.
.
আজম একের পর এক হাসির কথা বলছে। আমরা সবাই হাসছি। ভরাট গলার একজনও কথা বলছে। ওর নাম হায়দার। ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের মেম্বার। পরে জেনেছি, ওর একটা গার্মেন্টস আছে। ও শুধু পানি নিয়েছে। ইউরিক এসিডের সমস্যা আছে । তাই পানি নিয়েছে। বনানীর এফ আর টাওয়ার থেকে শুরু করে ব্যাংক লোন, খেলাপী ৠণ, কিছুই বাদ যাচ্ছে না আলোচনা থেকে। আমাদের আজকের দাওয়াতে উপস্থিত অধিকাংশই গার্মেন্টসের মালিক ও ব্যাংকের সাথে জড়িত। সুতরাং আলোচনাটাও সেই দিকেই মোড় নিচ্ছে। আইটির কিছু লোকও আছে। সবমিলিয়ে আলোচনা করার বিষয়বস্তুর অভাব হচ্ছে না। তার সব কিছু আমার স্মৃতিতে ধারণ করতে পারিনি বলে দু:খিত। বিশেষ করে আজমের হাসির কথা গুলো কোন ভুলে গেলাম তার জন্য নিজের উপরই রাগ হচ্ছে। একটা কথা মনে এসেছে।
.
সবাই ঢাকা শহরের বিখ্যাত জ্যাম নিয়ে আলোচনা করছে। কে, কোথায়, কখন, কতক্ষণ আটকে ছিল তার বিশদ বর্ণনা চলছে। আমি বললাম, সজলের মেসেঞ্জারের মেসেজ দেখে আমি তাড়াতাড়ি রওনা দেই । সজল মেসেজ করেছিল, রাস্তায় ভয়াবহ জ্যাম। আমার কথা শুনে সজল হাসতে হাসতে বলে, ও বাসায় বসেই এই মেসেজ দিয়েছে। যাতে সবাই...। হা...হা.. আরো কিছুক্ষণ হাসি। সজলের হাস্যরস গুলো পরিবেশ কেন্দ্রিক। জোর করে জুড়ে দেওয়া নয়। তাই না হেসে পারা যায় না।
.
পঞ্চাশোর্ধ বন্ধুদের দাওয়াত দিয়ে একত্র করা বেশ কঠিন একটা কাজ। তার কারণ বহুবিধ। অন্যতম কারণ, আমি মনে করি, উৎসাহের অভাব। একদা তারুণ্যের উৎসাহে ভাটে পড়ে পলি জমে। নদীর মত জীবনও যেন স্রোত হারায়। সেই কঠিন কাজটা ফারুক বেশ সফলতার সাথেই করেছে বলে মনে হচ্ছে। ওর কাছে কে একজন জানতে চাইল কেমন করে এই অসম্ভব সম্ভব করছিস। ও বলল, চার-পাঁচটা পন্থা অনুসরণ করি। অনেকেই নেগেটিভ মন্তব্য করে দাওয়াতটাকে ভণ্ডুল করে দিতে চায়। তারপর যখন দাওয়াতটা সফল হয় তখন আফসোস করে। কী পন্থা অবলম্বন করে তা আর বলল না। সব গোমর ফাঁস করে দিলে ওস্তাদের আর কেরামতি থাকে না। প্রায় পঁচিশ জন এসেছিল দাওয়াতে-যা আগের সব দাওয়াতের রেকর্ড ভঙ্গ করে।
.
আমাদের কথাবার্তায় একটা ছেদ পড়ে। চমৎকার চাপ দাঁড়ির এক ভদ্রলোক প্রবেশ করলেন। কালো দাঁড়ির মাঝে সামান্য সাদার আভাস। আমার কল্পনায় আঁকা সজলের সাথে একদম মিলে গেল। লম্বা, একহারা গড়নের, শ্যামবর্ণের সম্ভ্রান্ত চেহারার ভদ্রলোকই সজল। চোখে চশমা । ৮২ সালের যে সজলকে আমি কল্পনা করে ছিলাম, তার দাঁড়ি ছিল না। আর সব প্রায় মিলে গেল।
.
কথায় কথায় সজল জানাল, কয়েক দিন আগে ওর উচ্চ রক্তচাপ হয়েছিল। হঠাৎ করেই। সাধারণত ওর প্রেশার ৭৫/১০৫ থাকে। ডাক্তার বলেছেন, অতিরিক্ত কাজের চাপের কারণে এমনটা হতে পারে। সজল মজা করে ডাক্তারকে বলেছে, সারা জীবনই কাজের চাপের মধ্যেই আছি। বিশাল গার্মেন্টসের মালিক হিসেবে চাপ থাকাটাই স্বাভাবিক। যাই হোক, তার পর থেকে প্রেশার স্বাভাবিক আছে।
.
