গল্পঃ বাহুডোরে রেখ আমায়
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
Tweet
ছবি-গুগুল
১.
কত নির্বোধ ছিলাম এই আমি। নিরীহ টাইপ একটা ভাব ছিল চেহারায়। নিলঞ্জন দা কে কত নির্যাতন যে করতাম! প্রশ্ন জিজ্ঞেস করে করে জ্বালাতাম।
- আচ্ছা নীলঞ্জন দা মানুষ কেন কাঁদে?
- নিলঞ্জন দা আমার দিকে নিষ্পলক চোখে কিছুক্ষন তাকিয়ে থেকে বলল- মানুষের মন যখন কালো মেঘে ঢেকে যায় তখন মানুষ কাঁদে।
- ওমা! মেঘতো আকাশে জমে, মনে আবার মেঘ জমে নাকি?
আমার কথা শুনে নিলঞ্জন দা মুচকি হেসে বলে – মেয়ে আরেকটু বড় হও তবেই বুঝবে।
- কি জানি আমার মাথায় কেন এত কিছু ঢুকে না, বুঝি না কিছু।
- বুঝবে একদিন ।
- কবে বুঝব নিলঞ্জন দা?
- সময় হলেই বুঝবে।
- আচ্ছা, এখন যাই তবে নিলঞ্জন দা।
- হুম যাও, আর শোন লক্ষ্মী কাল সব পড়া তৈরি করে আনবে কিন্তু।
- আচ্ছা।
২.
ন্যাড়াঃ এই লক্ষ্মী কিরে কেমন আছিস?
লক্ষ্মীঃ হুম ভালো, তুই কেমন আছিস?
ন্যাড়াঃ ভালইত ছিলাম। তা কোথায় যাচ্ছিস?
লক্ষ্মীঃ পড়তে যাচ্ছিরে। এই যাহ! দেরি হয়ে যাচ্ছে। নিলঞ্জন দা বকবে।
ন্যাড়াঃ আজ পড়া লাগবেনা , চল আমার সাথে পাখির মত ডানা মেলে দুইজন ঘুরে বেড়াব।
লক্ষ্মীঃ হিহিহি! আরে গাধা মানুষ কি পাখির মত ঘুড়তে পারে নাকি? আর তোর সাথে ঘুরব কেন?
ন্যাড়াঃ আরে রাগ করছিস কেন?
লক্ষ্মীঃ সামনে থেকে যা।
লক্ষ্মী ন্যাড়াকে ধাক্কা দিয়ে হনহন করে চলে গেল লক্ষ্মী।
নিলঞ্জনঃ কি ব্যপার লক্ষ্মী দেরি হল যে?
লক্ষ্মীঃ না মানে... মানে এমনি হয়ে গেল নিলঞ্জন দা। আচ্ছা নিলঞ্জন দা মানুষ কি পাখির মত ডানা মেলে উড়তে পারে?
নিলঞ্জনঃ নাতো , পারে না। তবে আবার পারেও।
লক্ষ্মীঃ কি পারে আবার পারেও না কিছুই বুঝিনা বাবা তোমার কথা?
নিলঞ্জনঃ তা তোমার মনে হঠাৎ এই প্রশ্ন কোথা থেকে উদয় হল শুনি?
লক্ষ্মীঃ ওই যে ন্যাড়া নিষ্কর্মা আছেনা ওর কাছ থেকে শুনেছি। ও আমাকে বলছিল। হিহিহিহি।
নিলঞ্জনঃ আহ লক্ষ্মী! এভাবে কথা বল কেন? কতদিন না তোমাকে নিষেধ করেছি পচা করে কথা বলবে না?
লক্ষ্মীঃ সরি নিলঞ্জন দা। হিহিহিহি!
নিলঞ্জনঃ শোন, এখন তুমি বড় হচ্ছ, যার তার সাথে একদম কথা বলবে না বিশেষ করে দুষ্টু ছেলেদের সাথে। মনে থাকবে?
ঘাড় কাত করে লক্ষ্ণী বলে - আচ্ছা।
৩.
-এই লক্ষ্মী যাতো মা এই পিঠা গুলো নিলঞ্জনদের বাড়িতে দিয়ে আয়
- পারবোনা মা, আমি এখন স্বরস্বতীদের বাড়ি যাচ্ছি।
- যা না মা এমন করিস কেন?
- ওহ মা তুমি না? মেজাজটাই খারাপ লাগে। ওদের বাড়িতে সবাই বসে আসে।
- কেন?
- জয়ীর আর স্বরস্বতির পুতুল বিয়ে হবে যে।
- সেকি! তোরা না বড় হয়েছিস, এখনো পুতুল খেলার বয়স আছে নাকি? এ বছর শেষেই স্কুলের গন্ডি পেরিয়ে কলেজে উঠবি।
- তো কি হইছে?
