"ভাত সেদ্ধ হয়েছে কি-না, তা দু'একটা ভাত টিপলেই বুঝা যায়; সব ভাত টিপা লাগে না।" - কথাটা খুবই সত্য। আমি ভাত যাচাই করার এই পদ্ধতিটা ব্যবহার করছি গত ০৮ ফেব্রয়ারি ২০২০ তারিখে বইমেলা থেকে সংগৃহীত বইগুলোর উপর। এটা করার আর একটা কারণ হচ্ছে, আমি মেলা চলাকালীন সময়ে পাঠকদের বই কিনতে উৎসাহিত করতে চাই। অন্য সময়ও যে পাঠকরা বই কিনছে না তা নয়। বিষয়টা অনেকটা ঈদ বা পূজার মতো। এই সময় নতুন জামা কেনার একটা হিড়িক পড়ে যায়। তাই বইমেলার এই উৎসবে সবার হাত ভরে ওঠুক নতুন নতুন বইয়ে।
.
স্মৃতি ভদ্র নিউ ইয়র্ক প্রবাসী । কিন্তু প্রবাসী হয়েও তিনি লিখেছেন বাংলাদেশের গল্প । বইয়ের ফ্ল্যাপের বামে গল্পকার কুলদা রায় তেমনটাই বলছেন । তিনি আরো বলছেন-
‘তার গল্প স্নিগ্ধ ও মানবিক । তিনি লেখায় গড়ে তুলতে চেষ্টা করছেন আখ্যানের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ একটি সহজ, স্নিগ্ধ, নিটোল গল্পভাষা ।‘...
‘অনায়াসে খেলছেন পাঠকের সঙ্গে চোর-পুলিশ । বাস্তবতার সঙ্গে কল্পনার যথার্থ মিশেলে আখ্যানের গায়ে লাগছে নতুনত্বের ছোঁয়া । কখনো কখনো উঁকি দিচ্ছে জাদুবাস্তবতা ।‘
.
স্মৃতি ভদ্র বইটা উৎসর্গ করেছেন ‘সময়’-কে । তাঁর উৎসর্গের তিন লাইনের ভাষায় পুরো বইটাকে ধারণ করেছেন অসামান্য দক্ষতায়-
‘ইতিহাসে ঠাঁই করে নেওয়া সময় বা অনাগত
অপার সম্ভাবনাময় সময়- যার পরতে পরতে
জমে থাকা মুহূর্তগুলোই গল্প হয়ে উঠেছে।‘
.
আমি সেই সময়ের গল্প শোনার অধীর আগ্রহে পাতা উল্টাই । স্মৃতি ভদ্রের লেখা চমৎকার ভূমিকা আমাকে আটকে দেয় । আমি তন্ময় হয়ে পড়ি-
‘অনেক রকমের দিন ভিড় করে এখানে । ধুলো ওড়ানো শূন্য দিন, গতি হারানো মন্থর দিন, আকাশ ফুরানো মিথ্যে দিন কিংবা ছায়া হারানো নির্লিপ্ত দিন । সেসব দিন বুকের ভিতর অবিরত পুড়িয়ে চলে সুগন্ধি ধূপ । খাগের কলম দোয়াতে ডুবিয়ে সময় বসে রচনায়, মহাকাল রচনায় । তানপুরার তারে ওঠে আশাবরির সুর । সে সুর ওক, বার্চের শুকনো ডালে জীবনের চরকি কাটে । সে সুর থেকেই আমি বুনে চলি জীবনের গল্প । জীবন আর সময়ের সেরকমই নয়টি গল্পের সংকলন এই বই ।‘
.
গল্পকারের সুরের মায়ায় জড়িয়ে শুরু করি প্রথম গল্প, ‘পরি ও একজন মালতি-দি’ । ‘নারিকেল গাছের চিরল পাতায় দ্বাদশীর চাঁদ...’ প্রকৃতির ছবিটা উনি এমন ভাবে আঁকেন, যেন আমিও সেই চিরল পাতায় দ্বাদশীর চাঁদের আলোয় মমিন সাহেবের মত নবগঙ্গায় পরির পিছনে ছুটে চলেছি ; নদীর তলে ডুবে যেতে যেতে মমিন সাহেবের শ্বাস বন্ধ হয়ে আসে ।
কিছুক্ষণ পর স্ত্রী কল্পনা স্বামীর গোঁ গোঁ আওয়াজে ঘুম থেকে জেগে উঠেন ।
এই যে স্বপ্ন ও বাস্তবতার মাঝে গল্পকারের অনায়াস, সহজ আনাগোনা – গল্পের পুরো অবয়ব জুড়ে তাকে উপলব্ধি করেছি গভীর ভাবে। পরির মালতি-দি হয়ে উঠার গল্পটাও কেমন অনায়াসে বলে গেলেন । সেখানে কামিনী ফুলের গাছের কথা আছে, মুক্তিযুদ্ধের কথা আছে, সেই সময়ের নির্মম কিছু বাস্তবতার কথা আছে । আবার গল্পের শেষে এসে ধরা দিয়েছে জাদুবাস্তবতা । কল্পনা মমিন সাহেবের বিছানার চাদর তুলে ঝাড়তে গিয়ে দুইটা কামিনী ফুল দেখতে পান ।
.
পরের গল্প ‘গোঁসাবাড়ির বীথিলতা” । একটি বাড়ির বর্ণনা দিয়ে গল্পের গুরু । তালেব আলীর খোঁজে পরাগ এসেছে এই বাড়িতে । শেষ না করে উঠা যায় না-এমনিই একটা গল্প এটা । সাতচল্লিশের দেশভাগের নির্মমতাকে পাশ কাটিয়ৈ গল্পকার বলেছেন মানবিক এক গল্প; এখানেই গল্পকারের স্বার্থকতা । আরো কিছু বলার ইচ্ছে ছিল গল্পটা নিয়ে । কিন্তু বইয়ের ফ্ল্যাপের পিছনে কথাসাহিত্যিক অমর মিত্রের কথাগুলোর পর আর কোন কথা চলে না-
‘অপূর্ব গল্প । বুকটা ভার হয়ে গেল । স্মৃতি গল্প লেখার কৌশল জানেন বুনতে জানেন গল্প । সুতরাং তিনি লিখবেন । আমিও পড়ব।‘
.
অমর মিত্রের সাথে গলা মিলিয়ে আমিও বলতে চাই, ‘সুতরাং তিনি লিখবেন । আমিও পড়ব।‘
পাঠক, আপনার কী পড়তে ইচ্ছে করছে না গল্প বুনার সেই গল্পকারকে?
.
অন্যান্য যে বইগুলো সংগ্রহ করেছি, সেই সব বই নিয়েও সংক্ষিপ্ত পাঠ প্রতিক্রিয়া লিখতে চাই, যেন মেলা চলাকালীন বইয়ের বিক্রি আশানুরূপ হয়।.
।
এটা স্মৃতি ভদ্রের তৃতীয় গল্পগ্রন্থ ।
আগের দুইটি - 'অলোকপুরীর ডাক' ও 'অন্তর্গত নিষাদ ও পায়রা রঙের মেঘ' ।
।
মো. শামছুল ইসলাম
১৩ ফেব্রুয়ারি ২০২০
সর্বশেষ এডিট : ১৪ ই ফেব্রুয়ারি, ২০২০ সকাল ১১:২৭