somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

চুয়েটের স্মৃতি (১৯৮২-৮৮) : পর্ব – ০৬

০৭ ই সেপ্টেম্বর, ২০২০ দুপুর ১২:৫০
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


.
একটা দুর্ঘটনা মানুষের জীবনের গতি পথকে পুরোপুরি পরিবর্তিত করে দিতে পারে। পরবর্তী জীবনেও থেকে যায় সেই দুর্ঘটনার রেশ।
.
চার তলায় সিনিয়র-জুনিয়রদের চমৎকার মিলন মেলা। দেলোয়ার ভাইয়ের সাথে খুব ভালো সম্পর্ক হয়ে গেল কিছুদিনের মধ্যেই । উনার রুমে আমাদের অবাধ যাতায়াত। উনিও আমাদের রুমে আসেন। আহসান আর ফেরদৌসের মাঝে প্রায়ই বিভিন্ন বিষয় নিয়ে তর্ক হয়। কেহ কাহারে নাহি ছাড়ে। তর্ক থেকে প্রায়ই হালকা মন মালিন্য হয়। দেলোয়ার ভাইয়ের কাছে নালিশ জানান হয়। উনি মিটি মিটি হাসেন । কারো পক্ষ নেন না। আবার যার দোষ, তাকে আকারে-ইঙ্গিতে বুঝিয়ে দেন তার কাজ বা কথাটা ঠিক নয়। আমাদের ছোট্ট সংসারের খুনসুটি লেগেই থাকে। আর অভিভাবকের মতো আমাদের সে সব সমস্যার সমাধান করেন দেলোয়ার ভাই। সম্ভবত শংকু ও চন্দ্র উনার রুমমেট ছিল। ওরাও আমাদের এই সব ছেলেমানুষী কাণ্ডে খুব মজা পেতো বলে মনে হয়। সদ্য কলেজ পেরিয়ে আসা অনেকের মধ্যেই তখনো সেই সারল্য রয়ে গিয়ে ছিল।
.
এমনি একজন সরল তরুণের নাম বিল্লাহ। আহসানের সাথে ওর খুব বন্ধুত্ব। দুজনের আলাপের বিষয়ও এমন যে আমরা তাতে অংশ নিতে পারি না। ওদের দুজনের শখ গাড়ি এবং ক্যামেরা। আমাদের আড্ডা থেকে বিল্লাহ প্রায়ই আহসানকে হাইজ্যাক করে নিয়ে যায়। বাগানের পাশের সিঁড়িতে বসে দু’জন মগ্ন হয়ে আলাপ করে। আবার কখনো আমাদের রুমেই আসর বসে গাড়ি-ক্যামেরার আলোচনার। আহসান বায়তুল মোকারম মার্কেট থেকে কিনে আনা বিভিন্ন মডেলের গাড়ির ক্যাটালগ বের করে। দুজনে এমন মগ্ন হয়ে যায় রুমে যে আর কেউ আছে তাও মনে থাকে না। আস্তে আস্তে বিল্লার সাথে ফেরদৌস ও আমার ভাব হয়ে যায়।
.
কুকুর বিল্লার খুব প্রিয়। ওকে দেখলে কুকুর গুলো লেজ নাড়তে নাড়তে ওর পিছু নেয়। আমরা সাথে থাকলে ও কুকুরদের আদর করে তাড়িয়ে দেয়। অনেক সময় দেখেছি ও কুকুর কোলে নিয়ে বসে আছে । আমার কাছে ব্যাপারটা ভয়ংকর মনে হয়। আমি কুকুর থেকে দূরে থাকি। কিন্তু কুকুরের সাথে বিল্লার অন্তরঙ্গতাটা ভালো লাগে। বিল্লার মনটা খুব পরিষ্কার মনে হয়। ওদের পরিবার বেশ ধনী। মধ্যবিত্তের হীনমন্যতা ওকে ছুঁতে পারেনি। অনেকেই ওর এই কুকুর প্রীতি নিয়ে বিরূপ মন্তব্য করতো। আমরা সব সময় তার প্রতিবাদ করতাম। বিল্লাহ যথেষ্ট বুদ্ধিমান। ও সেসব বিরূপ মন্তব্যকারীদের এড়িয়ে চলতো।
.
শামীম ছিল বিল্লার রুমমেট । দুজনই রেসিডেন্সিয়াল মডেলের ছাত্র। ওর সাথেও আমাদের বন্ধুত্ব হয়ে গেল। বিল্লার বড় ভাই ডন । উনিও কে কে হোস্টেলেই থাকতেন। পুর কৌশলের ছাত্র ।
বিল্লা আর ডন ভাইয়ের সম্পর্ক অনেকটা বন্ধুর মতো ছিল। ডন ভাই কখনো ওর সাথে বড় ভাই সুলভ আচরণ করেন নি।
.
