.
।
বছর পেরিয়ে গেল। নানা কাজের চাপে বন্ধু ওহাবের দেওয়া বই দুটা এখনো শেষ করতে পারিনি। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়য়ের “শ্রেষ্ঠ গল্প” ও সৈয়দ শামসুল হকের “মার্জিনে মন্তব্য” দুটোই একবারে পড়া শুরু করি। দুটোই অসমাপ্ত। মনের মধ্যে একটা গ্লানি বোধ করি। গতকাল আবার শ্রেষ্ঠ গল্প নিয়ে বসি। “বিবেক” গল্পটা আগেও একবার পড়েছি। গতকাল আবার পড়ে আমার বিবেক জেগে ওঠে।
.
কিছু একটা লিখবো বলে ল্যাপটপে বসি। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়য়ের মত বিশাল মাপের একজন লেখকের গল্প নিয়ে আমার মত সীমিত সাহিত্য জ্ঞানের মানুষ কি-ই-বা লিখতে পারে? তাই জ্ঞান নয়, হৃদয়ের পাঠশালায়, ভালোবাসা ও আবেগের যে অনুভূতি প্রচণ্ড ভাবে অনুভব করেছি, তাই লিখতে চাই।
.
শেষ রাতে ঘনশ্যামের স্ত্রী মণিমালার প্রায় মরণাপন্ন অবস্থা। তাঁকে বাঁচাবার জন্য দরিদ্র ঘনশ্যাম অস্থির হয়ে ওঠেন। ঘরে একটিও টাকা নেই, শুধু কয়েক আনা পয়সা। ডাক্তারের ভিজিট দিতে পারবেন না। তবুও বড় ছেলে সন্তুকে পাঠান ডাক্তার ডেকে আনতে। বড় মেয়ে ঘুমভরা কাঁদ-কাঁদ চোখে অসহায় বাবাকে দেখে। ঘনশ্যাম স্ত্রীর মুখে ওষুধ গুঁজে দেন। কিন্তু ওষুধ খাওয়ার মত অবস্থা মণিমালার নেই। আরো আগে ডাক্তার ডেকে চিকিৎসা করা প্রয়োজন ছিল। ঘনশ্যাম বড় মেয়েকে কান্না বন্ধ করে মায়ের হাতে পায়ে সেঁক দিতে বলেন। অভাবের তাড়নায় ঘনশ্যামের কথাবার্তা, আচার-আচরণে নিষ্ঠুরতা ও অসভ্যতা প্রকাশ পায়। নিজের মেয়েকে সে “হারামজাদী” বলে সম্বোধন করে।
শুধু তাই নয়। স্ত্রীর দুই হাতের দুটি রুলি খুলে নিতে চায়। বিক্রি করে স্ত্রীর চিকিৎসা করাবে। সন্তুর সাথে কোন ডাক্তার আসতে রাজী হয়নি। ওরা ভিজিট দিতে পারবে না তাই। মণিমালা সকালে কিছুটা সুস্থ হয়ে ওঠে।
এই স্ত্রী অন্তঃপ্রাণ, বদরাগী, দরিদ্র ঘনশ্যামকে আমি চিনি। আমাদের যাপিত জীবনে তাদের দেখা পাই।
.
ঘনশ্যাম ঘুমাতে গিয়ে দেখে ছোট মেয়েটা তার বিছানায় পেশাব করে ভিজিয়ে দিয়েছে। ঘনশ্যামের ইচ্ছে করে তাকে সজোরে চড় দিতে। আধঘণ্টা গুয়ে থেকে ঘনশ্যাম ওঠে পড়ে। স্ত্রীর চিকিৎসার জন্য বড়লোক বন্ধু অশ্বিনীর কাছে যাওয়ার প্রস্তুতি নেয়।
.
অভাবী মানুষদের ঘরের বাইরে বের হওয়া ঝক্কির ব্যাপার। পোকায়-কাটা, দাগ-ধরা সিল্কের পাঞ্জাবিটা দেখে বন্ধু অশ্বিনী মনে মনে হাসবে, এই চিন্তা থেকে ঘনশ্যাম তার ছেঁড়া ময়লা শার্টটা পরে যাওয়ার জন্য ঠিক করে। শার্টের ছেঁড়াটুকু সেলাই করা হয় নাই দেখে ঘনশ্যাম খুশি হয়ে ওঠে। বড় মেয়ে লতাকে কাল বলেছিল সেলাই করতে । সে করেনি। পেশাব করার অপরাধে ছোট মেয়েকে চড় দিতে পারেনি তার কান্না-কাটির ভয়ে। দুখী মনের রাগটা বড় মেয়ের উপর ঝেড়ে ঘনশ্যাম সুখ অনুভব করে।
এই ঘনশ্যামকেও আমরা প্রায় প্রতিদিন দেখি। অফিস বা অন্য কোথাও লাঞ্চিত হয়ে বাসায় এসে পরিবারের নিরীহ সদস্যদের উপর অত্যাচার প্রায়ই হচ্ছে ।
.
