মমিনুল ইসলাম :
আজ আমরা আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধকে শুধু কয়েকটি দিনের আনুষ্ঠানিকতার মধ্যেই সীমাবদ্ধ করে ফেলেছি। মহান ২১ ফেব্রুয়ারি, ২৬ মার্চ ও ১৬ ডিসেম্বর ছাড়া স্বাধীনতার সত্তাকে আমরা কেউ এখন তেমন স্মরণ করি না। মুক্তিযোদ্ধাদের মহান ত্যাগের কথা এ জাতি হিসেবে আমরা মনে হয় ভুলতে বসেছি। শুধু এই দিনগুলোর আগমনে আবেগঘন মুহূর্তের সাধারণ কিছু দেশাত্মবোধক গান, কিছু ভাষণ, কিছু ব্যানার তৈরি, মিছিল, মিটিং, সেমিনার, যুদ্ধের কিছু আলোকচিত্র প্রদর্শন, ক্রোড়পত্র প্রকাশ, শহীদ মিনারের সামনে কিছু আলপনা ও রঙ করে দিবসের পূর্ব রাতে হইহুল্লোড় করে পিকনিক উদ্যাপন ও শহীদ মিনারে ফুল দিয়ে নীরবে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়েই ক্ষান্ত থাকছি। ফলে আমরা আজও আমাদের নবপ্রজন্মদের ভিতরে মুক্তিযুদ্ধের ত্যাগের মহিমা আর দেশপ্রেমের মূল্যবোধকে জাগ্রত করতে পারছি না।
চেতনা শব্দটির অর্থ হলো জ্ঞান, সজ্ঞা, অনুভূতি ইত্যাদি। কোন ভালো বিষয়ের সঙ্গে শব্দটি ইতিবাচক অর্থে ব্যবহৃত হয়। বিজয় শব্দটি দিয়ে ১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১-এ আমাদের স্বাধীনতা অর্জনকে বোঝায়। সুতরাং বিজয়ের চেতনার অর্থ স্বাধীনতার শিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে রাংলাদেশকে গড়ে তোলা।
১৯৭১ সালের স্বাধীনতাযুদ্ধ বাংলাদেশের একটি গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস। দীর্ঘ শোষণ আর বঞ্চনার হাত থেকে মুক্তির তাড়নায় ছিনিয়ে আনা বিজয়। একটি সবুজ ভূখন্ড। একটি বাংলাদেশ। শত চড়াই-উতরাই পেরিয়ে আজকের এই অর্জন। ৪৩ বছর একটি নবজন্মা দেশের জন্য খুব বেশি সময় না হলেও কম সময় নয়। লাল-সবুজের এমন একটি পতাকা পেয়েছি যে পতাকাটি পৃথিবীর অন্য যে কোন দেশের পতাকার চেয়ে সুন্দর, যেমন সুন্দর এখানকার চোখ জুড়ানো প্রাকৃতিক দৃশ্য। এমন একটি ভূখন্ড পেয়েছি যে ভূখন্ডটি এশিয়ার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পরিধিজুড়ে। এখানকার মানুষ অসম্ভব পরিশ্রমপ্রিয়, অল্পে তুষ্ট। আমরা পেয়েছি একটি উর্বর ভূমি। সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির অনুপম বাংলাদেশ। এই ভূখন্ডকে ঘিরে আমাদের প্রত্যাশার কমতি নেই, এখনো এক বুক আশা বুকে চেপে বেঁচে থাকার সোনালি স্বপ্ন দেখে দেশের মানুষ।
একটি সুখী, সমৃদ্ধ, শোষণ-বঞ্চনাহীন সোনার বাংলা গড়ার প্রত্যয়ে একবুক আশা নিয়ে এ দেশের সাধারণ কৃষক, শ্রমিক, ছাত্র-শিক্ষক, বুদ্ধিজীবী, লেখক, সাংবাদিক ও সাধারণ মানুষ অস্ত্র হাতে ৯ মাস যুদ্ধ করে পরাধীনতার শিকল ছিঁড়ে দেশকে শত্রুমুক্ত করে লাল সবুজের পতাকার বাংলাদেশ নামের একটি স্বাধীন রাষ্ট্র এ জাতিকে উপহার দিয়েছিল। তাঁরা নিজেদের স্বার্থে নয় বরং এমন এক স্বাধীন রাষ্ট্র নবপ্রজন্মকে দেয়ার আশায় নিজের প্রাণ অকাতরে বিলিয়ে দিয়েছিল যে রাষ্ট্রে কোন মানুষকে না খেয়ে মরতে হবে না, শোষণ-বঞ্চনার শিকার হতে হবে না, অন্যের গোলামী করতে হবে না, চিকিৎসার অভাবে কাউকে ধুঁকে ধুঁকে মরতে হবে না, একশ্রেণীর সুবিধাভোগীর হাতে সাধারণ মানুষকে পাঁঠার বলি হতে হবে না, দলাদলি থাকবে না, ধনী ও গরিবের মধ্যে কোন ধরনের বৈষম্য থাকবে না। কিন্তু সেই লাখো শহীদ বাঙালির উষ্ণ রক্তস্রোতে অর্জিত স্বাধীনতার প্রকৃত উদ্দেশ্য ও তাদের আশার সেই সোনার বাংলাদেশ আজ এই জাতি হিসেবে আমরা কি অর্জন করতে পেরেছি? আমরা তা অর্জন করতে পারিনি।
