somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

আমার আম্মা...

১৩ ই সেপ্টেম্বর, ২০১৯ রাত ১১:২২
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :



ঘুম থেকে উঠতে না উঠতেই ঘরটাকে একেবারে কুরুক্ষেত্র বানানো শুরু হয়ে গেছে।
ঠাস! ঠাস! ধুম- ধাম, ধরাম, ঝনঝন, শনশন শব্দে ইতিমধ্যেই ঘরটাকে তিনি মাথায় তুলে বসিয়েছেন।
ছি! ছি! ছি! এতটুকুন ছেলে টিকটিকি কিভাবে ধরে আনে?
আমি চেঁচিয়ে যাচ্ছি।
সা-ই- ফ, থাম! সাইফ প্লিজ বাবা থাম।
সা-ই-ফ থাম্ বলছি!
এ্যাই দ্যেখো দ্যেখো হতচ্ছাড়া কোথাকার!
টিকটিকির লেজ ছিড়লে সে ব্যথা পাবে না?
মানুষ এত্ত নোংরা হয়?
তার স্বভাবসুলভ উত্তর-
- হ্যাঁ
-কে?
- সাইফ।
বেচারা টিকটিকির বারোটা বাজিয়ে গেছে বারান্দার গাছগুলির তেরটা বাজাতে।
আসার সময় দুই হাতে করে মাটিও নিয়ে এসেছে! সেই মাটি এনে ফেলেছে আমার আব্বার খাওয়ার পানির মগে!
আমি হুংকার দিয়ে বললাম,
-ওই পাজি! আমার আব্বার মগে মাটি ফেলেছিস কেন?
এত্ত বাঁদরামো কেউ করে?
-হ্যাঁ,
-কে করে শুনি?
-সাইফ।
আম্মাকে বললাম, দেখছেন আম্মা?
আপনার নাতির কান্ড দেখছেন? ওকে কিছু বলেন না কেন আপনি?
আম্মা কিছুই বললেন না।
আম্মা অবশ্য গত কয়েক বছর ধরে কিছুই বলছেন না।
দুএক বছর আগে দুই/ তিন ঘন্টা ধরে ফুটানো পানি তার মুখে, গায়ে পড়েছিল।
আমি হাউমাউ করে কাঁদতে কাঁদতে আম্মাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, আম্মা এখন আমি কি করব?
আম্মা কিছুই বলেন নি।
বেলভিউ হাসপাতালে সপ্তম দিন রাতে যখন আমার ছেলেটার জ্বরে জান যায় যায় অবস্থা, তখনও ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে বলেছিলাম, আম্মা, প্লিজ আল্লাহর কাছে বলেন, আমার ছেলেটাকে যাতে আমাকে ফিরিয়ে দেয়।
সেই শ্বাসরুদ্ধকর মুহূর্তেও আম্মা কিছুই বলেন নি।তারপরও আমি বলতে থাকি।
আমার মায়ের সাথে আমার সম্পর্কটা মা, মেয়ের সম্পর্ক কম, পিঠা- পিঠি ভাই বোনের সম্পর্ক বেশি।
সারাদিন খোঁচা-খোঁচি, ঠুকা-ঠুকি। ইন্টারে থাকতে একবার আমি গাল ফুলিয়েছিলাম।
পাক্কা ছয় মাস কথা বলিনি। আম্মা অনবরত কথা বলে গেছে।
এইবার আমার পালা।
গত সাত বছর ধরে আমি একা একা কথা বলে যাচ্ছি। যখন মন খারাপ হচ্ছে, যখন মন ভাল হচ্ছে, যখন খুব দূঃখী হচ্ছি, যখন খুব খুশি হচ্ছি। সারাদিনই কিছু না কিছু বলে যাচ্ছি।
অথচ আম্মা কিছুই বলছেন না। তারপরও আমি বলে যাচ্ছি।
জন্মের পর থেকে গড়ে ওঠা অভ্যেস, এই বুড়ো বয়সেই বা ছাড়তে যাব কেন?