ঘনশ্যামের সেই সুখ বেশিক্ষণ স্থায়ী হয় না। শুধু বন্ধু অশ্বিনী নয়, তার চাকর পশুপতিও ঘনশ্যামকে করুণার চোখে দেখে, অপমান করে। অশ্বিনী রসিয়ে রসিয়ে বন্ধুর করুণ কাহিনি শুনে। তারপর বিশ-পঁচিশ টাকা ধার দেয়।
ঘনশ্যামের সেই অপমানের যাতনা, আমি অনুভব করি। কারণ আমি সেই কিশোরকে চিনি, যে বাকির জন্য পাড়ার দোকানে কুণ্ঠিত হয়ে দাঁড়িয়ে থাকত। সবার সদাই নেওয়া শেষ হলে মৃদু স্বরে বাকি চাইত। পরিবেশ-পরিস্থিতি হয়তো ভিন্ন। কিন্তু ঘনশ্যাম আর সেই কিশোরের হৃদয়ের রক্তক্ষরণের ধরণ একই।
.
বহুদিনের লাঞ্চনা-বঞ্চনার একটা শোধ নেওয়ার সুযোগ ঘনশ্যাম সেদিন পেয়ে যায়। অশ্বিনীর সোনার ঘড়িটা টেবিলের উপর থেকে ঘনশ্যাম চুরি করে। বন্ধুর স্ত্রীর কঠিন অসুখের কথা শুনেও অশ্বিনীর মন গলে না্। মাত্র পাঁচ টাকা দেয় ঘনশ্যামকে। শুধু তাই নয়। চাকর পশুপতিকে বলে ঘনশ্যামকে একটা কাপড়-কাচা সাবান দিতে – যাতে ময়লা কাপড়টা ধুয়ে পরে আসে।
.
চূড়ান্ত অপমানিত হয়ে ঘনশ্যাম বাসায় ফিরে বৈঠক খানায় বন্ধু শ্রীনিবাসের সাক্ষাত পায়। দুই বন্ধুর ভাগ্যই একই সূতায় গাঁথা। দুই জনেরই চাকরি গেল এক মাসের ব্যবধানে, অসুখ-বিসুখও শুরু হল একসঙ্গে। কাল রাতে ঘনশ্যামের স্ত্রী আর শ্রীনিবাসের ছেলের যায় যায় অবস্থা। দুই জনই টাকার খোঁজে বাইরে বেরিয়েছিল। শ্রীনিবাস স্ত্রীর বালা বিক্রির টাকা থেকে ম্যানিব্যাগ বের করে বন্ধুকে দশ টাকা দেয়। শ্রীনিবাস অনুভব করে, আবেগের বশে দশটা টাকা এখনই না দিলে পরে আর দেওয়া হবে না। শ্রীনিবাস চলে যায়। আবার প্রায় সাথে সাথেই ফিরে আসে। একটা সিগারেট কিনতে পকেটে হাত ঢুকিয়ে দেখে মানিব্যাগটা নেই। দুই বন্ধু মিলে অনেক খুঁজে মানিব্যাগটা পায় না।
তখন ঘনশ্যাম তাকে দেওয়া দশ টাকা শ্রীনিবাসকে ফিরিয়ে দেয়। নিরুপায় হয়ে শ্রীনিবাস সেই টাকাটা নিয়ে আবেগে প্রায় কেঁদেই ফেলে।
.
কী হয়েছি মানিব্যাগটার?
সোনার ঘড়িটা নিয়েই বা ঘনশ্যাম কী করেছিল?
এসব প্রশ্নের উত্তর পেতে সংগ্রহ করুন মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের “শ্রেষ্ঠ গল্প্”, তারপর পড়ে ফেলুন “বিবেক”।
.
মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় যে ভাবে গল্পটা বর্ণনা করেছেন, তাতে আমি মুগ্ধ। আমার ইচ্ছে করে প্রায় পুরো গল্পটা টাইপ করে লিখে ফেলি। সোনার ঘড়িটা চুরির সময় ঘনশ্যামের যে মানসিক অবস্থা, তার বর্ণনা দেওয়ার লোভ সামলাতে পারলাম না।
.
...ঘরে ঢুকিয়াই ঘনশ্যাম সাধারণভাবে বুঝিতে পারিয়াছিল ঘরে কেউ নাই । সোনার ঘড়িটার দিকে চোখ পড়ার পর আর একবার বিশেষভাবে সে বুঝিতে পারিল ঘর খালি । উনানে বসানো কেটলিতে যেমন হঠাৎ শোঁ শোঁ শব্দ হয় এবং খানিক পরে আওয়াজ কমিয়া জল ফুটিতে থাকে, ঘনশ্যামের মাথাটা তেমনি খানিকক্ষণ শব্দিত হইয়া থাকিয়া থাকিয়া ভাঙা ভাঙা ছাড়া ছাড়া চিন্তায় টগবগ করিয়া উঠিল । হৃৎপিণ্ড পাঁজরে আছাড় খাইতে শুরু করিয়াছে । গলা শুকাইয়া গিয়াছে । হাত পা কাঁপিতেছে ঘনশ্যামের । নির্জন ঘরে টেবিল হইতে তুলিয়া একটা ঘড়ি পকেটে রাখা এত কঠিন!...
.
বাইশ টা গল্পে সমৃদ্ধ “শ্রেষ্ঠ গল্প”। অনেক গুলো পড়েছি।
সেগুলো নিয়েও লেখার ইচ্ছে আছে। “বিবেক” গল্পের মাধ্যমে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় আমার মনের গহীনে জায়গা করে নিয়েছে । হৃদয়ের গহীন থেকেই লিখছি ।
.
মো. শামছুল ইসলাম
২২ সেপ্টেম্বর ২০২০
.
সর্বশেষ এডিট : ২২ শে সেপ্টেম্বর, ২০২০ দুপুর ২:২৮