের সব শক্তি দিয়ে বন্ধ দরজায় আঘাত করতে লাগলাম। কিন্তু ভারী দরজার এক চুলও নাড়াতে পারলাম না । উষ্মাদের মতো চিৎকার করতে লাগলাম , দরজা খুলো , দরজা খুলো । আমি তোমাকে উদ্ধার করতে এসেছি তোমাকে , দরজা খোলো। দরজা খোলো ।
আমাকে অপ্রাকৃত গ্রস্তের মতো আচরণ করতে দেখে নয়ন দৌড়ে এসে আমার হাত খামছে ধরে টান দিলো । আমি রক্তাক্ত চোখে ওর দিকে তাকিয়ে বললাম, "কি? কি হয়েছে তোর ?"
নয়ন তখন আঙুল দিয়ে অন্যপাশের একটা দরজা দেখিয়ে দিলো।
সেদিকে তাকিয়ে আমি চমকে উঠলাম । দরজায় সাদা শাড়ি পরা অল্প বয়সী এক নারী দাঁড়িয়ে আছে । মুখে লেগে থাকা আলতো হাসিটুকু না থাকলে আমি জ্ঞান হারিয়ে পরে যেতাম । বুকের ভেতরটা হাপরের মতো লাফাচ্ছে ।মনে হচ্ছে, হৃৎপিণ্ডটা মুখ দিয়ে বের হয়ে যাবে । প্রাণ পণ নিজেকে শান্ত রাখার চেষ্টা করে ও ব্যর্থ হচ্ছি । মনে হচ্ছে, কেউ যেন একটু একটু করে আমার নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নিচ্ছে ।
আমি অপলক দৃষ্টিতে মেয়েটির দিকে তাকিয়ে আছি । আমার সঙ্গে চোখা চোখি হতেই ছনছন ছনছন নূপুরের শব্দ তুলে মেয়েটি দৌড়ে আবার ভেতরের দিকে চলে গেল । আমিও ছুটলাম তার পিছু পিছু । নয়ন আমাকে আঁকড়ে ধরে থামাতে চাইলো । কিন্তু পারল না । নূপুরের শব্দ অনুসরণ করে এ ঘর ও ঘর ছুটে বেড়াতে লাগলাম । কিন্তু মেয়েটাকে কোথাও দেখতে পেলাম না । শুধু নূপুরের ছন ছন শব্দ আর হাসির খিলখিল শব্দ দেয়ালে দেয়ালে প্রতিধ্বনিত হয়ে টেনে নিয়ে চললো আমাকে।
ছুটতে ছুটতে খোলা একটা বারান্দায় আসতেই মোটা, কালো একটা লোকের সঙ্গে ধাক্কা খেয়ে প্রায় পরে যাচ্ছিলা। দেয়াল ধরে নিজেকে সামলে নিয়ে লোকটার দিকে তাকিয়ে দেখি সে আঙুল উচিয়ে বারান্দার শেষ মাথায় একটা দরজা দেখিয়ে দিয়ে বলল, "ওই দিকে যান বাবু।" আমি কোন প্রশ্ন না করে তার দেখিয়ে দেওয়া দরজা বরাবর ছুটলাম । মেয়েটি'কে দেখার জন্য আমার ভেতরটা তখন ছটফট করছে । পৃথিবীর যে কোন কিছুর বিনিময় আমি তার মুখটি আর একবার দেখতে চাই । নিশি! নিশি ভৌমিক ................নিশি ভৌমিক । তোমার একটি বার আমাকে দেখতেই হবে ।
ঘরটাতে ঢুকেই আমি চমকে উঠলাম । সঙ্গে সঙ্গে মনে হলো ঘোর কেটে গিয়ে মাথাটা পরিস্কার হয়ে গেলো । ঘরে মাঝখানে গোল হয়ে কয়েকজন ষণ্ডা মার্কা লোক দাঁড়িয়ে আছে। দু’জন লোক দু’পাশ হতে মেয়েটিকে শক্ত করে ধরে রেখেছে । আমি ঘরে ঢুকতেই মেয়েটা আমার দিকে করুণ দৃষ্টিতে তাকাল। সঙ্গে সঙ্গে আমার ভেতরটা যেন মোচড় দিয়ে উঠল । "হায় ঈশ্বর ! এ আমি কাকে দেখছি? এ মেয়ে'কে তো আমি জন্ম, জন্মান্তর চিনি । নিয়তির নির্মম পরিহাসে যে ছিটকে গিয়ে ছিলো আমার জীবন থেকে আজ বিধাতার কোন ঈশারায় সে আমার মুখোমুখি।"
ঘরের ঠিক মাঝখানে হাতলওয়ালা একটা চেয়ারে বৃদ্ধ এক ব্যক্তি আয়েসি ভঙ্গিতে বসে আছেন । তার ঠিক সামনেই কয়েকজন একটা লোককে শক্ত করে ধরে মেঝের চেপে রেখেছে । লোকটা বারবার নিজেকে ছাড়াবার চেষ্টা করেও পারছে না। আমি কাছে গিয়ে চিৎকার করে বলে উঠলাম কি হচ্ছে এ সব ? ছাড়ো, ছাড়ো বলছি। এখুনি ছেড়ে দাও ওকে । কিন্তু কেউ আমার কথায় ভ্রুক্ষেপ করলো না ।