দুই ভাই খুব ভালো গাড়ি চালাতো। প্রায়ই খোলা রাস্তা পেলে দুজন কার রেসিং এ মেতে উঠতো। কোন খুশির উপলক্ষ্য উদযাপনের একটা উপায় ছিল কার রেসিং। সেনাবাহিনীতে বিল্লাহ চূড়ান্ত ভাবে নির্বাচিত হয়েছে। বাসায় খুশির আবহ। এমন খুশির খবরটাকে উদযাপনের জন্য গাড়ি নিয়ে দুই ভাই বেরিয়ে পড়ে। ফাঁকা রাস্তা । একবার ডন ভাই এগিয়ে যায় আবার বিল্লাহ। হাড্ডাহাড্ডি লড়াই চলছে । প্রতিযোগিতার শেষ পর্যায়ে। বিল্লাহ গাড়ির গতিটা বাড়িয়ে দিয়ে ডন ভাইয়ের গাড়িকে অতিক্রম করছে। মুখে বিজয়ীর হাসি। এক হাতে স্টিয়ারিং, অন্য হাত ভি সাইন দেখিয়ে ডন ভাইয়ের গাড়িটাকে অতিক্রম করছে। ডন ভাইও দ্রুত গতি বাড়িয়ে দেয়। দুই গাড়ির সংঘর্ষে প্রচণ্ড আওয়াজ হয়। বিল্লাহ সহ গাড়িটা রাস্তার পাশে উল্টে পড়ে।
.
তারপর পুরোটাই বিল্লাহ ও তার পরিবারে জন্য চরম দুঃস্বপ্নের মতো। অনেকদিন অচেতন ছিল বিল্লাহ । সবাই জীবনের আশা ছেড়ে দিয়েছিল। তারপর আল্লাহর রহমতে বিল্লাহ ধীরে ধীরে জ্ঞান ফিরে পায়। এক সময় মোটামুটি সুস্থ হয়ে বাসায় ফিরে আসে। কিন্তু ওর বাম পায়ে সমস্যা রয়েই যায়। তাই সেনাবাহিনীতে আর যোগদান করা হয়নি। ভগ্ন হৃদয়ে জীবনটাকে আবার ঢেলে সাজাবার জন্য ভর্তি হয় চট্টগ্রাম ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে।
.
স্বাভাবিক ভাবেই বাবা-মার একটা অতিরিক্ত স্নেহ ছিল বিল্লার প্রতি। উনারা প্রায় প্রতি সপ্তাহেই চট্টগ্রাম শহর থেকে আসতেন ওকে ও ডন ভাইকে দেখতে। সাথে প্রচুর খাবার নিয়ে আসতেন। আমরাও তার ভাগ পেতাম। হোস্টেল জীবনের বিস্বাদ রান্নার মাঝে সেগুলো নতুন মাত্রা যোগ করতো।
.
চাকরি জীবনে এসেও সহজ-সরল বিল্লাহ একটুও বদলায়নি। ওহাবের কাছে শুনেছি, ঝিল বাংলা সুগার মিল এলাকার এক রিকশাওয়ালা বিল্লার খুব ভক্ত। ঝিল বাংলায় এলেই ও রিকশাটা সারাদিনের জন্য ভাড়া নিত। যখন যেখানে খুশি ঘুরে বেড়াতো। আর কুকুরের সাথে সখ্যতা তো আছেই। বছর তিন আগে ওহাবের বাসায় বিল্লার সাথে দেখা। সাথে ভাবী ও মেয়ে ছিল। তারপর একদিন শুনলাম চিনি ও খাদ্য শিল্পের চাকরি ছেড়ে বিল্লাহ পরিবার সহ আমেরিকায় চলে গেছে। ডন ভাই ওকে নিয়ে গেছে। ডন ভাই অনেক বছর আমেরিকায় আছেন ।ভালো একটা চাকরি করছেন।
.
মাঝে মাঝেই বিল্লাহ আমাকে মোবাইলে ফোন করে। বেশি কথা বলে না। প্রথম দিকে ফোন করে হাদির খবর নিত। এখন ফোন করে একটাই কথা, “বাবু, তুমি, আমি, রুহুল আর ওহাব ঢাকায় কোথাও আড্ডা দিবো।“ আহসানের কথা বলে না, ও জানে আহসান বিদেশে। এই কথাটা বলেই বলে, “বাবু, রাখি।“ অল্প কথার এই মানুষটাকে বড্ড ভালো লাগে। জীবনের জটিল পরিক্রমায় অধিকাংশ মানুষই তার ছাত্র জীবনের সরলতা হারিয়ে ফেলে। বিল্লাহ সেই বিল্লাই রয়ে গেছে। আমাদের এই দেশে ও যেন একজন এলিয়েন।
.
একদিন বৃষ্টিমুখর কোন এক বর্ষার সন্ধ্যায় হয় তো আমরা চারজন আড্ডা দিব। হঠাৎ বিদ্যুৎ চলে যাবে। বিল্লাহ রুহুলকে বলবে, গাও না আমার প্রিয় গানটা। রুহুল গাইতে থাকবে, পাগলা হাওয়ার বাদল দিনে,... ।