স্বাধীনতার মুক্তির সংগ্রামে যারা সেদিন অংশগ্রহণ করেছিল তাদের প্রত্যেকের তীব্র আকাক্সক্ষা ছিল আমরা স্বাধীন সার্বভৌম একটি বাংলাদেশ পাবো। গড়ে উঠবে বৈষম্যহীন সুদৃঢ় ঐক্যের বাংলাদেশ। থাকবে না রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়ন; থাকবে অর্থনৈতিক সুদৃঢ় ভিত্তি। বন্ধু অবয়বে আমাদের কোনো শত্রু থাকবে না, এ দেশের প্রতি থাকবে না খবরদারি; থাকবে শুধু বন্ধুত্ব ও পরস্পর সহযোগিতার সম্পর্ক। ৪৩ বছর পরও আমাদের ভাবতে হয় আমাদের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব কতটুকু নিরাপদ। প্রতিনিয়ত সীমান্তবর্তী মানুষের মৃত্যু যন্ত্রণায় প্রতিটি দেশপ্রেমিক নাগরিক দেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব নিয়ে উদ্বিগ্ন। একটি জাতির জন্য ৪৩ বছর কম সময় নয়। আমাদের অনেক চড়াই-উতরাই পেরিয়ে দেশ যতটা না সামনে এগোচ্ছে তার চেয়ে বেশি পিছু হটছে।
দুঃখ হয় যখন দেখি আজও এ দেশের মানুষকে দুমুঠো ভাতের জন্য হাহাকার করতে হয়, রাজনৈতিক উদ্দেশ্য হাসিলে জনগণকে পাঁঠার বলি বানানো হয়। দেশ স্বাধীন হয়েছে ৪৩ বছর কিন্তু আজও আমরা এ দেশের মানুষের নূ্যনতম মৌলিক চাহিদা পূরণ করতে সক্ষম হয়নি, শোষণহীন সমাজব্যবস্থা কায়েম করতে পারিনি, এখন পর্যন্ত আসেনি দেশে অর্থনৈতিক মুক্তি ও সঠিক গণতন্ত্র।
আমরা আশাবাদী এই ভেবে যে, তরুণরা গড়তে জানে, তার সাক্ষর তরুণরাই রাখবে প্রতিনিয়ত প্রতিটি কাজের সফলতার মাধ্যমে। দেশের নীতি নির্ধারকদের কথায় না প্রকৃত দেশপ্রেমিক হতে হবে ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়নে এগিয়ে আসতে হবে। শুধু বিশেষ দিনগুলিতে ফুল দিয়ে অনুষ্ঠান পালন নয় প্রকৃত মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বুকে লালন করতে হবে এবং এই চেতনায় জাতিকে আরো উদ্ধুদ্ধ করতে হবে। যে চেতনার বলে দেশ ও দেশের মানুষের জন্য এ জাতি পরাধীনতার গ্লানি থেকে দেশ ও জাতিকে মুক্তির জন্য একতার বন্ধনে আবন্ধ হয়েছিল সেইরূপ চেতনা দেশের ১৬ কোটি মানুষের মধ্যে জাগিয়ে তুলতে হবে।
তাই এবারের এই বিজয়ের মাসে আমাদের সকলের শপথ হোক মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনা শুধু দিনের আনুষ্ঠানিকতা মধ্যদিয়ে নয়, এই চেতনাকে বুকে ধারণ করে ৩০ লাখ শহীদের স্বপ্ন পূরণে ক্ষুধা, দারিদ্র্য, শোষণ, নিপীড়ন ও বঞ্চনামুক্ত হয়ে ও দাসানুদাস মনোবৃত্তি থেকে বেরিয়ে একটি সোনার বাংলা গড়ে তুলবো। আর এখন থেকে এই চেতনাই বুকে ধারণ করে সবাই একযোগে দেশ ও দেশের মানুষের জন্য কাজ করবে। এবারের এই মহান বিজয় দিবসের মধ্যদিয়ে সকলের ভেতরে এই চেতনা, দেশ গড়ার ইচ্ছা ও দেশপ্রেম জাগ্রত হোক।