লোকগুলোর মাঝে হঠাৎ আমি জামালকে দেখতে পেলাম । হাতে একটা বড় রাম দা নিয়ে সে বৃদ্ধ লোকটার পাশে দাঁড়িয়ে রয়েছে । ওর হাতে থাকা দা’টা মশালের আলোয় চকচক করছে । আমার আর বুঝতে কিছু বাকি রইলো না এ ঘরে কি ঘটতে চলেছে । আমি কিছু একটা বলতে চাইলে বৃদ্ধ লোকটা আমার দিকে তাকিয়ে ক্রুর হাসি হেসে মুখের কাছে আঙুল নিয়ে হুসসসসসস করে শব্দ করে কিছু বলতে নিষেধ করলো । তার সেই ভয়ংকর চোখের দৃষ্টিতে আমার পুরো শরীর কেপে কেপে উঠলো। হাত পাগুলো অসার হয়ে আসতে লাগলো । পাথরের মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে রইলাম । মেঝেতে চেপে রাখা লোকটার মুখ থেকে একটু পর পর চাপা গোঙ্গানির শব্দ ভেসে আসছে । আমি বড় বড় চোখ করে সে দিকে তাকিয়ে আছি । জামালের দিকে চোখ যেতেই দেখি রক্তের নেশায় চুর হয়ে থাকা লোভী শেয়ালের মতো সে মিটমিট করে হাসছে।
রাগে আমরা ভেতরটা কেঁপে উঠল আমি কিছু করার আগেই বৃদ্ধ লোকটা জামালের দিকে তাকিয়ে নিজের বৃদ্ধা আঙুলটা গলার কাছে নিয়ে কেটে ফেলার মতো ইশারা করতেই জামাল মাটিতে চেপে রাখা লোকটাকে উল্টো শোয়াতে বলল । লোকটাকে চিৎ করে শোয়াতেই আমি আবার চমকে উঠলাম। হায় , হায় এ লোক তো আর কেউ নয়, এ স্বয়ং আমি নিজে। ভয়ে আতংকে আমি পিছিয়ে এলাম ।
জামাল আমার দিকে তাকিয়ে আবারও হাসল । তারপর তাকাল বৃদ্ধার দিকে । বৃদ্ধ লোকটা হেসে মাথা নেড়ে হা বলার সঙ্গে সঙ্গে সে মাথার উপর দা’টা তুলে চোখের নিমিষে নীচে নামিয়ে আনলো । সঙ্গে সঙ্গে ফিনকি দিয়ে রক্ত বের হয়ে এলো। আমি বিস্ফোরিত চোখে সেদিকে তাকিয়ে থাকলাম । মুখ দিয়ে টু শব্দটি বের হলো না ।
মেয়েটার তাকিয়ে দেখি সেও একেবারে নিস্তব্ধ হয়ে গেছে ।
অবাক চোখে একবার তাকাচ্ছে কেটে ফেলা লোকটার মুখের দিকে আবার তাকাচ্ছে আমার দিকে । মেঝেতে পরে থাকা লোকটার শরীর কাটা মাছের মতো লাফাতে লাফাতে এক সময় স্থির হয়ে গেল । বৃদ্ধ লোকটা এবার আমাকে ধরে থাকা লোক দু’জনের দিকে ইশারা করতেই লোক দু'টো আমাকে এক টানে নীচে শুইয়ে ফেলল । বুঝতে পারলাম আমার ও ওই একই পরিণতি ঘটতে চলেছে । জামাল আমার বুকের দু’পাশে দু'টো পা রেখে দাঁড়ালো । দা’টা থেকে তখন টপটপ করে উষ্ণ রক্ত পরছে আমার শরীরে। ভয় শূন্য দৃষ্টিতে আমি দা'টার দিকে তাকিয়ে রইলাম । তীব্র ভয়ে আতংকে একেবারে জমে গেছি । নড়ার শক্তিটুকুও যেন শরীরে অবশিষ্ট নেই।
বৃদ্ধ লোকটা এবার মেয়েটার দিকে তাকিয়ে দাত মুখে খিচিয়ে বলে উঠলো, "দেখ,নিশি দেখ, আমার অবাধ্য হলে কি নির্মম পরিণতি ভোগ করতে হয় , তা নিজ চোখে দেখ ।
বৃদ্ধের কথায় মেয়েটির শরীরে যেন ঐশ্বরিক শক্তি ভর করলো । প্রকাণ্ড এক হুঙ্কার দিয়ে চোখের নিমিষে নিজেকে ছাড়িয়ে লাফ দিয়ে জামালের হাত থেকে দা’টা কেড়ে নিয়ে বৃদ্ধের গলা লক্ষ্য করে আঘাত করলো। সঙ্গে সঙ্গে ফিনকি দিয়ে ছুটে এলো রক্তের ধারা । হঠাৎ মেয়েটির এই ক্ষিপ্ততায় সকলে হতবিহবল হয়ে পড়লো। এরপর মেয়েটি দা নিয়ে জামালের দিকে ঘুরতেই সে আমাকে ছেড়ে দিয়ে পেছনে সরে গেল ।