- ভগবান জানেন এই মেয়ের বুদ্ধি সুদ্ধি কবে হবে?
- আচ্ছা দাও , আমি কিন্তু নিলঞ্জন দার বাড়ি থেকেই স্বরস্বতির বাড়ি চলে যাব।
- আচ্ছা যাস। এই নে , আবার ফেলে দিসনে।
- আচ্ছা।
- এই শোন এখন বড় হইছিস না বুকে ওড়নাটাও দিতে শিখিসনি, আমার হয়েছে যত জ্বালা। এই মেয়ে কিচ্ছু বুঝেনা।
- আচ্ছা আমি ভাল করেই দিচ্ছি এই দেখ। হিহিহিহি!
যেতে যেতেই পথে বৃষ্টি পড়তে শুরু করল। একরকম দৌড়ে লক্ষ্মী নিলঞ্জনের বাড়ি গেল।
- মাসিমা ও মাসিমা
- কিরে লক্ষ্মী তুইতো ভিজে গেছিস। এই বৃষ্টির ভেতর আসলি ? হাতে কি তোর?
- মা পাঠিয়েছে, দেখ।
- ইস তোর মায়ের যে কান্ড, এই বৃষ্টির ভেতর তোকে পিঠা দিয়ে পাঠিয়েছে। আলনার উপর গামছা আছে, যা গা মুছে নে।
লক্ষ্মী গামছা নিয়ে গা মুছে নিল।
- মাসিমা, নিলঞ্জন দা কই?
- ওর ঘরেই তো আছে।
- ওও। আচ্ছা মাসিমা পিঠা দাও গরম গরম দিয়ে আসি নিলঞ্জন দা কে। খেয়ে মজা পাবে।
- দাড়া দিচ্ছি।
লক্ষ্মী নিঃশব্দে নিলঞ্জনের রুমে ঢুকে বলল-
- এই নাও নিলঞ্জন দা গরম গরম পিঠা খাও।
- কি ব্যাপার তুমি কোথা থেকে আসলে?
- তুমি কি ভূত দেখার মত চমকে গেলে নাকি গো? হিহিহি
- হুম! সেরকমই।
- মা পিঠা দিয়েছে তাই নিয়ে আসলাম। আচ্ছা তুমি খেয়ে নাও আমি যাই।
নিলঞ্জন লক্ষ্মীর হাতটা ধরে ফেলল। একদম কাছে টেনে নিল লক্ষ্মীকে। চোখে চোখ রাখল কিছুক্ষণ। ভেজা এলো কেশে লক্ষ্মীকে ঠিক যেন দেবীর মতই লাগছে। চোখ সরাতে পারেনা নিলঞ্জন।
- তোমাকে দেবীর মত লাগছে লক্ষ্মী
- হিহিহি! তাই নাকি?
- হুম তাই!
- নিলঞ্জন দা, আহ ছাড় , হাতে ব্যথা পাচ্ছি।
- না, ছাড়ব না।
- মাসিমা ও মাসিমা।
- আরে কি করছ লক্ষ্মী?
মুখ চেপে ধরে নিলঞ্জন আর বলে প্লিজ কিছু বলোনা মা কে। এই ছেড়ে দিচ্ছি। লক্ষ্মী দৌড়ে বের হয়ে যায়। নিলঞ্জন ভাবে এই মেয়ের কোন বুদ্ধি সুদ্ধি নেই। বাবাহ একটুর জন্য ভয় পাইয়ে দিয়েছিল মেয়েটি।
লক্ষ্মী আর নিলঞ্জনের বিয়ে ঠিক হয়ে আছে। নিলঞ্জন চায় লেখাপড়া শেষ করতে। আর লক্ষ্মীও লেখাপড়া করুক তাই চায়। নিলঞ্জন বেশ ভদ্র ছেলে। কখনোই লক্ষ্মীকে খারাপ চোখে দেখেনা। গ্রামের হিন্দু ঘরের মেয়েদের এত লেখাপড়া সাধারনত করতে দেয় না আগেই বিয়ে দিয়ে দেয় বাবা মা। লক্ষ্মীর পরিবার লেখাপড়া করাতে চায়না কিন্তু নিলঞ্জনের পরিবার অন্যরকম তারা চায় লক্ষ্মী লেখাপড়া করুক।
৪.