আগের পর্ব: Click This Link
.
চলবে...
.
০৭ সেপ্টেম্বর ২০২০
মো. শামছুল ইসলাম
.

সর্বশেষ এডিট : ০৭ ই সেপ্টেম্বর, ২০২০ বিকাল ৪:১৪
৭টি মন্তব্য ৭টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

কুড়ি শব্দের গল্প

লিখেছেন করুণাধারা, ২৪ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৯:১৭



জলে ভাসা পদ্ম আমি
কোরা বাংলায় ঘোষণা দিলাম, "বিদায় সামু" !
কিন্তু সামু সিগারেটের নেশার মতো, ছাড়া যায় না! আমি কি সত্যি যাবো? নো... নেভার!

সানমুন
চিলেকোঠার জানালায় পূর্ণিমার চাঁদ। ঘুমন্ত... ...বাকিটুকু পড়ুন

ধর্ম ও বিজ্ঞান

লিখেছেন এমএলজি, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ ভোর ৪:২৪

করোনার (COVID) শুরুর দিকে আমি দেশবাসীর কাছে উদাত্ত আহবান জানিয়ে একটা পোস্ট দিয়েছিলাম, যা শেয়ার হয়েছিল প্রায় ৩ হাজারবার। জীবন বাঁচাতে মরিয়া পাঠকবৃন্দ আশা করেছিলেন এ পোস্ট শেয়ারে কেউ একজন... ...বাকিটুকু পড়ুন

তালগোল

লিখেছেন বাকপ্রবাস, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ৯:৩৫


তু‌মি যাও চ‌লে
আ‌মি যাই গ‌লে
চ‌লে যায় ঋতু, শীত গ্রীষ্ম বর্ষা
রাত ফু‌রা‌লেই দি‌নের আ‌লোয় ফর্সা
ঘু‌রেঘু‌রে ফি‌রে‌তো আ‌সে, আ‌সে‌তো ফি‌রে
তু‌মি চ‌লে যাও, তু‌মি চ‌লে যাও, আমা‌কে ঘি‌রে
জড়ায়ে মোহ বাতা‌সে ম‌দির ঘ্রাণ,... ...বাকিটুকু পড়ুন

মা

লিখেছেন মায়াস্পর্শ, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:৩৩


মায়াবী রাতের চাঁদনী আলো
কিছুই যে আর লাগে না ভালো,
হারিয়ে গেছে মনের আলো
আধার ঘেরা এই মনটা কালো,
মা যেদিন তুই চলে গেলি , আমায় রেখে ওই অন্য পারে।

অন্য... ...বাকিটুকু পড়ুন

কপি করা পোস্ট নিজের নামে চালিয়েও অস্বীকার করলো ব্লগার গেছে দাদা।

লিখেছেন প্রকৌশলী মোঃ সাদ্দাম হোসেন, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ২:১৮



একটা পোস্ট সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বেশ আগে থেকেই ঘুরে বেড়াচ্ছে। পোস্টটিতে মদ্য পান নিয়ে কবি মির্জা গালিব, কবি আল্লামা ইকবাল, কবি আহমদ ফারাজ, কবি ওয়াসি এবং কবি... ...বাকিটুকু পড়ুন

×