সেদিন সন্ধ্যায় পড়ার টেবিলে ছেলেকে চ থেকে ঞ পর্যন্ত লিখতে দিলাম।
সে ঝ পর্যন্ত লিখে তারপর আপন মনে বলে বলে লিখছে,
এইব্রে(এইভাবে) এ লিখতে অবে(হবে), তাপ্রে( তারপরে) এ তে লাভ ইউ দিতে অবে,ঞ।
শুনে খুব মজা পেয়েছিলাম। সাথে সাথেই ছোটবেলার একটা স্মৃতি চোখে ভেসে উঠল।
তখন ক্লাস ফোর এ কি ফাইভে পড়ি। আমার একটা খুবই প্রিয় জামা ছিল। একদিন সেটা খুঁজে পাচ্ছিলাম না। জামাটার সারা গায়ে লাভ, লাভ প্রিন্ট করা। অনেক খুঁজা খুঁজি করে যখন কোনমতেই জামাটা খুঁজে পাচ্ছিলাম না। তখন চিৎকার দিয়ে বললাম, আমার লাভ লাভ জামাটা কই গেল? কয়েকবার চিৎকার দিতেই পেছন থেকে পিঠের ওপর ধমাধম চড়!
একেবারে বিনা মেঘে বজ্রপাতের মত। বেশি অবাক হয়নি। কারণ, মাইর এর ডোজ আমার রুটিনের মধ্যে এমনি দিনে চারবার পড়ত।
সকালে নাশতার টেবিলে, দুপুরে খাওয়ার সময়,রাতে কয়েক ঘন্টার ব্যবধানে দুই ডোজ একসাথে।
পড়তে বসা এবং খাওয়া।
কিন্তু এই পঞ্চম চপেটাঘাতের কারণ জানতে উৎসুক দৃষ্টিতে আম্মার দিকে তাকাতেই তিনি অগ্নিশর্মা রূপ নিয়ে হুংকার দিয়ে বললেন, লাভ, লাভ কি জিনিস? বেয়াদব? পান পাতা, পান পাতা বলতে পারিস না?
সেদিনের সেই ঘটনা আম্মাকে মনে করিয়ে দিলাম। আম্মা কিছুই বললেন না।
ফের বললাম, আমার বেলায়ই যত দাদাগিরি তাই না?
আর নাতির বেলায়?
আম্মার কোন কথা নেই। দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে আবার ছেলের পড়ার দিকে মন দিলাম। মনে মনে বললাম, এত অভিমানী কেন গো বুড়ি তুমি?

দুই বছর আগে, আমার আব্বার বিয়ের কেনাকাটার দায়িত্ব আমার কাঁধেই পড়েছিল। আব্বার বউ এর জন্যে শাড়ি কিনতে শাড়ির দোকানে ঢুকতেই বুকের মধ্যে হাহাকার করে ওঠল। মন মানছিল না দেখে আম্মার জন্যেও একটা শাড়ি কিনে ফেললাম।
সে শাড়ি তাকে পড়াতে পারিনি।

আম্মার সাথে আমার শেষ কথা হয়েছিল, ২২ নভেম্বর ২০১২ সাল। দিনের বেলায়। সময় মনে নেই। আম্মা ছিলেন, ইউনাইটেড হাসপাতালের আই.সি.ইউ তে। আমি আই.সি. ইউর বাইরে পাইচারি করছিলাম। কে যেন ডেকে নিয়ে গেল। বলল, আম্মা শুধু সারমিনকে খুঁজছে। মাথায় ক্যাপ, গায়ে এপ্রোন, মুখে মাস্ক, হাতে গ্লাবস, হাবিজাবি সব পরে আম্মার কাছে গেলাম।
কাছে গিয়ে মাথায় হাত বুলিয়ে বললাম,
-কেমন লাগছে আম্মা?
আম্মা বললেন,
-কে?
আমি মাস্ক একটু নামিয়ে বললাম,
-আম্মা আমি সারমিন। তারপর তার সহজাত চিটাইংগা ভাষায় যা বললেন, তা হল,
-ও তুই?
তারপর আবার বললেন, আমি আপনাকে দেখে মনে মনে বলছিলাম, এত সুন্দর মেয়েটা কে?
আপনার চোখগুলি খুব সুন্দর! ঠিক আমার মেয়ের মত! তারপর বুঝলাম, না। এইটাতো আমার সারমিন! এইটাতো আমার যাদু, মণি, আমার ধন।এরজন্যেই ত আমি বেঁচে আছি।(আম্মা জীবনেও আমাকে সুন্দরত দূরে থাক, ম্যাচা, বোঁচা ছাড়া কিছুই বলেনি।)
তারপর আমার হাতটা একটু চেপে ধরে বললেন, আমার মেয়েটাকে একটা ভাল ছেলের হাতে তুলে দিয়েন, মেয়েটা অনেক সহজ সরল। আমি চলে গেলে ওর কি হবে কে জানে!
আমার গলা ধরে আসল। কিছুই বলতে পারলাম না। চিৎকার করে বলতে ইচ্ছে করছিল, আম্মা! আমাকে একা ফেলে জাইয়েন না।
বুক ফেটে কান্না আসছিল। অনেক কষ্টে কান্না চেপে তার কপালে চুমু দিলাম। সে সাথে সাথে বলে ওঠল,
-কে?
আবারও ঐ একই কথার পুনরাবৃত্তি করল, আবার আমাকে চিনতে পারল, আবার ভুলে গেল আমি কে?
সবাই বুঝতে পারছিল, আর বেশি সময় নেই। শুধু আমি ছাড়া!
আমি অবশ্য এখনও বুঝি না। এক বাচ্চার মা হয়ে গেছি। তারপরও কিছু বুঝি না। একদম আগের মতই আছি।
যেমনটা উনি আমাকে রেখে গিয়েছিলেন, আর ততদিন পর্যন্ত তেমনটাই থাকব, যতদিন না আবার আমাদের দেখা হচ্ছে, আম্মা আমার সাথে কথা বলছে। আমাকে যাদু, মণি বলে ডাকছে।
সর্বশেষ এডিট : ১৪ ই সেপ্টেম্বর, ২০১৯ দুপুর ১২:০৩
৬টি মন্তব্য ১টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