কখন যে রাত গভীর হয়ে গেছে টের পাইনি। হায়দার আড্ডা ছেড়ে যখন চলে যেতে চাইল, তখন বুঝলাম রাত বেশ হয়েছে। ফারুক ওকে খাওয়ার জন্য খুব অনুরোধ করল। ডিনার সার্ভ হয়ে গেছে। ও সবার সাথে কুশল বিনিময় করে চলে গেল।
.
নতুন যারা এসেছে আড্ডায়, তাদের মধ্যে তিনজন আমার পূর্ব পরিচিত। একজনের কথা আগেই বলেছি, আমার ধানমণ্ডি স্কুলের বন্ধু তৌহিদ। বাকী দুজন বাণিজ্য অনুষদের, হাবিব ও রাসেল। আমাদের পাড়ার বন্ধু জাকির ওদের বিশ্ববিদ্যালয়ের বন্ধু ছিল। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মাঠে ওদের সাথে কত আড্ডা দিয়েছি । কিন্তু ওদের সাথে কখনো নটরডেম কলেজে দেখা হয়নি আমার। আজ পরিচয়টা নতুন মোড় নিল। সোহেলের কাছে জানতে চাইলাম, ও জাকিরের খবরটা জানে কি-না। ও বলল, জানে। ওদের ফ্ল্যাটে জাকিরের এক আত্মীয় থাকেন। উনি জাকিরের মৃত্যু সংবাদটা রাসেলকে জানায়। জীবনটা কেমন অদ্ভুত। যার মাধ্যমে একদিন আমাদের পরিচয়, আড্ডায় মেতে ওঠা, পাড়ার কমিউনিটি সেন্টারে ব্রিজ খেলা, আরো কত কত স্মৃতি জড়িয়ে। সেই জাকির নেই, আমরা আছি। রাতের আড্ডায় মশগুল হয়ে আছি। বড় ভালো ছেলে ছিল জাকির। ওর মতো বন্ধু-বৎসল ছেলেকে কোন বন্ধু ভুলতে পারে কী?
.
স্মৃতিকে ধরে রাখার জন্য ফারুক এক অভিনব উপায় বের করেছে। সবার সাথে যুগল ছবি তুলছে । ওর মোবাইলটা আজাদের হাতে ধরিয়ে দিয়েছে। আজাদ সম্ভবত বাণিজ্য বিভাগের। আমি আর ফারুক পাশাপাশি দাঁড়ালাম- আজাদের ক্লিকে স্মৃতি হয়ে গেলাম। এভাবে ফারুক সবার সাথে ওর যুগল ছবি মোবাইলে বন্দী করে ফেলল। সবাইকে আলাদা-আলাদা করে মনে রাখার জন্যই এই যুগল ছবির আয়োজন। ওর স্মৃতিকে ধরে রাখার বুদ্ধিটা আমার পছন্দ হয়েছে।
.
ছবি তোলা শেষে সবাই খাওয়া নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। বুফে সিস্টেমে খাওয়া। যে যার মতো খাওয়া নিয়ে বসে পড়েছে টেবিলে। ফারুক বসল সবার পরে। তখন কারো কারো একবার প্লেট বদল করা হয়ে গেছে। আমার পাশের চেয়ারে বসেছিল আহাদ। আড্ডার শুরু থেকেই আছে, আমরা পাশাপাশি বসেছিলাম। খুব সজ্জন ব্যক্তি। ও আবার খাওয়া আনতে গেছে। ফারুক ওর প্লেট নিয়ে হাজির। চেয়ার খালি দেখে ফারুক বসে পড়ল। কিছুক্ষণ পর আহাদ ফিরে আসল প্লেট হাতে। একটু অস্বস্তিকর অবস্থা। আমার খাওয়া প্রায় শেষ হয়ে গিয়ে ছিল। আমি আহাদকে আমার চেয়ারটা ছেড়ে দিলাম। টেবিলটা ঘিরে যতগুলো চেয়ার ছিল সব পূর্ণ হয়ে গেছে। খুবই আনন্দের একটা বিষয়। একঝাক প্রৌঢ় নটরডেমিয়ানের এই বিশাল আড্ডা মনে রাখার মতো। বেয়ারা পিছন থেকে একটা চেয়ার এগিয়ে দিল। আমি দ্বিতীয় সারিতে বসলাম। হঠাৎ ঝনঝন শব্দে সবাই সচকিত। আমিও অপ্রস্তুত হয়ে গেলাম। আমার প্লেটের চামচ ও অবশিষ্ট সামান্য খাওয়া মেঝেতে পড়ে গেছে। বেয়ারা এসে জায়গাটা পরিস্কার করে দিল। আমাকে আর একটা প্লেট নিতে বলল। আমি একটা প্লেটে নান আর মাংস নিয়ে এলাম। আসার পথে হাবিবের সাথে চোখাচোখি ও মৃদু হাস্য বিনিময় হলো। আজমের পাশে গিয়ে বসল হাবিব। আমি, আহাদ, ফারুক আড্ডার শুরুতে ছিলাম বামপাশে, আজমের পাশে। চলমান আড্ডায় সবাই ঘুরে ফিরে সবার সাথে কথা বলছে। সবার সাথে মতবিনিময় হচ্ছে। কোন গণ্ডি আর কাউকে বেধে রাখতে পারছে।
.