আজ বিদায়ের বেলা। নিলঞ্জন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে যাচ্ছে। অনেকক্ষন অপেক্ষা করল নিলঞ্জন লক্ষ্মীর জন্য। লক্ষ্মীর কোন দেখা নেই।
সব আয়োজন শেষ। বিকেলের লঞ্চে চড়েই ঢাকায় যাবে নিলঞ্জন। বাড়ি থেকে বের হয়ে গেল লক্ষ্মীর সাথে দেখা হলনা। ভেবেছিল ওর যাওয়ার কথা শুনে বাড়িতে অন্তত আসবে। কিন্তু না বাড়িতে আসেনি।
কিছুদূর যাওয়ার পরই নিলঞ্জনের সাথে লক্ষ্মীর দেখা। কৃষ্ণচূড়া গাছের নিচে দাড়িয়ে ছিল মুখ ভার করে।
- সারাদিন কোথায় ছিলে লক্ষ্মী? আমি কতক্ষণ অপেক্ষা করেছি তোমার জন্য সেকি তুমি জানো?
- মুখ নিচু করে উত্তর দেয় লক্ষ্মী জানি।
- তবে আসলেনা কেন?
- লক্ষ্মী কেঁদে দেয়।
নিলঞ্জন লক্ষ্মীর চোখ মুছে দেয়। হাত ধরে বলে নিলঞ্জন
- কেঁদো না লক্ষ্মী। ভালো মত লেখা পড়া করো।
- আচ্ছা
- আমার দিকে কি চোখ তুলে তাকাবেনা?
- আমার খুব কষ্ট হচ্ছে নিলঞ্জন দা।
- সব কষ্টের একদিন শেষ হবে, দেখো।
চুপ করে থাকে লক্ষ্মী। কিছুই বলতে পারেনা।
- লক্ষ্মী আমার জন্য অপেক্ষা করো।
- আমি তোমার জন্য অপেক্ষা করব নিলঞ্জন দা।
নিলঞ্জন দার পথ পানে চেয়ে সেদিন আমি খুব কেঁদেছিলাম।
আমি বুঝতে পারছিলাম নিলঞ্জন দা কে আমি ভালবাসি। আজ দু বছরের বেশি হল বাড়ি আসেনি নিলঞ্জন দা। কেন আসেনি জানিনা। আমার প্রতিদিন কেটেছে নিলঞ্জন দা কে ভেবে। কত বোকা ছিলাম ভাবতেই লজ্জায় মরে যাই। উচ্চ মাধ্যমিক শেষ আমার। রেজাল্ট এর আশায় আছি। ভালো একটা রেজাল্ট করতে হবে নইলে নিলঞ্জন দা রাগ করবে আমি জানি। ফোনে কথা হত নিলঞ্জন দার সাথে। তাও আবার মার ফোন দিয়ে কথা হত। আমি লজ্জায় কথাই বলতে পারিনা। শুধু শুনে যাই তার কথা।
আমার বুকের ভেতরে এতো আনন্দ হচ্ছে বুঝাতে পারবোনা। আমার আজকের দিন কাটতেই চাইছেনা। নিলঞ্জন দা আসবে কাল। সারাদিন কি বলব কি করব তাই নিয়েই পার করে দিলাম। দিনের রবি ডুবে গিয়ে আঁধার নেমে এলো পৃথিবীতে, কিছুতেই ঘুম নেই চোখে।
৫.
দূরের মসজিদ থেকে আজানের ধবনি শোনা যাচ্ছে। রাতের নৈঃশব্দ্য ভেঙে ভোরের পাখি গান করে উঠল। সারারাত চোখের পাতা এক করতে পারিনি। ভোর বেলাতেই স্নান সেরে পূজো করে বের হয়ে গেলাম। কেমন যেন ছটফট করছি কখন আসবে নিলঞ্জন দা। কেমন যেন অদ্ভুত একটা ব্যথা অনুভব করছি। দৌড়ে গেলাম নিলঞ্জন দার বাড়িতে। লজ্জাও লাগছে মাসিমা কি বলবে তাই ভেবে। কিন্তু একি! কান্নার শব্দ কেন শুনা যাচ্ছে?
- মাসিমা কাঁদছ কেন, কি হয়েছে?