হাদিসের সনদের মান নির্ধারণ করা শয়তানী কাজ

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ১৭ ই এপ্রিল, ২০২৪ ভোর ৬:৪০



সূরাঃ ৯ তাওবা, ১০১ নং আয়াতের অনুবাদ-
১০১। মরুবাসীদের মধ্যে যারা তোমাদের আশেপাশে আছে তাদের কেউ কেউ মুনাফিক। মদীনাবাসীদের মধ্যেও কেউ কেউ মোনাফেকী রোগে আক্রান্ত। তুমি তাদের সম্পর্কে... ...বাকিটুকু পড়ুন

ছায়ানটের ‘বটমূল’ নামকরণ নিয়ে মৌলবাদীদের ব্যঙ্গোক্তি

লিখেছেন মিশু মিলন, ১৭ ই এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১:৩৩



পহেলা বৈশাখ পালনের বিরোধীতাকারী কূপমণ্ডুক মৌলবাদীগোষ্ঠী তাদের ফেইসবুক পেইজগুলোতে এই ফটোকার্ডটি পোস্ট করে ব্যঙ্গোক্তি, হাসাহাসি করছে। কেন করছে? এতদিনে তারা উদঘাটন করতে পেরেছে রমনার যে বৃক্ষতলায় ছায়ানটের বর্ষবরণ... ...বাকিটুকু পড়ুন

বয়কটের সাথে ধর্মের সম্পর্কে নাই, আছে সম্পর্ক ব্যবসার।

লিখেছেন ...নিপুণ কথন..., ১৭ ই এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ২:৫০


ভারতীয় প্রোডাক্ট বয়কটটা আসলে মুখ্য না, তারা চায় সব প্রোডাক্ট বয়কট করে শুধু তাদের নতুন প্রোডাক্ট দিয়ে বাজার দখলে নিতে। তাই তারা দেশীয় প্রতিষ্ঠিত ড্রিংককেও বয়কট করছে। কোকাকোলা, সেভেন আপ,... ...বাকিটুকু পড়ুন

মানুষের জন্য নিয়ম নয়, নিয়মের জন্য মানুষ?

লিখেছেন রূপক বিধৌত সাধু, ১৭ ই এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৫:৪৭



কুমিল্লা থেকে বাসযোগে (রূপান্তর পরিবহণ) ঢাকায় আসছিলাম। সাইনবোর্ড এলাকায় আসার পর ট্রাফিক পুলিশ গাড়ি আটকালেন। ঘটনা কী জানতে চাইলে বললেন, আপনাদের অন্য গাড়িতে তুলে দেওয়া হবে। আপনারা নামুন।

এটা তো... ...বাকিটুকু পড়ুন

একজন খাঁটি ব্যবসায়ী ও তার গ্রাহক ভিক্ষুকের গল্প!

লিখেছেন শেরজা তপন, ১৭ ই এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৯:০৪


ভারতের রাজস্থানী ও মাড়ওয়ার সম্প্রদায়ের লোকজনকে মূলত মাড়ওয়ারি বলে আমরা জানি। এরা মূলত ভারতবর্ষের সবচাইতে সফল ব্যবসায়িক সম্প্রদায়- মাড়ওয়ারি ব্যবসায়ীরা ঐতিহাসিকভাবে অভ্যাসগতভাবে পরিযায়ী। বাংলাদেশ-ভারত নেপাল পাকিস্তান থেকে শুরু করে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×