মুক্ত গণ্ডির আড্ডার কিছু ছবি আমিও মোবাইলে ধারণ করলাম। তৌহিদের সাথে একটা সেলফি তুললাম। খাওয়া শেষে আজকের স্মৃতিতে সবাইকে একসাথে ধারণ করার জন্য সবাই সিঁড়ির ধাপে ধাপে বসে পড়লাম। সজল বসেছে সিঁড়ির একদম উপরের ধাপে। আমি ওর কাঁধে হাত দিয়ে হাঁটু গেড়ে বসে পড়লাম। আমার পাশে আরো দুজন। সিঁড়ির জায়গা শেষ। এবার সিঁড়ির দু’পাশে, সামনে – যে যেখানে পারল, জায়গা করে নিল। বেয়ারার হাতে মোবাইলটা দিয়ে ফারুকও সামনে জায়গা করে নিল। একটা ফ্রেমে সন্ধ্যা সাতটা থেকে সাড়ে দশটা পর্যন্ত সময়ের নায়কেরা জায়গা করে নিল।
.
বাসায় ফিরতে হবে, রাত অনেক হয়েছে। আমার পাশে যে দু’জন ছিল, ওরা আর সিঁড়ি দিয়ে নিচে নামল না। আমিও ওদের সাথী হলাম। সবার কাছ থেকে বিদায় নিতে গেলে আরো দেরী হয়ে যাবে। যানবাহন পাওয়াটা মুশকিল হয়ে যাবে। পায়ে পায়ে আমরা তিনজন বেরিয়ে এলাম স্বর্ণিল সন্ধ্যার স্মৃতি পিছনে ফেলে। অনেকের সাথেই কথা হয়নি এই স্বপ্ল সময়ে। তাদের মধ্যে ওরাও আছে। জহির ও জুলহাস বিজ্ঞান বিভাগের। কথায় বুঝলাম ওরা প্রকৌশলী হিসেবে চাকরি করছে। একটু ক্ষোভ মিশ্রিত স্বরে জহির জানাল, প্রকৌশলীরা সারাদিন কাজ করে। অবসর পায় না একটুও । আর এডমিন-একাউন্টসের লোকজন এসির মধ্যে বসে আরাম করে। ইংগিতে সদ্য আড্ডার কাকে যেন ইংগিত করল। আমি ডিটেইলে গেলাম না। এ পৃথিবীতে কেউ সুখী নয়। সবারই অভিযোগ আছে কারো না কারো প্রতি। ওরা যাবে মালিবাগের দিকে। আমি মিরপুর যাবো শুনে জহির বলল, অনেক দূর। ফার্মগেটটা এভয়েড কর। আমি ওকে জানালাম, উবার নিয়ে নিব।
.
ঢাকা ক্লাবের গেট দিয়ে বেরিয়ে এলাম। রাস্তা পেরিয়ে ওপর পাশে আসলাম। দেখি একটা বাস আসছে। মিরপুর যাবে। ওঠে পড়লাম। বাসে ওঠেই শাহানাকে ফোন দিলাম। আড্ডার মাঝে ও একবার ফোন করেছিল। আমি কোথায়, কোন বাসে- ওকে জানিয়ে মোবাইলটা পকেটে রাখলাম। একটা সিট খালি হলো। আমি বসলাম। বাসে লোক কম। আমার মন চলে গেল ঢাকা ক্লাবে। অনেকদিন পর চমৎকার একটা সন্ধ্যা কাটালাম। মোবাইলটা বের করে বন্ধুদের ছবিগুলো দেখছি। বাস থামে । পাশের লোকটা ওঠে চলে গেল। আমি জানালার পাশে বসি। হঠাৎ আমি চমকে ওঠি। কে যেন আমার মোবাইলটা টান দিয়ে নিয়ে গেছে জানালার পাশ থেকে। আমি বলে ওঠি, আমার মোবাইল নিয়ে গেছে। সবাই চুপ। একজন বলে ওঠে, যান, দৌঁড়ে ধরেন ছিনতাইকারীকে। আমি দ্রুত বাসার দরজা দিয়ে নামি। বাস যেদিকে যাচ্ছে, তার উল্টো দিকে দিয়ে একজন ছুটে যাচ্ছে। আমিও দৌঁড়ে রাস্তা পার হচ্ছি। দেখলাম, একটা ছেলেও ছিনতাইকারীর পিছনে ছুটছে ফুটপাত ধরে। ভিতর থেকে কে যেন আমাকে বলল, ওদিকে যেও না। আমি থেমে গেলাম। একটি চমৎকার সন্ধ্যার স্মৃতিগুলো ছিনতাই হয়ে গেল।
.
চলবে...
মো. শামছুল ইসলাম
১৫ এপ্রিল ২০১৯
সর্বশেষ এডিট : ১৫ ই এপ্রিল, ২০১৯ দুপুর ১:৫৫