- লক্ষ্মী সব শেষ হয়ে গেছেরে মা, কাল রাতে নিলঞ্জন যে লঞ্চ টাতে উঠেছিল সেটা ডুবে গেছে। তোর মেসো গেছে লঞ্চ ঘাটে।
- না না মাসিমা এ হতে পারেনা। আমি জানি নিলঞ্জন দা আসবেই, দেখো আসবেই।
লক্ষ্মীর পুরো শরীর কাঁপতে লাগল। বার বার শুধু বলছে নিলঞ্জন দা আসবে। আমার মন বলছে আসবে। আস্তে আস্তে বেলা বাড়তে থাকে আর নিলঞ্জনের বাড়িতে মানুষের ভীড় হতে থাকে। লক্ষ্মীর চোখের জল গড়িয়ে পড়ছে। লক্ষ্মীর মা তার মেয়েকে ধরে কাঁদছে। কি হবে এখন তাই ভাবছে। মেয়ের কপাল এভাবে পুড়বে ভাবেনি। লক্ষ্মী দৌড়ে ঘর থেকে বের হয়।
- কোথায় যাচ্ছিস লক্ষ্মী? শোন মা , মেয়েটা পাগল হয়ে গেছে।
লক্ষ্মী সেই কৃষ্ণচূড়া গাছটার নিচে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করতে লাগল। লক্ষ্মীর মন বলছে আসবেই নিলঞ্জন দা। সন্ধ্যা নেমে এলো নিলঞ্জনের দেখা নেই। লক্ষ্মী এবার ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে লাগল। আর কিছুতেই মনকে বুঝাতে পারছেনা। এভাবে সব শেষ হয়ে যাবে ভাবেনি। একটা বার বলতে পারেনি “নিলঞ্জন দা আমি তোমাকে অনেক ভালোবাসি”। লক্ষ্মী শুধু কাঁদতে লাগল। ক্রমশঃই আবছা দেখা যাচ্ছে মানুষজন। স্বপ্নগুলো এভাবে শেষ হয়ে যাবে ভাবেনি। বুকের ভেতরটাইয় শুধু যন্ত্রনা হচ্ছে।
বেশ কিছুক্ষন পর কাধে কার যেন হাত অনুভব করল লক্ষ্মী। ফিরে তাকাতেই ভূত দেখার মত চমকে উঠে লক্ষ্মী।
-নিলঞ্জন দা তুমি? নিলঞ্জনের বুকে ঝাপিয়ে পড়ে লক্ষ্মী।
- আমি জানতাম তুমি আসবে নিলঞ্জন দা। আর কখনো আমাকে ছেড়ে চলে যেয়োনা। তোমার বাহুডোরে রেখ আমায়।
নিলঞ্জন লক্ষ্মীকে শক্ত করে বুকের মাঝে ধরে রাখে, আর বলে-
- সারাজীবন আমার বাহুডোরে থাকবে তুমি , কোথাও যাবনা। পাগলি মেয়ে! এত কাঁদতে আছে?
১৫টি মন্তব্য ১৫টি উত্তর
আলোচিত ব্লগ
তোমাকে লিখলাম প্রিয়
আবার ফিরে আসি তোমাতে
আমার প্রকৃতি তুমি,
যার ভাঁজে আমার বসবাস,
প্রতিটি খাঁজে আমার নিশ্বাস,
আমার কবিতা তুমি,
যাকে বারবার পড়ি,
বারবার লিখি,
বারবার সাজাই নতুন ছন্দে,
অমিল গদ্যে, হাজার... ...বাকিটুকু পড়ুন
ছাঁদ কুঠরির কাব্যঃ মিসড কল
নতুন নতুন শহরে এলে মনে হয় প্রতি টি ছেলেরি এক টা প্রেম করতে ইচ্ছে হয় । এর পেছনের কারন যা আমার মনে হয় তা হলো, বাড়িতে মা, বোনের আদরে... ...বাকিটুকু পড়ুন
হিটস্ট্রোক - লক্ষণ ও তাৎক্ষণিক করণীয়
সাধারণত গরমে পরিশ্রম করার ফলে হিটস্ট্রোক হতে পারে। এতে দেহের তাপমাত্রা অতি দ্রুত বেড়ে ১০৪ ডিগ্রী ফারেনহাইট বা তারও বেশি হয়ে যেতে পারে।
হিটস্ট্রোক জরুরি চিকিৎসা প্রয়োজন। চিকিৎসা... ...বাকিটুকু পড়ুন
আল্লাহকে অবিশ্বাস করার সংগত কোন কারণ নাই
সব কিছু এমনি এমনি হতে পারলে আল্লাহ এমনি এমনি হতে সমস্যা নাই। বীগ ব্যাং এ সব কিছু হতে পারলে আল্লাহও হতে পারেন। সব কিছুর প্রথম ঈশ্বর কণা হতে পারলে আল্লাহও... ...বাকিটুকু পড়ুন
যুক্তরাষ্ট্রে ইসরাইল বিরোধী প্রতিবাদ বিক্ষোভ
গাজায় হামাস উচ্ছেদ অতি সন্নিকটে হওয়ায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে নিউইয়র্ক ও লসএঞ্জেলসে কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে বিক্ষোভ ছড়িয়ে পরেছিল। আস্তে আস্তে নিউ ইয়র্ক ও অন্যান্ন ইউনিভার্সিটিতে বিক্ষোভকারীরা রীতিমত তাঁবু টানিয়ে সেখানে অবস্থান নিয়েছিল।
... ...বাকিটুকু পড়ুন