মেয়েটি আবার বৃদ্ধের দিকে তাকিয়ে, ক্রুদ্ধ কণ্ঠে বলে উঠলো, "তুই শুয়োর ,তুই জানোয়ার। তোকে আমি নির্বংশ করে দিবো।" এরপর হিংস্র পশুর গর্জন করতে করতে ঝাঁপিয়ে পড়লো বৃদ্ধের নিশ্চল হয়ে যাওয়া দেহের উপর। আঘাতের পর আঘাত করে চলল । মনে হলো , বিশ্ব ভ্রমান্ডের সব শক্তি এসে ভর করছে তার শরীরে । এ যেন রক্ত মাংসে গড়া কোন নারী নয় । এ যেন অন্যায়, অবিচার, নিপীড়নের বিরুদ্ধে রুক্ষে দাঁড়ানো কোন দেবী ।
এক সময় ক্লান্ত হয়ে ছিন্নভিন্ন হয়ে যাওয়া বৃদ্ধের দেহের উপর থু করে এক ধলা থুতু ফেলে আমার দিকে তাকিয়ে বলল, "এসো আমার সাথে।" কথাটা বলেই একটি হাত বাড়িয়ে দিলো আমার দিকে। আমি সে হাত ধরতেই সে ছুটতে লাগল । আমিও ঊর্ধ্বশ্বাসে ছুটতে লাগলাম তার সাথে সাথে। কোথায় যাচ্ছি, কেন যাচ্ছি ? কিচ্ছু জানি না। শুধু এটুকু জানি, যে করেই হোক নিশি'কে নিয়ে পালিয়ে যেতে এই মৃত্যুপুরী থেকে বহু দূরে।
ছুটতে ছুটতে টের পেলাম অনেকগুলো পায়ের শব্দ আমাদের অনুসরণ করে ছুটে আসছে। নিশি শক্ত করে আমার হাত চেপে ধরে বলল, "ভয় পেও না, ভয় পেও না লক্ষ্মীটি, ওরা কিচ্ছু করতে পারবে না আমাদের।" এ ঘর ও ঘর, এ বাক ও বাক ধরে ছুটতে ছুটতে অবশেষে আমরা যখন বাড়িটার সদর দরজার কাছে চলে এসেছি আর কয়েক কদম যেতে পারলেই বের হয়ে যেতে পারবো অভিশপ্ত এ বাড়িটি থেকে; ঠিক সে সময়, পেছন থেকে কয়েক'জন এসে নিশিকে ধরে ফেলল ।
এক টানে তারা নিশিকে ছিনিয়ে নিলো আমার কাছ থেকে। মুহূর্তে মনে হলো আমার হৃদপিণ্ডটা আলাদা হয়ে গেল শরীর থেকে। নিশি, নিশি বলে আমি চিৎকার করে উঠলাম। নিশিও আমার দিকে তাকিয়ে চিৎকার করে বলে উঠলো, যাও,যাও, তুমি চলে যাও, চলে যাও,এখুনি চলে যাও....
কান্না জড়িত কণ্ঠে আমিও চিৎকার করে বলে উঠলাম, "না নিশি না, আমি কিছুতেই তোমাকে ছেড়ে যাবো না।"
নিশি বলল, "ঈশ্বরের দোহাই তোমার, আর এক মুহূর্তও দেরি করো না । এখুনি চলে যাও । চলে যাও বলছি। কথা দিলাম, আবার দেখা হবে আমাদের । আবার দেখা হবে, পৃথিবীর কোন শক্তি আমাদের আলাদা করতে পারবে না। চলে যাও, চলে যাও বলছি। দয়া করে আমার কথা শুন।"
নিশির আকুতি আমার প্রাণ ছুঁয়ে গেলো । আমি আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারলাম না। অনিচ্ছা সত্ত্বেও সদর দরজা দিয়ে বের হয়ে বাড়ির সীমানা প্রাচীর ধরে ছুটতে লাগলাম। কিছুটা যেতেই হঠাৎ ভারি কিছু একটা উড়ে এসে মাথার পেছনে আঘাত করলো৷ তীব্র ব্যথায়, মা গো বলে চিৎকার করে মুখ থুবড়ে পরে গেলাম মাটিতে।
......................................................................।শেষ.........................................................................
সর্বশেষ এডিট : ১৯ শে অক্টোবর, ২০২২ বিকাল ৩:১৫